৯.
ডিভোর্সের ঝামেলায় আমেরিকা যাবার দিনক্ষণ পিছিয়ে গেল। তার উপর তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শীতের শেষের শেষমেশ পর্তুগালের বন্দর থেকে জাহাজে করে আমেরিকায় পৌঁছতে সক্ষম হলাম। এবং আমার ভাগ্য যে কাজ লিখে রেখেছে তাতেই মনোনিবেশ করতে হলো। চুক্তি অনুযায়ী আমি চাচার ব্যবসার দেখাশোনা করতে লাগলাম। কাজ তেমন কিছুই না, চাচার বিশাল পারফিউমের ব্যবসা। তার বিজ্ঞাপন বিভাগের তদারকির কাজ আমার উপর দিয়ে গেছেন। পারফিউমের বিজ্ঞাপন আমাকে তৈরি করতে হতো। ভাবনাশক্তি কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল বলে ভাল লাগে। কাজটাকে শিল্প হিসেবে নিয়ে বেশ আনন্দের সাথে অফিসে থিতু হয়ে গেলাম।
এছাড়া ওখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ানোর অনুরোধ আসে। সেখানে আমি ইংরেজি ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফরাসি সাহিত্যের তুলনামূলক ইতিহাস পড়াই। ফরাসি সাহিত্যের তুলনামূলক ইতিহাসের প্রথম খণ্ড বের করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায়। তখন দিনে প্রায় পনেরো ঘন্টা শুধু গবেষণার কাজেই সময় দিয়েছি। সেই দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে অদ্ভুত অনুভূতি জাগে।
অনুভূতিটা দুইরকম। একটা আলোর রশ্মি, আরেকটা ছায়াময়। মানে আলোকরশ্মির ব্যাপারটা ছিল তথ্য সংগ্রহ করা, জ্ঞান অর্জন করার অংশকে বুঝিয়েছি। লাইব্রেরিতে আমার প্রচুর পড়াশুনা করতে হতো। এরপর লেখালেখির কাজ। দিনের পর দিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে গোসল ছাড়া পাগলের মতো শুধু কাজই করে গেছি। অন্যদিকে ছায়াময় অংশ হিসেবে আমার অসুস্থ কামনা, ইনসমনিয়া, সাইকোলজির সমস্যা। প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়ত বুঝবেন, আমি নিমফেট মেয়েদের সান্নিধ্য পাবার জন্য ভেতরে ভেতরে সব সময় ছটফট করতাম। এসব ভুলে থাকার জন্য কাজে ব্যস্ত থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। সেন্ট্রাল পার্কে যেতাম, সেখানে বিকেলবেলা নিমফেট মেয়েরা খেলাধুলা করত। কাউকে কাছে পাইনি। আমার অফিসের মহিলাদের মাঝে অনেকেই সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু তারা কেউ আমার মনমতো ছিল না। সবাই প্রায় মধ্যবয়স্ক। এরপর আবার এক বছর আমি চিকিৎসার জন্য স্যানিটোরিয়ামে চলে যাই।
মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে দূরে কোথাও ভ্রমণের বিকল্প নেই।স্যানিটোরিয়ামে থাকাকালে এক ডাক্তারের সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। বাদামী রঙের দাড়ি, ভদ্রলোককে আমি বেশ পছন্দ করতাম। আর্কটিক কানাডা অঞ্চলে ঘুরে আসতে তিনি পরামর্শ দিলেন। তাঁর এক ভাই আছে যে কিনা সেবার আর্কটিক কানাডার নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছিল। আমি আগ্রহ দেখালাম। কাজটা মূলত গবেষণার। জ্ঞানের সন্ধানও হবে, ভ্রমণও হবে, প্রাকৃতিক চিকিৎসাও হয়ে যাবে এই সুযোগে- এইসব ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। কিছুদিনের মধ্যেই ডাক্তার সাহেবের ভাইয়ের সাথে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার কাজটি ছিল আসলে শারীরিক প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করা। আমার সাথে ছিল দুইজন তরুণ উদ্ভিদবিদ, একজন ছুতার। ড. অনিতা জনসন নামে একজন পুষ্টিবিদও ছিলেন। উনি অল্প কয়েকদিন থেকেই ফেরত আসেন।
আমার জন্য ভালই হয়েছিল। মেয়ে মানুষ ভুলে থাকতে চাই, ড. অনিতা জনসন থাকলে সেটা হয়ত সম্ভব হতো না। মনে মনে খুশি হলাম। একটা কানাডিয়ান গ্রুপের সাথে যৌথভাবে আমরা মেলভিল সাউন্ড পিয়েরেতে আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন করি। প্ল্যাঙ্কটন সংগ্রহ করার জন্য আমাদের আরেকটা গ্রুপ ছিল। তৃতীয় আরেকটা দল যক্ষ্মার জীবাণুর উপর কাজ করার জন্য তুন্দ্রা অঞ্চলের দিকে ছিল। অন্যদের কাজের কথা তেমন জানতে পারিনি। ওষুধের উপাদান ছাড়াও বিভিন্ন কাজে এই গবেষণাগুলো দরকার হয়।
শুরুর দিকে প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে কাজ করছিলাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে একঘেয়ে লেগে যায়। থাকার জন্য আগেকার দিনের ক্যামব্রিয়ান অঞ্চলীয় গ্রানাইটের সাথে কাঠ দিয়ে তৈরি কতগুলো কেবিন ছিল। কাজের জন্য সেখানেই প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র ছিল, টিকে থাকার জন্যও সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখা হয়। খাবার, মদ, গরম পোশাক, এমনকি ক্রিসমাস উদযাপনের সরঞ্জামও ছিল। এইসব অতিরিক্ত জিনিস বহনের জন্য মাঝে মাঝে রাগ হতো। খাবার ফুরিয়ে এলে অল্প করে খেতে হতো। অথচ অতিরিক্ত জিনিস না আনলে আরো কিছু খাবার আনা যেত।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একাকীত্ব ও বিরক্তি চেপে ধরল। প্রথম প্রথম চমৎকার মানিয়ে নিলাম। অন্তত আমার অতীতের চাইতে তখন সুখে ছিলাম। আর ওই সময় আমেরিকা ফিরে এলে আবার আমাকে বিষণ্ণতা পেয়ে বসবে। গবেষণার কাজে আমি পুরোদমে লেগে রইলাম। আমাকে অমনোযোগী করে তোলার মতো সেখানে এমন কিছুই ছিল না। শুধু অবসরে সহকর্মীদের সাথে সেখানকার কোনো হিংস্র প্রাণি নিয়ে, খাবারের সংকট নিয়ে, অতীত স্মৃতি নিয়ে, আরো এরকম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতে করতে নিজেকে ক্লান্ত মনে হতো। আমেরিকা ফিরে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, কিন্তু কাজ ফেলে যাওয়া উচিত হবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে নিউ ইয়র্ক ফিরে আসার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।
গবেষণার সময় হিসাব করলে প্রায় বিশমাস আমি কানাডার আর্কটিকে ছিলাম। আমার বিশ মাসের কাজ ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লেখা ১৯৪৫-১৯৪৬ এর একটি বার্ষিক ম্যাগাজিনে প্রকাশ করলাম। সেখানে আমার যতই কষ্ট হোক না কেন, কাজের প্রশংসা আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিল।
যদিও আমার অনেককিছুই করার মত ছিল। অনেককিছুতেই আগ্রহ পাচ্ছিলাম। কিন্তু আবার সেই মানুষের সমাজে ফিরে আসাতে আমার মানসিক চাহিদা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে লাগল। পাঠক/পাঠিকা, আপনি নিশ্চয়ই এই বিষয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন! কারণ আমার সেই অসুস্থ মানসিকতা প্রকাশ হবার জন্য ছটফট করছিল, প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিচ্ছিল। দেখা যাক কী হয়!
১০.
আর্কটিক কানাডায় আমার গবেষণার কাজ শেষ করে আসার পরে আমি থাকার জন্য নিউ ইংল্যান্ডের আশেপাশে ছোট নিরিবিলি শহর খুঁজতে লাগলাম। যাতে পুরো গ্রীষ্মটা আমি পড়াশুনা ঠিকমত করতে পারি, পাশাপাশি লেখালেখিও যাতে চালিয়ে যেতে পারি। আর বাড়ির আশেপাশে গোসলের জন্য কোনো লেক থাকতে হবে। গ্রীষ্মের ছুটিতে হাতের কাছে লেক না থাকলে গ্রীষ্মটাই মাটি। আমার পড়াশুনা, লেখালেখির পাশাপাশি ব্যবসায়িক কাজে আবার মনোযোগী হতে শুরু করলাম। আমার সৃজনক্ষমতার প্রকাশ যাকে বলে, আংকেলের পারফিউম ব্যবসার বিজ্ঞাপনের কাজে পুরোদমে লেগে যাই।
আমার আংকেলের অফিসের একজন পুরনো কর্মচারী জানালেন, তাঁর এক দরিদ্র চাচাত ভাই আছে, নাম মি. ম্যাককু। মি. ম্যাককুর বংশ ভাল, এককালে দাদা-পরদাদা সম্ভ্রান্ত ছিলেন, আর বাড়িটাও আমার থাকার জন্য উপযোগী হবে। ইদানিং তাদের টাকা পয়সায় টানাটানি চলছে। আমার থাকার সুবাদে যদি এই সময় কিছু টাকা পায় তাহলে তাদের উপকার হবে। আমি চাইলে সেখানে কয়েকমাস থেকে আসতে পারি। সেখানে আমার থাকতে কোনো সমস্যা হবে না। বাড়ির কাছেই গোসলের জন্য সুন্দর একটা লেকও আছে। আর বাড়িতে দুটো ছোট ছোট মেয়ে আছে, একটা সদ্যজাত, আরেকজন বারো বছর বয়সী, চমৎকার একটা বাগানও আছে। আমি শুনে খুব খুশি, লেক আছে বা বাগান আছে এই কারণে না, কারণটা অন্য কিছু। আমি বললাম, ‘চমৎকারভাবে চমৎকার!’ সেখানে আমার ওঠার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করে দিতে বললাম। মি. ম্যাককু পরিবারের সাথে চিঠি আদান-প্রদান হলো। অগ্রিম কিছু টাকাও পাঠিয়ে দিলাম।
মি. ম্যাককুর বাড়িতে ‘আসছি’ লিখে চিঠি পাঠিয়ে দ্রুত রওনা হয়ে গেলাম। ট্রেনে দারুণ একটা রাত কাটল। সারারাত শুধু ওই বাড়ির বারো বছরের মেয়েটিকে নিয়ে কল্পনা করে কাটিয়েছি। কখনো দেখিনি, নিমফেট কিনা তাও জানিনা, কিন্তু আমার ভাগ্য যেন আমাকে ওইদিকে টেনে নিয়ে চলল। সারারাত প্রচণ্ড উত্তেজনার ভেতরে কাটল, অনেক প্ল্যান করে নিলাম, এটা সেটা ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু স্টেশনে নেমেই বিপত্তি শুরু হল। স্টেশনে আমাকে কেউ নিতে আসেনি। এরকম হবার কথা ছিল না। মি. ম্যাককুর বাড়িতে কয়েকবার ফোন করলাম; কেউ ফোন ধরল না।
আমার সাথের জিনিসপত্র, ব্যাগ বেশ দামী ছিল। কেউ আসল না, কেউ ফোন ধরল না- চিন্তায় পড়ে গেলাম। শেষমেশ উপায় না পেয়ে স্থানীয় হোটেল খুঁজতে লাগলাম। রওনা দেবার আগেই রামসডেলের টুকিটাকি তথ্য জেনে এসেছি। ‘হোটেল রামসডেল’- খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। চেক ইন করার কিছুক্ষণ পরেই মি. ম্যাককু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন। চেহারা বিধ্বস্ত, ভেজা শরীর, কাহিনী কিছুই বুঝতে পারলাম না। মি. ম্যাককু জানালেন, তাঁর বাড়িতে আগুন ধরেছিল। নেভাতে নেভাতে ততক্ষণে পুরো বাড়িটাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভেতরের জিনিসপত্র সব পুড়েছে, থাকার মতো অবস্থা তো নেইই! একটা গাড়ি ধার করে তিনি পরিবারসহ তাদেরই একটা ফার্মে আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, তাদের সাথে আমার আর থাকা হচ্ছে না!
হতাশ হলাম। আমার হতাশা বাড়াতে মি. ম্যাককু আবার জানালেন, মিসেস হেজ নামে তাঁর স্ত্রীর এক বান্ধবী আছে, ৩৪২, লন স্ট্রিটে থাকে। ভদ্রমহিলার বাড়িটাতে আমার থাকার সব ব্যবস্থা করে এসেছেন। মি. ম্যাককু অতিথিপরায়ন, সম্ভবত রামসডেলের সবাই অতিথিপরায়ণ। নিজের বাড়ি পুড়ে যাবার পরেও আমার কথা ঠিকই মাথায় রেখেছে। শুধু তাই না, আমার থাকার আলাদা ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। মিসেস হেইজের সামনের বাড়ির এক মহিলা মি. ম্যাককুকে লিমুজিন গাড়িটা ধার দিয়েছেন আমাকে তুলে নেবার জন্য। কিন্তু দুঃখিত! আমি আর রামসডেলে থাকতে পারব না। এখানে এসেছিলাম মি. ম্যাককুর মেয়ের টানে। একসাথেই যখন থাকতে পারব না তখন আর রামসডেলে থেকেই কী হবে!
লিমুজিনটা দেখতে সুন্দর, পুরনো বডি, আগেকার ফ্যাশনের, ছিমছাম। লিমুজিনটার দিকে তাকাতে তাকাতে টের পেলাম আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। যে কারণে এখানে আসা তার পুরোটাই মাটি হয়ে গেল। বাড়ি পুড়েছে ভাল কথা, বাড়িটার কি কোনো ইনস্যুরেন্স করানো ছিল না? আমার একইসাথে প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ এবং বিরক্তি চেপে ধরল। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা আমার জন্য অর্থহীন! তবু একজন ইউরোপিয়ান ভদ্রলোক হিসেবে সৌজন্যতাটুকু দেখাতেই হল। বেচারা ম্যাককু এই ভয়াবহ অবস্থার ভেতরেও যেহেতু আমার কথা ভেবেছে, সম্মান জানাতেই হল। ওই মুমূর্ষু লিমুজিনটাতে ব্যাগ রেখে উঠলাম। গাড়িতে যেতে যেতে প্রতিজ্ঞা করলাম, এখানে থাকব না! যে কোনো অজুহাতে বা অজুহাত ছাড়াই চলে যাব। এরচেয়ে বারমুডা বা বাহামার ওদিকে কোথাও গিয়ে গ্রীষ্মটা কাটানো যেতে পারে। ওখানে গ্রীষ্মকাল মানে অনাবিল সৌন্দর্য। সমুদ্রসৈকতে সময়টা খারাপ কাটবে না। এসব ভাবতে ভাবতে মনে হল নিজেকে গাধার মত সাজেশন দিচ্ছি। ট্রেনে আসতে আসতে যে ভাবনাগুলো ছিল, যে স্বপ্নগুলো ছিল, সেই ভাবনার, সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের ব্যর্থতার কাছে সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য কিছুই না।
গাড়িটা করে আমরা লন স্ট্রিটে পৌঁছে গেলাম। জানালা খোলা ছিল। কোত্থেকে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে খোলা জানালা দিয়ে আমাকে প্রায় কামড়ে দিয়েছিল। জানালার কাঁচ তুলে দিলাম, তবু লাফিয়ে লাফিয়ে বারবার জানালায় উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, তারপর হাল ছেড়ে দিল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ দূরে সরে গেল। মিসেস হেইজের বাড়িটা দেখতে পেলাম, সাক্ষাৎ হরর সিনেমার পোড়োবাড়ি! মেজাজ সপ্তমে থাকলে তাজমহলকেও ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হবে। মিসেস হেইজের বাড়িটা একটু পুরনো, সাদা রঙের চাইতে ধূসর ভাবটাই বেশি। বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামল। ভেবেছিলাম আমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে যাবে, আর আমি বাড়িটাতে না ঢুকে সোজা ট্রেন ধরতে স্টেশনে চলে যাব। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হলো আমাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে না দেখা পর্যন্ত ভদ্রলোকের স্বস্তি নেই। অগ্যত বেল চাপলাম। তখন গাড়িটা চলে গেল, ওপাশের বারান্দায় বসা বৃদ্ধা চেয়ারে বসে বসে কার উদ্দেশ্যে যেন হাত নাড়ছে। একজন কাজের মহিলা এসে দরজা খুলে দিল। নিগ্রো পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধ মহিলা, অধিকাংশ চুল পাকা, বাবুর্চির পোশাক গায়ে, স্বাস্থ্য ভাল। আমাকে ঢুকতে দিয়ে ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে ব্যস্ততার সাথে আবার রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল।
একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। নিচে বসার ঘর। দরজাটা সুন্দর। আশেপাশে তাকালাম, হলঘরটা মাঝারি আকারের, ডানদিকের দেয়ালের সাথে সোফা। সুন্দর সব মেক্সিকান আসবাব দিয়ে সাজানো। একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। শোবার ঘরগুলো সব দোতলায় বোঝা গেল। একটা পুরনো ধূসর টেনিস বলের দিকে আমার নজর চলে গেল। তখনই উপর থেকে আওয়াজ এলো, ‘আপনি নিশ্চয়ই মসিয়ে হামবার্ট?’
ভদ্রমহিলার হাতে একটা সিগারেট ধরানো। সেটা থেকে কিছু ছাই পড়ে গেল। উনি তাহলে মিসেস হেইজ! সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসল। তার পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল, হলুদ ব্লাউজ, তার উপর মেরুন রঙের জামা পরে আছে। বললাম, ‘আজ্ঞে, আমিই!’
লক্ষ্য করলাম ভদ্রমহিলা সিগারেট ছাই ফেলার ভঙ্গিতে অবিরত সিগারেটে টোকা দিয়ে যাচ্ছে। বাজে অভ্যাস!
ভদ্রমহিলাকে সহজভাবে বর্ণনা করতে গেলে বলব, বয়স আনুমানিক ত্রিশের মাঝামাঝি, কপালটা উজ্জ্বল সুন্দর, প্লাক করা ভ্রু। দেখে যথেষ্ট সাদাসিধে মনে হলেও একেবারেই যে সাধারণ এমন না। যথেষ্ট আকর্ষণীয়, মুখে হাসি আছে কিন্তু সেটা অল্প সময়ের জন্য। শুধু ভ্রু নেচে ওঠে। ভদ্রমহিলা আমাকে বাড়িটা দেখাতে লাগল। প্রথমে যে ঘরটায় গেলাম সেটা সাজসজ্জার ঘর। মি, ম্যাককু’র বাড়ি পুড়ে যাওয়া নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো, রামসডেলে কেন থাকতে এসেছি বললাম। ভদ্রমহিলার শান্ত স্নিগ্ধ চাহনিটা বেশ মজার ছিল। আপনার দিকে সারাক্ষণ ঠিকই তাকিয়ে আছে, সারাদেহে চোখ বুলিয়ে যাবে কিন্তু সরাসরি চোখের দিকে তাকাবে না। আলতো করে এড়িয়ে যাবে। আমরা আবার বসার ঘরে এসে বসলাম। উনি এটা সেটাকে ছাইদানি হিসেবে ব্যবহার করে অভ্যস্ত বোঝা গেল। সোফায় একটা পা তুলে পেতে বসল।
ভদ্রমহিলাকে যতটুকু মনে হল খুব গুছিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করে। অনেকটা বইয়ের ভাষার মত গোছালো, বা থমথমে পরিবেশে কোনো সভা-সমিতির ভাবগম্ভীর বক্তব্যের মত। মনে হবে কথাগুলো শুধু বলার জন্যই বলছে, মন থেকে বলছে না। হাস্যরসহীন, আনমনা ধরণের, অল্পতেই আমার বিরক্তি এসে গেল। এখানে আর এক মুহূর্তও না, বের হয়ে সোজা স্টেশন! মনে মনে এই মহিলার হাত থেকে মুক্তি পাবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার রামসডেলে যথেষ্ট হয়েছে, এবার মুক্তি চাই। আমি যদি এই বাড়িতে উঠতামও তাহলে এই মহিলার সাথে কীভাবে মিশব আমি নিজেও জানি না।
কে থাকছে এখানে! থেকে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। এরকম একটা বাড়িতে আমার পক্ষে আরাম করে থাকা সম্ভব না। মিসেস হেইজের পিছনে পিছনে দোতলার থাকার ঘর দেখতে গেলাম। আর বেশিক্ষণ নেই। ঘর দেখে সোজা পছন্দ হয়নি বলে বেরিয়ে যাব। আমার জন্য যে ঘরটি বেছে রেখেছে সেই ঘরে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বামপাশের ঘর। ভেতরের তথাকথিত আধুনিক আসবাবপত্রকে আমার স্রেফ হাস্যকর মনে হলো। টেবিল ল্যাম্পের বাতি নষ্ট, এইপাশে একটা মাত্র বাথরুম। বাথরুমে গোলাপি রঙের বক্ষবন্ধনী ঝুলছে, সেটা থেকে টুপটাপ পানি ঝরছে। মেঝেতে একটা খেলনা সাপ পড়ে আছে, প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত কয়েকটা লম্বা চুলও দেখতে পেলাম। আমার রুমের সাথে আরেকটা রুম, এই একমাত্র বাথরুমটা পাশের রুমের বাসিন্দার সাথে আমাকে শেয়ার করতে হবে। আমি এতবড় একজন পুরুষ মানুষ, তার কোনো প্রাইভেসির ব্যাপার নিয়ে মাথাব্যথা নেই? রুমের জিনিস এদিক সেদিক অগোছালো হয়ে পড়ে আছে, কোনো যত্ন নেই। নিচে কাজের লোকদের থাকার জন্য যে ঘর, কাজের লোক নেই বলে ভদ্রমহিলা সেটাকে ‘সেমি –স্টুডিও’ বলে দাবী করল। হামবার্ট, ভাগো! নিজেকে বলতে থাকি। বাড়িটাতে না থাকতে চাওয়ার একগাদা কারণ দেখাতে পারব। কিন্তু থাকার একটা কারণও আমি খুঁজে পেলাম না। অসহ্য হয়ে উঠলাম, বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলাম। আমার মাথায় তখন পরের ট্রেনের শিডিউল ঘুরপাক খাচ্ছে।
তবে ভদ্রমহিলার অমায়িক ব্যবহার ভাল লেগেছে। এইজন্য অন্তত একটা ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসা উচিত। আমার কমোরেডের পিছন পিছন পাশের ঘরে গেলাম। ‘বুঝতে পারছি বাড়িটা আপনার পছন্দ হয়নি’ ভদ্রমহিলা বেশ ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল। আমার এই পছন্দ না হওয়াটাতে উনি কিছুটা বিব্রত বোঝা যাচ্ছিল। এক মুহূর্ত কথা গুছিয়ে নিয়ে এগিয়ে এসে আমার বাহুতে একটা হাত রেখে আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে আবার বলল, ‘আমি জানি এই বাড়িটা থাকার জন্য আহামরি কিছু না। কিন্তু আমি এইটুকু কথা দিতে পারি, এখানে আপনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবেন। আপনার কোনো সমস্যা হবে না, কথা দিচ্ছি!’ ভদ্রমহিলা কথা দিতে দিতে আমার ঠোঁটের দিকে তাকাল। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে আবার বলল, ‘চলুন, আপনাকে আমার বাগানটা দেখাই!’
আমি আমার অসাধারণ পথ প্রদর্শকের পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে হলঘরের শেষে ডানদিকে সেই সাজসজ্জার ঘর ছিল, আর তার সাথেই ছিল খাবার ঘর। আমার থাকার জন্য যে ঘরটা ভদ্রমহিলা দেখিয়েছে তার নিচে একটা পুরনো গ্যারেজ আছে। আমাকে দরজা খুলে দেয়া সেই নিগ্রো কাজের মহিলাকে দেখলাম চ চলে যাচ্ছে, ‘মিসেস হেইজ! আমি যাচ্ছি!’
‘আচ্ছা ঠিক আছে লুইস’- মিসেস হেইজ জবাব দিল, ‘তোমার সাথে শুক্রবারে বসব আমি!’
লুইস মাথা নেড়ে সায় এদিয়ে চলে গেল। সাজসজ্জার ঘর বরাবর গিয়ে এরপর ডাইনিং রুম। মেঝেতে একটা মোজা পড়ে থাকতে দেখলাম। মিসেস হেইজ সেই মোজাটা তুলে নিয়ে কাছের ক্লোজেটের দিকে ছুঁড়ে দিল। ডাইনিং রুমে একটা মেহগনি কাঠের টেবিল, তার উপর সুন্দর করে ফলদানি সাজানো রয়েছে। সেখানে ফল নেই অবশ্য, শুধু সুন্দর একটা পাথরের টুকরো আছে। আবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। পরের ট্রেইনটা ধরতে পারলে ভাল হতো। যত দ্রুত যাওয়া যায় তত মঙ্গল। এখানে থাকা মানে সময় অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। বাগানে পা রাখতেই সুর করে কেউ চেঁচিয়ে উঠল, ‘পিয়াজ্জা!’ বিশ্বাস করুন পাঠক, কোনো প্রকার পূর্ব সংকেত ছাড়া, একটা বিশাল নীল ঢেউ আমার হৃদয়ে এসে আছড়ে পড়ল। সেই ঢেউয়ের প্রাণপণ ঝাপটা আমার মুখের উপর এসে পড়ছে। আর আমার ভেতরে এতগুলো বছর পর এক নিমেষেই সেই রিভেইরাতে ফেলে আসা প্রেম তোলপাড় করে জেগে উঠল।
হ্যাঁ, এই তো সে! এই তো সেই মেয়ে! সেই ভাঙ্গা শরীর, সেই মধুরঙা কাঁধ, সেই একই চোখ, ত্বক, সেই একই বাদামী রঙের চুল! বুকের উপর একটা হালকা জামা পড়ে আছে। শুধু আমার চোখ থেকে আড়াল করার জন্য, কল্পনা থেকে ওই স্তনযুগল কিছুতেই আড়াল হচ্ছে না। ওর গালের একপাশে একটা ছোট্ট কালো-বাদামী তিল দেখতে পেলাম। এইতো সেই মেয়ে, অবশেষে তোমাকে খুঁজে পেলাম। ললিতা, যাকে আমি পঁচিশ বছর আগে সমুদ্র সৈকতে পেয়েছিলাম, জানি না কোন ভুলে হারিয়েও ফেলেছিলাম। এবার কোথায় যাবে? আর হারাতে দেব না! আমি আমার সেই অতীতকে ফিরে পেলাম, আমার অতীতের ভালবাসাকে খুঁজে পেলাম, ললিতা! আমার বিশুদ্ধতম পাপ, এতদিন কোথায় ছিলে?
কী দারুণভাবে ওকে ঠিকই চিনে নিতে পেরেছি। হতে পারে আমি এখন এক মধ্যবয়সী পুরুষের দেহ নিয়ে আছি, কিন্তু আমার মন সেই বয়সেই আটকে আছে, সেই রিভেইরার সৈকতে আটকে আছে। নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছিল না, মরীচিকা ভেবে আরো গভীর করে তাকালাম, না, মরীচিকা না। জলজ্যান্ত বাস্তব, আমার সামনে ঘাসের উপর উপুর হয়ে শুয়ে আছে, একটা ফোয়ারা থেকে পানি ছিটকে এসে পরম আদরে ওর শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর কী গভীর মনোযোগ দিয়ে ম্যগাজিন পড়ছে। একবার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিল, তারপর আবার ম্যাগাজিনে মুখ ডুবালো। আমি চিনতে ভুল করিনি! এইতো আমার ললিতা, আমার ছোট্ট ললিতা, আমার ধ্যান, আমার সমস্তকিছু, ল-লি-তা!
কোনো দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে না। বরং আমি যেন আমার অনুভূতিগুলোকে আবার সতেজ ভাবে জেগে উঠতে
দেখছি। কী অসাধারন!
‘ও আমার মেয়ে, লো’- ভদ্রমহিলা বলল, ‘আর এই যে বাগান। আমার আদরের ফুলগুলো। চমৎকার না?’
‘নিশ্চয়ই চমৎকার’- লো’র দিকে তাকিয়ে শুধু এতটুকু বলতে পারলাম, ‘চমৎকার! অসম্ভব চমৎকার!’
রনক জামান
কবি ও অনুবাদক ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১, মানিকগঞ্জে জন্ম।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : অগ্রন্থিত ওহী [তিউড়ি, ২০১৯] এবং
ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা [অনুপ্রাণন ২০১৬]