ঈশ্বর
ঈশ্বর আমাকে ভুলুন, রাত্রি নেমেছে
ঔ বনে বাঘ এসেছে, ডাক শুনছি তার
ঈশ্বর আমাকে ভুলে যান
যদি পথ হারাই, যদি অন্ধ হয় চোখ,
যদি খেতে না পেয়ে কাঁদি সারাদিন
তবু জানবো কেউ নেই,
যদি অপেক্ষায় থাকি আপনার
ডাক শোনার পরেও
আপনি চুপ করে রইলেন।
ঈশ্বর এখন নতুন সমস্যা লিখবো
আপনি চুপ করে থাকুন।
লাল রঙের আপেল
হেলেন নামটার সাথে আপেল চলে আসে
একটা আপেলের জন্য কতকিছু হলো
প্রেম, প্রতিজ্ঞা, ঈর্ষা আর গোটা একটি ট্রয় নগরী
পতন, পাপ আর বীরত্ব।
আমাদের চারতলার যে ছেলেটি
রোজ পড়া মুখস্থ করতো
দরজায় কড়া নেড়ে যাকে সামনে পেতো
তার হাতে একটি লাল রংয়ের আপেল দিয়ে
দ্রুত চলে যেত।
সে ছিল আমাদের অতি পরিচিত
দিনের বেলায় তাকে দেখতাম
একটি ঝাঁকড়া চুলের ছেলে
অনেকেই দরজা খুলতো তার আপেলের জন্য
অনেকেই ভাবত, সে কেন এমন করে?
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো দরজাটা আমিই খুলি
খুলতে পারিনি,
সেই ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা, সেই আপেল
সেই লাল আপেল হাতে ছেলেটা এখন কোথায় আছে?
নার্স
গরম জলে মুছিয়ে দিলে প্রান্তর
শিউলি হয়ে উঠল মন
এখন মিটিংয়ে যাবে
মায়ার নার্স তুমি ফিরে এলে
ঈশ্বরকে বলব একটা গোলাপি বিকেল কিনে দিতে,
বাড়িতে বাচ্চার মা তুমি, বাইরে আমাদের বিষণ্ণতা
কী করে সামলাও পৃথিবীর ক্লেদ
ঈশ্বর কী জানেন তোমার নিরাপত্তা?
যে ভয়ে নিজেকে খুঁজতে যাই, সেখানে তুমিও কি থাকো?
যারা পথে আসে তাদের আঙুলগুলো বাঁকা
জামার বোতাম থেকে খুলে নেয় নীল বোতাম,
বিকেলগুলো হাওয়াকে বলে ঝাউবন আঁধার লেগেছে
ফোনে,ফোনে এসে যায় মৃত্যুর খবর।
তুমি নার্স তোমার বিছানা আজ গুছিয়েছে কে?
কে কাটে দেহ
সুগন্ধির মতো জেগে উঠে, বিস্ময় জাগে
এই যে কনক দিন, প্রভাতের নাও
দেখি জলে ভাসে ভেজা ছায়া মুখ।
কার কাছে ভিজবে একা, কে মুছবে
ভরা চোখ জল, কানে কানে বলবে
সব একদিন ঠিক হয়ে যায়।
অপেক্ষা এক মধুর ঔষধ
পান করো পরস্পরের নাম।
ভয় হয় করাত কলে কে কাটছে দেহ
কে নিয়ে যায় অংশগুলি, কে দেয় বাটালিতে ধার।
জ্যোৎস্না ছিঁড়ে আমি-তুমি ব্যান্ডেজ লাগাবো পায়ে
খুঁড়িয়ে হাঁটছি সেই কতকাল জুড়ে….
সাদা লেস
সাদা লেসের পর্দা দেয়া একটি বাড়ি
এই চৈত্র দিনে আমাকে ডাকে
ইংরেজি সিনেমার আদলে কী যে হাওয়া
রবীন্দ্র সংগীতের মতো সেই বাড়িটি
আমি আজও দূর থেকে দেখি।
অনেকের পায়ের শব্দ আমাকে মনে করিয়ে দেয়
এই তো, এসেছে ও-মুখ সওদাগর, দরজার খিল খুলি
তার পায়ের শব্দ কোন রবিবার আসবে কী?
সাদা লেসের পর্দা ঘুমের ভেতরে জেগে ওঠে
ভাঙা ঘুমে কান পাতি চৈত্র ঝিঁঝিঁ গান খুলে রাখে
পায়ের শব্দ নিয়ে সে কী আর আসে?
ভূমিকার পাথরে রোদ
বানান ভুল করে পথ দাঁড়িয়ে গেলে
ভূমিকার পাথরে রোদ গলে
অন্তর্বাসের মতো কতকিছু লুকাতে হয়
মাহুতের সন্ধ্যা এসে আড়াল ঢাকে
প্রশ্নের বাজারে বিক্রি হয় সাদাসিধা দিন।
পায়ের ওপর ত্রিভুজ শুয়ে থাকে আধুনিক পাঠ
ভূমিকা থামে না।
যেন একটা বগি ছাড়া রেল ছুটে যায়
মানুষের ক্ষত এড়াতে
কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে থাকা যাপনের অসুখ।
সময়ের স্লেটে যে দাগ পড়ে
তার ছবি বাঁকা হয়
কোনদিন আর ফুল আঁকা হয় না
সারসংক্ষেপে একটা চিৎকার ধ্বনি শুনে
মরে যায় চৌকাঠের শরীর।
গতজন্মের পাপ নিয়ে দাবা খেলছে যারা
তারা রাত্রিঘোর জলসায় ঢেকে রাখে মুখ
দুআনা, চারআনা সুখে বিবেক বন্ধক
সারি সারি ভূমিকার পাথর।
যেভাবে বলা যায় রঙিন হওয়ার গল্প
তার শব্দ নিয়ে বিজ্ঞাপন ওড়ায় ঘুড়ি
হারিয়ে যাচ্ছে আজ মানুষের খোঁজ
মৃত শেকড়ে ঘাস সবুজ হারায়
যতদূর ছায়া যায়, কেবল জিজ্ঞাসা।
আসমা চৌধুরী
আসমা চৌধুরী জন্ম–৩০নভেম্বর ১৯৬৫ মেহেন্দিগঞ্জ,বরিশাল । তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সহকারী অধ্যাপক। লেখালেখি – গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ ও শিশুতোষ সাহিত্যে বিচরণ। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, বসবাস,গল্পগ্রন্থ। প্রকাশকাল–১৯৯০। প্রকাশিত গ্রন্থ– ১৭টি। পুরস্কার– ২০০০সালে শিশুতোষ সাহিত্য রচনায় ইন্টারলাইফ বাংলাদেশ কর্তৃক সুনীতি পুরস্কার। ২০১৩তে জয়িতা পুরস্কার, ২০১৬তে শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক, ২০১৬তে জাতীয় কবিতা পরিষদ কর্তৃক কবি সম্মাননা,২০১৭তে বরিশাল জেলাপ্রশাসন কর্তৃক জীবনানন্দ পদক লাভ ।