মোহকাল
এ পথেই বসে থাকি অনন্ত ঋতুকাল
মৃত পাথরের মতো তরঙ্গহীন
অভিশপ্ত পাখির নিদ্রাহীন আয়তচোখে
যেভাবে তীরকাঁটা বিঁধে আছে শূন্য করোটিতে
ঝুলে আছে স্তব্ধতার ইতিহাস
এমনই এক চিরচেনা দূরত্বের মাঝে
সরল হেলেঞ্চা হয়ে তীক্ষ্ণ মনোযোগ
দানা বাঁধে
দুচোখের দৃষ্টি !
অথচ আমরা দুজনই জানি
এই দূরত্বের মোহকাল ঘুচবে না কখনো আর…
নিলাম
তোমার এ নিদ্রা ঘোরে
অঝরে ঝরেছে কত নুন
আতঙ্কিত ধর্ষিতার মতো
ব্যথাতুর কামনার পর
কলুষিত বুনো আলিঙ্গনে
অসুস্থ আদিম ক্ষুধার যাতনা
সর্ব অঙ্গে যার রক্ত ঝরে
হে অচেনা ! হে অসুর !
দাও আরও আরও দাও নীরবে আরোগ্য তবে
জ্বালাও আরও একবার আলোর অট্টহাসি
জাগাও বিক্ষোভ
ক্ষুধার্ত ওই মহাপ্লাবনে
এভাবেই মৃত্যু আর জরা শোকে, সুখের অসুখে
তোমার ইস্পাত কঠিন মুখোশ
নিলামে উঠবে জানি।
তবু মুক্ত করো দ্বৈতসত্তা আর এ অসার বাণী
অনন্ত জিজ্ঞাসার ফাঁদে আটকে পড়া
গ্লাডিওলাসের মায়া
দাও! দাও! শুধু আরেকবার
সবুজ শীতল আলোর স্নিগ্ধতা
আর নিরাভরণ শীতল কবিতার ছায়া…
ঘৃণা
আমার শহরে
ঝুলন্ত মেঘের ফাঁসে বিদ্রূপ করে বেহেড মগজ
আমার শহরে
মসজিদে মসজিদে বিকট চিৎকারে জড়পিণ্ড প্রহরীর দল
আমার শহরে
উম্মতের পায়ের গোড়ালি ফেটে ভেসে আসে চাপচাপ রক্ত
আমার শহরে
প্রতিটি জানালার শার্সিতে ছিটানো ধূসর কান্না
আমি অপেক্ষা করি সমস্ত অন্ধ-ঘুমন্ত স্নায়ু জ্বলে ওঠার
আমি অপেক্ষা করি অপহৃত হয়ে ঝলসানো পোড়া মাংসে
আগুনের ছটা লেগে থাকার
যদি চাও
অন্তত একবার অনন্য মানবী হবো, দু’ঠোঁট অস্ফুট অট্টহাসিতে
দোমড়ানো মুচড়ানো হৃদয়ে হানবে জ্বালা ধরে ওঠা তীব্র ঘৃণা।
তুমি কি আমার সঙ্গে দাবা খেলবে
পাথর বাঁধানো পথে
অভয়ারণ্যের সীমানা ছাড়িয়ে
বহুদূর চলে গেছে তুষার ধবল শৃঙ্গ!
এই মাত্র শেষ সিকোয়েন্সে এসে
আটকে গেছে দৃশ্যপট
কী এক ব্যঙ্গের ইঙ্গিত দিলেন মহাশয় বার্গমান!
দশ বছরের ধর্মযুদ্ধ শেষে
রণক্লান্ত নাইট ব্লকের মুখোমুখি মৃত্যুদূত
আসে!
তার ফ্যাকাসে মুখের হাসি
উজ্জ্বল লুব্ধক চোখ
যেন দীর্ঘ কৃষ্ণ পোশাকের ধূর্তমূর্তি এক।
অতঃপর মৃত্যু প্রশ্ন করে নাইটকে তুমি কি প্রস্তুত?
নাইটের উত্তর – আমার দেহ প্রস্তুত হে, মহামান্য মৃত্যুবর!
কিন্তু আত্মা নয়।
তুমি কি আমার সঙ্গে দাবা খেলতে প্রস্তুত? – নাইট জানতে চায়
মৃত্যু-ব্যঙ্গ করে হাসে,
তবু রাজি হয় খেলতে অবশেষে ,
হায়বিধি!
দশ বছরের ক্লান্তিকর ধর্মযুদ্ধ শেষে
অগত্যা নাইট চায় কিছুক্ষণ সময় মৃত্যুর কাছে এসে…
জানতে চায় মৃত্যুর কাছেই,
ঈশ্বর কি সত্যি আছে?
মৃত্যু ভেংচি দিয়ে বলে হেসে –
ঈশ্বর সম্পর্কে উদাসীন আমি আছি
তবে মেয়েদের কিন্তু খুব ভালোবাসি…
বিপ্লব
শুনেছি একজন বিখ্যাত বিপ্লবী বলে গেছেন,
বিপ্লব দরকার হলে
ঘোড়ার পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে।
এবং সেখান থেকে বেরুবে সময় হলে,
বিপ্লবকে বাঁচাতে হলে তো দরকার
সার ও সেচের
আমার বিপ্লবী বন্ধুগণ!
সেই সার? জানেন কোথায় আছে?
সেই সার আছে জোতদার আর
শ্রেণিশত্রুর রক্তের মধ্যে…
বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবীরা
আজকে নিজেকে দেখুক
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখুক
ওখানে স্টেপল ফুড বলতে কিছুই নেই আর
শুধু কতগুলো তাজা বোমা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,
আর আছে নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি
এদিকে ফাটছে এক এক করে বোমা
ভোরের আলোয় কৃষকের মেয়ে-বউ
জোতদারের ক্ষেতের ধান তুলে নিচ্ছে
কেউ কেউ পাহারায় আছে
কাঁধে বন্দুকের নল
এটাই বিপ্লব…
পার্টি মরে যায়
স্পার্টাকাস থেকে চারু মজুমদার, চে গুয়েভারা
মরেছে সবাই
এম্পিডোক্লেসের মৃত্যু হয়
বিপ্লব মরে না শুধু!
আজ শ্রেণিশত্রুরা দেখুক-
শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চেহারা লাল সন্ত্রাসের।
ফারহানা রহমান
প্রধানত কবি, গল্পও লিখে থাকেন। চলচ্চিত্র সমালোচনাতেও আগ্রহ অনিঃশেষ। ১৯৭২ সালের ১৩ আগস্টে ঢাকায় জন্ম। বেড়েও উঠেছেন ঢাকায়। পড়াশোনা প্রথমে পল্লবী মডেল হাই স্কুলে, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পরে ইডেন মহাবিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। উদার সংস্কারমুক্ত উচ্চ শিক্ষিত পিতা শেখ রহমতউল্লাহর ছায়ায় নাগরিক অনুষঙ্গে বেড়ে উঠবার কারণে সংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। মাঝে কয়েক বছর শিক্ষকতা এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার পর এখন পারিবারিক ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অপরাহ্ণের চিঠি (২০১৬), অপেরার দিনলিপি (২০১৭) ও লুকিয়ে রেখেছি গোপন হাহাকার (২০১৯), শ্রেণীশত্রু (গল্পগ্রন্থ) ২০২০, বিশ্বসেরা সিনামা কথা(চলচ্চিত্রের উপর লেখা গদ্যের বই) ২০২০। এছাড়া, দিপাঞ্জলি (যৌথ) ২০১৭ ও মনোরথ (যৌথ) ২০১৮। তিনি বই পড়তে, মুভি দেখতে ও বেড়াতে ভালোবাসেন।