জামাল পুলিশের মেজাজ আজ ভাল নেই।
গতরাতে এক আসামিকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ধরতে পারেনি। একেবারে নিজের বোকামি, এমন বোকামি! —কাউকে বলার মতও না। খুবই নিরীহ ভদ্রলোকের মত বাড়ির বাইরে এসে ওদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল সেই আসামি, তারপর কথাবার্তার ফাঁকে যখন ভেতরে গেল মোবাইল আনতে ঘুণাক্ষরেও ধারণা হয়নি আর ফিরবে না কিন্তু তাই হল, লাপাত্তা হয়ে গেল। তল্লাট চষেও আর পাওয়া গেল না। হতাশ মনে মেসে ফিরতে রাত কাবার। ভোর ৬টা থেকে ডিউটি। কাজেই চোখ বুজতে না বুজতেই আবার উঠে পড়তে হল তাকে। পুলিশের পোশাক পরে মালখানা থেকে অস্ত্র নিয়ে ঘাড়ে ঝুলিয়ে যখন সে থানার বারান্দায় এসে দাঁড়াল তখন তার সামনের সমস্ত জগৎ নদীর ঢেউয়ের মত দুলছে। সে নিজেও যেন দুলে দুলে উঠছে সেই সাথে।
থানার পাশ দিয়ে ছোটো একটা রাস্তা অল্প একটু যেয়ে মিশেছে হাইওয়ের সাথে। সেই সংযোগের একপাশে একটা নবীন বটগাছ ইচ্ছেমতো ডালপালা মেলে বেশ জাঁকিয়ে উঠেছে, অন্যপাশে একটা চায়ের দোকান, মুদি আর মনোহারীর দোকান কয়েকটা।
ওসি সাহেবের কাছে কিভাবে গতরাতের ঘটনাটা রিপোর্ট করা যায় এই ভাবনায় মগ্ন হয়ে টলোমলো পায়ে জামালপুলিশ এগিয়ে গেল চায়ের দোকানের দিকে। চায়ের দোকানে তখন ভিড়। তারপরও জামালপুলিশের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে একটু যেন থমকে গেল দোকানদার। সে দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে দোকানের ভেতরে পা বাড়াল জামালপুলিশ। ঘুপচি দোকান। ভেতরে মাত্র কয়েকটা বেঞ্চ। বেঞ্চে পা তুলে দিয়ে কেউ চা খায়, কেউ আসন করে বসে আড্ডা দেয়। জামালপুলিশকে ঢুকতে দেখে ভেতরের সবাই একটু তৎপর হয়ে তাকে সম্মান দেখাল আর তখন এক পাশ থেকে লাফ মেরে দাঁড়াল দেলোয়ার, —আরে গুরু—!
দেলোয়ারের বয়স ২৫/৩০ এর মধ্যে হবে। থানার আশেপাশেই তার সারাদিন কাটে। থানার স্টাফদের সাথে তার বন্ধুর মত সম্পর্ক আর এই সম্পর্ক রাখাটাই যেন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। লাভ দু’পক্ষেরই হয়, থানার স্টাফদের যেমন, তারও তেমন। কথাবার্তায় সে চৌকশ। পোশাক-পরিচ্ছদও মার্জিত। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, সময় বিশেষে মাথার চুলগুলো সে এমন ভাবে ঝাঁকায়, সেটা যেন তার কথায় নতুন মাত্রা দেয়।
জামালপুলিশের হাত ধরে সে নিজের পাশে বসায় তারপর চায়ের অর্ডার দেয়।
ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে ঘর। বিশাল এক ডেকচিতে দুধ ফোটানো হচ্ছে। সেখান থেকে উঠে আসছে সাদা বাষ্প। দুধের মিষ্টি আঁঠাল গন্ধ চুলোর ধোঁয়ার সাথে মিশে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরময়। ধুমোটা থামা নারে বাপ —দোকানদারের উদ্দেশ্যে এই কথা বলে দেলোয়ার জামালপুলিশের দিকে একটু ঝুঁকল, —কাল রাতে গফুররে ধরতি গিয়েলেন ? ও শালা বিরাট কাউটা। জামালপুলিশ কিছু বলার আগেই সে বলল,—আমারে কতেন, সাপ ধরার মত খপ করে ধরে দিতাম।
তুই জানলি কি করে?
আহ্, —দেলোয়ার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথার চুলগুলো ঝাঁকিয়ে পেছনে সরাল, –আমি জানব না! বিশ্বাস তো করেন না, এই থানার কোথায় কখন কি হচ্ছে সব খবর আমার কাছে পাবেন।
গফুরকে চিনিস?
চিনিনে! আবার মাথার চুলগুলো ঝাঁকাল দেলোয়ার। –চিনি মানে কি? ডাক দেবো, যেখানেই থাক, আসতিই হবে।
ডাক তো দেখি। —একটু যেন আশার আলো দেখল জামালপুলিশ।
এক হাতে মাথার চুলগুলো পেছনে সরিয়ে আর এক হাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল দেলোয়ার, গভীর মনোযোগে চোখ ছোট করে কপালে ভাঁজ ফেলে গফুরের নাম্বারে রিঙ করল তারপর উপরের দিকে মুখ তুলে মোবাইলটা কানে চেপে ধরল সাড়ার প্রতীক্ষায়।
নাহ্,—একটু পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,—ধরছে না, গতরাতে হুড়োতাড়া করেছেন তো, শালা এলার্ট হয়ে গেছে।
প্রায় ১০/১২ বছর হয় পুলিশের চাকরি করছে জামাল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢুকেছিল। দোহারা স্বাস্থ্য, লম্বা, আকর্ষণীয় চেহারা, গায়ের রংটাও ফর্সার দিকে। চাকরি নেওয়ার পর জামাল নামটার সাথে পুলিশ শব্দটা এমনভাবে জুড়ে গেছে যে শুধু জামাল নামে এখন আর কেউ তাকে চেনে না, এমনকি বাড়ির লোকরাও না। অন্যদের থেকে সে না হয় একটু সরল, একটু মানবিকও, তাই বলে দেলোয়ারের এ নাটক সে বুঝবে না এমন তো না! ইচ্ছে হল রাইফেলের কুঁদো দিয়ে দু’ঘা বসিয়ে দেয়।
কিন্তু এখন তার মন ভাল নেই।
কেমন এক গোলযোগের শব্দ আসছে বাইরে থেকে। জামালপুলিশ উঠে রাইফেলটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে দোকান থেকে বের হল।
মধ্যবয়স পার হওয়া এক বেহেড মাতাল, বিশাল ভুঁড়ি, লম্বা, স্বাস্থ্যবান, মাথায় এলোমেলো কাঁচাপাকা চুল আর ঝাঁটান গোঁফ, বটতলায় তাকে ঘিরে কিছু উঠতি যুবক মজমা জমিয়েছে। নানাভাবে তারা উত্ত্যক্ত করছে মাতালটাকে আর এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে মাতালটা যাতে মজা পাচ্ছে সবাই, এমনকি মাতালটা নিজেও। জামালপুলিশের মাথায় হাঠাৎ একটা বুদ্ধি এল, এই দিনের শুরুতে মাতালটাকে যদি ওসি সাহেবের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া যায় তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন আর সেই সাথে গত রাতের ব্যর্থতার কথাটাও বলে ফেলা যাবে।
জামালপুলিশ এগিয়ে গেল সেদিকে আর তাকে আসতে দেখে মাতালটাকে ঘিরে থাকা যুবকরা একটু সরে গেল।
তখন টলোমলো পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সেই মাতাল তারপর দুই হাত দিয়ে নিজের বুকরে উপর দু’টো থাবা বসিয়ে বীরদর্পে বলল, –মেরা নাম রুস্তমজী।
গতরাতে যে ভুল করেছিল এবার সে ভুল করবে কেন জামালপুলিশ?
বিনা বাঁধায় রুস্তমজীর দু’হাত পেছনে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল সে।
বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগল রুস্তমজীর। তারপর ভীষণ অবাক হয়ে সে বলল, —আরি, ইয়ে তোম কিয়া করতা, ম্যায় তো জেন্টেলম্যান হ্যায়!
সকালের ক্লান্তি আর চোখজোড়া ঘুম এর মধ্যে উধাও হয়ে গেছে জামালপুলিশের শরীর থেকে। এখন সে পুরোদস্তুর জোয়ান, ঘাড়ের রাইফেলটা নামিয়ে যে কোনো মুহূর্তে গুলি চালিয়ে দিতে পারে।
চল, থানায় চল—।
এতক্ষণে রুস্তমজী টের পেল যে তার হাত দু’টো বাঁধা। বিষাদের ছায়া নেমে এল তার হাস্যোজ্জ্বল মুখে। মনে হল দুর্মর বিপুল মানুষটা যেন মুহূর্তে কলের পুতুল হয়ে গেল। —ঠিক হ্যায় চলিয়ে। নির্বিকারভাবে বলল সে।
হাঁসের মত থপথপ করে পা ফেলছে রুস্তমজী, পেছনে দু’হাত পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা। তার পেছনে দড়ি হাতে জামাল পুলিশ, সর্বশেষ কিছু উৎসুক জনতা।
বটগাছের পাতা ছুঁয়ে রোদ নামছে রাস্তায়। আলো ছায়ার খেলা সেখানে।
হুড়মুড় করে রুস্তমজী কোনো রকম অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ঢুকে পড়ল ওসি সাহেবের রুমে। তিনি তখন আরও দু’জন পুলিশ অফিসারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে শলাপরামর্শ করছিলেন। হঠাৎ তাকে এইভাবে ঢুকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল সবাই। জামালপুলিশ নিজেও যেন কেমন দিশাহীন হয়ে পড়ল। থমথমে হয়ে গেল পরিবেশ আর তখনই বিকট শব্দে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল রুস্তমজী।
এই, কি ব্যাপার! —হতভম্ব জামালপুলিশ চিৎকার করে উঠল, —তোমারে কি মারা হয়েছে নাকি? এই!
কিন্তু তার কথায় কোনো কাজ হল না বরং কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। পরিস্থিতি এমন হল যে নিরুপায় কালক্ষেপণ করা ছাড়া তাদের যেন কিছু করার থাকল না। শেষে বোঝা গেল হাত বাঁধা থাকায় সে যে ওসি সাহেবকে সালাম দিতে পারছে না সেটাই তার কান্নার কারণ।
ওসি সাহেবের নির্দেশে হাত খুলে দেওয়া হল, তখন খুব তমিজের সাথে মাথার উপর ডান হাত তুলে সে বলল, —সেলাম।
জামালপুলিশকে কাছে ডেকে ঘটনা জানতে চাইলেন ওসি সাহেব কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত নেড়ে রুস্তমজী বলল, —হামভি জেন্টেলম্যান আছি, তোমভি জেন্টেলম্যান আছো, দারু তো জেন্টেলম্যান পিয়ে থা, —বলেই সে হো হো শব্দে হেসে উঠল, —ওতো বাচ্চা পুলিশ থা ওসি সাব, কায়সে মালুম হোতা! মাগার আদমি বহুত আচ্ছা হ্যায় স্যার, —তারপর দু’ হাত জড়ো করে ঘাড় নেড়ে অতি বিনয়ের সাথে বলল,—উসকো মাফ কি জিয়ে জনাব।
রুস্তমজীর আচরণ, ভঙ্গি আর আবেদনের বিচিত্র বিষয়ের কারণে পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল। মৃদু একটু হাসির রেখাও যেন ফুটে উঠল ওসি সাহেবের ঠোঁটে, —তোমহারা কাম কিয়া হ্যায়? এসব ক্ষেত্রে ওসি সাহেবের গলা যতটা ভারি হয়ে ওঠে তেমন হল না।
মেরা নাম হ্যায় রুস্তমজী, —আবার নিজের বুকের উপর একটা থাবা বসিয়ে বেশ গর্বের সাথে সে বলল, —দশ চাক্কার ট্রাক হ্যায় না, হাম উসকো ডিরাইভার থা।
রুস্তমজী দুলতে লাগল। বোঝা গেল, দাঁড়িয়ে থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে। জামালপুলিশকে কাছে ডেকে নিচু স্বরে ওসি সাহেব বললেন, —হাসপাতালে নিয়ে যা, ওয়াশ করে ছেড়ে দিবি, মদ খাওয়ার মজা টের পাবে।
হতাশ হল জামালপুলিশ। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, আসামিকে হাজতে রাখা হয়, দেনদরবার চলে, সমঝোতা হলে ছাড়া হয়, না হলে চালান দেওয়া হয় কোর্টে। সমঝোতা হলে জামালপুলিশের একটা ভাগ যে সেখানে থাকত না এমন না। সেসব কিছু না করে ওসি সাহেব যা করলেন সেটা মোটেই প্রত্যাশিত ছিল না জামালপুলিশের। গত রাতের রিপোর্টটাও তার করা হল না। আবার যেন রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করল তার উপর, আবার যেন পরিপার্শ্ব দোলায়মান হয়ে উঠল।
এদিকে থানা থেকে রুস্তমজী বের হল বীরবিক্রমে, আয়েশি কেতায় পা ফেলতে ফেলতে। পাখির ডানার মত হাত দু’টো দুলতে লাগল নিরুদ্বেগ ছন্দে।
বটতলায় এসে পৌঁছতেই মানুষজন ঘিরে ধরল তাকে আর কি যে হল; হাত পা নেড়ে বক্তৃতা দেওয়ার শখ হল তার।
—ওসি সাব, মেরা জিকিরি দোস্ত, বহুত খানদান আদমি।
চল চল বক্তৃতা না, পা চালাও। —চরম বিরক্তি নিয়ে তাগাদা দিল জামালপুলিশ।
আরি! —থমকে দাঁড়াল রুস্তমজী। চোখে মুখে মহা বিস্ময় নিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলল, —ওসি সাব মেরা জিকরি দোস্ত, খানদান আদমি, মাগার ইয়ে মাসুম বাচ্চা কিয়া বলতা হ্যায়?
রুস্তমজীর বলার নাটকীয়তায় হাসির হুল্লোড় উঠল ভিড় করে থাকা দর্শকদের মধ্যে আর হঠাৎ করে অপমানে জর্জরিত হয়ে গেল জামালপুলিশ। হাতের লাঠি ঘুরিয়ে জনতাকে একটু দূরে সরিয়ে দিল সে তারপর প্রচন্ড জোরে লাঠিটা বসিয়ে দিল রুস্তমজীর পিঠে, —শালা মাতাল, হাড় গুঁড়ো করে দেব শুয়োরের বাচ্চা। আমি মাসুম বাচ্চা?
লাঠির আঘাতে রুস্তমজীর সামান্য কোনো প্রতিক্রিয়া হল বলে মনে হল না। হতভম্ব সে জামালপুলিশের দিকে তাকাল, —তোম মেরে মারতা হ্যায়! এই কথা বলে সে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল, —ম্যায় নেহি জাউঙ্গি।
যাবিনে মানে, তোর চোদ্দগুষ্টি যাবে, —সজোরে পিঠে লাথি বসাল জামালপুলিশ।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রুস্তমজী। পায়রার ডিমের মত তার উদ্ভাসিত দু’টো চোখে ভয় কিংবা আতঙ্কের চিহ্ন মাত্র দেখা গেল না। মনে হল বিমল বিস্ময়ে সে যেন স্তম্ভিত হয়ে গেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় বরফ শীতল নীরবতা নেমে এল তাদের ঘিরে থাকা দর্শকদের মধ্যে।
আবার লাঠি উঁচু করল জামালপুলিশ, ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এসে দেলোয়ার তার হাত চেপে ধরল, —গুরু করছেন কি?
দেলোয়ারকে পেয়ে জামালপুলিশ ভরসা পেল কিনা বলা যাবে না তবে হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার অনিচ্ছুক চেষ্টার মধ্যে সে চিৎকার করে উঠল, –শুয়োরের বাচ্চা মাতাল, কি ভেবেছে, আমি ওর হাড় গুঁড়ো করে দলা পাকিয়ে ছাড়ব।
দেলোয়ারকে দেখেই যেনবা জনতা কিছুটা এগিয়ে এল।
গুরু কি করছেন কি? —আবার এই কথা বলল দেলোয়ার , —ওদের ইউনিয়ন খবর পেলে কি হবে ভেবেছেন? এখনই ট্রাক আড় করে দেবে হাইওয়ের উপর, তখন? কি হবে বুঝতি পারছেন?
দেলোয়ারের এই কথায় ক্ষুব্ধ জামালপুলিশের লাঠি ধরা উদ্ধত হাত আস্তে নিচে নেমে এল।
ওদের ঘিরে থাকা জনতার বৃত্তটা ছোট হয়ে এল আরও।
দেলোয়ার ছুটে গেল রুস্তমজীর কাছে, —ওস্তাদজী।
নেহি, কই বাত নেহি, ও লেডকা বাচ্চা পুলিশ মেরে ইনসাল্ট করা, ম্যায় কভি নেহি ছাড়ঙ্গি।
যত সময় যাচ্ছে পরিস্থিতি যে ততই জটিল হয়ে আসছে এটা জামালপুলিশ টের পায়। এখন তার ভরসা দেলোয়ার কিন্তু সেটা প্রকাশ করা মানে যে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়া সেটাও সে বোঝে। ঘাড় থেকে রাইফেলটা নামিয়ে হাতে নিয়ে দৃঢ় পায়ে সে একটু পায়চারি করল। সারা শরীর তার ঘামে ভিজে যাচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘন ঘন ঘাম মুছতে লাগল সে।
একজন দু’জন করে জনতার ভিড় বাড়ছে।
থানায় রিপোর্ট করার উপায় নেই। গতরাতের ব্যর্থতার পর আবার যদি এই ঘটনার কথা বল হয়, ওসি সাহেব কেন; যে কেউ তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এমনকি কোনো ধরনের পানিশমেন্ট যে হবে না সে কথাও বলা যায় না।
এদিকে রুস্তমজীকে নমনীয় করার জন্য বারবার মাথার চুল ঝাঁকিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে দেলোয়ার। রুস্তমজী হা হা শব্দে হাসে আর প্রবলভাবে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে, –নেহি, ও বাচ্চা পুলিশ মেরা খানদান কো ইনসাল্ট করা, মেরা জিকরি দোস্ত ওসি সাবকো ইনসাল্ট করা—।
রিঙ বাজল মোবাইলে। এতক্ষণ পকেটে রাখা মোবাইলের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল জামালপুলিশ। তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা বের করে তার উপর চোখ রাখতেই বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খেল সে, ওসি সাহেব।
এই বটতালায় গ্যাঞ্জাম পাকিয়েছিস কেন?
স্যার!
টাকা চাইছিস?
স্যার, স্যার!
চোপ, –বাজ পড়ার মত শব্দ হল কানের ভেতর। –একঘন্টা সময়, এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে কাজ সেরে থানায় এসে রিপোর্ট করবি।
কোনো রকম কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিল ওসি সাহেব।
কপালের ঘাম গড়িয়ে এসে চোখে ঢুকল জামালপুলিশের আর হঠাৎ করে যেন যন্ত্রণার সুচ ফুটল চোখ দু’টোয়।
গুরু, —দেলোয়ার কাছে এসে অসহায় দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, —কি বলি, বলছে সবার সামনে পায়ে ধরে মাফ চাতি হবে আর মদ এক বোতল। শেষে কি বলি লজ্জাশরম ভুলে আপনার হয়ে মাফ চালাম কিন্তু বোতল না দিলি তো হবে না।
এখনই? —খুব ক্লিষ্ট শোনাল জামালপুলিশের স্বর।
দেলোয়ার ঘাড় নাড়লে জামালপুলিশ পকেটে হাত ঢোকাল মানি ব্যাগ বের করার জন্যে। —কি করেন, কি করেন বলে দেলোয়ার নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে একজনকে দিল বোতল আনতে।
সময় বাড়ছে, বাড়ছে উৎসুক মানুষের ভিড়ও। নিজের গাম্ভীর্য ধরে রাখতে এখন মনোযোগী জামালপুলিশ। ঘাড়ের রাইফেলটা কখনও সে হাতে নিচ্ছে, নাড়াচাড়া করছে আবার ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখছে।
রুস্তমজী মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে নিশ্চুপ। ঘুমের আবেশে তার চোখ বুজে আসছে, মাথা নুয়ে পড়ছে, মুহূর্তেই ঘুমের ঘোর কাটিয়ে মাথা সোজা করে সতর্কতার সাথে সে তাকাচ্ছে আশেপাশে।
কি ঘটতে যাচ্ছে তাই নিয়ে তাদেরকে ঘিরে থাকা জনতার মধ্যে কৌতূহল চরমে। নীরব উত্তেজনায় নিশ্চল সবাই। বটগাছ থেকে দু’টো শুকনো পাতা হেলেদুলে নামল মাটিতে আর একটা কাক তীব্রস্বরে ডেকে উঠল কা কা করে।
বোতল চলে এল। তৎপর হয়ে উঠল জামালপুলিশ। হাতের লাঠি ঘুরিয়ে উৎসুখ জনতাকে সে দূরে সরিয়ে দিল। গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল দর্শকদের মধ্যে।
বোতলটা হাতে পেয়ে যেন নতুনভাবে জেগে উঠল রুস্তমজী। বিজয়ের আনন্দে হা হা করে হেসে উঠল তারপর জনতার উদ্দেশে বোতলটা উঁচু করে ধরে নাড়তে লাগল।
জনতাও হাততালি দিয়ে উৎসাহ জোগাল তাকে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে কয়েক ঢোকেই বোতলটা শেষ করল রুস্তমজী। তারপর দেলোয়ার আর জামালপুলিশের দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিল। তারা তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলে এক হাত দিয়ে জামালপুলিশের গলা জড়িয়ে ধরল সে। আর এক হাত দর্শকদের উদ্দেশে উঁচু করে বলল, —ইয়ে বহুত বড়িয়া আদমি হ্যায়, দিলদার আদমি, মেরে বাচ্চা দোস্ত, —বলেই শরীর কাঁপিয়ে হা হা শব্দে হেসে উঠল।
হাসপাতালের পথে জামালপুলিশের ঘাড়ে হাত রেখে এলোমেলো পা ফেলল রুস্তমজী।
উপজেলা হাসপাতালে তখনও লোকজন তেমন আসেনি। ডাক্তারের সহকারি সবে অফিস গুছিয়ে বসেছে। এমন সময় পুলিশসহ বিশাল আকৃতির রুস্তমজীকে আসতে দেখে সে একটু তটস্থ হল।
ডাক্তার আসেনি এখনও তাড়াতাড়ি কল দেন।
জামালপুলিশ তো এখন পুলিশ, ঘাড়ে অস্ত্র। তার কথার তাড়নায় পকেট থেকে মোবাইল বের করে ডাক্তারের কাছে কল দিল সহকারি। বিশেষ খাতিরে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে বসাল তাদের।
অস্ত্রটা টেবিলে রেখে চেয়ারে বসল জামালপুলিশ। এতক্ষণের কর্মকান্ডে বিধ্বস্ত তার শরীর, ক্লান্তিতে মাথাটা নুয়ে পড়ল টেবিলের উপর। রোগী দেখার বেডে পা ঝুলিয়ে বসল রুস্তমজী। ক্লান্ত সেও। দুই কাঁধের মাঝখানে তার মাথাটা ঝুলে পড়েছে পাকা বেলের মত। কিসের ঘোরে মাঝে মাঝে দুলে উঠছে সেটা।
উপজেলা ডাক্তারের নাম সামসুল আলম। অল্প বয়স, কর্মঠ। তার বন্ধু সহকর্মীরা যখন টাকা আর নাম কেনার নানা ফন্দ ফিকিরে ব্যস্ত, তিনি তখন জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে নিঃস্বার্থ আর যথাসাধ্য নিবেদিত। তার মেজাজ চড়া, রুক্ষও কিন্তু আন্তরিক সদিচ্ছার কারণে ইতিমধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয়, অনেকের ঈর্ষারও কারণ।
সহকারীর ফোন পেয়ে দ্রুত তিনি এলেন হাসপাতালে, নিজের চেম্বারে অভ্যাগতদের অবস্থা দেখে অবাকই হলেন।
চেয়ার টেনে বসলেন তিনি আর সেই চেয়ার টানার শব্দে টেবিল থেকে মাথা তুলল জামালপুলিশ।
ওকে ওয়াশ করে দিন। —ঘুমচোখে রুস্তমজীকে দেখিয়ে বলল জামালপুলিশ।
মানে? —মেজাজ চড়ে গেল ডাক্তারের। —কি করতে হবে না হবে সেটা তো আমার ব্যাপার, উনার সমস্যাটা কি বলেন।
জামালপুলিশ নড়েচড়ে বসল। টেবিলের উপর থেকে অস্ত্রটা হাতে নিল তারপর ভারি গলায় বলল, —ওসি স্যার বলেছে ওয়াশ করে দিতে।
ওসি সাহেব ডাক্তার নাকি? —উত্তেজনা বেড়ে গেল ডাক্তারের। —এতই যদি ইচ্ছে হয় অন্য কোথাও নিয়ে যান, আমি লিখে দিচ্ছি, সেখানে যা মনে চায় করবেন।
ধৈর্য্য হারাল জামালপুলিশ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওসি সাহেবকে ধরল। —স্যার ডাক্তার তো ওয়াশ করতে চাচ্ছে না, আরও সব উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলছে, বলছে ওসি সাহেব ডাক্তার নাকি?
তাই! ডাক্তারকে দে।
জামালপুলিশ ফোনটা ডাক্তারকে দিলে ওসি সাহেব খুব সৌজন্যের সাথে বললেন, —স্লামালেকুম, ভাল আছেন?
ওসি সাহেবের এই বিনয় আর আদবে ডাক্তারের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। —ভাল আছি, আপনি ভাল তো?
একজন মাতালকে পাঠিয়েছিলাম ওয়াশ করানর জন্য। বোঝেন তো !
তাতো বুঝি, —শক্তভাবে ডাক্তার বলল, —ওয়াশ করা বললেই তো আর করা যায় না, নানা রকম ইনভেসটিগেশন আছে , রুলস আছে, তাছাড়া ডিসিশনটাতো আমাদের।
ও আচ্ছা,—ওসি সাহেবের গলাটা একটু ভারি শোনাল, —আপনি এখানে কতদিন এসেছেন?
তা মাস তিনেক হবে।
আমি কে বলছি বোঝেন ? হঠাৎ ওসি সাহেবের গলা এমন ভারি আর কর্কশ হয়ে গেল, মনে হল কানের মধ্যে কোনো শব্দ না, গরম সীসার গোলা আছড়ে পড়তে লাগল। —আমি যা বলছি তাই করবেন। তা না হলে ঘাড় ধরে আপনার মত ডাক্তার লকারে পুরতে আমার সময় লাগবে না। —ফোন কেটে দিল ওসি সাহেব।
অপমান ক্ষোভে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল ডাক্তারের। চারিদিকের দৃশ্যমান জগৎ অন্ধকারে ছেঁয়ে যাচ্ছে যেন। এক ধাক্কায় চেয়ারটা পেছনে ঠেলে ঝড়ের বেগে তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
এসবের কিছুই বুঝে উঠতে পারল না জামালপুলিশ। কেন যেন রাইফেলটা সে হাতে নিল। চেম্বার খুলে গুলিগুলো ছড়িয়ে দিল টেবিলের উপর, গুনে গুনে সেগুলো আবার চেম্বারে ভরে লোড করল তারপর রাইফেলটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে বাইরে এল।
ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বারান্দায় কয়েক পা হাঁটল জামালপুলিশ। রোদ বেশ চড়েছে, ঘরের ভেতরে থাকায় এতক্ষণ টের পাওয়া যায় নি। হাসপাতালে রোগীর ভিড়ও বেড়েছে।
সে ডাক্তারের সহকারীর রুমে গেল। নানা লোকের ভিড়ে সহকারী তখন মহা ব্যস্ত। ভিড়ের ভেতর থেকেই সে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, –কি হল, ডাক্তার গেল কোথায়?
ও, —ত্বরিৎগতিতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সহকারী তারপর ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে বলল, —আপনার পেশেন্ট কোথায়?
ওরা দু’জনে ডাক্তারের চেম্বারে এল। রোগী দেখার বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে রুস্তমজী তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। তার নাসারন্ধ্রের বিকট শব্দে মনে হচ্ছে সমস্ত হাসপাতালটাই যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
পাভেল চৌধুরী
যশোর শহরে জন্ম ১৯৫৭ সালে, বেড়ে ওঠাও যশোরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। অতঃপর শহীদ মশিয়ূর রহমান কলেজ, ঝিকরগাছা, যশোর-এর অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১৮ সালে। ১৯৮২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। লেখালিখির সংখ্যা খুবই কম, প্রকাশনার সংখ্যা আরও কম। ২০১৭ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘চলে যাচ্ছি’ প্রকাশিত হয়। ছোট গল্প ছাড়াও প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখায় আগ্রহী।