ঘড়ির কাঁটার লম্বা হাত
ঘড়ির কাঁটার সঙ্গ ধরে শুরু হল আমার মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন। মিলিটারি জীবন। মিনিট আর ঘণ্টার কাঁটায় আমার দিনরাত আটকে গেল। টিক টিক! টিক টিক! সকাল-বিকাল ঘড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে লেফট রাইট করছি। ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম-ঘড়ি কানের কাছে বিটকেল শব্দে বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল। কর্তা উঠে শোবার ঘরের পর্দা সরিয়ে দিল। ঘুম জড়ানো চোখে বললাম–এই ভোর-রাতে পর্দা সরাচ্ছ কেন?
–রাত কোথায়? এখন তো ভোর পাঁচটা! পিটিতে যাব।
আমি পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঠিক পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ক্লিন শেভড, সাদা হাফ-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পরে কর্তা বেরিয়ে যাচ্ছে পিটি করতে। ছয়টার মধ্যে ইউনিট পিটি গ্রাউন্ডে হাজির থাকতেই হবে। দু-এক মিনিট এদিক-সেদিক হলে চলে না। ঘুম চোখে আমাকেই বিছানা থেকে উঠে টলতে টলতে দরজা আটকাতে হল। এই সাত-সকালে কাকে আর ঘুম থেকে ডেকে তুলি!
চারপাশে সরবে ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে চলেছে। বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে সবার শেষে আমি বিছানা ছাড়তাম। কোনোদিন সকালে ক্লাস থাকলে আটটা, সাড়ে-আটটায় খুব কষ্টে ঘুম থেকে উঠে দৌড়াতে দৌড়াতে নয়টার সাইকোলজি সাবসিডিয়ারি ক্লাসে ঢুকতাম। তাড়াহুড়া করতে দেখে মা বলতেন– ‘একটু আগে উঠলেই তো পারিস! সকালে নাস্তাটাও ঠিক মতো করিস না৷’ যেদিন দশটা-এগারোটায় ক্লাস থাকত সেদিনও আধ-ঘণ্টা আগেই বিছানা ছাড়তাম। শাড়ি পরে ব্যাগ ঝুলিয়ে মায়ের হাতে চায়ের কাপে দু-চুমুক দিয়ে আমার দিন শুরু হতো।
যাই হোক সে সব অতীত দিনের কথা। বিস্মৃত অধ্যায়!
বিবাহোপলক্ষ্যে কর্তার সাতদিনের ছুটি শেষ। রাত পোহালেই অফিস শুরু হবে। আগেরদিন সন্ধ্যায় কর্তার ব্যাটম্যান এসে রিপোর্ট করল। এই ব্যাটম্যান কমিকস সিরিজের সুপার হিরো নয়। এ হচ্ছে ডিফেন্স অফিসারের সাহায্যকারী ব্যাটম্যান। পনেরো-ষোলো বছরের সদ্য নরম গোঁফ ওঠা কিশোর দেলোয়ার। বাড়ি নোয়াখালী। অফিসার্স মেসে স্যারের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ছয় মাস। স্যারের ছুটির সুবাদে সে-ও ছুটি পেয়েছিল। দেশের বাড়িতে এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে এসেছে। দেলোয়ারের সঙ্গে অল্প-স্বল্প বাক্যালাপেই বুঝে গেলাম সে ছিল স্যারের গার্জিয়ান প্লাস কেয়ারটেকার প্লাস গাইড প্লাস ওয়েলউইশার… যাবতীয়! স্যারের জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই তার তত্ত্বাবধানে হয়ে আসছিল এ যাবৎকাল। স্যারকে সে চেনে ছয় মাস আর আমি মাত্র সাতদিন!
সন্ধ্যা থেকেই দেখি কর্তা আর ব্যাটম্যান অফিসের জামা-কাপড়, জুতা-মোজা নিয়ে মহা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আপাতত বাড়ির গেস্টরুম কর্তার ড্রেসিংরুম হয়ে উঠেছে। গেস্টরুমের আলমিরা, বিছানা জুড়ে সাত-আট সেট কাপড় সাজানো৷ মেঝে দখল করে আছে নানা পদের জুতা, বুট, অক্সফোর্ড স্যু ও স্যান্ডেল। অবাক হলাম, ব্যাটম্যান এক সপ্তাহের জামাকাপড় আগে থেকেই বের করে বিছানায় সাজিয়ে রেখেছে! শুধু তাই নয় ধোপদুরস্ত গুছানো শার্ট প্যান্টগুলোকে আরেক দফা ইস্তিরি করে নিপাট করা হল। সকাল হতেই বুঝতে পারলাম, গত সন্ধ্যায় মস্ত ভুল করেছি , এই জামাকাপড় সাজানো এক সপ্তাহের নয়। একদিনের। এসমস্ত জামা-কাপড় সারাদিন ধরে একের পর এক পরা হবে! পিটির জন্য সাদা হাফ-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার। মেঝেতে বরাবর রাখা আছে সাদা পিটি স্যু আর সাদা মোজা। পিটি স্যু চক ব্ল্যাঙ্কো হোয়াইট দিয়ে সাদা ধবধবে করা হয়েছে। এরপর পাশে সযত্নে হ্যাঙারে ঝুলছে কমব্যাট ইউনিফর্ম। আলমিরাতে খাকি ইউনিফর্ম আর সেরিমনিয়াল ড্রেস! কর্তা সদ্য পদবি পেয়ে মেজর হয়েছেন! এ মেজর মাইনর থেকে মেজর হওয়া নয়, ক্যাপ্টেন থেকে মেজর! আর আমিও অবশ্য এসব বুঝতে বুঝতে মাইনর থেকে মেজরের দিকে আগাচ্ছি! ইউনিফর্মের দু-কাঁধের উপর চকচক করছে দুটি পিতলের ছোট্ট শাপলা! পিতল পালিশ দিয়ে এই শাপলা দুটাকে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পালিশ করেছে ব্যাটম্যান। তারপর পাতলা সাদা মলমলের কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হল যাতে সকালবেলা এর ঔজ্জ্বল্য একফোঁটাও কম না হয়! কমব্যাট বরাবর রেখেছে ঝকঝকে কালোবুট। সেই বুটও সন্ধ্যায় কালি, ব্রাশ আর তুলা দিয়ে ঘষে ঘষে অনেকটা সময় নিয়ে চকচকে ওয়াটার পালিশ করা হল। তার পাশে ঘরে পরার পাজামা-পাঞ্জাবি, মেঝেতে একজোড়া স্যান্ডেল। এরপর বিকেলের গেমস-এর পোশাক। সাদা হাফ-শার্ট ও সাদা শর্টস। মেঝেতে কেডস আর সাদা মোজা। আরও কয়েক জোড়া জুতা পালিশ করে ঘরের একপাশে রাখা আছে। পরে ওদের পরিচয় পেলাম। যেমন বুট এফটি অর্থাৎ ফিল্ড ট্রেনিং বুট। অক্সফোর্ড স্যু। বিলাত থেকে আসেনি, বাংলাদেশের তৈরি। পরা হয় ফর্মাল পোশাকের সঙ্গে। এসব বিষয়ে ধীরে ধীরে আমার জ্ঞানের পরিধি ক্রমশ বাড়তে লাগল।
ঘর্মাক্ত দেহে চল্লিশ মিনিট পিটি সেরে কর্তা ফিরল। স্নান ও নাস্তা সেরে এবার ইউনিফর্ম পরার পালা। শীত গ্রীষ্ম বারোমাস মোটা উলের মোজা পরতে হয়। নইলে বুটের ঘষায় পায়ের চামড়ার এমন অবস্থা হবে, যে পা আর জুতা পরার লায়েক থাকবে না! দেখলাম বুট পরা অত সহজ কর্ম নয়! জুতা পায়ে গলালাম আর ফটাফট চললাম, সে হবার নয়। এই বুটে, নয় দুগুণে আঠারোটি ফুটা রয়েছে। প্রতিটি ফুটায় একবার এদিক আরেকবার সেদিক করে কালো মোটা স্যু লেস ঢুকিয়ে নীচে থেকে উপরে টেনে টেনে পরা হল তারপর ঘুরিয়ে শক্ত করে একটা গিঁট। সে গিঁট হতে হবে বাহিরমুখো। কারণ ভিতরমু্খো হলে চলার সময় ঘষা লেগে ফিতা খুলে যেতে পারে। সময়সাপেক্ষ কাজ!
এ যে-সে বুট নয়, মিলিটারি বুট বলে কথা! দেহে পা থাকুক বা না থাকুক বুট জোড়া কোনো অবস্থায় বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না! সেই বুটের তলায় আবার বুট নেইল লাগানো থাকে আর বুটের গোড়ালিতে থাকে লোহার হর্স-স্যু। বুটের তলার এত সাজসজ্জার কারণ হাঁটার সময় মিলিটারিকে ভারী শব্দ তুলে হাঁটতে হবে। টগবগ টগবগ। এরপর কোমরে বেল্ট পরার পালা। ব্রেকফাস্টের ডিম রুটি মাখন, কলাকে পেটে যতখানি পারা যায় এঁটেসেঁটে বুক টান করে বেল্ট পরা হল। ব্যাটম্যান সামনে পিছনে দাঁড়িয়ে পোশাক পরতে কর্তাকে সাহায্য করছে৷ আমার চেনা ছোটোখাটো মানুষটি পোশাকের ভিতর ঢুকে ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল। সবশেষে টুপি পরতে আয়নার প্রয়োজন হল। কর্তা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টুপি ঠিকঠাক করে নিল। এবার আর ভদ্রলোককে চেনা যায় না। পুরো চেহারাটাই পালটে গেল। দেখলাম চোয়াল কিছুটা যেন শক্ত হয়ে গেল! বললাম, টুপি পরলে এমন গম্ভীর হয়ে যেতে হয়, জানতাম না তো!
– কই নাতো। বলে হাসল।
হাসিটাও কেমন নোনতা নোনতা!
এই অফিস যাত্রাযজ্ঞে আমার কোনো ভূমিকাই ছিল না। আমড়া গাছের ঢেঁকির মতো পুরোটাই দেখে গেলাম। দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি। ভাবছি, এই যদি অফিস যাবার সাজ হয় তাহলে যুদ্ধে যাবার সাজ কেমন হতে পারে! সবে তো বুট পালিশ, পিতল পালিশ আর ওয়াটার পালিশ দেখলাম! আরও কত যে পালিশ দেখতে হবে কে জানে!
সাড়ে সাতটা থেকে দুটা পর্যন্ত অফিস। সবই চলছে ঘড়ির কাঁটা ধরে! দুপুর দুটার পর থেকে লক্ষ করলাম দেলোয়ার দরজার কাছে পায়চারি করছে। বুঝে গেলাম কর্তার আসার সময় হয়ে গিয়েছে। সকাল থেকে ভালোবাসা প্রকাশের কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কর্তার জন্য একটি নীল পাঞ্জাবি বের করে দেলোয়ারকে দিয়ে বললাম, এটা তোমার স্যারের কাপড়ের সঙ্গে রেখে দাও, দুপুরে অফিস থেকে এসে পরবে।
দেলোয়ার আমার হাতে নীল পাঞ্জাবি দেখে দু-পা পিছিয়ে গেল।
– না না ম্যাডাম এই নীল রঙের পাঞ্জাবি স্যার কখনো পরবে না। আমি স্যারের জন্য বাদামি রঙের পাঞ্জাবি বের করে রেখে দিয়েছি।
মন খারাপ হয়ে গেল। আহা বিয়ের কেনাকাটা করার সময় কত শখ করেই না এই পাঞ্জাবিটা কিনেছিলাম! কে জানত ওর নীল রং পছন্দ নয়।
টেবিলে খাবার সাজানো হয়েছে। দেলোয়ার একবার এসে দেখে গেল সব ঠিক আছে কিনা! বুয়াকে বলল, স্যারের জন্য সালাদ কুচি করে কাটবেন না। শসা, টমেটো গোল গোল করে কেটে দিবেন। আর গোটা গোটা কাঁচা মরিচ দেবেন। আমায় বলল, স্যারের রুইমাছ পছন্দ নয়। স্যার কাজলি মাছ খেতে বেশি পছন্দ করেন।
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,
– কী আর করা! আজ রুইমাছই রান্না হয়েছে। তোমার স্যারকে এটাই খেতে হবে।
লাঞ্চের পর কর্তা জানাল,
– চারটায় গেমস-এ যেতে হবে। যাই এখন একটু ঘুমিয়ে নেই।
রাত আটটার মধ্যে ডিনার শেষ। দশটায় লাইট অফ!
সপ্তাহে পাঁচদিনের রুটিন সেট করা রয়েছে ঘড়ির কাঁটা ধরে। ঝড়-বৃষ্টি, শীত-বসন্ত বলে কোনো বিরাম নেই। নিয়মের কোনো নড়চড় হবে না। তবে হ্যাঁ শীতকালে পিঠাপুলি খাওয়া হোক বা না হোক ইউনিট অফিসারদের এক মাসের জন্য যুদ্ধকালীন মহড়ায় মাঠে ময়দানে থাকতেই হবে। রাত্রিবাস বাঙ্কারে করতেই হবে। মানে যুদ্ধ যুদ্ধ, শত্রু শত্রু খেলা। যাক সে গল্প আরেকদিন করা যাবে।
কর্তা গেমস-এ চলে যাবার পর ভাবছিলাম আমার জীবন সাতদিনেই কেমন পালটে গেল! উড়নচণ্ডী, খামখেয়ালি, গা এলানো জীবন কেমন দ্রুত বদলাল! এই সাতদিনে কতবার শুনতে হয়েছে ভাবি আর ম্যাডাম! এসব সম্বোধন হজম করতে বেশ ধাক্কা লাগে। আমি এসেছি সিভিলিয়ান ব্যবসায়ী পরিবার থেকে, একটু তো সময় লাগবেই! হঠাৎ করেই ভড়কে যাই! হকচকিয়ে যাই যখন দেখি বাবা, চাচা, মামার বয়সী মানুষগুলো হয় ভাবি নয় ম্যাডাম বলে ডাকছে! লেডি-ওয়াইফকে দেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে! এটাই নিয়ম, এটাই ট্র্যাডিশন!
শুনেছি বয়সের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়…আমিও বদলাতে থাকি। ধীরে ধীরে পালটে গিয়ে রীতিমতো মিলিটারির বউ হয়ে আমিও ঘরের ভিতর লেফট রাইট লেফট রাইট শুরু করে দিলাম ঘড়ির কাঁটা ধরে।
বাবলী হক
বাবলী হকের জন্ম পঞ্চাশের দশকে ঢাকা শহরে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পুরোনো ঢাকায়। কৈশোর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। ছোটোদের পাতায় ছড়া ও কবিতা দিয়ে শুরু। সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালী সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বের হয় প্রথম উপন্যাস। তারপর চলে গিয়েছিলেন অন্তরালে। দীর্ঘ তিরিশ বছর পর ২০১৫ তে স্মৃতির পটভূমিতে লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আম্বিয়াদাদি ও তার বিড়ালেরা’। আবার ফিরে এলেন লেখালেখির জগতে। ‘অষ্টপ্রহর আনাগোনা’ তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও তিনি মূলত গদ্য লেখেন কিন্তু কবিতা পড়তে ভালোবাসেন। প্রিয় কবির তালিকাও দীর্ঘ। প্রিয় লেখক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা চৌধুরী ও কবিতা সিংহ। বৃষ রাশির জাতিকা এই লেখকের শখ—ভ্রমণ ও বাগান করা।
এমন লেখা যে মজে গিয়ে মুচকি হাসছিলাম।
আর ভাবছিলাম এমন কৌতুক ভরা লেখা তাঁর হাতে আরো চাই। আরো।
সম্পাদককে ধন্যবাদ
আর লেখকের জন্য 🌹
আপনার গদ্য গড়ানে পাথরের লাল আভারমতো ।
Lekha ta pore koto bhalo legeche ta ekhane likhe bojhate parbo na, onake koshte chokher pani atke rekhechi. Aro porar opekkhay roilam.