লুৎফুল হোসেন
পহেলা বৈশাখ বলতে বিশ্বব্যাপী বাঙালির চোখে আজ ভেসে ওঠে বর্ণিল মঙ্গল শোভাযাত্রা ও জনসমাগমে আনন্দ উদ্বেল উৎসবমুখর চারুকলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, শহিদ মিনার, শাহবাগ, রমনা বটমূলকে ঘিরে বিপুল উদযাপন যজ্ঞের এক ছবি। গোটা দেশে এ উদযাপনের ঢেউ ছড়িয়েছে দিনে দিনে। বাঙালির ঘরে ঘরে লালিত পরবটিই আজ বিশ্বনন্দিত কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বর্ণময় উৎসব।
আমাদের গর্বের বিষয় যে, বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ‘স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ক আন্তরাষ্ট্রীয় কমিটি’ (ইন্টার গভর্নমেন্টাল কমিটি অন ইনট্যানজিবল হেরিটেজ) তার একাদশতম সভায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির ঐতিহ্যের উৎসবটিকে বৈশ্বিক এই স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রতিটি অর্জন কিংবা মাইলফলক ঘটনা ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবার পেছনে কোনো না কোনো বেদনা ও ত্যাগের সম্পৃক্তি থাকেই। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের পেছনের ইতিহাসে রয়েছে এমন ত্যাগ-তিতিক্ষার একাধিক পর্ব।
নব্বুইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সাংস্কৃতিক অঙ্গন তখন একে একে নিচ্ছিল নানান উদ্যোগ। উদ্দেশ্য জনমানুষকে বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও চেতনায় নিবিড়মনষ্ক ও উজ্জীবিত রাখা। এমন প্রচেষ্টার সূত্র ধরে রাজনীতির মঞ্চে যেমন ক্রিয়াশীল হয়েছে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। তেমনি জন্ম হয়েছে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’ ও ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’-এর মতো সার্বজনীন সম্পৃক্ততার নানান মঞ্চ ও সংগঠন। এমন উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯ সালে চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীরা জনতার উৎসবের আঙ্গিকে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। আবহমান বাংলার অতীত জুড়ে বৈশাখী মেলায় পসার বসতো যেসব মাটির কাঠের বাঁশের খেলনা, মুখোশ এসব থেকে উপকরণ তুলে এনে আঁধার ও অপকে সরিয়ে আলো ও সূর্যোদয়ের উন্মেষকে তুলে ধরার প্রয়াসে বিবিধ কারুপণ্যের সাযুজ্যে অনেকগুলো বিশালাকার নির্মাণ এর বিশেষত্ব হিসেবে নজর কাড়ে সবার। সেই থেকে শুরু হয়ে বাঙালি জাতিসত্তার সাথে সম্পৃক্তি ঘিরে এর রঙ-বর্ণ ও ব্যাপ্তি ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
নব্বুইয়ের গণ-আন্দোলনের নিকট অতীত থেকে দূর অতীতের দিকে যদি তাকাই তবে আমাদের ফিরে যেতে হবে ’৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থানের পূর্ববর্তী সময়টাতে। বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষাকে দাবিয়ে রাখবার অনায্য চেষ্টা হিসেবে বায়ান্নের উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার জের ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক ও নিপীড়ক গোষ্ঠী কর্তৃক রবীন্দ্র সংগীত চর্চা কিংবা বৈশাখ উদযাপন রহিত করবার অপচেষ্টা ঠেকাতে বাংলা ১৩৭২ অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৬৫ সালে ‘ছায়ানট’ রমনা বটমূলে রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ’ গেয়ে ঘটা করে বাংলা নববর্ষকে বরণ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই থেকে বছরের প্রথম দিনের এই আয়োজন বাঙালি সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে প্রাণের স্পন্দন হয়ে।
পৃথিবীর দেশে দেশে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আপন ভাষা, কৃষ্টি, জাতিসত্তা ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখবার প্রচেষ্টাকে ঘিরে ঐতিহ্যের ইতিহাসে এভাবেই একে একে যুক্ত হয়েছে বিবিধ গণসম্পৃক্তির অনুষ্ঠান, পালা-পার্বন। ঘরে ঘরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সময়ের আবর্তে দেশ জুড়ে ব্যাপ্তি পেয়েছে গণ উদযাপনের আঙ্গিকে। অবশ্য আজ আমরা একে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করলেও এর সূত্রপাত হয়েছিল চৈত্র সংক্রান্তি পালনের ভিতর দিয়ে। আজও বৈসাবি, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক এসব নানা নামে এখনও চৈত্র সংক্রান্তি পালন করা হয় এদেশের বিভিন্ন স্থানে।
সর্বসাধারণ সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে ‘পহেলা বৈশাখ’ বা ‘বাংলা নববর্ষ’ পালন করা শুরু হয় জানলেও প্রকৃতপক্ষে এর শুরু তারও বহুকাল আগে থেকে। দূর অতীতে ভারতবর্ষের আসাম, বাংলা (বঙ্গ), কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরায় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সৌর বৎসরের প্রথম দিনটি পালিত হতো। সৌর বৎসর শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। প্রকৃতি নির্ভর কৃষিকাজ করে মানুষের জীবন চলতো ঋতুর হিসাবের সাথে তাল মিলিয়ে। তখন উৎসবটির নাম ছিল ‘আর্তব উৎসব’। সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কের আমল থেকে বাংলা বৎসরের চল থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ভারতবর্ষ মুসলিম শাসনের অধীনে চলে গেলে হিজরী পঞ্জিকা বৎসরের অনুরূপ চন্দ্র বৎসরের চল হয়।
কৃষিনির্ভর সমাজে আয়ের উৎসের সাথে ঋতুর একটা সরাসরি সম্পর্ক ছিল। চন্দ্র বৎসরের প্রচলন ফসল ও মানুষের আয়ের সাথে তাল মিলিয়ে না চলায় বছর শেষে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায়ের পরিমাণ কমে আসে। খাজনা আদায়ের উপর প্রভাব এবং সৌর বৎসরের সাথে ফসলী বছরের সমিল সুবিধা বিবেচনায় মুঘল সম্রাট আকবর রাজদরবারের জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে নির্দেশ দেন সৌর বৎসরের প্রচলন চালু করতে প্রচলিত পঞ্জিকায় পরিবর্তন আনতে। সৌর ও চন্দ্র বৎসরের হিসাবের সম্মিলনে নতুন বাংলা সনের আনুষ্ঠানিক গণনা শুরু হয় আকবরের শাসনামলের ২৯ তম বৎসর থেকে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে। যদিও নতুন বাংলা বৎসরের গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা শুরু হয় আকবরের শাসনামলের প্রথম দিকে ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সে সময় এর পরিচিতি ছিল ফসলী সন হিসেবে। শুরুতে বলা হতো ‘তারিখ-এ-এলাহী’। পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ হিসেবে এর পরিচিতি গড়ে ওঠে।
নতুন বর্ষপঞ্জী অনুসারে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে প্রজাদেরকে সকল খাজনা, মাশুল বা শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। সমস্ত পাওনা আদায় শেষে চৈত্রের শেষ দিনের পরদিন, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূস্বামী বা জমিদাররা নিজ এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টি খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতো। এইদিন পুরনো হিসাব চুকিয়ে নতুন হিসাবের ‘হালখাতা’ খুলতো সকল খাজনাপ্রদায়ী দোকান-পাট ও ব্যবসা বানিজ্য। সে সময় এই দিনটিকে বলা হতো হালখাতা উৎসব। চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে পুরনো বকেয়া আদায় শেষে ও খাজনা দেয়া শেষে পরদিন প্রজা, রাইয়ত বা ক্রেতাদের আপ্যায়ন করার ভিতর দিয়ে সম্পর্ক জোরদারের একটা বিপণনী উদ্যোগ ছিল।
৩১ চন্দ্র বৎসর সমান ৩০ সৌর বৎসর। এই হিসাবে চন্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১ বা ১২ দিন কম হওয়ায় ফসলি হিসাবের সাথে ক্রমশ অধিকতর গড়মিলের হিসাব এখানেই শেষ নয়। অধিবর্ষের কারণে নতুন বাংলা সনের সাথে ৪ বৎসর অন্তর অন্তর ১ দিন করে গড়মিল বাড়তে থাকার একটা জটিলতা থেকেই গিয়েছিল। ১৯৬৬ সালে ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বাংলা বৎসরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনে বাকি মাসগুলো ৩০ দিনে এবং অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩২১ দিনে হবে এই রীতি প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে গ্রেগরীয় দিনপঞ্জির সাথে বাংলা দিনপঞ্জির সমন্বয় আনতে প্রথম ছয় মাস ৩১ দিনে, ফাল্গুন মাস ছাড়া বাকি পাঁচ মাস ৩০ দিনে এবং ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে কিন্তু অধিবর্ষে ৩০ দিনে হবে ধার্য হয়।
ঘরে ঘরে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চৈত্র সংক্রান্তি এবং হালখাতা উদযাপনের সাথে মিষ্টি বা ভালো খাবার সমাভ্যিবিহারে উৎসব পালনের রীতিটি প্রথম বহিরঙ্গন উদযাপনের নজির পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের বিজয় কামনা করে হোম কীর্তন ও পূজার মধ্য দিয়ে প্রথম উন্মুক্ত ও সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়। ১৯৩৮ সালেও একই রকম ভাবে পহেল বৈশাখ উদযাপনের নজির পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রকারান্তরে রাজনৈতিক কোনো ঘটনা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সামাজিক রীতি ও ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা ঘটাবার বা নিয়ম প্রবর্তন করার চর্চাটা আদি থেকেই আছে, আজও বিদ্যমান।
আদিতে বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল না, লিখিত সকল কিছুর প্রয়োগ প্রমাণ পাওয়া যায় সংস্কৃত ভাষায়। লিখিত বাংলার প্রচলনের আগে তাই আমাদের অতীত ঐতিহ্যের বিবিধ প্রসঙ্গ আমরা পাই সংস্কৃত ভাষায়। অমনই কারণে বাংলা বর্ষ প্রচলনের প্রথমে বারো মাসের নাম ছিল কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ও ইস্কান্দর মিজ। পরবর্তীতে সময়ের আবর্তে বাংলায় বারো মাসের নাম এসেছে নক্ষত্রের নাম থেকে। বিশাখা থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ন, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
বাংলা বর্ষ প্রচলন এবং নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উৎসব উদযাপনের ভিতর দিয়ে পালন করার রীতি ও ঐতিহ্য এদেশের মাটি, কৃষি, কৃষ্টি এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়, এটা লোকজ ঐতিহ্যের উৎসব, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের উৎসব, বাঙালির উৎসব। এর সাথে মিশে আছে বাংলার মানুষের ঘাম শ্রম, ফসল, অর্জন এইসব। মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু-পিঠা, মিঠাই-সন্দেশ বা উৎসব সাযুজ্যে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি-রঙিন জামা, আলতা-কাচের চুড়ি, মাটির-পাতার-বাঁশের খেলনা কিংবা ঢোল-খোল করতাল বাজিয়ে আনন্দ, গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে লোকজ মেলা; এসবের ভিতর দিয়ে ভালো ও ইতিবাচক আনন্দের মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে প্রাণ সঞ্চারের ভিতর দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবার রীতি আমাদের রক্তের ভাব ও ভাষা প্রকাশেরই আরেক মাধ্যম। রমনা বটমূলে কাকডাকা ভোরে হাজার ওয়াটের উচ্চগ্রামে রাগ ভৈরবী কিংবা বেলা উঠতে শুরু করলে সমবেত ‘এসো হে বৈশাখ’ অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় মঙ্গল শোভাযাত্রা – সবই আমাদের অতীত ইতিহাসের ছায়া, ঐতিহ্যের পদচ্ছাপ, আপন কৃষ্টি ও অস্তিত্ব পরিচয়ের ধারক-বাহক। সকল বৈরিতার বিপরীতে বাঙালির মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবার চিহ্ন-পতাকা। সেই পতাকাটি থাকুক উড্ডীন, উড়ুক পতপত করে বাঙালির বিজয়ের উচ্চকিত আওয়াজ হয়ে। মানুষ থাকুক ও বাঁচুক মাটির স্পর্শ নিয়ে, আপন কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে।
শুভ নববর্ষ !
লুৎফুল হোসেন
কবি, প্রকাশক ও সাহিত্যকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন রকমের পোর্টাল ও পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধ এবং গান লিখছেন। বাংলাদেশের লিটলম্যাগ ও নানা প্রকাশনা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন সেই ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকেই। শৈল্পিক মননশীলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলছেন তার নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘রচয়িতা’।