সেলিম জাহানের মুক্তগদ্য: যা হতে পারতো, কিন্তু হয় নি

তখন আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মফ:স্বল শহরে গৃহ- অভ্যন্তরে কলের জলের ব্যবস্হা ছিল না। বরিশালও তার ব্যতয় নয়। পানীয় জলের জন্য শহরের বড় রাস্তাগুলোর ওপরে শান-বাঁধানো কল ছিল – যেখানে বিকেল ৪ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত জল আসত। স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যেক বাড়ীর গৃহকাজে যাঁরা সাহায্য করতেন তাঁরা বিকেল সাড়ে তিনটে থেকেই লোটা-কলস নিয়ে প্রত্যেক কলতলায় লাইন দিতেন জল ধরার জন্য।

আসলে লাইন দেওয়ানো হতো কলসীদের এবং যাঁদের জল ধরার কথা, তাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করতেন নিজেদের মধ্যে, কখনও সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন হয়ে। কলসীর লাইন কিংবা জলের অগ্রাধিকার নিয়ে মাঝে মাঝে তুমুল কলহ বঁধে যেত।। গ্রীষ্মকালে বা কোন জরুরী অবস্হায় পৌর প্রতিষ্ঠানের জলের গাড়ীও আসত। তখনও ঐ কলসীর লাইন এবং প্রবলতর বিবাদ।

বরিশালের বৈদ্যপাড়া অঞ্চলের একটি একতলা সাদা দালান বাড়ী। সামনে মাঠ— সেটা একটু তেরছা ভাবে পেরুলেই বড় রাস্তা এবং শান-বাঁধানো কলতলা। এক বিকেলে ওই বাড়ী থেকে এক হাতে পেতলের কলস ও অন্য হাতে একটি ৩/৪ বছরের শিশুর হাতে একটি কিশোর গৃহপরিচারক বেরুল । লক্ষ্য কলতলা—শিশুটিও চেনে জায়গাটি, প্রায় প্রতিদিনই এ তার বৈকালিক ভ্রমন।

কলতলায় কলসীটি বসিয়ে গৃহপরিচারকটি অন্যান্যদের সঙ্গে গল্পে মত্ত হয়ে উঠল। শিশুটি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে নিত্যকার মতো। জল ধরা শেষে কিশোর পরিচারকটি যখন শিশুটিকে ডেকে নেবে, তখন দেখা গেল সে কোথাও নেই। চারদিকে খোঁজ খোঁজ রব উঠল, কিন্তু কোথাও শিশুটিকে দেখা গেল না। খবর পেয়ে শিশুটির পিতা পাগলের মতো চলে এলেন ঘটনা স্হলে, এলেন প্রতিবেশীরা—না, কোথাও সে নেই।

মাঠের পাশের পুকুরে জাল ফেলা হলো। প্রতিবেশীদের একজন ছুটলেন থানায় খবর দিতে। অন্যরা ঘটনাস্থলের আশে পাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। শিশুটির মা সংবাদটি পেয়ে মুর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন বাড়ীতে। তাঁকে ঘিরে রইল আশেপাশের মহিলারা। সাদা বাড়ীটির সামনে ভীড় জমে গেল।

ইতিমধ্যে এখানে যখন এত কিছু ঘটছে, তখন পশ্চিম প্রান্তে শহর ছাড়িয়ে যেখানে কাশীপুর গ্রামের শুরু হয়েছে, সেখানে কিন্ত ভিন্ন দৃশ্য। ঘনায়মান সন্ধ্যায় দেখা গেল এক পাগলী হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে এবং তার কোলে ঐ শিশুটি। বিকার নেই তার। বেশ আনন্দে চারদিক দেখতে দেখতে সে চলেছে পাগলীর সঙ্গে।

বড় রাস্তা থেকে নেমে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরল পাগলীটি—তারপর আলপথ। বেশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে তখন। কাশীপুরের মেঠো পথ, ধানের ক্ষেত, গাছের সারিতে ধূসর কুয়াশা। পাগলির চলার যেন কোন বিরাম নেই। ঠিক তখনই দেখা গেল আলপথের উল্টোদিক থেকে আসছেন একটি তরুন—পা’জামা, পান্জাবী পরা। হাতে বিজলী বাতি, সেটার আলো ফেলেই এগুচ্ছেন তিনি। তরুনটি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র, যাচ্ছেন শহরের দিকে সান্ধ্যকালীন গৃহশিক্ষকতা করতে।

সামনের শিশুটি কোলে নারীটির ওপর বিজলী বাতির আলো পড়তেই তিনি চমকালেন। শিশুটিকে তিনি চেনেন—দেখেছেন তাঁর অধ্যাপকের বাড়ীতে। পাগলীটিকে দেখে আন্দাজ করলেন। তারপর শিশুটিকে নিয়ে টানাটানি— পাগলী কি ছাড়তে চায়? একরকম জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে জোর পা চালালেন শহরের দিকে। পেছনে পড়ে রইল পাগলীর চিৎকার আর গালাগাল।

হারিয়ে যাওয়ার ঘন্টা দু’য়েক পরে শিশুটিকে নিয়ে তরুনটি হাজির হলেন বৈদ্যপাড়ায় তাঁর অধ্যাপকের একতলা সাদা বাড়ীটায়। মৃতপুরী থেকে বাড়ীটি যেন কোন যাদু কাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠল। তারপর হাসি, কান্না, অশ্রু, কৃতজ্ঞতা, শতবার সেই উদ্ধার কাজের গল্প, সহস্রবার সেই তরুনটিকে ধনযবাদ সব মিলিয়ে এক অনাস্বাদিত আনন্দের বন্যা বয়ে গেল—পৃথিবী যেন হেসে উঠল।

পুরো ঘটনাটা আমি শুনেছি আমার মা’য়ের কাছে। বেনু ও আমাদের কন্যারাও শুনেছিল ঐ আমার মা’য়ের কাছেই। যতবার আমার মা ঘটনাটি বলেছেন, আমার মা’য়ের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে এবং আমাদের কন্যাদের চোখেও জল টলটল করেছে।

আমার মা ঘটনাটি কি করে জেনেছেন এবং সেটি বলতে গিয়ে কেন তাঁর চোখে জল আসত? কারন, সেই শিশুটি তাঁর প্রথম সন্তান এবং সেটি আমিই।

 

সেলিম জাহান

সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top