যে যেভাবে, সে সেরকম
পিঠের ওপর ক্রমাগত বৃষ্টি ঝ’রে পড়ছে –
গাছের গোড়া বাঁধা আছে একটি শেকড়েই।
যে যেভাবে ছিলাম আমরা,
সে সেভাবে নেই।
হাতের চেটোয় ক্রমাগত বৃষ্টি ঝ’রে পড়ছে—
গোপন চিঠি রাখা আছে নিঃস্ব মুঠোতেই।
যে যেরকম ছিলাম আমরা,
সে সেরকম নেই।
গাছের পাতা মোমের মতো পড়ছে ঝ’রে,
দূর-আকাশে পায়রা-শালিক যাচ্ছে উড়ে—
ছটফটিয়ে উঠছে কাছের কেউ…
বুকের ভেতর একশো পাথর ভাঙছে ফেনিল ঢেউ।
চাঁদের আলোয় ঘাসের মানুষ যাচ্ছে পুড়ে,
নিথর হয়ে খড়ের মতো ভাসছে দূরে—
দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে শালের বন…
মাঝ-দরিয়ায় হন্যে হয়ে খুঁজছে আর-এক মন।
হারানো আমিষ গন্ধ
নাকে এসে লাগে তোমার আমিষ গন্ধ,
অথচ জেগে উঠেই দেখি কপাট বন্ধ।
কপাট খোলার জন্য যখন উঠতে যাবো,
মনে ভাবি এবার বুঝি দেখতে পাবো—
তোমার মতো ভয়ানক একা চাঁদ,
জেগে বসে থেকে সারাটা শীতল রাত;
কীভাবে গোঙায় ভীষণ কঠিন জ্বরে,
মেঘের দেরাজে কীভাবে ফুঁপিয়ে মরে!
ক্রমে ক্রমে খালি বাড়তে থাকে দ্বন্দ্ব,
কমে যেতে থাকে জীবনের যতো ছন্দ।
ভালো-মন্দ কিছুই চায় না মন,
ফিরে পেতে চায় হারানো হেতাল বন—
যে-ই বনেতে ঘুমিয়ে রয়েছে বাঘ,
যে-ই বনেতে নেই মানুষের বাস;
রয়েছে কেবল বর্বর দুটি জীব :
বিরহী আদম আর, বিরহিণী ইভ।
এটুকুই
বৃষ্টিভেজা রাস্তায় রাত জেগে চলে গেছে দূরপাল্লার গাড়ি।
অজস্র চাকার দাগ, কাদাজলে দানা খুঁজছে সতর্ক কাক,
সুর ক’রে ডাক দিয়েছে রঙিন আইসক্রিমের গাড়ি।
একটু হাঁটা মাত্রই মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে গ্যাঁজলা,
ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত—
জামা-কাপড় খোলা ব’লে,
শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে শরীর :
এসি চালু ব’লে, কলম থেকেও ঝরছে না উত্তাপ।
হঠাৎ দেখি :
পাখি উড়ছে খুব;
রাঙা ধুলোয় উঠছে সেজে বুড়ো-বুড়ো ঘরবাড়ি।
দেখি হঠাৎ :
আধো-ভাঙা কিছু মুখ;
বাসের পেছনে ধাবমান বহু সাদা-কালো বুনোহাঁস।
ধর্মতলায় হঠাৎ দেখি দাঁড়িয়ে আছো একা—
দুঃখিত কোনো নদীর পাশে সবুজ গাছের মতন।
বুকের ভেতর গর্জে উঠলো মেঘ,
পরক্ষণেই বেড়ালের মতো এলিয়ে দিলো দেহ।
রিফিলে শিশির ভরা আছে
তুলোর উড়ন্ত নকশার থেকে যখন সে নেমে এলো,
তালপাতা-মোড়া নরম কষা গন্ধে
ভ’রে উঠেছিলো চতুর্দিকের সকল ভগ্নাবশেষ।
তার যন্ত্রণানীল চোখের বিষণ্ণতায়,
বুকের তলায় ভ’রে উঠেছিলো ধু-ধু নির্জনতা।
রাত্রি শেষের নদীতরঙ্গ ছুঁয়ে,
দূরের দিগন্তে জেগে উঠেছিলো অজস্র অশ্রুবিন্দুর মতো অগণিত নক্ষত্রলোক।
ধানক্ষেতে বাতাসের মতো,
আশশ্যাওড়ার ডগায় সেদিন ঝরে পড়েছিলো মধু।
চকিত উদভ্রান্তের মতোই তাকে বললাম, এসো এসো,
কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো—
তারপর অনেক কথা হবে
কেননা দেখেই মনে হচ্ছে তুমি বহুদূর থেকে এসেছো।
সে বললো, একটু দাঁড়াও :
নোটপ্যাড, ডটপেন খুলে
বাদাম-পাতায় নামটা তোমার লিখি সবার আগে।
জল ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়লো জলে…
বললাম, কিন্তু তোমার সবটুকুই তো দিয়েছো তুমি আগে—
পেনের কালি তো বোধ করি সব শেষ।
ফুলের মতো সহজ হেসে সে বললো,
চিন্তা ক’রো না,
আমার রিফিলে শিশির ভরা আছে।
শীতঘুম
দু-সপ্তাহ ভাত খাইনি আমি—
ভাত দিতে পারো আমায় এক মুঠো?
কথা দিয়েও যাইনি তোমার বাড়ি—
ক্ষমা ক’রে দেবে আমায় প্লিজ?
আসলে কিছু মনে ক’রো না ভাত চাইলাম ব’লে—
মদ খেতে-খেতে আসলে আমি ক্লান্ত!
তাই আজ দুপুরে এলাম দুয়ারে তোমার—
তোমার রাঁধা ভাতের ধোঁয়ায় ঠোঁট ভেজাবো ব’লে।
আসলে আমার মাথাটাই ঠিক নেই…
বেশি-বেশি ক’রে মনে পড়ছে তোমায়।
তোমায় বারবার ছুঁয়ে দেখতে চাইছে
ঘুমন্ত এই অহ্নের মতো শিথিল
আমার দেহ।
আত্মবিলোপের প্রবল ইচ্ছার পরেও;
তুমি তো জানোই ক্লান্তি আমার শ্রেষ্ঠ দুর্বলতা!
তাই এসেছি দুটি অন্নের টানে।
ভাত দিয়ে দাও —
আবারও আমি ফিরে যাবো ধানক্ষেতে।
শীতঘুম দিয়ে শুয়ে থাকবো গোটা ডিসেম্বর।
পরিচিতি
অভ্র ঘোষাল নিজেকে মনে করেন, সামান্য একজন কবি। যৎসামান্য একজন মানুষ। বিধাননগর সরকারি কলেজে নৃতত্ত্বে বিষয় নিয়ে পড়ছেন। কলকাতায় বসবাস।