আজ এঞ্জেলার জন্মদিন। আনন্দের এই দিনে প্রতি বছর বেদনাদায়ক এক স্মৃতি গুমরে ওঠে সাজিয়ার বুকের ভেতর। সাজিয়া মাথা নেড়ে ভাবনাটা উড়িয়ে দিতে চায়। আজ যে ওকে হাসিমুখে থাকতে হবে। চকলেট ফ্রস্টেড ডোনাট খেতে খুব ভালোবাসে এঞ্জেল। আদর করে সাজিয়া ওকে এই নামে ডাকে। ওর জীবনে এই মেয়েটা তো আসলেই এঞ্জেল। চকলেট ফ্রস্টেড ডোনাটের একটা বক্স আলাদা করে রেখে দিয়েছে সাজিয়া। একটু পরে এঞ্জেল দেখা করতে আসবে ওর সঙ্গে। সবাই মিলে ওর জন্মদিন পালন করবে। এরপর তো দীর্ঘদিন আর ওর সঙ্গে দেখা হবে না।
এঞ্জেলা অনেক দূরে চলে যাবে ভাবতে সাজিয়ার বুকের মধ্যে কেমন চাপ চাপ ব্যথা করতে আরম্ভ করে। হাত পা অবশ হয়ে আসে। ‘কেমন করে ওর চলে যাওয়া দেখব আমি!’ মনের আয়নায় দাঁড়ানো নিজেকে জিজ্ঞাসা করে। রক্তের সম্পর্ক ছাড়া এমন নিঃস্বার্থ সম্পর্ক কারো সাথে হতে পারে সাজিয়া কখনও কল্পনা করেনি। আয়নায় ওপাশে নিজেকে প্রতিবিম্বকে আবার বলে ‘কিন্তু আমিই তো বার বার চেয়েছি ও ডানকিনের কাজ বাদ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ুক। জীবনে অনেক বড় হোক। একটা ফুলতোলা কাঁথার মতো সুন্দর-স্বপ্নময় হোক ওর সবকিছু।’ সন্তান দূরে চলে গেলে মায়ের যেমন কষ্ট হয়, সাজিয়া বুকেও তেমন উথাল পাথাল হচ্ছে। আসলে মাতৃস্নেহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ কোন সীমারেখা টানে না।
বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। আর সাজিয়ার হৃদয়ে হচ্ছে বেদনার রক্তক্ষরণ। কাঁচের দেয়ালের গায়ে নাক ডুবিয়ে সাজিয়া দূরের ল্যাম্পপোস্টটা দেখে। মন খারাপের দিনে বারবার ল্যাম্পপোস্টটা দেখে নেওযা ওর পুরনো স্বভাব। বুকের মধ্যে বেদনা তখন যেন আরো ঘন আর তীব্র হয়। হালকা পাতলা কষ্টতে যেন সাজিয়ার মন ভরে না। নিয়তি নামের বেদনার চোখে চোখ রেখে কথা বলে সাজিয়া।
ডানকিনের ম্যানেজার বলে সাজিয়াকে এখন সকাল সাতটার পরে এলেও চলে। যখন ম্যানেজার ছিল না তখন ভোর পাঁচটার আগে পৌঁছে যেতে হত। বাসা থেকে বের হতে হত ভোর চারটায়। ঘুম থেকে উঠত রাত সাড়ে তিনটায়। তখনও চারদিকে অন্ধকার, শুনশান, নিরিবিলি চারদিক। মায়ের হাতে সেলাই করা নকশীকাঁথার ওম ছেড়ে কোনদিন কি ভেবেছে এভাবে ভিনদেশে জীবন সংগ্রামে নামতে হবে! স্টোরের কাছে এসে দূরের ওই ল্যাম্পপোস্টের নীচে এসে প্রতিদিন থামতো। বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতো।
ল্যাম্পপোস্টে তখনও বাতি জ্বলত। সেই আলোতে মনের অন্ধকার দূর হত না। পথের ওপর নিজেরে ছায়া দেখতো সাজিয়া। হিম হাওয়ায় জমতে জমতে সমস্ত ব্যর্থ কান্না উগরে দিতে চাইতো। এই জীবন কি চেয়েছিল সে! কোন স্বপ্নঘোরে এখানে এসেছিল ও!
’ম্যাম, নতুন কফি মেশিনের জন্য কি অর্ডার করবে আজ?’
বাইশ বছর বয়সী হ্যাংলা পাতলা ছেলে জুলিয়েন। সামান্য কোন সমস্যা হলে নিজে সমাধানের চেষ্টা না করে সাহায্য চাইবে সাজিয়ার। তবে ছেলেটা কখনও ছুটি চায় না। জুলিয়েন আর ইসাবেলা তুষারের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ভোর পাঁচটার মধ্যে চলে এসেছে। কাস্টোমারের জন্য সব রেডি করে ফেলেছে। ক্রুসান, মফিন, ব্যাগেল বেক করেছে। আলাদা ভাবে হট কফি, কোল্ড কফি, আইস টি, গ্রিন টি তৈরি করেছে। চকলেট ফস্টেড, বোস্টন ক্রিম, ওল্ড ফ্যাশন, স্ট্রবেরি ফস্টেড, ভ্যানিলা ফস্টেড, হানি গ্লেইস, মানস্কিন- নানা ধরনের ডোনাট দিয়ে ট্রে সাজিয়েছে।
তুষারপাতের কারণে কাস্টোমার নেই বলে ওরা বসে বসে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে। এঞ্জেলা চলে যাওয়াতে ওরাও দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু ওদের বয়স কম তো, কোন বিচ্ছেদ সেভাবে মনে ছাপ ফেলে না।
কফি মেশিনটা কদিন ধরে সমস্যা করছে। নতুন একটা কিনবে নাকি এটাই ঠিক করাবে সেটাই প্রশ্ন। সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে ম্যানেজারের। ডানকিন ডোনাটের ম্যানেজার অনেকটা ডাক্তার কিংবা পুলিশের মতো, রাত-দিন নেই, চব্বিশ ঘণ্টা ফোন খোলা রাখতে হয়। রাত তিনটার সময়ও কোন সমস্যা হলে ম্যানেজারকে ফোন করবে ওরা। কখনও সশরীরে চলেও আসতে হয়। ম্যানেজারের শারীরিক পরিশ্রম কম অন্যদের তুলনায়। কিন্তু মানসিক চাপ বেশী। মাঝে মাঝে সেই চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।
একটা লাটে কফি আর স্ট্রবেরি ডোনাট নিয়ে সাজিয়া স্টোরে ঢোকার মুখে একটা চেয়ারে বসে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সামনের ডেস্কে রাখে। এই চেয়ারে বসলে বাইরের পৃথিবী স্পষ্ট দেখা যায়। বাইরে থোকা থোকা ফুলের মতো তুষার ঝরছে। ল্যাম্পপোস্টের লাইট তুষারে ঢেকে গেছে। তুষারপাত বন্ধ হয়ে গেলে জমে থাকা পানি টুপ টুপ করে পড়বে কয়েকদিন। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে সাজিয়ার মনে হয়, ‘এঞ্জেলের সঙ্গে দেখা হওয়াটা কি আসলেই নিয়তি! প্রথম দিন ওর বায়োডাটা দেখে চমকে উঠলাম কেন! ঈশ্বর কি ইচ্ছে করেই ওকে আমার জীবনে পাঠিয়েছেন!’
বাইরে তুষারপাত বেড়ে গেছে। মোবাইল বের করে দেখে সাজিয়া। এখন তুষারপাত শতকরা একশ ভাগ হারে হচ্ছে। বাইরে আজ ভয়াবহ ঠান্ডা। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নামতে দেরী নেই। এঞ্জেলাকে এই তুষারের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আসতে হবে। তবে এদেশের মানুষ তাতে অভ্যস্ত। এত বছর পরেও সাজিয়া তো অভ্যস্ত হতে পারেনি। এমন তুষারপাত আর ঠান্ডা আবহাওয়ায় সাজিয়ার মনে পড়ে সেই রাতের কথা। যে রাতে ওর প্রথম ডানকিন স্টোরের ম্যানেজার ওকে তিন ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সাবওয়ে স্টেশনে। সেই সব দিনের কথা মনে করলে রক্ত হিম হয়ে আসে।
মফস্বল শহরে জন্ম নেয়া উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সাজিয়া। রংপুর জেলা সদরে ওদের চারতলা বাড়ি। বেশ আরাম আয়েশে বড় হয়েছে। বাবার খুব আদরের মেয়েকে কোনদিন কোন কাজ করতে হয়নি বাসাতে। কখনো শখ করে চা-ও বানাইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতো চা, নাস্তা সব তৈরি। একটা ঘটনাই সবকিছু ওলট পালট করে দিল। বাবা-মায়ের চোখের মনি থেকে ও যেন রাতারাতি হয়ে গেল গলার কাঁটা। এভাবে চলল মাসের পর মাস। তারপর ব্যাপক যৌতুকের বিনিময়ে জহিরের সঙ্গে ওর বিয়ে দেয়া হল। বিয়ের পরে স্ত্রীসহ জহিরকে আমেরিকায় পাঠানো যৌতুক তালিকার প্রথম দিকে ছিল। সাজিয়াও চেয়েছিল দু:সহ স্মৃতি থেকে পালাতে।
পারিবারিক অবস্থান বা ব্যক্তি জহির কোনটাই সাজিয়াদের সঙ্গে তুল্য ছিল না। পরিস্থিতি দুজনকে স্বামী-স্ত্রী হতে বাধ্য করেছিল। আমেরিকা আসার পরে জমানো টাকা শেষ হয়ে গেলে সাত মাসের মাথায় নিরুপায় হয়ে কাজে যোগ দিয়ে সাজিয়া বুঝতে পারল এ দেশ তার জন্য না। প্রথম দিন সে কাজে যাওয়ার সাথে সাথেই মালিক বললেন, ‘আগে কাজ শেখেন পরে বেতনের কথা বলবো’। সাজিয়া মাথা নেড়ে বলল- ‘আচ্ছা’। পরাজিত মানুষ তখন ও। মেনে নেয়াই ছিল নিয়তি।
নিউইয়র্ক শহরে শ্রমজীবী শ্রেণীর বাঙালি নারীদের মধ্যে ডানকিন ডোনাটের চাকরীটি বেশ প্রিয়। এই শহরে যে প্রান্তেই যাও ডানকিনের স্টোরে বাঙালি মেয়েদের দেখা যায়। বাংলাদেশের শহর কিংবা মফস্বল থেকে আসা মেয়েরা ডানকিনের চাকরী দিয়ে প্রথম আয়ের স্বাদ পায়। হয়তো বাংলাদেশে থাকতে কল্পনায় ত্রিসীমানায় ছিল না বিদেশে গিয়ে কোনদিন কাজ করবে, সেই মেয়ে একদিন ডানকিনের ম্যানেজার হয়।
কত বছর হল? সাজিয়া ভাবে মনে মনে। দেখতে দেখতে প্রায় ষোল বছর হয়ে গেল। ম্যানেজার হয়েছে তাও তো সাত বছর। কাউকে টপকে ওপরে উঠে যাওয়া কোনদিনই ওর স্বভাবে ছিল না। ও যেন সারাজীবন পিছনে থাকার মানুষ। কাউকে কখনও মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে শেখেনি। কিন্তু তার বিনিময়ে শুধু মানুষই নয়, সৃষ্টিকর্তাও প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে ওকে।
প্রথম স্টোরের সেই ম্যানেজার সব সময় খোটা দিয়ে কথা বলতো। দেখা যেত খুব আগ্রহ নিয়ে নতুন জামা কাপড় পড়ে কাজে গিয়েছে, কিন্তু এমন একটা কথা বলল লোকটা যে হতবুদ্ধি হয়ে যেত। একদিন কথায় কথায় ডানকিনের সেই পুরুষ ম্যানেজার বাঁকা সুরে জানতে চাইল, ক্যাপসিক্যাম, লেটুস, ব্রকোলি বাংলাদেশে দেখেছে কিনা! সাজিয়া অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল। ম্যানেজার নিজে অজ পাড়াগাঁ থেকে এসেছে বলে সবাইকে সেরকম ভাবে। সাজিয়ার বাসায় যে মহিলা রান্না করতো, সেও চেনে এসব। তবে মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না সাজিয়া। হাসিমুখে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, সে চেনে।
দুই মাস কাজ শেখানোর নাম করে প্রচণ্ড খাটালো সাজিয়াকে এই ম্যানেজার। কিন্তু এক পেনি না দিয়েই বিদায় করে দিল। উল্টো সাদিয়ার সাবওয়ে ট্রেনে ব্যবহারের জন্য আনলিমিটেড কার্ডটি প্রায়ই ম্যানেজার ব্যবহার করতো। একদিন তো… ওহ সেদিনের কথা সাজিয়া জীবনে কখনো ভুলবে না। কনকনে শীতের রাত। উপরন্তু আজকের মতো তুষারপাত ছিল সেদিন। এমন দুর্যোগময় রাতে তিন ঘণ্টা ট্রেন স্টেশনে সাজিয়াকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল শুধু ওর আনলিমিটেড মেট্রো কার্ডটি ব্যাবহার করার জন্য।
অন্যের মাত্র দুই ডলার পঁচাত্তর সেন্ট বাঁচানোর জন্য একজন নিরুপায় মানুষকে তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছিল। সাজিয়া ঠান্ডায় জমে গেছে তারপরেও সে যায়নি। পাছে তাকে যদি কাজ না শেখায়। সাজিয়ার স্বামী সময় পেলেই তখন বলত- তুমি এদেশে কাজ করতে পারবে না, চল আমরা বাংলাদেশে ফিরে যাই । সাজিয়া চায়নি জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে। যে তিক্ত জীবনের ইতিহাস পিছনে ফেলে এসেছে, সেটাকে মুছে দিতে চেয়েছিল ও। ওখানে আর পা রাখতে চায়নি।
সাজিয়া নতুন কাজ খুঁজে বের করার পরে শুরু হলো আরেক যুদ্ধ। রাত না পোহাতে কাজের জন্য রওনা হতে হত। একা নির্জন রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে বারবার পিছনের দিকে তাকাতো সাজিয়া। দেখতো পিছনে কেউ আসছে নাকি! ঘন অন্ধকার চারপাশে কেউ নেই শুধু সে একা বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতো। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ভাবতো- রংপুরের বাড়িতে শুধু ওর জন্য সারারাত একটি হারিকেন ধরিয়ে রাখা হতো কারণ সে অন্ধকার ভয় পায়। আর এখন সেই মেয়ে ফাঁকা অন্ধকার রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নীচে একা দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। বাবা, মা, ভাইবোনের সঙ্গে কাটানো সেই জীবনটা হৃদয়ের সমস্ত আকুলতা দিয়ে অনুভব করতো তখন।
নূতন কাজের জায়গায় অনেক বাঙালি শুনে সাজিয়া শুরুতে মনে মনে খুব খুশী হয়েছিল। কিছুদিন যেতে সেই আনন্দ বিস্ময়ভরা বেদনায় রূপান্তরিত হল। স্বদেশীদের কাছে এত বাজে ব্যবহার ও জীবনে কোন দিন আশা করেনি। তাকে কোন কিছু স্পর্শ করতে দেবে না। সব কিছুতে ভুল ধরবে। ও অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে থাকতো। কিছু করার নেই। তার কাজ দরকার। বাথরুমে গিয়ে কেঁদে চোখ মুছে আবার কাজে ফিরতো । একদিন সাজিয়া গরম কফি বানাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেললো! হাত নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে যে মেয়ে কখনো শখ করেও মাছ কাটেনি, সে তার পুড়ে দাগ হয়ে যাওয়া হাত কাউকে দেখায়নি পাছে তার কাজটা চলে যায়। এভাবেই কথা শুনতে শুনতে একদিন সে সব কাজ শিখল।
সাজিয়া সব সময় ভাবতো নিশ্চয় ভাল মানুষের সাথে ওর কোন একদিন না একদিন দেখা হবে। সেই ভালোমানুষটি একদিন এঞ্জেলার রূপে এসে পূর্ণ করে দিল ওর জীবনকে। এঞ্জেলার সঙ্গে দেখা হওয়া যেন সাজিয়ার ভিনদেশের জীবনে সেরা ঘটনা। ওকে সাজিয়া নিজের হাতে মায়ের মমতা নিয়ে যত্ন করে সব কাজ শিখিয়েছে। ডানকিনে কাজ শুরুর সময় যে তিক্ত স্মৃতি ওর হয়েছিল, সাজিয়া চায়নি এঞ্জেলার জীবনেও সেটা ঘটুক। মেয়েটার শৈশব-কৈশোর জীবন ছিল বেদনায় ভরা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পরে কোন সুন্দর জীবন পায়নি ও। ওকে দেখলে সব সময় মনে হত- কি যেন অজানা কষ্ট তাড়া করে ফিরছে ওকে। সাজিয়ার ইচ্ছে হত একটা ড্রইং খাতা আর রঙতুলি কিনে দেয়, যেখানে এঞ্জেলা ওর লুকানো স্বপ্নগুলিকে আঁকতে পারে।
এঞ্জেলা প্রথম যেদিন কাজের ইন্টারভিউ দেয়, ও যা বলল তাতেই রাজি হয়ে গেল সাজিয়া। যে কাজ ও ছেড়ে এসেছে সেখান থেকে বেশী ঘণ্টা দিয়েছে। এদেশে ঘণ্টা মানেই ডলার। পরে ওর কাজ দেখে ওকে শিফট লিডার বানায় সাজিয়া। এমনিতে এঞ্জেলাকে কাজের কথা বলতে হতো না, সাজিয়া কিছু বলার আগেই করতো। ও যেন মনের কথা বুঝতে পারতো। লংআইল্যান্ড সিটির কুইন্স প্লাজার কাছের ওদের স্টোরটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এঞ্জেলা ভোর পাঁচটায় এসে রাতের লোককে বিদায় দিতো। জুলিয়েন, ইসাবেলা, লুৎফা, আরতি বিভিন্ন শিফটে কাজ করতো।
সাজিয়া কাজে আসার সঙ্গে সঙ্গে এঞ্জেলা যেখানে থাকুক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরত। তারপর বলতো- মিস, তুমি ভালোভাবে ঘুমিয়ে আসবে। আমি ভোরে এসে তোমার সব কাজ গুছিয়ে রাখবো। আবার সাজিয়া কাজ শুরুর আগে বলতো, তোমাকে আগে কিছু খেতে হবে। সবাই মিলে একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিল ওরা। ক্রিসমাসের সময় ওদের পছন্দ অনুযায়ী উপহার কিনতো সাজিয়া। প্রত্যেকের জন্মদিন উদযাপন করতো। ওরাও চমকে দিতো ওদের ম্যানেজারকে তার জন্মদিনে কেক, মোমবাতি আর বেলুন দিয়ে। ওদের এত ভালোবাসতো সাজিয়া যে বেতন বাড়ানো নিয়ে মালিকের সঙ্গে তর্ক করে চাকরী ছেড়ে দিতে চেয়েছিল।
এঞ্জেলাকে অনেক কাস্টোমার পছন্দ করতো। ও কখনো তার সুযোগ নিতো না। বরং সব সময় এড়িয়ে যেতো। ও বুঝেও না বোঝার ভান করত। এঞ্জেলার বয়ফ্রেন্ড ছিল, কিন্তু পরে একটা ভুল বোঝাবুঝিতে সম্পর্ক ভেঙে যায়। ছেলেটা আসতো সবসময় স্টোরে। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবার পরেও আসতো। কিন্তু আরেকজনকে সাথে নিয়ে আসতো ওকে রাগাবার জন্য। কিচেনে গিয়ে কাঁদতো তখন এঞ্জেলা। সাজিয়ার খুব খারাপ লাগতো। এঞ্জেলার মেক্সিকান বাবা আর ডোমিনিকান মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। এঞ্জেলা মায়ের সঙ্গে থাকলেও দুজনের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক ছিল না। ওর মা লিজা ছিল এ্যালকোহলিক। মদ কেনার টাকা না থাকলে মেয়েকে মারতো প্রায়ই। বিভীষিকাময় শৈশব এঞ্জেলাকে বারবার বেদনার্ত করতো।
সেই ভোরের কথা সাজিয়া কখনও ভুলবে না। একদিন ল্যাম্পপোস্টের দিকে হেঁটে আসছিল সাজিয়া। দূর থেকে অবাক হয়ে দেখল, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসার পরে বুঝল- এঞ্জেলা। কাছে এসে কাঁধে হাত রাখতে এঞ্জেলা ঘুরে দাঁড়িয়ে সাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। জীবনের সব কষ্ট উগরে দিতে চেয়েছিল যেন সেই কান্নায়। সাজিয়ারও খুব ইচ্ছে করছিল ওর সবটুকু কষ্ট শুষে নিতে। এঞ্জেলার মুখে, গলায়, শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারের দাগ সাজিয়ার নরম হৃদয়কে চুরমার করে দিয়েছিল। কিভাবে পারে এক মা এভাবে সন্তানকে মারতে! চাকরী খুইয়ে হতাশায় বিধ্বস্ত লিসা আগের দিন সন্ধ্যায় মাতাল হয়ে দিগ্বিদিক শূন্য অবস্থায় মারধোর করেছিল মেয়েকে। পরে হুশ ফেরার পরে মেয়ের কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু এঞ্জেলা জানতো এটা সাময়িক। ওর মা আবার একই কাজ করবে। গুমরে ওঠা হৃদয়ের কষ্টের ঝাঁপি একমাত্র সাজিয়ার কাছে ও প্রকাশ করতো। চিরন্তন মাতৃ-স্নেহের প্রতি আকণ্ঠ তৃষ্ণা ছিল এঞ্জেলার। সেই ভালোবাসা যেন খুঁজে পেয়েছিল সাজিয়ার মধ্যে। ওইদিনই যেন নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। রক্তের সম্পর্কের বাইরে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধন অনুভব করেছিল। সাজিয়া অবাক হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল- ল্যাম্পপোস্টের আলো আঁধারিতে ওদের দুইজনের ছায়া এক হয়ে গেছে।
বিপন্ন শৈশবের কারণে হাইস্কুল শেষ করতে না পারা এঞ্জেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতো সাজিয়া। জহির মাঝে মাঝে বলতো, তুমি তো নিজের ছেলেদের নিয়েও এত ভাব না।
নিউইয়র্কে আসার পরে দুই ছেলে সন্তানের মা হয়েছে সাজিয়া। একজন হাইস্কুল শুরু করল। অন্যজন এলিমেন্টারি স্কুলে যায়।
জহিরের কথায় সাজিয়া হেসে উত্তর দিতো, ওদের সম্পর্কে ভাবার জন্য তো তুমি আছ।
জহির বলতো, সব মানুষের জীবনে একটা অবসেশন থাকে। তোমার অবসেশনের নাম এঞ্জেলা।
সাজিয়া রেগে গিয়ে বলতো, এঞ্জেলা আমার অবসেশন কেন হবে! ও আমার মেয়ের মতো। মা মেয়ের জন্য চিন্তা করবে না!
‘মেয়ের মতো বলছ! মেয়ে তো নয়।’ জহিরের সেদিনের এই একটি কথায় এত অবাক হয়ে গিয়েছিল সাজিয়া যে আর কোন উত্তর মুখে যোগায়নি। জহিরের মানসিকতার সঙ্গে আদতে কোনদিনই ওর মিল ছিল না। সেদিন সাজিয়া সিদ্ধান্ত নেয়- এঞ্জেলার ব্যাপারে এখন থেকে ও নিশ্চুপ থাকবে। যা করার নিজে থেকে করবে।
সাজিয়ার উৎসাহে এঞ্জেলা সেনাবাহিনীর চাকরীতে আবেদন করল। সাজিয়া জানে, আমেরিকান সেনাবাহিনীতে চাকরী হলে দূরে চলে যেতে হয়। এমনকি দেশের বাইরেও চলে যেতে হতে পারে। কিন্তু তবু নিজের মন শক্ত করে সাজিয়া। ও চেয়েছিল ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা মেয়েটা যেন ফিনিক্স পাখীর মতো একটা নতুন জীবন পায়। যে জীবন নিয়ে ও গর্ব করতে পারে।
এঞ্জেলা যতদিন ট্রেনিংয়ে ছিল কিছুক্ষণ পরপরই সাজিয়াকে ছবি টেক্সট করতো। দূরে থাকলেও সাজিয়ার মনে হত খুব কাছে আছে ও। নিয়মানুযায়ী সেনাবাহিনীতে কেউ যোগ দিলে আইআরএস নামে আমেরিকার একটি সংস্থা তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষের কাছে বিভিন্ন খোঁজ খবর নেয়। এঞ্জেলা ওর অভিভাবকের জায়গায় মা লিসা নয়, লিখেছিল সাজিয়ার নাম।
’আমি কি দেরী করে ফেললাম?’ সাজিয়া চমকে তাকিয়ে দেখে থিয়োফেনিস।
এঞ্জেলার ভাবনায় এতখানি ডুবে গিয়েছিল যে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে দরজা দিয়ে ঢুকতেও দেখেনি সাজিয়া। মধ্যবয়সী এক গ্রীক ভদ্রলোক থিয়োফেনিস। এই স্টোরের নিয়মিত ক্রেতা তিনি। স্টোরের আশেপাশে গ্রীক বসতি বেশী বলে কাস্টোমারের মধ্যে তাদের দাপট বেশী। গ্রীক বুড়ো-বুড়িদের একটি দল প্রতিদিন সকালে এখানে এসে আড্ডা জমায়। আজকে আবহাওয়া খারাপ বলে তারা এখনও আসেনি। কিন্তু থিয়োফেনিস এসেছে। ও প্রতিদিন একবার করে হলেও আসে। ওদের স্টোরের প্রত্যেকের জন্মদিন ওর নোটবুকে আছে। সবার জন্য মনে করে চমৎকার সব উপহার নিয়ে আসে। ছোট করে চুল ছাটা আর শক্তপোক্ত দেহের কারণে থিয়োফেনিসের বয়স কত বোঝা যায় না। তবে কাজ থেকে সে অবসর নিয়েছে সেটা বলেছে। এখন ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তোলা ওর নেশা।
’তুমি একদম সময় মতো এসেছ।’ সাজিয়া হাসতে হাসতে উত্তর দেয়। ’এই যে দেখ এঞ্জেলা টেক্সট করেছে ও দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে।’
থিয়োফেনিস কিছু না বলে মৃদু হাসে। এই মানুষটার উপস্থিতি সব সময় সাজিয়াকে উষ্ণ অনুভূতি দেয়। আজকেও করল। থিয়োফেনিসের বাদামী চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন ওর কিছু বলতে ইচ্ছে হল। ওর এক সহানুভূতিশীল শ্রোতা দরকার যার কাছে ও মেলে ধরতে পারে বিবর্ণ এ্যালবামে লুকিয়ে রাখা কিছু ভুলের স্মৃতি।
’তুমি আমাকে কত বার বলেছ বাইরে একদিন তোমার সঙ্গে ডিনারে যেতে। আমি যেতে পারিনি।’ থিয়োফেনিস সামনের চেয়ারে বসার পরে সাজিয়া নিজের জীবনের দৈন্যতার কথা বলে। ‘তবু তুমি আমার বন্ধু আছ। ছেড়ে যাওনি।’
’আমি জানি তোমাদের সংস্কৃতি। আমি সব সময় তোমার বন্ধু আছি আর থাকবো।’ টেবিলের ওপর অলস পড়ে থাকা সাজিয়ার হাতের ওপর আলতো করে হাত রাখে থিয়োফেনিস।
’তুমি আমাকে যত ভালো মনে করছ, আমি ততটা নই। জানো..’। থেমে যায় সাজিয়া। তারপর দ্রুত বলে ওঠে, ’জানো, আমার একটা অবৈধ সন্তান হয়েছিল?’ বুকের মধ্যে তীব্র সুনামির পরে কথাটা অবশেষে বলতে পারল।
সোজা হয়ে বসল থিয়োফেনিস। ওকে সত্যি বিস্মিত লাগছে। তবে মুখে কিছু বলল না। আসলে বুঝতে পারছিল না কি বলবে! আজকে সাজিয়াকে কেমন অন্যরকম লাগছে।
’বাবা-মায়ের অতি আদরের সন্তান ছিলাম। পাড়ার এক তরুণের সঙ্গে খুব কম বয়সে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। অন্তঃসত্ত্বা হবার পরে আমার বাবা-মা খুব কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু আমাকে মুখে কিছু বলেনি। দূরের এক শহরে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তখন আমার বয়স ১৯ বছর। শরীরের অবস্থা নাজুক হওয়াতে ডাক্তার আমার অ্যাবরশন করতে পারিনি। পরে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’ ঘোর পাওয়া মানুষের কণ্ঠে সাজিয়া বলে যায়, ‘দিন দিন ওই শিশুটির প্রতি মায়া জন্মাতে লাগল। কত স্বপ্ন দেখেছি ও পৃথিবীতে আসার পরে কি করব!’
সাজিয়ার দম নেবার সুযোগে থিয়োফেনিস বলে,‘কিন্তু শিশুটির বাবা, সে কি চেয়েছিল?’
‘ও আমার বয়সী ছিল । স্বামী বা বাবা হবার মতো অবস্থা ওর ছিল না। আমার বাবা ওকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছিল।’ কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে এই আলোচনায় যেতে চায় না সাজিয়া। সে বলতে চায় অন্য কিছু। আর সেটা এঞ্জেলা এখানে পৌঁছানোর আগে। থিয়োফেনিস আর কোন প্রশ্ন করল না।
’অবশেষে সাত মাসের মাথায় একটি অপরিণত শিশুর জন্ম দিলাম। আমার মেয়ে। ইনকিউবিউটরে তেত্রিশ দিন বেঁচে ছিল। ওই তেত্রিশটা দিনের কথা আমি জীবনে ভুলব না।’ সাজিয়ার কণ্ঠ ধরে এল।
’ আজ কি ওর জন্মদিন?’ থিয়োফেনিস জানতে চাইল।
’কিভাবে বুঝলে?’ সাজিয়া টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে অবাক হয়ে তাকাল।
’তুমি এঞ্জেলাকে প্রচণ্ড ভালোবাস, কারণ আজ ওরও জন্মদিন।’ থিয়োফেনিস হাসল। ওর চোখ সাজিয়াকে ছাড়িয়ে চলে গেল রাস্তার ওপারে ল্যাম্পপোস্টের দিকে। ’ওই যে দেখ তোমার বার্থডে গার্ল আসছে।’
কাঁচের ভিতর দিয়ে সাজিয়া তাকালো ল্যাম্পপোস্টের দিকে। দেখতে পেল চারদিকে সাদা তুষারের মধ্যে আনন্দে ঝলমল করছে ওর এঞ্জেল।
মনিজা রহমান
জন্ম ৯ মার্চ, পিরোজপুরের কাউখালি নানাবাড়িতে। তবে শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের পুরো সময় কেটেছে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। বিয়ের পরে দীর্ঘদিন থেকেছেন ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডে। বর্তমান নিবাস নিউইয়র্কর সিটির এস্টোরিয়ায়। লেখকের লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে এই জায়গাগুলির কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরে বেছে নেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার মতো নারীদের জন্য অপ্রচলিত একটি পেশা। দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক মানবজমিনে। নিউইয়র্কে আসার পরেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন লেখালেখির সঙ্গে। প্রথম আলো উত্তরের নকশার বিভাগীয় সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন এস্টোরিয়ার একটি স্কুলে। বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র ও কণ্ঠশীলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। সেখান থেকেই সাহিত্য ভাবনার শুরু। ২০১০ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হয়। এই পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারোটি।
অনবদ্য।
ভালো লাগল।
কলম চলুক নদীর মতো।