একদিন মাঘ মাসের অতিপ্রত্যুষে কে বা কারা পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে দিলো।
কেউ বলে দেয়নি, তবু নিধি তার সে বয়সের চোখ দিয়ে দেখতে পায়- পোড়া কয়লা হয়ে আসা উঁচিয়ে থাকা হাঁটু, একটা দড়কচা পাঁকানো প্রায় কংকাল শরীর, পাটগুদামের একাংশের অসূর্যস্পর্শা ছাইয়ের স্তুপের মধ্যে অনড় হয়ে আছে। বাচ্চা মহিষের মত পেলব, উচ্ছল যে আবেদা, তার স্বামী মজনু পুড়ে গেছে আগুনে। অন্যদিকে তখনো লেলিহান আগুনের শিখা।
মজনু’র সঙ্গে নিধির খাতির হয়েছিল। মা’র অতর্কিত বাজারের ফরমায়েশ, ধনেপাতার চিলতে ক্ষেত নিড়িয়ে দেয়ার ফুরসতে নিধির সঙ্গে কথা বলতো মজনু। সেই মজনুকে নিয়ে মানুষের জটলা বারান্দার একটা খুঁটি জড়িয়ে ধরে ঘুম ভাঙ্গা ভ্যাবাচ্যাকা নিয়ে দেখতে থাকে নিধি।
-‘পাট সবগুলান পুড়িছে নাকি কায়ও চুরি করি তারপর আগুন দিছে কে জানে’?
-‘এত মন কে মন পাট চুরি কইরবে কায়’?
-‘চোরের কি আর অভাব আছে বাহে! পাহারাদারই পয়সা খায়া দুয়ার খুলি দিবা পারে’…
-‘সেই শালার গার্ড ব্যাটাই তো মরি ভুত…পয়সা কুন মুখ দিয়া খাইবে এলা’?
ভীড়ের গুঞ্জরণ ভোরের আলোর সঙ্গে আরো সোচ্চার, আরো স্পষ্ট। নিধি তখনো বারান্দার খুটি ধরে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল, আর ভীড়ের মধ্যে তার বাবার উদ্ভ্রান্ত চুলের আনাগোনা দেখছিল। আকন্দ গাছের ডালপালাফুলগুলি কৌতুহলী মানুষের পায়ের চাপে থেতলে গেছে- সকালের আলো তাকে সেটাও দেখিয়ে দিচ্ছিল, তাদের কদবেল গাছের চারা কেউ উপড়ে দিয়ে গেছে। নিধিকে কেউ খেয়াল করছিল না, আগের রাতের জ্বর তার শীতবোধ বাড়িয়ে দিচ্ছিল, সে জানে যে মা তার সোয়েটার বিছানার কিনারে ভাঁজ করে রাখে, কিন্তু ঘরে গিয়ে আনার সাহস ফুরিয়েছিল তার। সবাই বলাবলি করছে যে আরো কেউ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে।
ব্যস্ত, অস্থির, পায়চারীরত বাবা হঠাৎ নিধিকে দেখতে পায়। দৌড়ে এসে তাকে কোলে নিয়ে কাঁধে চেপে তার চোখ ঢেকে দেয়। নিধির আগুনের পোড়া স্তুপ দেখা মানা, যেন অচ্ছ্যুৎ কিছু।
বাবার দু’হাতের ভেতরে শরীরের থরথর কম্পন অনুভব করতে করতে সে শুধু তার কর্কশ কন্ঠ শুনতে পায়- ‘আবেদা, মেয়েটাকে সরাও, দূরে নিয়া যাও এখান থেকে’।
এক ভয়তাড়িত কাঁপুনি থেকে নিধিকে আরেক ভীতিবিহবল কোল লুফে নেয়, আর সে ক্রমশ দূরে যেতে থাকে, আগুনের উত্তপ্ত শিখা থেকে। সেই আকাশ ছোঁয়া উত্তুঙ্গ আগুনের শিখা তাকে এখনো, উনত্রিশে এসেও ঘুমে জাগরণে ছুঁয়ে যায়।
নিধির দাদুর দশ কানি জমির লিচু বাগান। সে ঘুরে বেড়ায় আবেদার হাত ধরে। লিচু বাগানের মুখে একটা গোয়াল ঘর। সকালবেলা গরুর বাছুরগুলো মুখে ঠুলি বেঁধে আশ্চর্য ঘুরে বেড়ায়। একটু আগেই আবেদা তাকে জোর করে কলা আর দুধের সঙ্গে ঘরে তৈরী ছাতু খাইয়ে দিয়েছে। এড়ে বাছুরগুলি এত বেলা অব্ধি না খেয়ে থাকে! কেন থাকে সে তথ্যাদি আবেদা তাকে বলতে বলতে লিচু বাগান দেখাতে নিয়ে যায়। লিচু গাছগুলি খর্বাকৃতির, হাত বাড়ালে পাতা ছোয়া যায়, ধুলোমাখা পাতাদের মন খারাপ ছুঁয়ে দেখার জন্য আবেদা তাকে কখনো কখনো উঁচু করে ধরে থাকে। তারা খুঁজে খুঁজে নিচু ডালে লাল হয়ে আসা টসটসে লিচুর থোকা খুঁজে বের করে।
আবেদা একটা লিচুর মুখের কাছ থেকে সাবধানে খোসা ছাড়ায়, বোটার কাছে গিয়ে আর এগোয় না। তারপর ঠোঁট চৌকো করে আধেকটা খেয়ে নেয়। আধখাওয়া লিচু গাঢ় খয়েরী আঁটি সমেত ঝুলে থাকে গাছে। দাঁত বের করে হাসে নিধি। আবেদা সে হাসির বার্তা বয়ে নিয়ে ভেতর বাড়িতে পৌঁছে দিতে ছোটে। উঠানের চেয়ারে উপবিষ্ট দাদু বিদ্যুৎ গতিতে সংক্রামিত, আবেদার কৌতুক নৈপুণ্যে নাতনী হেসে ওঠার সংবাদ সমস্বরে প্রসংশা পায়।
উঠানে আবেদা দাদুর পায়ের কাছে বসে গল্প করে যায়। হাসি সংক্রামক, ওর হাসির কাছে দাদুর সবসময়ের গাম্ভীর্য্য টাল খায় বলে মনে হয়।
বাগানের মধ্যে কিষানেরা আবেদাকে থামায়। তার শাড়ি পরা (যতই না নিজেকে গ্রামগন্ধী বলুক, শাড়ি পরার ধরনে আবেদার বদল এসেছে), হাসির সৌন্দর্য তাদের ভালো লাগে নিশ্চয়ই। সৌন্দর্যের বিপুল ইন্ধন আর মাহাত্ম্য বোঝার বয়স নিধির হয়নি। সে বিরক্ত হয়। মজনু আগুনে পুড়ে মরে গিয়ে আবেদা’র সারাক্ষণ কান্নাকাটি করার উচিৎ-সমুচিৎ নিয়ে তার শিশুমন প্রশ্নের উদ্রেক করে। নির্দ্বিধায় সে আবেদার হাসির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে- ‘এত হাসবে না’।
কিষাণদের কেউ হাতের কাজ থামিয়ে নিধিকে ডাকে, কাছাকাছি হলে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে
-আহ হা রে, এতটুক দুধের বাচ্চা একনা, এর কপালত এইরখম আছিল! মা’টা থাকিয়াও নাই!’
কিষানদের মুখগুলি নিধির কাছে একই রকম মনে হয়, ধুলিময়, প্যাচানো দড়ির মত।
তাদের দরদ মাখা কন্ঠস্বরের আওতা থেকে নিধির ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে।
সে আবেদাকে হাত ধরে টানে, সামনে ঠেলে দেয়— ‘ওদেরকে মজনু’র কথা বলো’।
আবেদা কিছু বলে না, তার মুখে আলগা করে আটকে থাকা মুখোশটা কেউ সরিয়ে নিয়েছে বলে মনে হয়। কিষাণেরা নিধিকে লিচুর থোকা উপহার দেয়, লাল খসখসে আর ভেতরে অন্তহীন রস নিয়ে সেগুলো নির্বিকার আবেদার হাতে দুলতে থাকে।
ভোমরা দহ, দাদুবাড়ির গ্রামের নাম— নিধি কতবার মা’র কাছে শুনেছে যে নামটা নাকি তার বুকের ভেতরে একটা অচেনা অনুভূতির জন্ম দেয়।
দহ মানে দীঘির অতল, মা’র নাকি মনে হতো নামটা আসলে দহন, লোকে শেষের ‘ন’ টা বলতে ভালোবাসে না। তারা তীব্র দহনের কথা ভুলে যেতে চেয়ে জলের ঘূর্ণির তলদেশে পৌঁছে যেতে যায়। যে দহনকালের শেষ ছিল না।
গল্পটা মা নির্ঘাত বানিয়ে বানিয়ে বলতো।
নিধি গ্রোসাসে বিশ্বাস করেছে -‘গোটা গ্রামবাসী অলীক এক আগুনে পুড়ে ভোমরা’র মত উড়ে যাচ্ছে। অথবা একটা বিশালাকার কালো ভোমরা রানী মৌমাছির বেশে গ্রামের মধ্যমাঠে শুয়ে ছিল, তার কৃষ্ণবর্ণ শরীর থেকে বিচ্ছুরিত আগুনের ফুলকি ঠিকরে বের হচ্ছিল, বড় মায়াময় আর চৌম্বকীয় সে প্রজ্জলন। গ্রামবাসী নারী পুরুষ ঝাঁপ দেয়ার আগে নিজেদের সুসজ্জিত করে, চর্মচাদরে, বল্কলে, সুবাসিত চন্দনে চর্চিত দেহ নিয়ে তারা কোন অবিমৃষ্য ঘোরের ভেতর থেকে নিজেদেরকে সেনাদলের শৃংখলায় সুসজ্জিত ক’রে আত্মাহুতি দেয়, আর সেই অগ্নিনির্বাপক ঝাঁপের সঙ্গে সঙ্গে মাঠের মধ্যে বিশালাকার দীঘির জন্ম হয়।
-‘তখন থেকে কি এই গ্রামের নাম ভোমরাদহ? কিন্তু দীঘি কই?’
মা নিধির কথার কোন জবাব দেয়নি, মুখ টিপে হেসে উঠে গিয়েছিল চিরুনী এনে তার চুলে কষে একটা ঝুটি বাঁধবে বলে।
মায়ের হাসিটা ছিল চাপা, সমস্ত মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়, রিনরিনে এক প্রকার শব্দ ছড়িয়ে যায়। এখন এখানে, এই ভোমরাদহে এসে নিধি তার মায়ের নাম সর্বত্র শুনতে পায়। বীণা, বীণা, বীণা। কে ডাকে? শ্বশুর বাড়িতে তাকে নাম ধরে কে ডাকবে? নিধির দাদি তার সম্পর্কের বোনের মেয়েকে প্রাণভরে ‘বৌমা’ ডাকার ফুরসত পায়নি।
বড় তাড়াতাড়ি দাদী পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে গেল।
আকুল হয়ে হাত বাড়িয়ে নিধিকে ডেকে ডেকে দাদী অন্যদের শরণাপন্ন হতো- ‘কেউ আমার কাছে বীণার মাইয়াডারে একটু আইনা দেও, আমি অরে একটু আদর করি, চুমা দেই, আহহারে বাচ্চাডা আমার, মা’রে না দেইখা কেমুন শুখায়া গেছে,…’ নিধিকে অস্থির হয়ে ডাকলেও সে দাদীর খাটিয়ার কাছে যায় না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেও তার দাদীর চেহারাটা কঠিন কোন বানানের মত তার সামনে হাজির হয়। অক্ষরগুলি বেজায় অচেনা ঠেকে। নিধি ঘাড় গোজ করে দাঁড়িয়ে থেকে লেপা উঠানের মাটি পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে খুটে তুলতে থাকে।
দাদীকে দেখার অতি শিশুকালীন স্মৃতি তার মনে পড়ে না। শুধু কোমর অব্ধি খাড়া করে উঠে বসতে পারে এমন মানুষ সে আগে দেখেনি। নিধি কাছে ঘেষতে চায় না,তবু কী এক অমোঘ আকর্ষণ তাকে টানে, ধনুকের ছিলার মত কষে কাছে এনে ফট করে দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। দাদির সংক্ষিপ্ত যাতায়াতের (ঘর আর বারান্দা) পরিসর নিধি যত্নে এড়িয়ে যায়।
রোজ সকালে পরিচর্যার পর দাদীকে বারান্দায় এনে একটা দড়ির খাটিয়ায় আধশোয়া করে দেয় মোমেনার মা। সেখান থেকেই যথাসম্ভব সংসারের দেখভাল করে দাদী। দুপুরে খায়, দিবানিদ্রা দেয়।
একদিন যখন দাদী তার খাটিয়ার ওপরে গভীর ঘুমে প্রায় নাক ডাকছে, পরন্ত দুপুরের রোদ লম্বমান হয়ে তার পায়ের পাতা ছুঁয়ে দিচ্ছে, নিধি পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পান আর জর্দ্দার তামাটে প্রাচীন গন্ধে তার ভালরকম দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দৌড়ে বারান্দা থেকে নামতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল। দাদী যদি জেগে ওঠে আর খপ করে তাকে ধরে ফেলে?
আবেদাকে ডাকতে গিয়ে জিভ অসার মনে হয়েছিল, অথচ আবেদাকে তার তখুনি চাই, এত বড় বাড়িতে নিজের বলে আর কাউকেই তার চোখে পড়ে না।
আজমত চাচা তাকে এক সকালে উঠানের কোনে বেড়াল বাচ্চা ধরার মত ধরে ফেলে বলে— ‘দাদি ডাকলে কাছে যাইতে হয়, নাইলে তোমার দাদির সঙ্গে যে জ্বীন থাকে সে তোমারে ধইরা নিয়া দূরে বাংগি ক্ষ্যাতে রাইখা আসবো, একলা একলা ফিরা আসতে পারবা তুমি?’
দাদীর সঙ্গে জ্বীন! সে জন্যেই কি বুড়ি উঠে বসতে পারে না? একটা অবশ ভয় ধরানো জ্বরভাব এসে লহমায় ঘিরে ধরে নিধিকে। সে অবশ্যই আর দাদির কাছে ঘেষবে না। পরক্ষণেই মত পালটায় নিধি। কাছে গেলে যদি জ্বিনটা তার মা’এর খবর এনে দিতে পারে, তাহলে তো কাউকে জিজ্ঞেস না করেই সে মা’কে দেখতে পাবে, তার খবর পাবে। ইচ্ছেটাকে দোনমনার মধ্যে বন্দী রেখে সে আবেদার হাত থেকে ভাত খায়, গোসল করে। আর স্বপ্ন দেখে একদিন দাদীর পোষা জ্বীন তাকে উড়িয়ে মায়ের ভাই মামার বাড়ি রেখে এসেছে।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।