|| দূরদেশে জ্বরগ্রামে বসে ||
এখানে এখন বিকেল সাতটা তিরিশ
টান টান গ্রীষ্মের আলো এসে কামড়ে যাচ্ছে
শরীর পুড়ছে বলে ধরে নেই আজ আমার জ্বর!
বলেছিলে জ্বর হলে কাছে থাকবে, ছেড়ে যাবে না একেবারে
সেকথার তাপ এসে লাগছে, এখানে এখন সাতটা তিরিশ
কাজে যাই ঘরে ফিরি, বসে থাকি হেমলক পেয়ালা হাতে
এক দুই তিন-সিপ ভেঙে আসছে নীরব পতন
যেখানে সারা বসন্ত গান গাইলো সোনাটা গজল
সেখানে দারুণ তাপ গলিয়ে দিয়ে যায় লৌহ জাহাজ
জ্বরগ্রাম ধরে তাই গেয়ে চলি শীতের গজল এবং
ত্রিভঙ্গ মূরতি মাখা নৈঃশব্দ্য সংগীত
|| কত পথ বাকি ছিল কত যে নদী ||
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় আমি কপিলাবস্তুর গৌতম
ফেলে এসেছি রাজ্যপাঠ, সংসার, পিতা শুদ্ধোদনের স্বপ্ন-অভিষেক
মরমি আয়ুর পাখি আমাকে ডেকে নিয়ে চলে গেছে দূর বহুদূর
আমার পৃথিবী জুড়ে অশোকস্তম্ভের মেলা, হাজার বছরের অস্ত্রোপচার
জরুরি বিভাগ আর তার অনর্গল চিৎকার
গৌতম গৌতম বলে ডাকছে অচেনা রাত, শনশন বইছে উত্তুরে বাতাস
কোনো ডাক লাগে না কানে। সারারাত কুড়িয়েছি বিজন আধোঘুম
মেলা শেষে ফেলে যাওয়া অসংখ্য পণ্যের বিচ্ছিন্ন টুকরো রাশি
মনে পড়ে সন্ধ্যার মুখ, ভোরের অসুখ, নরম আলোয় গড়া সূর্যের ছবি
কত পথ বাকি ছিল কত যে নদী…
|| ফেরারি প্রেমী ||
বিপন্ন চিকিৎসা আমার আজই সমাপ্ত হলো
আমাকে দিয়েছে ওরা একাকাশ পথ্য, একসাগর বিপর্যয় সিরাপ
একা একা খেতে ভালো লাগে না তাই ডাক দেই পান্থজনে
বলি, এসো হে এসো পান করো জগত-তরল
গিলে নাও গুটি কয়েক ট্যাবলেট
এসো ভাগাভাগি করে ভুলে থাকি যাবতীয় যাবজ্জীবন
মরিচা পড়েছে দূর স্বপ্নের লৌহ ফটকে
ধ্বনির আগে এখন প্রতিধ্বনি এগিয়ে আসে
নবতারা আকাশে না উঠলে স্বস্তি পায় পুরানো আঁধার
আমার চিকিৎসক একজন নামজাদা ফেরারি প্রেমী
তার পায়ে আঁকা ছিল এককোটি বছরের আত্মঘাত উল্কি
বাড়ি তার জিউসের পাশের বাড়ি
জিউস তার প্রেমিকাকে ভোগ করেছিল
যদিও একথা লেখা নাই পুরাণে, কিন্তু জানতো সকলে
সেই থেকে চিকিৎসক আমার লিখে যাচ্ছেন শুকনো নদী
আমি তার একাগ্র রোগী, খুব রাগী জানেন বলে
প্রতিদিন লিখে দেন একরাশ উজান ভাটি
|| বসেছিলাম হাজার বছর ||
জীবনের চিকিৎসা জীবন দিয়ে হয় না
বারবার অসুখের সংবাদে তোমরা বিরক্ত জানি
আমার চারদিকে এক অচিন আকাশ, নিরবচ্ছিন্ন অন্ধ মাতাল শ্বাস
উজানে নাও ঠেলে যে আসবে বলে কেটে নিয়েছে সীমিত আয়ু
তাকে আজ পৌছাতে দাও তোমাদের টোল তোলা ঘাটের পারে
আমার যে নিজস্ব ঘাট ছিল সেখানে এখন ধস নেমে গেছে বলে
তোমাদের ঘাট ধার চাইছি জেনো
বাকিটা চিকিৎসা অবেলার হিসাবের খাতায় পত্র লেখে শূন্য পাতায়
জেদহীন জাদুঘর তোমাদের কাছে জমা দিয়ে আজ চলে যাই
তার সাথে দেখা হলে বলো আমিও এসেছিলাম, বসেছিলাম হাজার বছর
তবু তার দেখা তো মেলে নি। কারো কাছে নেই তাই অভিযোগ
|| ম্যানহাটনের প্রতিটি ঘরে তখন ||
সারারাত মদ্যপানের ঘোরে বারবার মনে পড়ছে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি গড়ার গল্প
বুকের বামপাশে বেদনার ঘরবাড়ি সেখানে তিমির রাত্রির ঝিম ধরা শব্দশ্বাস
আছড়ে পড়ছে আটলান্টিকের দাউ দাউ ঢেউ-শিখা, ফিরব না আর-
যেখানে সূর্যের পোশাকে মৃত্যু এসে দাঁড়ায়। কত যে বিক্ষুব্ধ তর্কের অসমাপ্ত কোরাস
দু’পাশে ফেলে টলমলে পায়ে হেঁটে চলছি ম্যানহাটন টাইমস স্কয়ার !
সারারাত নাম ধরে কারা যেন ডাকছে, পুরোপুরি শোনা যায় না
তারপরও কিছু ঝাপসা কণ্ঠস্বর আশেপাশে উড়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে থেমে যাই
মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই, কোথা থেকে আসে এই সাইবার কণ্ঠ
ঠিক করেছি আজ সারারাত জেগে থেকে তাকেই ধরবো, বলবো এটা তো ঠিক নয়
ম্যানহাটনের প্রতিটি ঘরে তখন ঝিম ঝিম অন্ধকার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোবে
ফেরদৌস নাহার
ফেরদৌস নাহারের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। নেশা, দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ও বইপড়া।
ফেরদৌস নাহার বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগীত রচয়িতা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা: ১৫টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অসংখ্য যৌথ কবিতা সংকলন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের দল ‘মাইলস’-এর অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও কানাডা থেকে কম্পিউটার ট্রেনিং প্রোগ্রাম কোর্স করেছেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি ছবি আঁকেন, গান লেখেন, ব্লগিং করেন, কফিশপে ধোঁয়া আর ঘ্রাণে আড্ডার ঝড় তোলেন। কিন্তু সবকিছুর উপরে এক বিশ্ব বোহেময়ান কবি আর চির তারুণ্যের নাম ফেরদৌস নাহার। মন চাইলে বেরিয়ে যান। ঘুরে বেড়ান খেয়াল-খুশি মতো, যাকে তিনি ‘ঘুরণ’ বলেন। ভালোবাসেন প্রকৃতি ও মানুষ। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া, ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। ইমেইল : [email protected]
২১ এর ভোর গেল প্রিয় কবির কবিতার সৌরভে।
২১ এর ভোর ভরে গেল প্রিয় কবির কবিতার সৌরভে।
এখানে এখন রাত নটা তেতাল্লিশ, উঁকি দিতে এসে পেয়ে গেলাম একমুঠো চমৎকার কবিতা। 🙂