লিচু গাছের কান্ড শক্ত, পাতারা মুচমুচে। নিধি অন্যমনস্ক হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ডাল ধরে টেনে এনে আঙ্গুলে ডলে পাতা গুড়িয়ে দেয়। কিষাণদের কারো ফেলে যাওয়া কাঁচির ধারালো মাথা দিয়ে গাছের গোড়ায় বসে নাম লেখে সে- “বীণা”।
এক, দুই, তিন কতগুলো গাছের দেহে উল্কির মত বসে যায় সেই নাম, যেন গাছগুলির মালিক তার মা, যেন গাছেরাও চারদিকে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। মথুরাপুরে তাদের বাসাটা আচমকা খুব জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে চলে আসে।
লিচু বাগানে ভেতরের দিকে একলা যাওয়ার অনুমতি নেই নিধির, দাদুর কড়া নির্দেশ। কখনো কখনো গাছের গোড়ায় ঠায় বসে থেকে শোনে দাদি তার খাটে বসে তাকে ডাকছে- খেতে ডাকছে, গা ধুতে ডাকছে। না শোনার ভান করে গোজ হয়ে বসে থাকে নিধি। কানে তুলো গুজতে পারলে ভালো হতো। মা’র প্রসঙ্গ আনলে দাদির ওপর ভয়াবহ রাগ হয় নিধির (বুড়িও পণ করেছে নিধি’র কাছ থেকে গুপ্ত কিছু শুনবে! যেন কতকিছু জানে নিধি!)।
বসে বসে লিচু গাছের গোড়ায় ভ্রমণরত পিঁপড়াদের নিজের পায়ের দিকে টেনে টেনে আনে। রোদ ক্রমশ তেতে ওঠে যখন পিঁপড়াগুলি কামড় দিয়ে ওর পায়ের পাতা লাল করে দেয়। মধ্যমা আর কড়ে আঙ্গুল ফুলে উঠলেও সে নড়ে না। তেতে ওঠা রোদের ভেতর দিয়ে দু-একটা কাকের তারস্বরে ডাক পেড়ে যাওয়া শুনতে শুনতে বসে থাকে, বসেই থাকে।
আজ থেকে ঠিক তিন মাস আগে তার মা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। নিধি যে দিন গুনছে তা বোধহয় কেউ অনুমান করতে চায় না। এই তিন মাসে মায়ের চেহারা একবারের জন্যও তার পরিস্কার মনে পড়েনি, তুমুল বৃষ্টিতে ফটো ভিজে গেলে যেমন অস্পষ্ট তেমন করে ভেসেছে মায়ের মুখ। অথচ অন্য কতকিছু মনে আছে!
ঐ যে তার জামার বোতাম ভুল রং সূতা দিয়ে সেলাই করে দিলো মা, সেই বোতামটা চরকির মত কতবার চোখের সামনে ঘুরে গেছে। তারপর যেদিন পাটগুদামের চাতালে দৌড়াতে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেললো। মা যতই তুলা চেপে চেপে ডেটল দিচ্ছে আর ততই চামড়া ফুঁড়ে বুদবুদের মত রক্ত বেরিয়ে আসছে। মায়ের উদ্গত কান্না চাপা চোখ দেখে নিধির মায়া লেগেছিল। দু’দিন বাদে হাঁটুর ক্ষতটা একদম ভালো হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এখন এই লিচু বাগানে বসে আবার সেই জ্বলুনিসমেত ব্যথা ফিরে আসে, হাঁটুটা অকারণে হাতায় নিধি, নিশ্চিত হতে চায় ব্যথা কি সত্যিই সেরে গেছে!
নিধির মা’কে লাল চেক চেক কম্বলে মুড়িয়ে সরকারী হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, আবেদা বলেছে। একটা রিক্সা পাওয়া গিয়েছিল তৎক্ষনাৎ, খুব বেশী দেরী হয়নি। তাও নাকি হাসপাতালের ডাক্তার কম্বল সরিয়ে আফসোস করেছিল- ‘এত দেরী করলেন নিয়া আসতে!’
আবেদা জানলো কি করে এত কথা!
সে তো কখনো মজনুর কথা বলে না (কেউ কি জানতে চায়!)
মজনুকে কার কাছে সোপর্দ করে দিয়ে আলো অন্ধকারে ছাওয়া বন উপবন খোলা প্রান্তর পার হয়ে সে ভোমরাদহে চলে এলো!
দাদুর উস্কোখুস্কো চুলের সঙ্গে তারা যখন সোজা ভোমরাদহের ট্রেন ধরলো, আবেদা তখনো নিধিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। আর নিধির জ্বর মাপার জন্য দাদু ষ্টেশনের আশপাশে ফার্মেসীর খোঁজ করছিলো, না হলে চায়ের দোকানে নিদেনপক্ষে প্যারাসিটামলও যদি পাওয়া যায়।
আবেদার নিভু নিভু অনুরোধ- চলেন হসপিটালত যাই, মেয়াটা ওর মাকে দেইখবার চাচ্ছে’- পাত্তা পায় না দাদুর কাছে (অনুচ্চারিত অনুরোধে আবেদা নিশ্চয়ই মজনুকেও দেখতে চাইছিল!)
-‘ও এখনো একটা দুধের শিশু, এইসব কি দেখবে?’ – দাদু হিসহিসিয়ে উঠলে আবেদা চুপ করে গেছে।
নিধি আধোঘুম, আধো জাগরণে জ্বরের মধ্যে ট্রেনের দুলুনিতে ভোমরাদহ চলেছে, ট্রেনের শব্দ বদলে গেলে বুঝেছে এখন নদীর ওপর ব্রীজ পার হচ্ছে তারা, আবার নুড়ি উড়ে জানালায় পড়ার শব্দে বুঝেছে লাইনের ওপর গুড়ো পাথর ছিটিয়ে রেখে গেছে রেলকর্মচারীরা। বেশীক্ষণ লাগেনি মথুরাপুর থেকে ভোমরাদহে পৌঁছতে, বড়জোর চার ঘন্টা। অথচ বাড়ির আঙ্গিনায় পা দিয়ে নিধির মনে হয় তাদের বাসার সঙ্গে এ বাড়ীর নিযুত-লক্ষ পার্থক্য।
মনে হয় গতকালের সঙ্গে আজকেরও সহস্র যোজন দূরত্ব।
আগুন লাগার আগেরদিন পাটগুদামের রোজকার শোরগোল থেমে গেলে তিন কামরার মাঝারী বাসা শুনশান শান্ত ছিল। বারান্দা ঘেষে নিধি আর তার মায়ের লাগানো টাইম ফুলের গাঢ় গোলাপী ফুলগুলিও তখন বিমর্ষ ঠেকেছিল। পাশে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা লজ্জাবতীর নিদ্রাতুর পাতা। নিধি বারান্দায় বসে পাঁচগুটি খেলেছিল। দু’পা ছড়িয়ে পথ কুড়ানি ভাঙ্গা পাথর দিয়ে এই খেলাটা সে সদ্য শিখেছে আবেদার কাছ থেকে। আবেদা কোমরে আঁচল গুজে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে, একটু পরে নিধিকে নিয়ে এক্কা দোক্কার ঘর কাটবে।
মা একটা পাটভাঙ্গা শাড়ি আধপরা করে তাকে ডাক দিলে ঝাড়ু ফেলে সে দৌড়ে আসে। মায়ের চুল বাঁধা হয়ে গেছে, একটা লাল-কালো টিপ কুচফলের মত কপালে জ্বল জ্বল করছে, তার লাল শালের গায়েও কালো কালো বুটি। আবেদা তার শাড়ির কুচি ঠিক করে দৌড়ে মজনুকে ডেকে আনতে যায়।
আজকে মা একা একা বাইরে যাবে বাবা দু’দিনের জন্য তেতুলিয়া গেছে, পাটক্রয় সংক্রান্ত কোন জটিলতার মীমাংসা করতে।
জীবনের অভিজ্ঞতা বিষয়ে, বিশেষ করে নারী সৌন্দর্য সম্পর্কে নিধির এ যাবৎ দু’রকমের সঞ্চয়, যা মা’কে ঘিরে আর আবেদাকে নিয়ে সে দেখেছে। মা যখন হেঁটে গিয়ে এক পা’য়ে আলতো লাফ দিয়ে রিক্সায় উঠে বসে, তখন কোন পুরুষলোক তাকে দেখলে সে লোকটার মুখাবয়ব কোমল হয়ে আসে। আর যৌবনবতী আবেদাকে দেখলেও তাদের ভালো লাগে কিন্তু মুখের ভাবে মনে হবে খামচে দিতে ইচ্ছে করছে। তার শক্ত কালো ত্বক, ঝাঁট দেয়ার ভঙ্গীতে উদ্ভিন্ন নিতম্বে গোপনে একটা নখরের আঁচড় না দিতে পারলে তাদের মন শান্ত হয় না।
বড় হয়ে নিধি দেখেছে রূপের দিকে মানুষের আবর্তিত হওয়ার তেমন রদ বদল হয়নি, যেখানে পতঙ্গের মত উড়ে যেতে পারে না মানুষ, সেখানে স্থাণু হয়ে থেকেও তাদের মুখের কোমল, কঠিন পেশী আবিস্কার করে আর হতবাক হয়নি সে।
তো, মা’র ফিরতে বোধহয় সেদিন সন্ধ্যা হয়েছিল, নিধি জানতে চায়নি মা কোথায় যাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ একা বেরিয়ে যাওয়ার বেপরোয়া ভাব মা’কে নিধির উপস্থিতির ভার থেকে কিছুটা বিরতি দিতো (নিধি মা’কে ছাড়া এক দন্ড থাকতে পারে না)। বিষয়াদি এমন সহজ করে বোঝার ক্ষমতা তো আর তার ছিল না, জানতে না চাওয়ার কারণ- তারও আগেরদিন সে মা’র ওপর বেজায় অভিমান করেছিল। এক্কা দোক্কা আর পাঁচগুটি খেলে এক থেকে দশ গোনা শিখে যাওয়ার উত্তেজনা মার কাছে না পৌছে দিয়ে অভিমানের ওপরে আরেকপ্রস্থ ইচ্ছের বালাপোশ চাপিয়ে
বসেছিল নিধি। মনে মনে অপেক্ষা করেছিল, মা ডাকবে। আদর করে হাতি রাজকুমারের বই থেকে পড়ে শোনাবে। কিন্তু তার বদলে তাকে ধমক দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে বের হয়ে গেলো!
দুপুরে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন নিয়ে উঠে দেখেছে সে একা।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।