ফেরদৌস নাহার
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা;
সে আমার স্মৃতিকাতর মুখে একটি চুম্বন
কমরেড, কমরেড! চলো কমরেড চলো, আজ রাতে জ্বলন্ত জ্বলে যাই এসো! আরেকবার নতুন চোখে তোমার দিকে তাকাতে চাই। না, পুবের নদী মেখলা দেশের নরম মাটির মতো করে নয়, ইউরোপের পাহাড়ি সৌন্দর্যের দৃঢ়তা নিয়ে, চোখে চোখ রেখে জানাতে চাই- তুমি পর্বতময় গাঢ় সবুজতম, কিংবা বুনেলা ঘ্রাণে ভরা প্রগাঢ় উপকথা, স্প্যানিশ মদ কিংবা গিটার …
ক.
বধ্যভূমিতে রাতের আকাশ চেয়ে আছে প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতা নিয়ে। অন্ধকার সভ্যতার স্বরে কথা বলার জন্যে গলা খাঁকারি দেয় বেশ ক’বার। অথচ এখন তার কণ্ঠস্বর বুজে আসছে বারবার। পরিত্যক্ত জ্যোৎস্নায় হিম হয়ে আসে সমস্ত পরিচয়। তারই মাঝে লোরকা এসে দাঁড়ান। মাথার উপর আন্দালুসিয় আকাশ, মাথা ঘুরিয়ে দেখে নেন চারপাশ। কাকে যেন খুঁজে বেড়ান এই নিষ্ঠুর গভীর খাদের গভীরে দাঁড়িয়েও, বলতে থাকেন- কোথায় আমার চাঁদ? বধ্যভূমিতে আচমকা লোরকার জিজ্ঞাসা ঘুরে বেড়ায় বুনো বাতাসের টানে। প্রতিধ্বনি ঘুরতে থাকে, কোথায় আমার চাঁদ…!
স্থানীয় কাফেতে উড়ছে লোরকার কবিতা প্রহর। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তিনি আবৃত্তি করছেন স্বপ্নসময়। গ্রানাডার বাতাসে ভাসে জলপাই ঘ্রাণ। জনযুদ্ধের জোয়ার উঠেছে চারদিকে। আর লোরকার মঞ্চনাটকগুলো পৌঁছে যাচ্ছে পুব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। সারা স্পেন জুড়ে লোরকা-ঘ্রাণ। ঘুম নেই কবি ও কথকের, বিরাম নেই আন্দালুসিয়ার জনপদে। এমন দিনে কে আর ঘরে থাকে? রক্ত বিবাহের অলিগলিতে ছুটছে সহস্র দুরন্ত ষাঁড়। ফুয়েন্তে ভ্যাকুয়েরস থেকে খুব কি বেশিদূর সিয়েরা নেভাদা পাহাড়ের পায়ের কাছে জেগে থাকা সত্তর বছরের বুড়ো বধ্যভূমি? যেখানে স্পেনীয় জলপাই বৃক্ষ বসন্তের ধ্রুপদী বাতাস হাঁকায় সারাক্ষণ। ভূমধ্যসাগরের নীলে ছায়া ফেলে গার্সিয়ার দুচোখ, অহং রাত্রির কিনারে ক্রমাগত ভিড়ছে শাশ্বত জাহাজ। নোঙর ফেলো বন্ধু, তাড়াতাড়ি নেমে পরো এই বধ্যভূমির কারুকাজে। কান্নাসিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে চাই লোরকার একান্ত কাছে। যেখানে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন প্রাচীন চাঁদ। মুগ্ধ বিস্ময়ে বারবার বলেছেন, এ চাঁদ আমার, চিরকালের আমার !
কফিখানার গরম ধোঁয়া আর লোরকার কবিতা কাচের জানালার দুপাশেই উড়ে যায়, স্পেনীয় বাতাসে কারা যেন ফিসফিস কথা কয়। মৃত্যুর আগে উন্মাদ ঢেউ এসে জাগিয়েছে যাকে, তার নাম মিশে থাকে জনপদ, জন্ম এবং জিপসি জীবনের বাঁকে
খ.
সেই নির্জন মৃত্যুর কাছেই ছিল ফুয়েন্তে গ্রানাডার সম্ভ্রান্ত বসন্ত, জলপাই গাছের ছায়া। জন্ম থেকে মৃত্যুর দূরুত্ব ঘুচে গিয়ে এখন কেবলই জীবন হো হো হাসছে জীবনের মাঝে বসে। চলো তাকে পান করি, অলিভওয়েলে টোস্ট করি দুমুঠো অগ্নি। বলেই ডান হাত তুলে উল্লাসের ভঙ্গি করলেন লোরকা, ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকা। স্পেনের বুকের মাঝে জন্ম নেয়া আরেকটি স্পেন। কবিতা, নাটক আর কথোপকথনের ফুলকি ছুটানো ছেলেটা। ভালোবাসা দেবার জন্য জন্ম নেয়া এক রূপকথা। সে হেঁটে গেলে তার সঙ্গে হেঁটে যায় চাঁদ
বুনুয়েলের ফিল্মের রাস দেখে বাড়ি ফেরা, দালির ক্যানভাসে হুল্লোড় গুঁজে দিয়ে হেলুজিনেশনে ডুবে যেতে যেতে ভূতে পাওয়া স্বপ্ন হয়ে যাই। মাদ্রিদ কিংবা গ্রানাডার রাস্তায় কুকুরের শীর্ণ আর্তনাদ এবং মাতাল পুরুষের গালিবাজি এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ছে একসাথে। মধ্যরাত উতলা, লোরকা ঘরে এসো, আগামীকালের কবিতা পাঠের আসর ডাকছে তোমাকে, ঘরে এসো লোরকা…
ঢুকে পর চার নম্বর বাড়িটার গেইট দিয়ে। ঝুলন্ত বারান্দায় জ্যোৎস্নার চাটনি মেখে ঝুলে আছে টবগুলো। ফুলের নতুন দিন, কবির বাড়ির ফুল কিছুটা কি অন্যরকম নয়? চিলি থেকে নেরুদা লিখেছে চিঠি- এখন অনেক কাজ চোখ বুজে ঘুমবার নয়, একবার মাদ্রিদ যেতে হবে…
সেই নির্জন মৃত্যুর কাছাকাছি দুজন বুলফাইটার জীবনকে বাজী রাখে খেলবার নাম করে। বৃদ্ধ স্কুল মাস্টার সাদা চুলে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছু বুঝে উঠবার আগে ভাগে। গিটারে উঠেছে সুর, লোরকার মিহিন চোখে আন্দালুসিয় ভোর, যে ভোর দেখেনি কেউ আগে !
ফেরদৌস নাহার
ফেরদৌস নাহারের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। নেশা, দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ও বইপড়া।
ফেরদৌস নাহার বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগীত রচয়িতা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা: ১৫টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অসংখ্য যৌথ কবিতা সংকলন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের দল ‘মাইলস’-এর অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও কানাডা থেকে কম্পিউটার ট্রেনিং প্রোগ্রাম কোর্স করেছেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি ছবি আঁকেন, গান লেখেন, ব্লগিং করেন, কফিশপে ধোঁয়া আর ঘ্রাণে আড্ডার ঝড় তোলেন। কিন্তু সবকিছুর উপরে এক বিশ্ব বোহেময়ান কবি আর চির তারুণ্যের নাম ফেরদৌস নাহার। মন চাইলে বেরিয়ে যান। ঘুরে বেড়ান খেয়াল-খুশি মতো, যাকে তিনি ‘ঘুরণ’ বলেন। ভালোবাসেন প্রকৃতি ও মানুষ। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া, ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। ইমেইল : [email protected]
কবি ফেরদৌস নাহারের স্মৃতিকাতর মুখের চুম্বন চিহ্ন ধরে লোরকা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হলো। তাঁর সম্পর্কে
না জানার শূন্যতায় দিব্বি জুড়ে বসলো এইসকল জানাজানি। ভীষণ কাব্যময় লেখা, পড়ে খুব ভালো লাগলো।
এ জানায় রয়েছে কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও আবিস্কারের মোহ…। অনেক ভালোবাসা ও শুভকামনা তৃণা।
লোরকা, মৃত্যুঞ্জয়ী ফেদেরিকা গার্সিয়া লোরকা, তোমায় অভিবাদন, ভালোবাসা ফেরদৌস নাহারকে, লোরকার জন্যে ভালোবাসাকে আরো একবার উদযাপনের জন্যে!
অনেক ধন্যবাদ। পাঠ শেষে এমন একটি চমৎকার অভিব্যক্তি লিখে জানালে বলে।
আন্দালুসিয়া, গ্রানাডা, সিয়েরা নেভাদা, স্পেন, ক্যাফেতে উচ্চকিত কবিতা পাঠের কণ্ঠ এইসব এত চেনা একটা ইমেজ আর আমজেরে মধ্যে ছুঁড়ে দেয় তীব্রভাবে যে সেখানে যাবার ইচ্ছেগুলো ডাঙায় আটকে পড়া কৈ মাছের মতো তড়পায়। একটা ঘোর চেপে বসে আর ক্রমশ গ্রাস করে নিতে থাকে অন্তর্গত আমাকে।
মুগ্ধতা একরাশ। লেখাটা পড়ে যারপরনাই ভালো লাগা অনুভূতির এক ঘোরে আচ্ছন্ন হলাম।
অনেক ভালো লাগলো, লেখাটি পড়ে খুব সুন্দর একটি মন্তব্য লাভ করার জন্য। ধন্যবাদ প্রিয় লুৎফুল হোসেনকে।
আজ বাড়ি ফিরে পড়ার অবসর হলো। মনযোগ দিয়ে পড়লাম ‘..লোরকা; সে আমার স্মৃতিকাতর মুখে..’। যা ভালো লাগলো তা হচ্ছে, শব্দের বয়নে নির্মিত আবেগঋদ্ধ দৃশ্যকল্পের সমাহার, যা ভাসছে যেন প্রবাহমানতার স্রোতজলে। এছাড়া ইন্টারপ্রেটিভ দৃষ্টিভঙ্গিও মনযোগের দাবি রাখে। থ্যাংকস্ ফর শেয়ারিং দিস এন্ড হ্যাভ অ্যা গুড ডে।
এমন একটি শিল্পীত মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ মঈনুস ভাই।
অসাধারণ বাজে দ্রিমি!@
সাহিত্য ক্যাফে নামেই খুঁজে পাই বোহেমিয়ান এক দ্রিমি।আশা করি লিখব।শুভেচ্ছা।