যতক্ষণ পারে আজমত চাচার সঙ্গে ছায়ার মত লেপ্টে থাকে নিধি। ক্ষেতে গেলে ক্ষেতে, হাটে গেলে হাটে, কামলা কিষাণদের নালিশ সামলালে সেখানেও। হাটে এলে ভীড়ভাট্টায় না নিয়ে তাকে সিরাজুলের মায়ের চা দোকানের সামনে বাঁশের মাচায় বসিয়ে রাখে আজমত চাচা। সিরাজুলের মা চা বানায় আর নিধির সঙ্গে টুকটুক গল্প করে।
সেদিন নিধিকে বসিয়ে নিজেও পাশে বসে পড়ে চাচা। তার উল্টোদিকে একটা শহুরে ছেলে, পরনে জিন্সের প্যান্ট, আর কালো হাফ হাতা শার্ট। শ্যামলা হাতের কব্জিতে লাল চেকের গামছা বাঁধা। সাইকেলের হ্যাণ্ডেল একহাতে ধরে অন্য হাত নেড়ে নেড়ে আজমত চাচার সঙ্গে কথা বলে।
পরিবতর্ন, সমাজ, তৃণমূল পর্যায় এসব শব্দ নিধির কানে এসে ধাক্কা দেয়। ছেলেটার কপালে কাটা দাগ, ঘন চোখের পাপড়ি মেয়েদের মত দেখায়। নিধি আজমত চাচার হাটু ধরে জিরাফের মত গলা তুলে ওদের কথাবার্তা বুঝে উঠতে চায়।
ছেলেটার নাম ইরফান। আজমত চাচাকে চাচা বলেই ডাকছে। আমোদ লাগে নিধির। এ ছেলেটা তাদের বাড়িতে থাকলে কত ভালো হতো, সে পালা করে একদিন আজমত চাচা, আরেকদিন ইরফানের সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে পারতো।
ইরফানের কাজের এলাকা বদলের সময় হয়েছে শুনে আজমত চাচার মুখ বিচলিত দেখায়।
আফসোস করে ইরফানও- ‘পার্টি যেতে বললে তো যেতেই হবে। তবে আরো কিছুদিন থাকতে পারলে ভালো হতো। বর্গাচাষীদের মোটামুটি বুঝিয়ে ফেলেছিলাম। এখন আজমত চাচা আপনার হেল্প লাগবে’।
সিরাজুলের মা’য়ের চায়ের দোকান আস্তে আস্তে সরগরম হচ্ছে। সামনের চুলায় কড়াইতে জিলেপী ভাজার তেল গরম হচ্ছে।
আজমত চাচা হো হো করে হাসে-‘ তুমি ইরফান আমাকে জড়াইতেছো। জানো না, আমিও জোতদারদের দলের লোক, বড় জোতদার না হইলেও লিচু বাগানে কিষাণ কিন্তু খাটাই’।
-‘¬এই তো ভুল করছেন চাচা, যদি নায্য হিস্যা দেন, প্রাপ্য মুজুরী দেন তাহলেই তো ঝামেলা মিটে গেল’। ইরফানও তর্ক জুড়ে দেয়।
নিধির উসখুশ লাগে, সে চরকি চড়তে এসেছে। খুব ভালো লাগে তার। চরকি ওপরে উঠলে মনে হয় হাত দিয়ে আকাশ ছুঁয়ে দেয়া যাবে, নামার সময় পেটের ভেতরটা খালি হয়ে যায়। ওঠা নামার ঘূর্ণিপাকে কত কি ভেবে ফেলা যায়। আজমত চাচা তো জানে সে কথা। কোথায় তাড়াতাড়ি সেখানে যাবে, তা না ইরফানের সঙ্গে কি সব গল্প জুড়ে দিলো। চাচার কড়ে আঙ্গুল ধরে টানতে থাকে নিধি।
নিধির চড়কি চড়া হয়ে গেলে, গজা আর চিড়ের মোয়া কিনে তারা যখন বাড়ি ফেরার পথ ধরলো তখন হাটের গুম গুম আওয়াজ তখন একটা একক ধ্বনিতে রূপ নিয়েছে। হাটের বাইরেও ধুলিময় রাস্তা পার হওয়া অব্ধি চাচা সাইকেলটা হেঁটেই চালায়। নিধিরও তখন হ্যান্ডেলে বসতে ভালো লাগে না। সেও হাঁটে। তার হাওয়াই চপ্পলের লাল রং মেটে হয়ে ওঠে। হাটের গুঞ্জন মৃদু হয়ে এলে, কেটে ফেলা ধানের খড়খড়ে গোড়া দেখতে দেখতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় আজমত চাচা।
-নিধুয়া, বলতো দেখি, আমাদের দেশটার কপাল পোড়া না কি মানুষগুলার?’
আজমত চাচা কি উত্তর পাবার জন্য প্রশ্ন করে না, নিজেই বলে যায়- ‘ সেই যে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হইল, তেভাগা আন্দোলন হইল, বৃটিশ খেদাইলাম, পাকিস্থানের আগ্রাসন দূর করলাম, তাও কিন্তু যেই কিষাণ সেই কিষাণ। বুজলিরে বুড়ি, মানুষের লোভ বদলায় না, যে সময়ে যেমন ভাবে সম্ভব মানুষ তার লোভ বজায় রাখে’।
নিধির মনে হয় যে আজমত চাচা তার সঙ্গে না, আসলে ইরফানের সঙ্গে কথা বলছে। নিধি যে পাশে হেটে চলছে তা খেয়াল করছে না। কথা বলে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পাকা রাস্তা পার হয়ে সাইকেল মাটির রাস্তায় পড়লে দোল খায়, চাচার কণ্ঠস্বরও কেঁপে কেঁপে ওঠে।
সূর্য পশ্চিমাকাশের কোল ঘেষে শুয়ে পড়েছে, চারদিকে ছিমছাম সন্ধ্যার ছায়া। আজমত চাচার বিষণ্ণতা নিধিকেও গ্রাস করতে চায়।
-‘ চাচা আমি খালি একজন পোড়া মানুষ দেখছি, হাঁটুর হাড্ডি বের হয়ে গেছিল’।
আজমত চাচা সহসাই সাইকেল থামিয়ে নেমে দাঁড়ায়। নিধিকে জড়িয়ে ধরে, ফিস ফিস করে বলে- ‘ওইটা একটা দুঃস্বপ্ন আছিল মা মনি, ওইসব মনে রাখতে হয় না’।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।