গত ১২ মার্চ ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদের ৫ম প্রয়াণ দিবস । আর এবছরেরই স্বাধীনতার গৌরবময় সুবর্ণ জয়ন্তী। স্বাধীনতার সৈনিক দেখে যেতে পারলেন না ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই গৌরবময় সুবর্ণ জয়ন্তীর কাল-পর্ব। আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা দেখছি এই অনিন্দ্য মুহূর্ত, পলে পলে অনুভব করছি কবিকে এবং হাজারো মুক্তিসেনানী যারা নিজের জীবনের বিনিময়ে এই দেশটিকে স্বাধীন করে রেখে গেছেন আমাদের জন্যে। তাঁদের স্মরণ করছি মুহূর্মুহূ। শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় স্মরণ করি তাঁদের অপরিশোধ্য এই ঋণের কথা। মায়ের ঋণ যেমন অপূরণীয় থাকে চিরকাল, তেমনি স্বাধীনতার বীর সেনানীদের ঋণ কোনোদিন শোধ হবার নয়।
সুবর্ণ জয়ন্তীর এই প্রাক্কালে গভীরভাবে অনুধাবন করছি একটি কথা— একটি দেশ ও জাতির নয়মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা হাতে পাওয়ার মতো গৌরব বুঝি আর কিছুতে নেই। এই পরম অভিজ্ঞতাও সব মানুষের ভাগ্যে আসে না। যারা এই স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধ-আহ্লাদ পূরণের দুর্লভ সুযোগ ও অভিজ্ঞতা লাভ করতে পেরেছেন নিজ বাসভূমে দাঁড়িয়ে, সেই সময়ের প্রবল সাহসী জনগোষ্ঠীর মনে এটাই সারা জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হয়ে আছে বলেই বিশ্বাস করি।
যুদ্ধ শেষে স্বাধীনদেশের স্বপ্ন পূরণ হয়নি আমাদের, হঠাৎ করে অবিশ্বাস্য এক সুনামির তাণ্ডবে ১৯৭৫ সালে লুট হয়ে যায় আমাদের সর্বস্ব। আমাদের ভালোবাসা, অমিত সাহস, আমাদের পিতা, এমন কি আমাদের রক্তবর্ণ!
অবশিষ্ট মহান মুক্তিযোদ্ধা সকলে প্রবল এক মনোবেদনায়, হতাশায় পুরনো বাড়ির মতো সমূলে ধ্বসে পড়েছিলেন সেদিন। এই বাংলাদেশের ভূমিতে এমন একটা সময় গেছে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় লুকিয়ে চলতে হয়েছে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। ১৯৮৫ সালের দিকে রফিক আজাদ শব্দে-উপমায়-ছন্দে এঁকেছেন সেই সময়ের যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের এক ভয়াবহ চিত্রকল্প।
পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশ পরান্নে পালিত হতে হতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁর। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হলো রফিক আজাদের ‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’ শিরোনামে সপ্তম কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যের সর্বশেষ কবিতা ’যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ’ শিরোনামের কবিতায় মুক্তিযোদ্ধা কবি চূড়ান্ত হতাশা ও অন্তর্গত বেদনাভূমি থেকে, যে সত্য উচ্চারণ করেছিলেন সেই সময়ে তা ছিলো চরম সত্য।
বাস্তবতার এক সত্যাগ্রহ। যা সমকালীন সমাজের দর্পণ বা দলিল হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে আজ অনায়াসে। বিস্মৃতি প্রবণ জাতি আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই অনেক গর্হিত অপরাধের কথাও।
আজকের এই দিনে তিনি উপস্থিত না থেকেও তাঁর কবিতার চরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই বিষণ্ণ অতীতের চরম সত্যি ঘটনার অনেক সত্যতাকে।
অসংখ্য বিধবা, মায়ের চোখের জল অবিরল,
ইনভেলিড চেয়ারে উপবিষ্ট শ্মশ্রুময় মুখ,
পোড়া ঢেউটিন, ইজ্জতহারানো বোন,
ঘরে ফিরে না-আসা পুত্রের শোকে মোহ্যমান পিতা,
শিশু হত্যা,নারী হত্যা, নেতৃহত্যা থেকে ক্রমাগত
নিহতের তালিকাটি দীর্ঘ হতে থাকে—-
…… …… …… …… …… ……
স্বদেশের রাজপথে ট্যাংক, রক্তচক্ষু ঘাতকের জীপ,
মধ্যরাতে অবিরাম সামরিক যানের আনাগোনা,
নগরে কারফিউ, সারারাত ভারী বুটের আওয়াজ;
ফাঁপা মানুষের মুখ টিভি পর্দা জুড়ে, অযোগ্যের
দর্পে গ্রাম্যবধূর মতন জডোসড়ো মাতৃভূমি,
…… …… …… …… …… ……
‘একে একে নিহত সবাই—-স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক—-
বীরোত্তম; কেউ-কেউ বিতাড়িত স্বদেশ-স্বভূমি থেকে,
কেউ বা আবার স্বেচ্ছা-নির্বাসনে ——
একাত্তরে পরাজিত শত্রুরা সবাই
ক্ষমতার বারান্দায়, সার বেঁধে, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
—-এই স্বাধীনতা, এই তো আমার প্রিয় মাতৃভূমি।
…… …… …… …… …… ……
ক্ষুধার্ত, বেকার, কোণঠাসা মুক্তিযোদ্ধা ব্যর্থতার
বোঝা পিঠে বয়ে ধুঁকে-ধুঁকে চলে রাজপথ,
হাড্ডিসার সমস্ত শরীরে তার শুধু দু’টি চোখ
দৃশ্যমান—-ধ্বকধ্বক জ্বলে; আরেকটি যুদ্ধের জন্যে
মনে মনে তৈরি হয় মুক্তির সৈনিক…॥
( যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ)
একথা অনস্বীকার্য যে, ১৯৮৩ সালেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন, তাই তো স্বাধীনতার দুর্লভ মুহূর্তটিকে ধারণ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও সমাজ বাস্তবতার নিরিখে ‘নেবে স্বাধীনতা’ শিরোনামে তিনি লিখেছিলেন ভিন্ন ধরণের স্বাধীনতার এক ইস্তেহার। এই কবিতাটি কবির ‘এক জীবনে’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত।
নেবে স্বাধীনতা?——নাও তোমাকে দিলাম
অপার আকাশ—-উড়বে যদি একটি বেলুন দেবো,
হিলিয়াম গ্যাস ভরা—রঙিন বেলুন——
মধ্য-আকাশের বায়ুস্তর ভেদ ক’রে তুমি বেশ
নিশ্চিন্তে পেরিয়ে যাবে বাংলার আকাশ…
…… …… …… …… …… ……
নেবে স্বাধীনতা?—-নাও তোমাকে দিলাম
সবুজ সংকেতময় নীল পাসপোর্ট—-সুনিশ্চিত স্বাধীনতা,
‘গুডবাই বাংলাদেশ’ —-বলে তুমি খুব অনায়াসে
চলে যেতে পারো যে-কোনো আকাশে; তবে
তোমাকে ছাড়তে হবে একুশের মায়া,
দ্বাদশ মাসের ষোল, মার্চের ছাব্বিশ——
সারি-সারি গাছপালা, স্বদেশের হাওয়া…
নেবে স্বাধীনতা?—-নাও তোমাকে দিলাম—-
( নেবে স্বাধীনতা)
জলপ্রবাহের মতো সময়ও দ্রুত গতিতে এগিয়েছে। পালাবদল ঘটেছে সময়েরও ক্ষমতারও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার পুনরায় সরকার গঠন করে ১৯৯৬ সালে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯৭সালে বেকার মুক্তিযোদ্ধা ও কবির একটি চাকুরি হলো বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি পরিচালক হিসেবে। সেই অঞ্চলে তখন টেলিফোন যোগাযোগ ছিলো না।
তবে, টাঙ্গাইলের ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প সখীপুর অঞ্চলের খুব কাছাকাছি এলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভারাতুর মন এবার সরব হলো, সব সময় যেন যুদ্ধের অনুভূতি ও অনুভব তাকে আচ্ছন্ন রাখে তাঁকে। অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে যে দেশ, যে মাটি তিনি স্বাধীন করেছেন, এবার সেই মাটির ডাক যেন শুনতে পেলেন নতুন করে। কবিতায় নিয়ে এলেন রণাঙ্গনের স্মৃতিমধুর সহযোদ্ধাদের কথা এবং নিজের কথাও।
আমরা এই প্রথম অস্ত্রহাতে যুদ্ধরত প্রত্যক্ষ একজন কবির মুখে যেন শুনতে পাই তাঁর যুদ্ধের ইতিকাহন।
রণাঙ্গনের যোদ্ধা নয়, এমন অনেক কবির কবিতায় ভরপুর আমাদের বাংলা কাব্য-সাহিত্যে। কিন্তু প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের কবিতা আলাদা মূল্যায়নের দাবী রাখে বলে আমি বিশ্বাস করি। কাব্য ব্যঞ্জনার এইসব কবিতা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেরই অন্যতম দলিল। এই দলিলের কিছুটা খুঁজে পাওয়া যাবে রফিক আজাদের ‘স্মৃতিময় সখীপুর’ কবিতার উপমা ও চিত্রকল্পে——
সখীপুর মাহবুব সাদিককে জননীর স্নেহে
প্রথমেই দিয়েছিলো ঠাঁই——
ঘন গাছপালাময় শাল-গজারির বন,
শান্ত, স্নিগ্ধ পাহাড়িয়া টিলা, লালমাটি
জেগে ওঠে অসংখ্য যোদ্ধার পদপাতে—
সখীপুর কুরুক্ষেত্র, ন্যায়ের রাজধানী,
পুরনারীদের গ্রাম, প্রেমিকের প্রোজ্জ্বল ঠিকানা,
সখীপুরে যায় চিলপুরুষেরা, আমি অতি তুচ্ছজন—-
মাহবুব সাদিক, সানু, বুলবুল খান মাহবুব;
মহানন্দপুরে হাসপাতাল, আহত যোদ্ধার আর্তনাদ,
ডাক্তার শাহজাদা, নার্স, ডেটলের গন্ধ, ও.টি., আর
ওষুধ-বিষুধ, টিলা-চালা, ট্রেনিং ক্যাম্প, সদর দপ্তর—-
রণাঙ্গন নামে পত্রিকা প্রকাশ, পুরোপুরি সুষ্ঠু প্রশাসন
মমতাজ খাঁ : ন্যায় যুদ্ধে পাঠান যোদ্ধা;
লাঙ্গলের মতো বাঁকা নদী, হাওর-বাওর,
ঢাকার অদূরে সখীপুর এই যে এমন এক
যুদ্ধ পরিচালনা স্থান——শনাক্ত করতে পারেনি পাকিরা।
…… …… …… …… …… ……
আরো-আরো অনেকেই আসে —-জলস্রোতের মতো
আসে সব মুক্তির সৈনিক, পদপাতে মুখরিত
সখীপুর হানা দেয় বন্ধুদের মস্তিষ্ক ও মনে ——
যেখানেই যাই
সখীপুর আমারও তো সঙ্গে সঙ্গে থাকি…
( স্মৃতিময় সখীপুর, কাব্য: বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে)
মহান মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষের এই মাহেন্দ্রসময়ে তোমাকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
সশ্রদ্ধ সালাম তোমাকে হে বীর মুক্তিযোদ্ধা।
দিলারা হাফিজ
কবি দিলারা হাফিজ। ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগন্জের গড়পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা বখশী হাফিজ উদ্দিনআহমেদ, মা রহিমা হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি. এ অনার্স ও এম এ করেছেন। ১৯৯৮ সালে ঢাবি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রিলাভ করেন। ৩৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে সরকারি কুমুদিনী কলেজ, ইডেন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায় ছাড়াও মিরপুরের সরকারি বাঙলাকলেজ ও তিতুমীর কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যানহিসেবে চাকুরি থেকে অবসরে যান।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
১।ভালোবাসার কবিতা, ২।পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক ৩। প্রেমের কবিতা ৪। কে নেবে দায় ৫। খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান ৬। অবিনশ্বর আয়না ৭। নির্বাচিত কবিতা
৮। নারী সংহিতা
গবেষণা গ্রন্থ: বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ (১৯৪৭–১৯৭১)
স্মৃতি গদ্য: আনন্দ বেদনাযজ্ঞে রফিক আজাদ
স্মৃতি উপন্যাস: কে প্রথম কাছে এসেছি
শিশুতোষ:সুষমার গল্প
অনুবাদ:মার্কিন কবি ক্যারোলাইন রাইট ও ভারতীয় বহুভাষাবিদ পণ্ডিত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেককবিতার অনুবাদ করেছেন।
সম্পাদনা : গদ্যের গহন অরণ্যে
১৯৮৩ সালে কবিতার জন্যে লা ফর্তিনা সম্মাননা ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেণ্ডশীপ সম্মাননা লাভ করেন। বিটিভির বহুল প্রচারিত ও জননন্দিত গণশিক্ষামূলক অনুষ্ঠান “সবার জন্যে শিক্ষা” গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন ২২ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ (প্রয়াত) এর স্ত্রী। দুই পুত্র সন্তান অভিন্ন ও অব্যয় এর জননী।