মথুরাপুরে এই প্রথম অতিথি আপ্যায়ন তাদের, বলা যায় সংসার জীবনেও। নিধি’র মা মন ঢেলে রেঁধেছে। টাটকা পাওয়ার সুযোগ নাই, বরফাচ্ছাদিত ইলিশের পাতুড়িতে জিভে জল আনা স্বাদ আনতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। এই রান্নাতে সামান্য আদাবাটার ব্যবহার শাশুড়ি তাকে শিখিয়েছিল।
দুপুরের খাওয়া শেষ। টেবিলকে তবলা বানিয়ে চাটি মেরে নিধির বাবা গান শুরু করলে সে স্থাণু হয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
তার স্বামী গান গাইতে পারে শুনেছে নিধির মা। কিন্তু বিয়ের পর গান শুনতে চায়নি। আসলে চাইতে পারে নি। গান গাইবার প্রসঙ্গ এলে একদলা আঠা তার গলা আটকে ধরেছে। তারপর কতদিন হয়ে গেল। আবছা অপরাধবোধ ঘিরে ধরে তাকে। সে কখনো শুনতেও চায়নি কেন? কেন’র উত্তরটা সে জানে।
গান শুনে তমালিকার বিস্মিত চাউনি, আর অনুপের মুখের হা ক্রমশ স্ফীতকায়।
নিধি’র বাবা গানের অন্তরায় ঢুকে গেছে, … ‘ আঁখি জল কভু ফেলো না, নিবিড় আঁধারে একা… নেভা দ্বীপ আর জ্বেলো না… পথ চেয়ে আর থেকো না’…
নিধি আর আবেদা বারান্দা থেকে দৌঁড়ে এসে দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে।
গানের শিল্পীকে আজ মান্না দে’তে পেয়েছে। সে চোখ বন্ধ ক’রে,… ‘শুধু একদিন ভালোবাসা মৃত্যু যে তারপর, তাও যদি পাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর…’ লাইনগুলি নিধি’র মার বুকের ভেতরটা হাহাকার দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে যায়।
খাটের ওপরে আধশোয়া তমালিকা একের পর এক অনুরোধ করে চলেছে। তার কোন আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ থাকছে না। এত গান জানে নিধির বাবা!
‘কথা দাও আবার আসবে, আবার এমনি ক’রে ভালোবাসবে দিন যাক সেই ভরসায়’ শুনতে শুনতে তমালিকা আর অনুপ গানের মধ্যে নিজেদের ভেতর দৃষ্টি বিনিময় করে চলে।
এড়িয়ে যেতে না পারা সে দৃষ্টিপাত নিধির মা’কে দূরের কোন শূন্যতায় নিঃক্ষেপ করে, যে অনুভব তার একেবারেই ভালো লাগে না, কেমন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে সে।
পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে হাঁটুতে মুখ গুজে থাকে সে। বলকানো পানির শব্দের সঙ্গে ওঘর থেকে গানের সুর ভেসে আসে, … ‘তবে কি ভুলেরই স্বর্গ গড়েছি, জানি না কি অপরাধ করেছি…’
গানের কথাগুলো যেন নিধির মা’র মনের কথা।
যে কিনা এক উজ্জ্বল রোদে গাঁথা দিনে হাটতে শুরু করেছিল, গাছগাছালী-ফুলপাখি সে রোদের আঁচে সুখে কাঁপছিল। হাটতে হাটতে বেশ অনেকদুর চলে এসেছিল। তারপর হঠাৎ বৃষ্টি এসে পথঘাট কর্দমাক্ত করে তুললো দীর্ঘপথ, ধারে কাছে কোথাও যানবাহনের চিহ্নমাত্র নাই। নিধির মা’র মনে হয় এই কাদামাখা পথ কখনো ফুরোবে না। সে থেকে থেকে অনুভব করে নির্জীব সেই পথচলা।
ট্রে’তে চা আর পায়েসের বাটি চাপিয়ে ফিরে এসে তমালিকার মত মেদুর চোখ দিয়ে নিধির বাবার দিকে তাঁকাতে ইচ্ছে করে তার। স্বেদমাখা নাকের ডগা আঁচলে মুছে হাতে হাতে মিষ্টান্ন বেড়ে দিতে দিতে দেখে সঙ্গতরত তার স্বামীর দু’চোখ বন্ধ।
‘আবার এমনি করে ভালোবাসবে…’ নিধির বাবার গলা উদারা মুদারা, তারায় খেলতে থাকে,… ‘আবার নদীর কুল ভাসবে, একদিন নব বরষায়, দিন যাক সেই ভরসায়’।
ঘরে ফ্যান চলছে ফুল স্পীডে। চায়ের কাপ নিয়ে এইবার নিধি’র মা বিছানায় উঠে বসে। তখন ‘সেইতো আবার কাছে এলে’ শুরু হয়।
আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি নামবে। বাইরের জলো বাতাস ঘরে ঢুকে আলনায় ভাঁজ করে রাখা শাড়িজামাগুলোকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়।
বিকেল অনেকক্ষণ থেমে থেকে এলিয়ে পড়তে শুরু করেছে। গানের সুর সঞ্চারী ছেড়ে অন্তরাও ছাড়িয়ে এসেছে,… ‘তুমি তো আমায় ভাল চেনো, তুমি ছাড়া কোন গান ভাবতেও পারি না তা জেনো…’। তার বুজে আসা চোখ আধখোলা হয়ে সহসাই পরিস্ফুট হয়ে শ্রোতার চোখে চোখ রাখে।
-‘আপনি তো দাদা ওস্তাদ মানুষ, এত গান মুখস্থ রাখলেন কিভাবে?’, এইবার অনুপ গলিত হয়, ভক্তিতে।
-‘অনেকদিন অভ্যাস নাই, রেওয়াজ টেওয়াজ বন্ধ’, ফ্যাকাশে হাসির সঙ্গে নিধির বাবার চোখও বেমানান নতমুখী, যেন দৈবাৎ কারো চোখে পড়ে গেলে কোথায় রাখবে তাই নিয়ে রাজ্যের দ্বিধা।
– ‘বুবু, তোমার কি সৌভাগ্য,’ তমালিকা এগিয়ে এসে নিধির মা’কে জড়িয়ে ধরে, ‘ প্রত্যেকদিন এইরকম গান শুনতে পারো!’
এর মধ্যে কখন সত্যি সত্যি আকাশে মেঘ করেছে কেউ খেয়াল করেনি। ঘরের আলোতে আবছায়া দেখে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সবাই।
-‘কার কাছে গান শিখতেন দাদা?’ তমালিকা কলকল করেই যাচ্ছে।
-‘আমার ওস্তাদ ছিলেন সুশীল বড়ুয়া, খুব নিভৃতচারী লোক, মফস্বল না থেকে ঢাকায় থাকলে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাইতো, কিন্তু উনি এইসবের ধার ধারতেন না। গান তার কাছে প্রার্থনার মত। তার পুরানো ছাত্রছাত্রীরা কতবার তাকে ঢাকা কলিকাতায় নিয়ে যাইতে চাইছে, কিন্তু উনি বড় সাদাসিধা জীবন ভালোবাসতেন’, বলতে গিয়ে নিধির বাবা একটু সহজ হয়ে আসে, কিছুটা উত্তেজনাও হয়তো, একসঙ্গে অনেক কথায় বেছে বেছে শব্দ বলতে গিয়েও উদাস হয়ে।
বৃষ্টি হলে কী এক অতল টেনে নেয় নিধির মা’কে। খুব বেশীদিন তো না, তবু এই বিবাহিত জীবনে বৃষ্টির দিনগুলি তাকে ডুবিয়ে নেয়। তার স্বামী গান গাইতে জানে এটা সে অবশ্যই শুনেছে, কিন্তু এতগুলি ভালো গান এক বসায় সে যে গাইতে পারে এই আশ্চর্য সে এতদিনেও জানেনি। এই কথা লোক ধরে ধরে বললেও তো কেউ বিশ্বাস করবে না। দু’একবার নিধিকে নিয়ে পড়েছিল, হারমোনিয়ামে সারগম শেখানোর কসরত করেছিল।
কিন্তু তার নির্লিপ্ততায় হোক, কিংবা নিধির শেখার অনিচ্ছায় সে তোড়জোড়ে কবে ভাটা পড়ে গেছে। নিধিকে হারমোনিয়াম ধরে শেখানোর দুই তিন দিনের সা রে গা মা তাকে কখনো ঘোরগ্রস্থ করেনি। নিধি জন্মানোর আগের কোন একদিন স্বামীর কন্ঠে গুনগুন শুনেছিল। সেই প্রথম সেই শেষ, তেমনই ভেবেছিল। ভেবেছিল- জাগিয়ে না দিলে ঘুমিয়ে থাকবে তার মনোজগত।
আজকে আবার ধাক্কা খেলো, – শেষেরও তাহলে শুরু আছে আবার। নিধির বাবা গানের কাছে ফিরে আসতে পারছে। জন্মের পরও আরেকবার পূনর্জন্ম ভেঙ্গে!
হাতে মেহেদীর কালচে কমলা নকশা আর সোনার বালা, নিধির মা আঙ্গুল খুটতে খুটতে আল্লাদী গলা বানিয়েছিল- ‘সবাই তোমার গানের কথা বলে, গাও না একটা গান, শুনি’, তার চোখের পাতায় সদ্য পরিনীতার লাজুক ভাব তখনো উড়ে যায়নি।
-‘আর যে-ই চাক, তুমি কখনো গান শুনতে চাইবা না। আমি আর গান করবো না। আমার ঐ জীবনের মৃত্যু হইছে’।
হ্যা, এমন করেই শুনতে হয়েছিল, গান শিখতে গিয়ে নিধির বাবার নাকি পূনর্জন্ম হয়েছিল। আর সে পূনর্জন্মের নাম নিজমুখে বলে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে কেবল মৃতলাশের অধিকার দিয়ে দিলো। নামটা ছায়া ছায়া বাতাসে উড়তে দেখেছিল নিধির মা, নববধু হয়ে হাত বাড়িয়ে ধরার সাহস হয়নি। ধরে দেবে এমন কাউকে ভোমরাদহের বাড়িতে তখনো চিনে উঠতে পারেনি। নিধির বাবা সুলেখা বড়ুয়ার নাম বলে দিয়ে নিজেই কাজটি সম্পন্ন করেছিল।
-‘তুমি হইলা আব্বার পছন্দ, আর সেইটাই আমার পছন্দ’, তার মাচা থেকে ধেয়ে আসা গোটা গোটা পরিপক্ক শীমের দিকে শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গিয়েছিল তার স্বামী।
সুলেখার কাছে দ্বিতীয় জন্ম নেয়া স্বামীকে নিতে মন চায়নি নিধি’র মার, কিন্তু না নিয়ে ফস করে জ্বলে উঠবার কোন উপায় ছিল? সুতরাং গ্রহণ করলো নিধির মা, বলা যায় গলাধকরণ করলো, আকণ্ঠ কষ্ট হয়েছিল শুরুতে, ঠান্ডা ভাতের দলা পানি ছাড়া গিলতে যেমন হয়। বিয়ের অব্যবহিত পরে দু’জনকে ঘিরে দেখা স্বপ্নগুলি নিধির মা দ্রুতগতিতে খাক করে দিতে পেরেছিলো।
সংগীতের ওস্তাদ সুশীল বড়ুয়ার স্ত্রী’র ছোট বোন সুলেখা। যখন মেয়েরা বইখাতা বুকে চেপে কলেজে যায়, সে তখন বোনজামাইয়ের সঙ্গে তানপুরা সঙ্গত করে, আর দুর্দান্ত গান গায়। নিধির বাবার সঙ্গে ডুয়েট গেয়ে কলেজের ফাংশান বাজিমাত করে তোলে, শাড়িতে তাকে কলকাতার পুরানো সিনেমার নায়িকাদের মত দেখায়।
ব্যাস, এইটুকু জানতে পারে নিধির মা, আর বাকীটুক দিয়ে তার ভেতরে না ফুরানো নাটকের দৃশ্যাবলী তৈরী হয়। কালো তিলের মত মেঘবিন্দু থেকে বিশাল মেঘলা আকাশ দিনমান ছেয়ে থাকে তাকে। আজকে এতদিন পরে আবার ঘরময় সুর ছড়িয়ে নিধি’র বাবা নিজের অতীতের দিকে মুখ ফেরালে তীব্র খর দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে পারে না সে।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস- ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ- ‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।