ললিতা: ভ্লাদিমির নভোকভ

৩.
এনাবেলের প্রসঙ্গ যখন এলো তখন ওর পরিচয়টাও দিয়ে ফেলি। এনাবেল ছিল আমার মতই মিশ্র জাতীয়তার মিষ্টি এক মেয়ে। পার্থক্য এতটুকুই, ও ছিল অর্ধেক ইংরেজ আর অর্ধেক ডাচ। যদিও এনাবেলের স্মৃতি আমার মধ্যে থেকে গত কয়েক বছরে অনেকটাই মুছে গেছে। অথচ ললিতার সাথে দেখা হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এনাবেলের স্মৃতি এতটুকু মুছতে পারেনি। এমনকি কখনো ভাবতেও পারিনি এইভাবে এনাবেলকে আস্তে আস্তে ভুলে যেতে হবে। ললিতার প্রসঙ্গে পরে আসছি, আগে এনাবেলের কথা শেষ করে নিই। মানুষের স্মৃতি দুই ধরণের। এক ধরণের আছে, খোলা চোখেই স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়, দেখা যায়, চাইলেই ছোঁয়া যায়। যেন সেই স্মৃতিগুলো বারবার মনে হতেই প্রস্তুত হয়ে থাকে। ভাবনার সাথে সাথেই যেন সেই স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। স্মৃতিগুলো আবার একইভাবে ঘটতে থাকে মাথার ভেতরে। যেভাবে এনাবেলকে দেখতে পাই আমি। তার মধুরঙা সোনালি শরীর, চোখের লম্বা পাপড়ি, উজ্জ্বল মুখ, বাদামী রঙের ববকাট চুল, একেবারেই বাস্তব অনুভূতি জাগে। দ্বিতীয় ধরণটি হচ্ছে, যে স্মৃতি চোখ বন্ধ করে, মস্তিস্কের গভীর থেকে গভীরে ঢুকে, যেন সাধনার মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতে হয় এরকম। এই স্মৃতিতে শুধু ললিতাকেই দেখতে পাই আমি।

তার আগে কিছু ব্যাপার স্পষ্ট করে দিতে চাই, এনাবেল ছিল আমার কয়েকমাসের ছোট। যেন ভালবাসতেই তৈরি করা হয়েছিল ওকে, সুন্দর, স্নিগ্ধ, আদুরে মেয়ে। ওর বাবা-মা ছিল আমার আন্টির পুরনো বন্ধু। আমাদের হোটেলের কাছাকাছি একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে কিছুদিনের জন্য। এনাবেলের বাবার নাম মি. লেই, টাকামাথার মধ্যবয়সী লোক। আর এনাবেলের মা মিসেস লেই ছিল হাতির মত মোটা, বিশালদেহী। তাদেরকে আমি মোটেই পছন্দ করতাম না। এর সবচেয়ে বড় কারণ, তাদের জন্য এনাবেলের সাথে আমি ঠিকমত মিশতে পারতাম না। এনাবেলকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখত।

অথচ আমি এনাবেলের সাথে দেখা করার জন্য পাগল ছিলাম। ওর সাথে যতক্ষণ দেখা না হতো, কথা না হতো ততক্ষণ দমবন্ধ লাগত আমার। এ কথা তো আর ওর বাবা-মা বুঝবে না, তাই তাদের চোখ এড়িয়ে এনাবেলের সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজতাম সব সময়। সমুদ্রতীরে বসে এনাবেল একমুঠো বালি হাতে তুলে নিয়ে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরঝর করে ঝরতে দেবার দৃশ্য পাশে বসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতাম। বিকেলের সূর্যের আলো এসে আমাদের সময়টাকে রঙিন করে দিয়ে যেত। আমরা রঙিন সময় উপভোগ করতাম, ভালবাসতাম একজন আরেকজনকে। প্রচন্ডরকম সেই ভালবাসা। আমাদের দুজনের চিন্তা ভাবনার ধরণ কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির ছিল। মনে হবে ইউরোপের বিশাল কোনো পণ্ডিত আমরা, যতটুকু সুযোগ পেতাম ভারিক্কি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিতাম, পৃথিবীর জনসংখ্যা সমস্যা, টেনিস খেলা, আর সবকিছুই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের প্রেম বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় এসে ঠেকত। এনাবেল বড় হয়ে নার্স হতে চেয়েছিল। আর আমি? এডভেঞ্চারপ্রিয় কোনো স্পাই!

বাইরে থেকে মনে হবে আমাদের সম্পর্ক স্থির পানির মত নীরব আর প্রশান্ত। অথচ ভেতরে ভেতরে আমাদের ভালবাসা ছিল উন্মাদের মত উত্তেজনা, প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করত ভেতরে ভেতরে, দুজনের মাঝেই ছিল পরস্পরকে কাছে পাওয়ার অদম্য ব্যাকুলতা, অসংজ্ঞায়িত এক তীব্র যন্ত্রণাবোধ। যতই দিন যেতে থাকে আমাদের ভালবাসাও সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে, দুজন ছটফট করতে থাকি নিজেদের ভেতর। একে অন্যের মাঝে যেন রক্তমাংসে একাকার ছিলাম। তখন আমাদের বয়সী শিশুরা যতটুকু মেশার সুযোগ পেত আমরা ততটুকুও পাইনি। এমনকি পথের বা বস্তির বাচ্চারা যেরকম সুযোগ অতোটুকু মেশার সুযোগও আমরা পেতাম না। তাই বলে আমাদের একেবারেই দেখা হতো না এমন না। আমাদের দেখা হতো, কিন্তু পুরোটা সময় থাকতে হতো বড়দের সামনে। তাদের দৃষ্টির আড়াল হবার অনুমতি ছিল না একদম। সুতরাং একজন আরেকজনের সাথে দেখা করতে কতটা বেপরোয়া ছিলাম নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। বেপরোয়া হয়ে একদিন এনাবেলদের বাগানের ভেতর চুপি চুপি দেখা করেই ফেললাম।

দিন যায়। সমুদ্রতীরের নরম বালিতে আমাদের দুইজোড়া পায়ের ছাপ বড় হতে থাকে। এর মাঝে যতটুকু সুযোগ পেতাম, সবার চোখ এড়িয়ে পরস্পর পরস্পরকে ছুঁয়ে দিতাম আগ্রহ নিয়ে। বালির ভেতরে অর্ধেক হাত ডুবিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের হাতগুলো কাছাকাছি হতো। ছোঁয়ার তাগিদে আরো কাছে এসে শুধু হাতের ছোঁয়াতেই যেন রক্তে-মাংসে একাকার হয়ে যেতাম, ওই বয়সে এইটুকু স্পর্শই ছিল বিশাল পাওয়া। যেন আমরা দুজন দুজনকে ছুঁয়ে দেবার অবাধ্য ইচ্ছা নিয়েই বেঁচে ছিলাম সেই সব দিন। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের তৈরি বালির ঘরগুলো বেশ ভাল আড়াল হয়ে উঠত। সুযোগ বুঝে আমরাও একে অপরের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতাম, দুজনের লবণাক্ত ঠোঁট। কত কথা যে মিশে আছে সেই মুহূর্তগুলোতে। কিছুই বলা হতো না। বলতে না পারার যন্ত্রণা মেখে আরো ব্যাকুল হয়ে যেতাম ঠোঁটের ছোঁয়ায়।

তবু মনে হতো কী যেন রহস্য বাকি রয়ে গেল! পাখিদের মত হৃদয় নিয়ে দু’টো কিশোর কিশোরী সেই রহস্যের কোনো কূল কিনারা খুঁজে পেত না। ফলে রাগ হতো খুব, ক্ষোভ বেড়ে যেত শরীরের প্রতিটি কণায়। অলৌকিক কারো প্রতি সেই রাগ, ক্ষোভ, অভিমান সবকিছু শুধু বেড়েই চলত। আমরা ক্ষোভটুকু মুছে দিতে একজন আরেকজনকে নখ দিয়ে আঁচড়ে দিতাম। ভাবতাম এবার বুঝি আমাদের ভালবাসার যন্ত্রণা মুছবে, এবার বুঝি দেহের ক্লান্তিগুলো মিটে যাবে শেষমেশ। কিন্তু আমাদের যন্ত্রণা কমত না। বরং সেই রাগ, অভিমান অজানা সেই রহস্যের প্রতি আকর্ষণ প্রতি মুহূর্তে শুধু বেড়েই চলত।
গত কয়েক বছরে যত্ন করে রাখা প্রিয় জিনিসগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তারমধ্যে একটা ছবি ছিল। সমুদ্রের ধারে একটা সাইডওয়াক ক্যাফেতে আমার সিবিল আন্টি তুলে দিয়েছিল ছবিটা। ছবিতে এনাবেল ছিল, সাথে এনাবেলের বাবা-মা, ড. কুপার, আমি এবং আরো কয়েকজন ভদ্রলোক, সবাই সিরিয়াস ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বুঝি না তখন মানুষ ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে এমন ভাব নিয়ে কেন দাঁড়াত! যেন এইমাত্র কোনো যুদ্ধ শেষ হল বা রাজনৈতিক সংলাপ শেষ করে এসে ক্যামেরার সামনে বেচারাদের দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে। ছবিটা যেমনই হোক আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ সেটাই আমার কাছে এনাবেলার একমাত্র ছবি ছিল। আন্টির এলবাম নাড়তে নাড়তে তখন কীভাবে যে লুকিয়ে ফেলেছিলাম ছবিটা, সেই হৃদয় ঢিবঢিব করা বেপরোয়া কিশোরকে অনুভব করতে গিয়ে আজ নিজেই অবাক হয়ে যাই। মজার ব্যাপার হল, সেই ছবিতে এনাবেলা পুরোপুরি আসেনি, ওর শরীরের বেশিরভাগ অংশই ছবির বাইরে পড়ে গেছে, তোলার সময় কেটে গিয়েছিল। এনাবেলের শুকনো কাঁধ আর বাদামী চুলগুলো দেখে চিনে নিতে হয়েছে।

আর ছবিটাতে আমার থাকার ব্যাপারটা পুরোপুরি নাটকীয়। যারা ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে ছিল আমি তাদের কারো সাথেই দাঁড়ানো ছিলাম না। পিছনে একটু দূরে গিয়ে একা একা বসে ছিলাম। ছবি ওয়াশ করে আনার পরে দেখি আমি ফ্রেমবন্দী হয়ে গেছি। দেখলে মনে হবে, মন খারাপ ভাব নিয়ে একটা কিশোর ছেলে গায়ে কালো রঙের জার্সি, সাদা প্যান্ট, পায়ের উপর পা তুলে প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ওই ছবিটা তোলা হয়েছিল অবিস্মরণীয় সেই গ্রীষ্মের শেষদিন। এনাবেলের সাথে সেদিন ছিল দেখা করার শেষ সুযোগ। পরদিনই ওরা চলে যাবে। সুতরাং দেখা করাটা জরুরি ছিল। একটা দুর্বল অজুহাত দেখিয়ে আমরা ক্যাফে থেকে সরে সৈকতের দিকে চলে এলাম। ভাল সব অজুহাত ততদিনে ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই দুর্বল অজুহাত দেখানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না!

আমরা জনমানবহীন অন্ধকার সৈকতে এসে অবাক হয়ে গেলাম। চারিদিক সুনসান নির্জনতা, এদিকে কাকপক্ষীও নেই, শুধু বালির উপরে অসংখ্য পায়ের ছাপ পড়ে ছিল আর বড় বড় লালচে পাথরগুলো থেকে যেন ঝাপসা বেগুনি আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল। কেউ কি তখন আমাদের দেখছিল? বালির উপর একটা সানগ্লাস পড়ে ছিল। কেউ ভুল করে ফেলে গিয়েছিল হয়ত। সেই ফেলে যাওয়া একা সানগ্লাস সাক্ষী হয়ে উঠছিল খুব। হৃদয়ের সমস্ত কথা জানাতে আমি ভালবাসার মানুষটির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ি। একটা হাত আলতো বাড়িয়ে দিই ওর দিকে। ঠিক তখনই মনে হচ্ছিল হেমিংওয়ের লেখা সমুদ্রের সেই বিখ্যাত বৃদ্ধ জাহাজী আর তার ভাই প্রচন্ড চিৎকার করে আনন্দের সাথে অশ্রাব্য খিস্তি করে আমার ভেতরে তুমুল উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছিল।
সেই মুহূর্তের ঠিক চারমাস পরেই একদিন এনাবেলা প্রচন্ড জ্বরে ভুগে মারা যায়।

৪.
সেই দুঃসহনীয় স্মৃতির পাতা বারবার উল্টাই, নিজেকেই প্রশ্ন করি, সেই গ্রীষ্মের ঝলমলে দিনগুলোই কি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ? আমিই কি একমাত্র অস্তিত্ব যে এতটা ভালবেসেও একাকীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকছে? কেনইবা বেঁচে থাকছে? সমস্ত প্রশ্ন যেন মাথার ভেতর দেয়ালে দেয়ালে আছড়ে পড়তে থাকে, প্রতিধ্বনিত হয়, প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় এদিক সেদিক। গ্রীষ্মের সেই দিনগুলো আমার কাছে যতটা আনন্দের ছিল, এনাবেলের মৃত্যুর কারণে তারচেয়ে অনেক বেশি কষ্টের স্মৃতি হয়ে ওঠে। অনেক এড়িয়ে যেতে চেয়েছি, বিকল্প পথ খুঁজেছি, যত ভুলে যেতে চাই, স্মৃতিগুলো ততবেশি করে আমাকে আঁকড়ে ধরে। সময়ের স্রোতে এরপর ললিতার সাথে দেখা হয়ে যায়। আমি ললিতার ভেতরে আমার শৈশবের এনাবেলকে খুঁজে পাই। ললিতা কি এনাবেলের পরের জন্ম ছিল? নইলে কেন বারবার সেই ভালবাসাকে ললিতার মাঝে খুঁজে পাই আমি?
আমি জানতাম এনাবেলের মৃত্যুর ধাক্কা আমার পক্ষে হজম করতে সময় লেগে যাবে। সারাক্ষণ প্রচন্ড মন খারাপ একটা ভাব ভর করে থাকত। এনাবেলের মৃত্যুর ধাক্কাটাই আমার পরবর্তী জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে। যতবার প্রেম শব্দটা মাথায় আসে, আমি ওই বয়সটাতে চলে যাই, ওই বয়সেই আটকে থাকে আমার ভালবাসা, চাওয়া-পাওয়া, আবেগ, আরো অনেক কিছু। এনাবেলের মৃত্যুর পরে আমি অন্য কাউকে ভালবাসতে পারিনি। স্কুল শেষে কলেজে গিয়েছি, তরুণ বয়সে অনেক মেয়ের সাথেই মিশেছি, শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছি। কিন্তু এনাবেলকে আমি ভুলতে পারিনি। উল্টো এনাবেলের স্মৃতি আমাকে দ্বিধান্বিত করত, অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে বাঁধা দিত। এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে, তবু এনাবেলের স্মৃতি আমার কল্পনায় স্পষ্ট ভাসতে থাকে। চিন্তাগুলোর সাথে লুকোচুরি খেলে, সবার চোখ এড়িয়ে আমার আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয়, আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়, ঘোরের ভেতর এনাবেলকে খুঁজে পাই, ললিতাকে খুঁজে পাই। একমুঠো বালি ওর আঙ্গুলের ফাঁক গলে, আমার ভাবনার ফাঁক গলে ঝরে যেতে থাকে। আমাদের দুজনের ভাবনাগুলোর অদ্ভুত মিল ছিল, স্বপ্নগুলোও ছিল একই রকম।
মাঝে মাঝেই দুজন মেলাতে গিয়ে অবাক হতাম, ভাবনা, ইচ্ছা, স্বপ্ন এসব মিলে যেতেই পারে, কিন্তু তাই বলে এতটাই? একবার সেই বছরেরই (১৯১৯) জুলাইয়ের দিকে ওদের ঘরে কোত্থেকে একটা ক্যানারি পাখি ঢুকে পড়েছিল। কাকতালীয়ভাবে তখন আমাদের ঘরেও একটা ক্যানারি পাখি ঢুকে পড়েছিল। এবং সেটা একই সময়, জুলাইয়ের দিকে। পাখিটা যতক্ষণ বের হবার পথ খুঁজে পায়নি, ততক্ষণ সারাঘর তছনছ করে দিয়ে গেছে। এনাবেল চিঠিতে লিখেছিল ওদের ঘরেরও একই অবস্থা। অথচ আমরা দুজন তখন সম্পূর্ণ আলাদা দুই দেশে! হায় ললিতা, এইভাবে ভালবেসেছিলে তুমি?
এনাবেলের কথা শেষ করার আগে একটা ঘটনা তুলে ধরছি। এনাবেল প্রসঙ্গের শেষের দিকে বলব বলে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের চুরি করে সাক্ষাতের অনেক ব্যর্থ ঘটনাগুলোর একটি এটি। একদিন বিকেলবেলা দুজন মিলে ঠিক করলাম রাতে দেখা করব। রাতে এনাবেলদের বাসা বন্ধ থাকে, গেটে দারোয়ান পাহারা দেয়। এনাবেল ওদের দারোয়ানকে কোনোরকম এড়িয়ে রাতে বাইরে বের হয়। দারোয়ান ঝিমুচ্ছিল, টের পায়নি। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও বেরিয়ে আসার পরে দুজন মিলে ওদের বাড়ির পিছনের দিকে চলে গেলাম। জায়গাটা নিরাপদ, আমাদের কেউ দেখতে পাবে না। অসংখ্য লজ্জাবতী গাছ ঝোপঝাড় করে পুরো জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। একটা অল্প উঁচু ঢিবি পেয়ে তার উপর বসে পড়লাম আমি। এনাবেল আরো উঁচুতে বসেছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর ঠোঁটের একপাশে চুমু খেলাম। সেই বয়সে এর চাইতে বেশি কিছু জানতে পারিনি আমরা।

এইটুকুতেই মনে হচ্ছিল চূড়ান্ত ভালবাসায় মিশে গেছি আমরা। এক অচেনা শিহরণ আমাদের দুইজনের শরীর দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বিদ্যুতের মত প্রবাহিত হচ্ছিল। আর গাছ-পালা, পাতার ফাঁক দিয়ে আমাদের মাথার উপর কয়েকটা তারা জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল আকাশ কাঁপছে। কাঁপতে থাকা আকাশটাকে একবার এনাবেলের শরীর মনে হল। ওর জামার ভেতরের নগ্ন দেহের মত আকাশটা কাঁপছিল। ওর মুখ তাতে যেন নিজস্ব মহিমা নিয়ে ভাসছে। স্নিগ্ধ কিরণগুলো ওর মুখ থেকে ঠিকরে বের হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত আকাশে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ওর নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় আমি অতল গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। আর এনাবেল শুধু পাগলের মত ঠোঁটে ঠোঁট, মুখে মুখ ঘষেই যাচ্ছিল শুরুতে। যেন ভালবাসার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশা খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সেদিন সাজুগুজু করতে গিয়ে ওদের স্প্যানিশ কাজের মেয়েটার পারফিউম চুরি করে মেখে এসেছিল সম্ভবত। সেই পারফিউমের ঘ্রাণ আর ওর নিজস্ব বিস্কুট বিস্কুট ঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। সেই ঘ্রাণে আমি ডুবে যেতে যেতে সমস্ত অনুভূতি পূর্ণ হয়ে ভরে উঠছিল অবিরাম।

হঠাৎ পাশের ঝোপে শব্দ হলো! মনে হলো কারো পায়ের শব্দ। ছিটকে দুজন দুদিকে সরে গেলাম। একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই। প্রথমে ভেবেছিলাম মানুষের পায়ের শব্দ, কিন্তু সাথে সাথেই বুঝতে পারি ওটা মানুষের পায়ের শব্দ ছিল না। ‘মিউ মিউ’ করতে করতে ঝোপের কাছ থেকে একটা বিড়াল দৌড়ে দূরে চলে গেল। আমি যেদিকে ছিটকে পড়েছিলাম সেখানে শক্তমত কিছু একটার সাথে হাঁটুতে চোট লাগে। ব্যথায় ককিয়ে উঠি। আঘাত কতটুকু লেগেছে সেটা অন্ধকারে বোঝার উপায় ছিল না। আস্তে আস্তে ব্যথা বাড়তে থাকে।

একটু পরেই এনাবেলের মায়ের গলার স্বর শুনতে পাই। এনাবেলকে ডাকছে। ডাক শুনে মনে হচ্ছিল রেগে আছে। আমরা দ্রুত বাড়ির পিছন থেকে দেয়াল টপকে বাগানের দিকে নিঃশব্দে এগোতে থাকি। ওদের বাগানের কাছে আস্তেই দেখি ড. কুপার পায়চারী করছেন, উনিও এনাবেলকে খুঁজতে বের হয়েছেন। এরপর উল্লেখযোগ্য আর কিছুই ঘটেনি। এনাবেল শেষ চুমু খেয়ে একদিকে চলে গেল। আমি চললাম আরেকদিকে। বাগান থেকে রাস্তায় কোনোরকম বের হয়ে সোজা দৌড়। ধরা পড়িনি কেউ, ঘটনা এখানেই শেষ। তবে অসমাপ্ত রয়ে গেছে অনেককিছু। আমাদের ভালবাসাকে এনাবেল অসমাপ্ত রেখে চলে গেছে, কিন্তু সেই লজ্জাবতীর বাগান, শিশিরের ফোঁটা, কুয়াশার ফাঁক গলে আসা নক্ষত্রের আলো, পাতাদের ফাঁকে ফাঁকে অদ্ভুত আলোর খেলা এবং হাঁটুর ব্যথা- এসব এখনো যত্ন রাখা আছে। সেই ছোট্ট এনাবেলের হাতের আঙুল, আগুনরঙা ঠোঁট, জিভ, দেহের ঘ্রাণ বয়ে চলেছি চব্বিশটি বছর ধরে। তারপর? একদিন অন্য কারো মাঝে ভেতরে খুঁজে পাই এই ছোট্ট মেয়েটিকে। আহ! আমার ললিতা!

 

রনক জামান

কবি ও অনুবাদক ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১, মানিকগঞ্জে জন্ম।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : অগ্রন্থিত ওহী [তিউড়ি, ২০১৯] এবং
ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা [অনুপ্রাণন ২০১৬]

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top