চিনুয়া আচেবে
[প্রথম উপন্যাস লিখে পৃথিবীময় খ্যাতি পাওয়ার ভাগ্য খুব কম লেখকের জোটে। চিনুয়া আচেবে সেই বিরল সম্মানের অধিকারী একজন লেখক। ৬ নভেম্বর, ১৯৩০ সালে নাইজেরিয়ায় তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। চিনুয়া আচেবে আ
ফ্রিকান আধুনিক সাহিত্যের পথিকৃত এবং একাধারে খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, অধ্যাপক এবং সাহিত্য সমালোচক। ১৯৫৮ সালে চিনুয়া তাঁর প্রথম ‘উপন্যাস ‘Things Fall Apart’, প্রকাশ করেন। এই উপন্যাস তাঁকে একজন ক্ষমতাশালী লেখক হিসেবে বিশ্ব জুড়ে পরিচিত করে। শুধু তাই না আফ্রিকার গল্প একজন খোদ আফ্রিকান লেখকের মুখে শুনতে পাওয়ার উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় দেশ-বিদেশের অযুত-নিযুত পাঠক। কেননা এর আগে আফ্রিকান মহাদেশের গল্প মূলত ইউরোপীয়ান লেখকের কলমেই পড়ে অভ্যস্ত ছিল পাঠক সমাজ। পঞ্চাশের দশকে সে চিত্রটা পালটাতে শুরু করে। আফ্রিকান দেশগুলো তখন স্বাধীনতা লাভ করা শুরু করে। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর লেখকেরাও নিজেদের সাহিত্য সম্ভার আলোতে আনতে শুরু করেন। পৃথিবী পরিচিত হতে থাকে অন্ধকার মহাদেশ হিসেবে খ্যাত মহাদেশের দ্যুতিময় লেখকদের সাথে। এরপর ১৯৫৮ সালে চিনুয়া আচেবের ‘থিংস ফল এ্যাপার্ট’ যেন পুরো পৃথিবীর পাঠক সমাজকে চমকে দেয়। বোদ্ধামহলে আলোড়ন ওঠে। এটা বিশ্ব সাহিত্যের জন্য শুধু এক সোনালী অতীতই নয় একই সঙ্গে পৃথিবীর সামনে এক মহান লেখকের আত্মপ্রকাশের ইতিহাসও বটে। এই বহুচর্চিত বইটা ২০০৭ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এটা ৫০টির বেশি বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। প্রায় এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী লেখক ১৯৯০ সালে এক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হন এবং তারপর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্হায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এরপর একটা দীর্ঘ সময় কোনো বই প্রকাশ থেকে তিনি বিরত থাকেন। দীর্ঘ সময় তাঁর কোনো বই প্রকাশিত না হলেও তিনি যে সাহিত্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না তার প্রমাণ পরবর্তীতে প্রকাশিত তাঁর ২০টির মতো বই। দীর্ঘ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তাঁর আরেকটি বিশ্বখ্যাত উপন্যাস হলো ‘অ্যান্টহিলস অফ দি সাভানা’। বহু লেখকের প্রেরণার উৎস এই মহান লেখক ২০১৩ সালের ২১ মার্চ চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমান। গল্পকার ও অনুবাদক নাহার তৃণা Marriage Is a Private Affair এই মূল গল্পটির ভাষান্তর করেছেন।]
লাগোসের ১৬ নম্বর কাসাঙ্গা স্ট্রিটে এক বিকেলে নিজের ঘরে বসে নেনে জিজ্ঞেস করলো এনেমেকা কে, “তোমার বাবাকে এখনও লিখোনি?”
“না, লেখা হয়নি। বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবছি। আমার মনে হয় ছুটিতে যখন বাড়ি যাবো, বাবাকে তখন জানানোই ভালো হবে।”
“আজব! এখনও জানাওনি কেন? তোমার ছুটি এখনও অনেক দেরি। পুরো ছয় সপ্তাহ বাকি। আনন্দের খবরটা তাঁকে অবিলম্বে জানানো উচিত।”
এনেমেকা কিছুক্ষণ নীরব থাকে, তারপর ধীরে ধীরে খানিকটা যেন তার ইচ্ছের বিরদ্ধে বলা শুরু করলো, “আমাদের এই আনন্দময় বিষয়টা বাবার জন্যেও কতটা আনন্দময় সে বিষয়ে আমি আসলে নিশ্চিত হতে চেয়েছি।”
“অবশ্যই এটা তাঁর জন্য আনন্দময় একটা খবর।” নেনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো। “ হবে নাই বা কেন বলো তো?”
“তুমি সারা জীবন লাগোসে বাস করেছো, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকদের মনমানসিকতা সম্পর্কে খুবই কম জানো।”
“একথা তুমি সব সময়ই বলো। তবে আমি মোটেও বিশ্বাস করিনা কেউ এতটাই অন্যরকম হবে যে তার ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে শুনলে খুশি হয় না।”
“হয় বৈকি। যদি বাগদানের ব্যাপারটা তাদের নিজের পছন্দ সই না হয় তবে তারা সবচে’ বেশি অসন্তুষ্ট হয়। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো জটিল। কারণ তুমি তো এমনকি ইবোও নও।”
কথাগুলো এনেমেকা এত চাঁচাছোলা আর গভীরভাবে বলে যে নেনে তৎক্ষণাৎ কোনো কথা খুঁজে পায় না। আধুনিক কসমোপলিটন শহরের এই পরিবেশে বসেও যখন কেউ জীবনসঙ্গী বেছে নেবার ক্ষেত্রে কে কোন গোত্র থেকে এসেছে সেই প্রশ্নটা বিশেষ গুরুত্ব পায়, তখন ব্যাপারটা নেনের কাছে চূড়ান্ত রসিকতা বলে মনে হয়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নেনে বলে, “তুমি নিশ্চয়ই একথা বলতে চাইছো না যে আমি ইবো নই, শুধুমাত্র এই ছুতোয় তোমার বাবা আমাদের বিয়েতে আপত্তি করবেন? আমি সব সময় ভেবে এসেছি, তোমরা ইবো সম্প্রদায়ের মানুষেরা অন্য সম্প্রদায়দের যথেষ্ট সমীহের চোখেই দেখো।”
“হ্যাঁ সেভাবে দেখা হয় বটে। কিন্তু বিষয়টা যখন বিয়েতে গড়ায় তখন হিসেবটা আর অতটা সরল থাকে না।” এনেমেকা আরো যোগ করে – “এবং এমনটাই হতো যদি তোমার বাবা আজ ইবো-দেশের প্রাণকেন্দ্রে বেঁচে থাকতেন তবে তিনিও ঠিক আমার বাবার মতোই আচরণ করতেন।”
“আমি জানি না বাবা থাকলে কী করতেন। যাইহোক, তুমি তোমার বাবার প্রিয় বাবুসোনা, আমি নিশ্চিত তিনি তোমার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাগ পুষে রাখবেন না। ক্ষমা করে দেবেন। তাই, বলছি শোনো, লক্ষ্মী ছেলের মতো বাবাকে আমাদের কথা জানিয়ে সুন্দর করে একটা চিঠি লিখো।”
“চিঠির মাধ্যমে বাবাকে খবরটা দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। চিঠিটা তাঁর জন্য বড়সড় ধাক্কার কারণ হতে পারে। এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট নিশ্চিত।”
“ঠিক আছে, জান, শান্ত হও। আমারচে’ তুমি তোমার বাবাকে ঢের বেশি চেনো।”
সেদিন সন্ধ্যায় নেনের ওখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে এনেমেকা তার বিয়ে বিষয়ে বাবা কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন তা নিয়ে ভাবলো। বিশেষ করে এখন যেহেতু সে তার নিজের পছন্দের মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছে তখন বাবার বিরোধিতা সোনামুখে মেনে নেওয়া তার জন্য কঠিন।
এনেমেকা একবার ভেবেছিল পকেটে থাকা বাবার চিঠিটা সে নেনে কে দেখাবে। পরে সিদ্ধান্ত পালটে ফেলে। বাড়ি ফিরে সে চিঠিটা আরো একবার পড়ে এবং কিছুতেই হাসি সামলাতে পারে না। উগোয়ের নামের অ্যামাজন থেকে আসা মেয়েটার কথা তার ভালোই মনে আছে, যে ক্লাসের ছেলেগুলোকে বেধড়ক পিটানি দিতো, এনেমেকা নিজেও সে পিটানির ভাগ পেয়েছে, কী নিরেট বোকাটাই না ছিল সে স্কুলে থাকতে। বাবা চিঠিতে লিখেছেন-
এমন একটা মেয়ের সন্ধান পেয়েছি যার সাথে তোমাকে খুব মানাবে। আমাদের প্রতিবেশি জ্যাকব নিউকে’র বড় মেয়ে উগোয় নিউকে। মেয়েটা খুব লক্ষী। ধর্মকর্মে ভীষণ মতি। এই বিষয়ে তার বিশেষ শিক্ষাদীক্ষা আছে। কয়েক বছর আগে যখন সে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে তখন তার বাবা, বিচক্ষণ হিসেবে যাঁর বেশ নামডাক আছে, তিনি মেয়েকে ধর্ম শিক্ষার জন্য এক পুরুহিতের কাছে পাঠান। সেখানে সে ধর্মের পাশাপাশি একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যা যা প্রয়োজন যাবতীয় প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। রবিবারের স্কুল শিক্ষকও আমাকে জানিয়েছেন, সে খুব সাবলীলভাবে বাইবেল পড়তে পারে। আমি আশা করছি আগামি ডিসেম্বরে যখন তুমি বাড়ি আসবে তখন আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো।
লাগোস থেকে ফিরে আসার দ্বিতীয় সন্ধ্যায়, এনেমেকা গ্রামের বাড়িতে বাবার সাথে ক্যাসিয়া গাছের তলায় বসেছিল। এটা সেই জায়গা যেখানে বুড়ো মানুষটা নির্জনে বাইবেল পাঠ করতে পছন্দ করেন। রৌদ্রদগ্ধ ডিসেম্বরের সূর্য যখন অস্ত যায় এবং ঝিরঝির বাতাসের আদরে সবুজ পাতারা আরো সজীব হয়ে উঠে এনেমেকার বাবা সেই সময়টা একান্তে উপভোগ করেন। “বাবা,” হুট করে এনেমেকা বলা শুরু করে, “আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”
“ক্ষমা? কিসের জন্য ক্ষমা খোকা?” বৃদ্ধ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন।
“ক্ষমা, বিয়ের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে, বাবা।”
“কোন বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়?”
“ ইয়ে, মানে, আমি পারবো না- আমরা অবশ্যই – মানে… নিউকের মেয়েকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব বাবা।”
“অসম্ভব? কেন?” এনেমেকার বাবা প্রশ্ন করলেন।
“আমি ওই মেয়েকে ভালোবাসি না।”
“কেউ বলেনি তুমি তাকে ভালোবাসা। তুমি সেটা কেন করবে?” উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বাবা।
“আজকালকার বিয়েশাদি অন্যরকম…”
“দেখো বাপধন,” ছেলেকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন বাবা, “ কিছুই আলাদা নয়। স্ত্রী হিসেবে একজন নারীর ভেতর যা দেখা দরকার তা হলো উত্তম চরিত্র আর যথার্থ ধর্মীয় পরিবেশে সে বেড়ে উঠেছে কিনা সেটা।”
এনেমেকা বুঝে গেল বর্তমান তর্কে তার তেমন সুবিধা হবার নয়।
“তাছাড়া” সে মরিয়া হয়ে বলতে চাইলো, “আমি অন্য এক মেয়ের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কথা দিয়েছি তাকেই বিয়ে করবো। যার মধ্যে উগোয়ের সব ভালো গুণাগুণ গুলো রয়েছে এবং যে…”
এনেমেকার বাবা নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পরছিলেন না। “কী..কী বললে তুমি?” জলদগম্ভীর কণ্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করলেন।
“সেও ভীষণ ধার্মিক,” এনেমেকা বলে চললো, “লাগোসে মেয়েদের একটা স্কুলে পড়ায়।”
“সব্বোনাশ! শিক্ষক, তাই বললে কি? তোমার যদি মনে হয় ভালো স্ত্রী হওয়ার জন্য ওটা দারুণ একটা যোগ্যতা, তাহলে আমাকে বলতেই হয় , কোনো খ্রিস্টান নারীর শিক্ষক হওয়া উচিত নয়। সেন্ট পল তাঁর এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, “নারীদের অযথা না বকে চুপ থাকা উচিত।”
তিনি তাঁর আসন ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠলেন এবং অস্হিরভাবে আগু-পিছু পায়চারি শুরু করলেন। চিন্তাগ্রস্ত হলে এভাবে পায়চারি করাটা তাঁর অভ্যেস। সে অবস্হাতেই তিনি গির্জার সেইসব পুরোহিতদের
একচোট গালাগালি বর্ষণ করলেন যারা নারীশিক্ষা এবং স্কুলে মহিলাদের পড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহ দান করে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে, নিজের ক্ষোভ উপুড় করে অবশেষে তিনি ছেলের বাগদান নিয়ে নিরুত্তাপ গলায় আলাপ শুরু করেন।
“যাইহোক, মেয়ের বাবা কী করেন? নাম কী তার?”
“ ওর নাম নেনে আতং।”
“কি!” মুহূর্তের মধ্যে তার গলায় উত্তেজনা ভর করলো। নামটা তুমি নেনেআতাং বলেছো, তার মানে কী?”
“কালাবারের নেনে আতং। সেই একমাত্র মেয়ে, যাকে আমি আমার জীবনসঙ্গী করতে পারি।” এনেমেকার এমন সোজাসাপ্টা উত্তরে ভেবেছিল এই বুঝি বাবার ক্রোধের ঝড় আছড়ে পড়লো। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটলো না। একটাও শব্দ খরচ না করে তিনি কেবল সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ব্যাপারটা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে এনেমেকা হতবাক হয়ে গেল।
কারণ বাবার এভাবে চুপ মেরে যাওয়াটা রাগারাগির বন্যা বইয়ে দেওয়ার তুলনায় বহুগুণ ভয়ের ব্যাপার।
সে রাতে তিনি কিছু খেলেনও না।
একদিন পর তিনি যখন এনেমেকাকে ডাকলেন তখন তিনি তাঁর সাধ্যমত সব উপায়ই প্রয়োগ করেছিলেন যাতে ছেলেকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায়। কিন্তু এনেমেকাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়ানো গেল না। অগত্যা তিনি হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন।
“বাবারে, তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব ছিল কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেটা যথাযথভাবে বোঝানো।
আমি তাতে ব্যর্থ! যেই তোমার মাথায় এই বুদ্ধি ঢুকিয়ে থাকুক না কেন সে আসলে তোমার নিজস্বতাকে খুন করেছে। আর এখন তুমি যে ব্যবহার করছো সেটা হচ্ছে শয়তানের কাজ।” অভিমানে এনেমেকার বৃদ্ধ বাবা তাকে দূরে ঠেলে দিলেন।
“আপনি যেদিন নেনে কে ঠিকভাবে চিনতে পারবেন, সেদিন আপনার মতামত বদলে যাবে বাবা।”
“তার সাথে আমার কখনো দেখা হবে না। তিনি জবাব দিলেন। সেই রাতের পর থেকে বাবা এনেমেকারের সঙ্গে কথা বলা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিলেন। তবে মনে মনে তিনি এটাও আশা করতে ভুললেন না, তার ছেলে সামনে কী বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তা যেন উপলদ্ধিতে সক্ষম হয়। দিন রাত তিনি ছেলের সুমতির জন্য প্রার্থনা করতেন।
বাবার গভীর দুঃখবোধ এনেমেকাকে ভীষণভাবে পীড়িত করে। তারপরও এই দুঃসহ সময় কেটে যাবে এমনটাও সে গভীরভাবে আশা করতে ছাড়লো না। তার মনে হতো যদি তার গোত্রের ইতিহাসে ভিন্ন ভাষাবাসী মেয়েকে বিয়ে করার কোনো নজির না থাকতো, তাহলে সে হয়তো কম আশাবাদী হতো।
এর কয়েক সপ্তাহ পরে তাদের গ্রামের এক বৃদ্ধ এনেমেকার বিষয়ে খুব সংক্ষেপে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন, ‘এমন ব্যাপার আগে কখনো শোনা যায়নি।’ ছোট্ট এই বাক্য দিয়ে তিনি উপস্থিত লোকদের বোঝাতে চাইলেন যে এমন অদ্ভুত ঘটনা কখনো দেখেন নি। বৃদ্ধমানুষটি অন্যদের সাথে ওকেকের বাড়িতে এসেছিলেন সন্তানের দুষ্কর্মের ব্যাপারে তাকে সান্ত্বনা দিতে। ততদিনে এনেমেকা লাগোসে ফিরে গেছে।
“এমনটা কখনো শোনা যায়নি।” বৃদ্ধ বিষণ্ন ভাবে মাথা নেড়ে কথাটার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
“এ ব্যাপারে আমাদের ঈশ্বর কী বলেছেন?” সান্ত্বনা দিতে আসা আরেকজন জিজ্ঞেস করলেন। “সন্তানেরা জন্মদাতাদের বিপক্ষে দাঁড়াবে।” পবিত্র পুস্তকে একথা লেখা আছে।
“এসব আসলে ধ্বংসের নমুনা।” অন্য আরেকজন ফোঁড়ন কাটলেন।
এভাবে আলোচনা ক্রমশ ধর্মতাত্ত্বিক দিকে ঝুঁকে পড়ছিল, মাদুবোগু, উপস্হিতদের মধ্যে সবচে’ বিচক্ষণ একজন মানুষ, আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে সেটাকে সাধারণ পর্যায়ে আনতে তাঁর বেগ পেতে হলো না।
“ছেলের চিকিৎসার বিষয়ে আপনি কী স্হানীয় কোনো কবিরাজের সাথে পরামর্শের কথা ভেবে দেখেছেন?” এনেমেকারের বাবাকে তিনি প্রশ্ন করলেন।
“সে তো অসুস্হ নয়।” এনেমেকারের বাবা উত্তর দেন।
“তাহলে তার কী হয়েছে?” এই বয়সের ছেলেপেলের মন নানাভাবে আক্রান্ত হয়, একজন ভেষজ বিশেষজ্ঞই তাকে তার সঠিক অবস্হায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে তার জন্য যা দরকার ছিল সেটা হচ্ছে এমেলিলে নামের ওষুধ যা মহিলারা প্রয়োগ করেন তাদের স্বামীদের ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার জন্য ।”
“মাদুবোগু একদম ঠিক বলেছেন।” অন্য আরেকজন বলে ওঠেন। “ওর জন্য এরকম ওষুধের দরকার।”
“আমি কোনো কবিরাজকেই ডাকতে যাবো না।” এই ক্ষেত্রে এনেমেকারের বাবা তাঁর কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রতিবেশিদের তুলনায় ভালোই একরোখা ছিলেন। “আমি আরেকজন মিসেস ওচুবা হতে চাই না। আমার ছেলে যদি নিজেকে নিজে খুন করতে চায় তা সে করুক। আমি তাকে সে কাজে সাহায্য করতে যাবো না।।
“ওচুবার ঘটনার জন্য কিন্তু মহিলা নিজেই দায়ী ছিলেন।” মাদুবোগু বললেন। “ তার উচিত ছিল একজন
সৎ ভেষজ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া। সেটা তিনি করেননি। তবে মহিলা কিন্তু যথেষ্ট চালাক চতুর ছিলেন।”
“সে ছিল একটা ডাইনি, খুনী”, শান্তভাবে বললেন জোনাথন, যিনি সচরাচর প্রতিবেশিদের সাথে কোনো তর্কে লিপ্ত হওয়ার আগ্রহ দেখান না। কারণ তার ধারণা যুক্তিতর্কে তারা মোটেও উপযুক্ত না। “ওষুধটা তার স্বামীর জন্য তৈরী করা হয়েছিল, আর আমি নিশ্চিত ঠিকভাবে যদি মহিলা সেটা তার স্বামীকে দিতো তবে তার উপকারই হতো। কিন্তু খুনী মহিলা তা না করে উল্টো ভেষজ চিকিৎসকের খাবারে মিশিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিল ওষুধটা কেমন কাজে দেয়, মহা শয়তান না হলে কেউ এমনটা করে!”
ছয়মাস পর, এনেমেকা তার স্ত্রী নেনে কে বাবার পাঠানো ছোট্ট চিঠিখানা দেখিয়েছিল। যেখানে তিনি লিখেছিলেন:
তোমার বিয়ের ছবি পাঠানোর মতো এতটা নির্দয় তুমি কীভাবে হতে পারলে সেটা ভেবে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। ছবিটা তোমাকে ফেরত পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আবার ভাবলাম তোমার স্ত্রীর ছবিটা কেটে ফেরত পাঠাই। কারণ তার সাথে আমার কিছু নেই। তোমার সাথেও আমার আর কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা ভাবছি।
নেনে চিঠি পড়তে পড়তে যখন ছেঁড়াখোড়া ছবিগুলো দেখলো তখন তার দুচোখ জলে ভরে ওঠলো, সে ফোঁপাতে শুরু করলো।
“কেঁদো না ময়না,” গাঢ় মমতায় এনেমেকা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। বাবা কিন্তু আদতে অতটা রূঢ় স্বভাবের নন, তাঁর মনটা ভালো, দেখো একদিন তিনি ঠিকই আমাদের বিয়েকে সাদরেই মেনে নেবেন।”
কিন্তু বছর গড়িয়ে গেলেও সেই একদিন আর আসেনি।
আট বছর ধরে ওকেকের সাথে ছেলে এনেমেকার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই ঘটনার পর সাকুল্যে তিনবার(যখন এনেমেকা বাড়ি এসে ছুটি কাটাতে পারবে কিনা জানতে চেয়েছিল) তিনি ছেলেকে লিখেছিলেন।
তার একটি জবাবে তিনি লিখেছিলেন-
“আমার বাড়িতে তোমার উপস্হিতি কাম্য নয়। তুমি তোমার ছুটি কিংবা জীবন কোথায় এবং কীভাবে কাটাবে সে নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।”
এনেমেকার বিয়ে নিয়ে একদেশদর্শিতা শুধুমাত্র তার ছোট্ট গ্রামের বৃত্তেই আটকে ছিল না। লাগোসের কিছু মানুষ, বিশেষ করে তার পরিচিত গণ্ডীর যারা কর্মসূত্রে লাগোসে ছিলেন তারাও এই বিয়ে নিয়ে বিরুদ্ধ মনোভাব দেখাতে কসুর করেনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হলে তাদের অনেকের স্ত্রী নেনের সাথে অভব্য আচরণ করতেন। তারা আচার-ব্যবহারে এটাও বুঝাতে চাইতেন যে নেনে তাদের দলের কেউ না।
কিন্তু দিন গড়ানোর সাথে সাথে একসময় নেনে তাদের পূর্বধারণায় চিড় ধরাতে সমর্থ্য হয় এমন কি তাদের কারো কারো সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে। আস্তে আস্তে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে এবং ওইসব মহিলারাই স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তাদের অনেকের চেয়ে নেনে গৃহকর্মে সুনিপুণা, সে তার ঘরদোরও যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন রাখে।
ওদের সুখীগৃহকোণের গল্প অবশেষে ইবো দেশের প্রাণকেন্দ্র ছোট্ট গ্রামটাতেও পৌঁছে যায়, যে এনেমেকা এবং নেনে সবচে’ সুখী দম্পতি। কিন্তু এনেমেকার বাবা ছিলেন তাদেরই একজন যারা এ বিষয়ে বিন্দু বিসর্গও জানতেন না। যে কোনো আলোচনায় যখনই ছেলের বিষয় উত্থাপিত হতো তিনি ভয়ানক ক্ষেপে যেতেন, যে কারণে প্রায় প্রত্যেকে তাঁর উপস্হিতি এড়িয়ে চলতো। ছেলেকে বিস্মৃতির চাদরে ঢেকে দেবার প্রচণ্ড চেষ্টায় তিনি সফল হয়েছিলেন। যদিও ছেলের অবাধ্যতার ধকলে তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন, কিন্তু ছেলের স্মৃতি ঠেলে পেছনে সরানোর অধ্যাবসায়ে শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী হন।
তারপর একদিন তিনি নেনের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। প্রথমে চিঠিটার দিকে তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকালেও পড়তে পড়তে তাঁর মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হতে থাকে এবং তিনি গভীর মনোযোগের সাথে চিঠিটা পড়তে থাকেন।
… আমাদের দুই ছেলে যেদিন থেকে জানতে পেরেছে তাদের একজন দাদাজান আছেন, তখন থেকেই তারা দাদাজানের কাছে যাওয়ার আবদার শুরু করেছে। আপনি যে তাদের চোখের দেখাটা দেখতেও ইচ্ছুক নন সে কথা বাচ্চাদের খোলাখুলি বলাটা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই, সামনের মাসে ছুটির দিনে এনেমেকাকে ছেলে দুটিকে নিয়ে খুব অল্প সময়ের জন্য গ্রামে বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিনীত অনুরোধ করছি । আমি সাথে যাবো না, লাগোসেই থেকে যাবো।
চিঠিটা পড়বার পর বৃদ্ধ মানুষটির মনে হলো তাঁর এতকাল ধরে টিকিয়ে রাখা কঠোর সংকল্পে যেন চিড় ধরতে শুরু করেছে। তবু তিনি নিজেকে মনে মনে বললেন, এসব আবেগ অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। আবেগ অনুভূতির বিরুদ্ধে মনকে শক্ত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। তিনি ঝুঁকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। পুরো আকাশ গাঢ়কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, এবং প্রচণ্ড বাতাস বইতে শুরু করলো, ধুলো আর শুকনো পাতার ওড়াউড়িতে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। এ যেন সেরকম মুহুর্ত যখন মানবিক আবেগের সাথে প্রকৃতিও যুক্ত হয়ে যায়। খুব শিগগিরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো, বছরের প্রথম বৃষ্টি। সূচালো বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি মাটির বুকে নেমে আসতে থাকলো। সেই সাথে প্রচণ্ড বজ্রপাত ও বিদ্যুত চমক, ঋতু পরিবর্তনের লক্ষণ। ওকেকে নিজের সাথে যুঝে যাচ্ছিলেন যেন কোনোভাবেই নাতিদের চিন্তা তার মনে না আসে। শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি হেরে যাচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছিলেন। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে তিনি মনে মনে প্রিয় একটি স্তোত্র আওড়াতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বৃষ্টিপাতের শব্দে তাতেও বিঘ্ন ঘটে। তাঁর মন বার বার অদেখা শিশু দুটির দিকেই ধাবিত হয়। উত্তরাধিকাদের মুখের উপর কীভাবে তিনি দরজা বন্ধ করে দেন? তিনি যেন দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন তাঁর নাতি দুটি এমন ভীষণ বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পরিত্যক্তের মতো তাঁর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
আত্মঅনুশোচনায় সে রাতে তাঁর ঘুম হলো না। কেবলি মনে হতে থাকলো নাতি দুটোকে না দেখেই হয়ত তাঁর মৃত্যু ঘটবে।
—
নাহার তৃণা
জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।