সেলিমপুর বড়রাস্তার মোড় থেকে বাঁ দিকে যে মাটির পায়ে হাঁটা পথটা গেছে, সেটা ধরে কিছুদূর হাটলে নঁকুড়ির নালা। নালাটা খুব প্রশস্ত নয়, ডিঙিয়েই পার হওয়া যায়। কিন্তু তবুও নিরাপত্তার স্বার্থে একটা দুপাশ কাটা টিনের ড্রাম আড়াআড়ি করে ফেলা থাকে সারাবছর। ড্রামের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে সাপের মত ফোঁস ফোঁস করে পানির চিকন ধারা এগিয়ে যায়। বর্ষায় পোয়াতির মত বেড়ে ওঠে স্রোত, ঠেলে নিয়ে যেতে চায় নালার পানির ওপরে ভেসে থাকা দুপাশের গাছের ছায়া। নালাটা মূলত জোয়ারের পানি বের করে দেয়ার পথ। ড্রামের ভাঙা ছিদ্রপথে মাঝেমধ্যে রক্তাক্ত হয়ে আটকে পড়ে দু একটা পুঁটিমাছ। সেগুলোকে তুলে নিয়ে বরশীতে গেঁথে রাক্ষুসে মাছ ধরতে ছুটে যায় শিশুর দল। পা পিছলে নালায় পড়লে হালকা ব্যাথা পাওয়া যাবে হয়ত, কিন্তু মরচে ধরা ড্রামের প্রান্তে তীক্ষ্ণ ভাঙাগুলোয় হাত পা কাঁটলে, গ্যাংগ্রিন নিশ্চিত।
তবুও শিশুর দল লাফিয়ে পার হয় নালা, ড্রামের ওপর বসে পা ঝুলিয়ে পানির স্পর্শ নেয়, স্রোতের গায়ে ছড়িয়ে দেয় বুনোফুলের থোকা, কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে ছুটতে থাকে তার পিছু পিছু। নালার দুধারে ঘন সুপুরি বাগান, অন্যগাছও আছে, কিন্তু সুপুরির গাছই বেশি। সুপুরির পাতা পেকে খসে পড়ে গাছ থেকে নিচে, সেগুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে শুকিয়ে চুলার জ্বালানি করা হয়। আবার কেউ কেউ বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে বাড়ির চারিদিকের আব্রু রক্ষা করে। সুপারির গাছগুলো দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন দুইঝুটি করা কোন ঢ্যাঙা বাচ্চা মেয়ে। নালার দুপাশে দুটো সরু পথ দু’দিকে চলে গেছে। এপাড়ের পথটা বড় রাস্তার দিকে যায়, আর ওপারের পথটা এগিয়ে যায় গ্রামের গভীরে। মাটির উঁচুনিচু পথ, যেতে যেতে কয়েকটি পুকুর, পুকুরের কিনারায় পথ একটু বেশিই সরু। পথের মাঝে হুট করে জেগে ওঠা একটা ইয়া মস্ত চালতা গাছ। কমলাই সবুজ রঙের পাতা উঁকি দিচ্ছে, দু চারটে চালতাও দেখা যাচ্ছে। এগাছের চালতা সব পুকুরের পানিতেই ঝরে পড়ে, গোসল করতে এসে মেয়ে বউরা সাঁতার দিয়ে তুলে নেয়। তারপর হয়ত ডালে দেয় বা আঁচার অথবা খাওয়াদাওয়ার পর ঘাটলায় বসে এ ওর মাথার উকুন বাছতে বাছতে লবন দিয়ে কাঁচাই খেয়ে নেয়, টকে যাওয়া দাঁত শিনশিন করে ওঠে।
পুকুর ধারের বাদাম গাছটা এ গ্রামে অনেক দিন ধরে দাঁড়িয়ে। কতদিন? কেউ জানেনা। তবে অনেক প্রাচীন গাছ, গ্রামে এখন এই একটাই অবশিষ্ট আছে। লাল লাল বড় বড় পাতা, অনেকটা পাকা কাঁঠাল পাতার মত, কিন্তু আকারে আরও অনেক বড়, তার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় ধরেছে বাদাম। মুগুরের ওপর রেখে দাঁয়ের এক কোপে দুভাগ করে ফেলতে হয়, বড় আকারের এলাচের মত লালচে খোসার ভেতর থেকে তবেই বেরিয়ে আসে সাদা রঙের একচিমটি বাদাম, প্রাপ্তবয়স্কের নখের মত। যেতে যেতে যত বাড়ি দেখা যায়, সব দরজা খোলা। মানুষ দেখা যায়, আবার যায়না। উঠোনগুলো গোবর দিয়ে লেপা, যাতে ধুলো না ওড়ে। দড়িতে ঝুলে থাকে গামছা, শাড়ি-লুঙ্গি। এই উঠোনগুলোতেই রোদে দেয়া হয় আতপ ধান, ভেজা সুপুরি কিংবা পাকা বরই। হাতে ছড়ি নিয়ে অন্ধ ভিখারি হাত পেতে চেয়ে নেয় দুটো চাল আলু, চোখ বেঁধে শিশুর দল ছুটোছুটি করে খেলে কানামাছি।
দরজা খোলা থাকলেই কি ভেতরে ঢোকা উচিত? কি নিয়ম কে জানে! বাইরে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দেয়া ভালো কিছু সময়, যদি কাউকে দেখা যায়, কেউ যদি গিয়ে ভেতরে খবর বলে! পথে পথে কতজন জানাল তেমন কেউ নেই নাকি আর আজকাল, কেবল এক বৃদ্ধা , আর কাজের লোক বুঝি। নিচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি, গাঁদা আর বেলি গাছ সারি দিয়ে লাগানো, দুটো বোম্বাই মরিচ আর বেগুন চারাও দেখা যায়। কাল রাতে বুঝি বৃষ্টি হয়েছিল, একটা মরা কেঁচোর শরীর খুবলে খাচ্ছে মুরগী। হাঁসগুলো উঠানের একধারে দাঁড়িয়ে ঝিমুনির ভাব করছে। দেয়াল ঘেঁষে পেয়ারা গাছ, দেখতে দেখতে টক শব্দে একটা কড়া পেয়ারা টিনের চাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়লো। গাছের নিচেও অনেক বাদুড়ে খাওয়া পেয়ারার অংশ পড়ে থাকতে দেখা গেলো। শহরের রাস্তার কাসুন্দি দেয়া পেয়ারার মত নয়, ক্ষুদে টেনিস বল সাইজের গ্রামের পেয়ারা।
– আছেন নি কেউ? কেউ আছেন?
অল্পবয়সী একটা ছেলে বেরিয়ে আসে, হাফপ্যান্ট পরা। কিছু কাজ করছিল হয়ত, ছেঁড়া ময়লা একটা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে।
– কারে খুঁজেন?
– বাড়িতে কারা কারা আছে?
– কেউ নাই। আমি আর খালাম্মা।
– তুমি?
– আমি টুনু। কাম করি এই বাড়িত।
– বাকি আর কেউ?
– আর কেউ থাকেনা।
– আচ্ছা। তাইলে খালাম্মারেই বোলান দেও।
– আপনে?
– মোস্তফা। আমার নাম মোস্তফা। একটা কামে আইছি, শহর থাইকা।
টুনু ভেতরে চলে যায়, যাওয়ার আগে দরজাটা বন্ধ করে যায়। বলা যায়না, চোর বাটপার হতে পারে, আগে কখনই দেখেনি এই লোককে। যদি পরিচিত কেউ হয়, মুখের ওপর এভাবে দরজা বন্ধ করে দেয়ার জন্য খালাম্মার অশেষ গালাগাল কপালে জুটবে। কি আর করা, খাবে নাহয় গালি, তবুও, নিরাপত্তা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। খালাম্মা মেয়েমানুষ, তার সে বোধ কই! মোস্তফা সামনের পোস্তার ওপর বসে থাকে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেখে, ফেরার ভাড়ার বাইরে অল্প কিছু টাকা আছে সেখানে। মিষ্টি আনা উচিত ছিল? কুটুমবাড়ি প্রথমবার এসেছে, এভাবে খালি হাতে…. হ্যা, কুটুমই তো, নতুন আত্মীয়, কুটুম তো অবশ্যই। সত্যিই আত্মীয় কি? নাকি নয়? যদি না হয়? থাক, মিষ্টি না এনে ভালোই হয়েছে।
বসে থাকতে থাকতে মোবাইলের ছোট ঘড়ির দিকে তাকায়। প্রায় বারোটা বেজে এসেছে, রওনা দিয়েছিল নয়টায়। আরও আগে আসা যেত, পয়সা বাঁচাতে একটা লক্কর ঝক্কর টেম্পুতে উঠেই সময়টা গেল। তা যাক, সময়ের তো অভাব নেই, অভাব হলো পয়সার, পয়সাটা বাঁচলেই হলো, সময় গোল্লায় যাক।
পোস্তায় ফাটল ধরেছে, ভেতরের সিমেন্ট বের হয়ে গেছে অনেকখানি। ঘর নিয়ে গজিয়ে ওঠা পেঁপে গাছটা ঠুন্ডা, কোন ফল নেই। বাড়িটা বেশ বড়সড়, দোতলা ছাদে টিনদেয়া বিল্ডিং, কিন্তু লোক নেই, এককালে হয়ত ছিল। কিছুক্ষণ খুঁটখুট শব্দের পরে খট শব্দে দরজা খুলে যে বেরিয়ে এলো সে বৃদ্ধা নন, কিন্তু বার্ধক্যের কাছাকাছি চলে গিয়েছেন প্রায়। ছোটখাটো আকার, মাথায় কাপড় দেয়া, বলিরেখায় ঢাকা নম্র একটা মুখ, টুনু তার পেছনেই দাঁড়িয়ে। মোস্তফা সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সুফিয়া মাথাটা সামান্য নুইয়ে সালামের উত্তর নেয়ার একটা ভঙ্গি করে। ইশারায় ভেতরে এসে বসতে বলে। বসার ঘরটায় আসন লাগানো কয়েকটা বেতের চেয়ার, একটা ছোট টিভি, একপাশে একটা বড় বিছানা। দেয়ালে ঝুলছে বেশ কয়েকটি পুরনো ক্যালেন্ডার, একটা মোনালিসা আর একটা সোনালি কাটার সাদা ঘড়ি।
– তোমারে তো চিনলাম না বাবা।
– জ্বি, আমি মোস্তফা। মানে আপনার আমারে চিননের কথা না, আমিও কইতে গেলে আপনারে চিনিনা। কিন্তু মনে হয়, আপনেরা কোনভাবে আমার কিছু হন, মানে আত্মীয়কুডুম হয়ত।
সুফিয়া চুপ করে থাকে। তার ভ্রু দুটো ক্রমেই কাছাকাছি চলে আসছিল। সে টুনুকে ইশারা দেয় খাবারের ব্যবস্থা করতে। টুনু ভিতরে গেলে আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে আস্তে বলে,
– কোন দিকের আত্মীয়?
– মার দিকের মনে হয়।
– তোমার বাপ?
– বাপেরে দেহিনাই কোনদিন।
– মায়ের নাম?
– হাসি।
– এই ঠিকানা কই পাইলা?
– মায় যহন মরে, তহন আমি ছোড। বাপের নাম জানতে পারিনাই কোনদিন, তাই সেইভাবে পড়ালেখাও হয়নাই। যদিও পড়তে লিখতে পারি, কিন্তু বড় কোন পাশ দিবার পারিনাই। অহন একটা ফ্যাক্টরিতে কাম করি বহুবছর হইল, মেশিনের কাম, ভালো টাকা পাই। মায় জীবিত থাকতে এই ঠিকানাডা কইছিল, সেলিমপুর মুন্সি বাড়ি। কইছিল হে বোধহয় বেশিদিন বাঁচব না, বাঁচেও নাই। কইছিল যদি কোনদিন ভাতের কষ্ট হয়, আশ্রয়ের কষ্ট হয়, হেলে জানি এই ঠিকানায় আসি। এহন আপনে কি আমার মায়রে চিনেন?
সুফিয়া কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর দুইদিকে মাথা নাড়ে। মনে পড়েনা এমন কিছু, এমন কোন নাম, জানায় সে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
– এহন কি তাইলে তোমার কোন বিশেষ প্রয়োজনে আইছ বাবা?
– প্রয়োজন বললে প্রয়োজন আরকি! বিয়া করতেছি এইমাসে কিছুদিন পর, ভাবলাম যদি কিছু নিজের মাইনসের খোঁজ পাওন যায়। মায় তো বাড়ি বাড়ি কাম করত, পরে একদিন মইরা গেল। আমি বহু কষ্টে বড় হইছি, কেউ আছিলনা দেহার মত।
সুফিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মোস্তফাকে দেখে। চেহারা চলনসই, কিন্তু ভদ্রঘরে মানুষ নয় তা বোঝা যায়। ভরদুপুর বেলা এসে পড়েছে যখন না খাইয়ে বিদায় দেয়া ভালো দেখায়না। আরও এসেছে শহর থেকে, ফিরতে অন্তত তিন ঘন্টা তো লাগবেই। যা রান্না হয়েছে খাইয়ে দিলেই হবে, গরীব ঘরের ছেলে, কিছু মনে করবেনা বলেই মনে হয়।
– একটু বও বাবা।
বলে ভিতরে গিয়ে টুনুকে কাঁচের প্লেট গ্লাস নামিয়ে টেবিলে সাজাতে বলে সে। যদিও টুনুর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলনা এই উটকো লোকটাকে খাওয়ানোর, খালাম্মার ভয়ে তবুও সে তোরজোর শুরু করে। সুফিয়া বসার ঘরে ফিরে যায়, গিয়ে দেখে মোস্তফা টিভিটার কাছে গিয়ে এদিকওদিক দেখছে।
– সাদাকালা টিভি বাবা। খালি বিটিভি দেহা যায়।
শুনে হাসে মোস্তফা। তার ঘরে তো টিভিও নেই, মোড়ের চায়ের দোকানে গিয়ে খেলা দেখে।
– বিটিভিই ভালো। সুন্দর নাটক দেয়।
বলতে বলতে আবার এসে বসে পড়ে সে।
টুনু এসে দরজার কাছে দাঁড়ায়। সুফিয়া সেদিকে একবার তাকিয়ে সামনে ফিরে বলে,
– চলো বাবা। গরীবের ঘরে দুইডা ডাইল ভাত খাবা। আত্মীয় নয় নাই হইলাম, আইছ দুপারবেলা, না খাইয়া যাওন চলবোনা।
মোস্তফা কিছুক্ষণ অসম্মতি জানায়। কিন্তু সুফিয়া নাছোড়বান্দা, তাই শেষপর্যন্ত রাজি হতে হয়। খাবার টেবিলে গিয়ে হাত ধুয়ে বসে। সুফিয়া প্লেটে গরম ভাত বেড়ে দেয়। ডিমের তরকারি, ছোটমাছ আলু দিয়ে আর লাউপাতা ভর্তা। পাশে ছোট একটা বাটিতে লবণ, কাচামরিচ।
– আয়োজন সামাইন্য বাবা।
আয়োজন আসলেই সামান্য, কিন্তু মোস্তফা সেইটুকু দিয়েই তৃপ্তি করে ভাত খায়। ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্ন করে সুফিয়ার পরিবার সম্পর্কে। সুফিয়ার স্বামী মারা গেছে বহুদিন, মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, ছেলে শহরে থাকে, পড়াশোনা করে। নাতি আছে মেয়ের ঘরে দুইজন। ঈদের ছুটিতে সবাই আসে, তখন বাড়ি গমগমে হয়ে ওঠে। শুনতে শুনতে মোস্তফার মনটা ভারী হয়ে ওঠে। আহা! এমন একটা পরিবার তো তার আত্মীয় হলেও হতে পারত। মা যে কেন তাকে এই বাড়ির কথা বলে গেল, কিছুতেই মাথায় ঢোকেনা তার।
– মায় এই বাড়ির কথা কেন কইয়া গেল তাই বুঝতাছিনা।
– পুরান কাজের লোকটোক হইতে পারে বাবা। আমি আসা ইস্তক তো শুনিনাই এমন কোন নাম। আগের দিনের লোকজন কেউই তেমন বাইচা নাই, নইলে জিগান যাইত।
সুফিয়া থেমে থেমে বলে। মোস্তফা একটু দমে যায়। কাজের লোক? তার মা এখানেও কাজের লোক ছিল? তার মনে ক্ষুদ্র একটা আশা ছিল, যে সে এই বাড়িরই কেউ হবে, আত্মীয় হয়ত। কিন্তু কাজের লোকের ছেলে তো আর আত্মীয় হয়না! সুফিয়া চুপ করে ছিল, হঠাৎ বলে ওঠে,
– হেতে কি বাবা! তুমি বউ নিয়া আমার ধারে আইয়াই বেড়াইয়া যাইয়ো। একা মানুষ থাকি, খুব খুশি হমু।
মোস্তফা একটা মলিন হাসি দেয়। সে যদি আসেও, কি হিসেবে আসবে? পুরনো কাজের লোকের ছেলে? সেটাই তো হবার কথা! কোন যুক্তিতে তার মনে হয়েছিল যে সে এই বাড়ির আত্মীয় হতে পারে? এমন সুন্দর বাড়িঘর, এমন লোকজন, হয়ত খুব টাকাওয়ালা নয়, কিন্তু তার চেয়ে অনেক ওপরের লোক এরা। সে সামান্য মেশিনের মিস্ত্রি, এরা কি করে তার আত্মীয় হবে! ভাতগুলো যেন হঠাৎ খুব শক্ত মনে হতে থাকে তার, স্বাদহীন হয়ে ওঠে জিভ। ছায়াঢাকা মুখে খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে বসার ঘরে গিয়ে আবার বসে যায় সে।
সুফিয়া টুনুকে প্লেট ধুতে পাঠিয়ে ছোট চুলায় চা বসায়। দুধ ফুটিয়ে নেয় ডগমগ করে, তার ভেতর দিয়ে দেয় পাতা আর চিনি, তারপর বলগ উঠলে ছাকনি দিয়ে ছেঁকে কাপে ঢেলে নেয়। তারপর চা নিয়ে চলে বসার ঘরের দিকে।
– নেও বাবা। চা নেও।
আবার চা কেন, বলতে বলতে মোস্তফা কাপটা হাতে নেয়। জিড়িয়ে জিড়িয়ে সময় নিয়ে চাটুকু শেষ করে। সুফিয়া বসে থাকে, টুনু এসে হাত মুছে আবার পেছনে দাঁড়ায়। চা শেষ হলে কাপটা টুনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মোস্তফা।
– যাই তাইলে খালাম্মা। যাইতেও তো আবার সময় লাগব। এহন রওনা দিলেই ভালো।
সুফিয়াও উঠে দাঁড়ায়। মুখে একটা সৌম্য হাসি ফুটিয়ে তোলে।
– যাওন নাই বাবা, কও আসি। তোমারে ভালো খাওয়াইতে পারলাম না। আবার একদিন আইয়ো, বউ লইয়া আইয়ো। কোন সংকোচ করবানা। এই টুনু, যা, পোলাডারে বড় রাস্তা তামাইত আগাইয়া দে। যা যা! যাও বাবা, আস্তেধীরে সাবধানে যাইয়ো।
টুনুকে নিয়ে মোস্তফা বেড়িয়ে যায়। বারবার পেছনে ফিরে ফিরে বাড়িটাকে দেখতে থাকে সে। এখানে আসার পথে মনে অনেক আশা পুষে রেখেছিল সে, অনেক কিছু ভেবে ফেলেছিল, অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল। আচ্ছা, কি ভেবেছিল সে? এখানে এলে কাকে পাবে? খালা, মামা, ফুপু? নাকি অন্যকাউকে? বাবা? বাবার খোঁজ? বাবার প্রয়োজন কি আদৌ আছে তার? টুনুর প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে, কি যেন জিজ্ঞেস করল টুনু।
– কিছু জিগাইলা?
– হ। জিগাইছি ভাইজানের বাড়ি কই?
– জানিনারে ভাই। শহরেই তো কাডাইয়া দিলাম জীবনডা। বাড়ির খোঁজেই আইছিলাম, পাইলাম তো না। তা তোমার বাড়ি কই?
– আমার বাড়ি শরিয়তপুর। খালাম্মার মাইয়ার শ্বশুরবাড়ি ওইহানে। আমাগো তো নদী ভাঙছে পর ভিটাবাড়ি সব গেছে। হেইতেই এহানে কাম করতে পাডাইছে। খালাম্মায় ভালো অনেক। আইজ ডিমের ভুনা খাইলেন না? আমারেও হেইয়াই দিবে খাইতে, আস্তা ডিম দেয় রানলেই।
মোস্তফা হাসে, তার জীবনটাও এমনই ছিল। মা যেসব বাড়িতে কাজ করত, তারা প্রায়ই খাবার দিত, মা সেগুলো পলিথিনে বেঁধে নিয়ে আসত। প্রায় রাতেই মায়ের কাছে অনেক ধরনের লোকেরা আসত, তারাও খাবার নিয়ে আসত। কখনো কলা, কখনো লজেন্স বা মোয়া। খাবার হাতে দিয়ে মা তাকে পাঠিয়ে দিত বাবুলের মাদের বাড়ি। কখনো কখনো সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ত সে। একদিন হঠাৎ কি হলো! মা মরে গেল। মায়ের পা বেয়ে নামা রক্তের ধারার কথা এখনও মনে আছে তার। মায়ের কাছে তাকে কেউ যেতে দেয়নি, বাবুলের মা টেনে নিয়ে গিয়েছিল দূরে। মনে পরে, তারপরে একবার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দলবেঁধে ভিক্ষা করার সময় গাড়ির কাচ নামিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে তার হাতে একটা আধখাওয়া দামী চকলেট দিয়েছিল। সেদিনের সেই খুশির মত খুশি জীবনে আর কোনকিছুই তাকে দিতে পারবেনা। আজ হয়ত সে তার চেয়েও বেশি খুশি হতে পারত। কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কি!
কিছু সময় ওদের যাওয়ার রাস্তার দিকে তাকিয়ে দরজা চাপিয়ে পুকুরঘাটে চলে যায় সুফিয়া। ওজু সেরে ফেলে, যোহরের ওয়াক্ত প্রায় যায় যায়। ঘরে গিয়ে হাত পা মুছে চৌকির ওপর নামাজে বসে। সালাম ফিরিয়ে মোনাজাতে নামাজ শেষ হলে মছলার কোণা গুটিয়ে তার ওপরেই বসে থাকে। হাসিকে চেনে সে, হ্যা। দেখেনি কোনদিন, কিন্তু নাম শুনেছে। হাসির মা ছিল এ গ্রামের জোতদার ফিরোজ মিয়ার ছয় নম্বর বউ। সেকালে টাকাওয়ালা লোকেদের ঘরে এমন অহরহ দেখা যেত। তবে চার বউয়ের পর আর বিয়ে থাকলে বাকি বউদের সন্তানরা স্বীকৃতি পেতনা। তাই হাসি ওই বাড়িতে কাজের লোকের মতই থাকত। শোনা যায় হাসি নাকি বেশ সুন্দরী ছিল, অভিজাত চেহারা, শ্যাম গায়ের রঙ। একসময় গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল হাসি সন্তানসম্ভবা, তারপরে আর হাসিকে কেউ গ্রামে দেখেনি। হাসি কোথায় চলে গেল, কেউ খোঁজও নেয়নি।
মায়মুনার বাবার সাথে বিয়ে যখন হলো, তখন সুফিয়াই ছিল গ্রামের একমাত্র বউ যাকে কিনা ভীনগাঁ থেকে আনা হয়েছিল। বিয়ের পর সুফিয়ার পরপর তিনটি সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। তাবিজ কবজ পানিপড়া থেকে শুরু করে কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছিলোনা, একদিন মায়মুনার বাবা তাকে একান্তে ডেকে বলে হাসির কথা। মেয়েটা নাকি খুব ভালো ছিল। ছোটবেলা থেকেই তাদের জানাশোনা ছিল। ভালোবাসার কথা সেই বলেছিল হাসিকে। হাসি প্রথমে রাজি হয়নি , কিন্তু ধীরে ধীরে দুজনের সম্পর্ক গভীর হয়। হাসির পেটে যখন সন্তান আসে, তখন মায়মুনার বাবা খুব ভয় পেয়ে যায়। এই মেয়ে বিয়ে করলে বাপ ত্যাজ্য করবে, গ্রামে মুখ দেখাতে পারবেনা। প্রথম কয়েকমাস হাসি ঝুটমুট মাসিকের কাপড় ধুয়ে রোদে দেয়ার ভাণ করত যাতে ধরা পরে না যায়, জানাজানি হয়ে না যায়। তারপর পেট বের হতে শুরু করলে হাসির পক্ষে আর গোপন রাখা সম্ভব হলনা। মায়মুনার বাবা তখন ভয়ে শহরে পালিয়ে যায়। হাসি অনেকদিন অপেক্ষা করে, তারপর আশেপাশের মানুষের প্রশ্নের মুখে হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে সুফিয়া এই কাহিনি শুনেছিল, তার বুকের সেদিনের উথাল-পাথাল কেউ দেখেনি। চোখের পানি যেন শক্ত পাথরের দলা হয়ে আটকে ছিল গলার কাছটায়। মায়মুনার বাবা বলেছিল, তার মনে হচ্ছিল তার ওই পাপের কারণেই তাদের বাচ্চাগুলো পৃথিবীর মুখ দেখতে পারছেনা। তার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে সুফিয়া কোন মন্তব্যই করেনি, কিছু বলার মত অবস্থাতেই সে ছিলনা। শুধু বলেছে সবকিছু স্বীকার করে মৌলভি ডেকে তওবা করে নিতে। আশ্চর্যজনকভাবে, তার পরের সন্তানটি বেঁচে যায়। সুফিয়ার কোলজুড়ে আসে মায়মুনা, মায়মুনার বাবার খুশি সেদিন দেখার মত ছিল। কিন্তু মায়মুনার বাবাকে মনে মনে সে কোনদিন ক্ষমা করেনি। যদিও তারপরে আর কোনদিন হাসির প্রসঙ্গ তোলেনি সুফিয়া। তার আর কিছু বলার না উপায় ছিল, না প্রয়োজন। সত্য কাঁটার মতন, তাই বলে তাকে বিঁধিয়ে বেড়াতে নেই। আজ কোথা থেকে এই পুরনো ক্ষত জেগে উঠল সে নিজেও জানেনা। হাসিকে সে দেখেনি কোনদিন, তার প্রতি কোন সহানুভূতি সে অনুভব করেনা, সে যাদের দেখেছে শুধু তাদেরই ভালোবাসতে জানে, বাকিদের মুখ রাখা তার জন্য অবান্তর। দরজায় শব্দ হচ্ছে, ওই বুঝি টুনু ফিরল…।
দিলশাদ চৌধুরী
জন্ম ১৯৯৯ সালের ২৭ এপ্রিল, বরিশালে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছেন বরিশালেই। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগে সম্মান তৃতীয় বর্ষে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের চাবিকাঠির সন্ধান পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। কাজ করছেন অণুগল্প, ছোটগল্প এবং অনুবাদ নিয়ে।