১
আমার জন্ম গ্রামে, প্রাকৃতিক প্রসবের পর
নান্দনিক বৃক্ষরাজি গ্রামশোভা প্রভূত বাড়াল,
অনেক দূরের নদী পাড় ভেঙ্গে নিকটস্থ হল
আলো-ছায়ার তীরে রাত্রিদিন জোয়ারের স্বর ।
পৃথিবীর যাত্রা প্রাগৈতিহাসিক গ্রামের সজল
বুঝি গ্রাম উঠে যাবে নক্ষত্রের বিম্বিত ভেলায়,
বুঝি গ্রাম নৃত্যরত মেঘেদের ময়ূরী মেলায়
ঘনবর্ষণে অবাক শোনাবে সেই মীরার গজল ।
যখনি সে ঘোমটা খুলে দাঁড়াল অবাক সড়কে
যখনি সে অরুণাভ পাল তুলে ভাসল মাঝগাঙে,
ঘুমন্ত অনেক গ্রামে নিশিপরী প্রহরের পথ ভাঙে
কাকলি ফুটিয়া ওঠে গ্রাম্য বনে অলীক পালকে ।
২
যে দেশে পর্বত কম কবিদের পৃষ্ঠা ভরে খাঁড়া
সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি অনতিক্রম্য শৃঙ্গের দর্প দেখায়
যে দেশে অঢেল গ্রাম সে দেশে কবিরা পদ্যের
পদভারে নগরের আনকোরা ঘুঙুর বাজায়
বনশূন্য দেশে জঙ্গলের ভয়মূর্তি আনে ।
যে দেশে প্রপাত নেই কবিদের পঙ্ক্তি জুড়ে হারা
প্রবাহিত নদীজল সুললিত মুগ্ধকরি মুখটি দেখায়
যে দেশে অজস্র নদী মাতৃস্নেহে গলাটি জড়ায়
সে দেশে কবিরা প্রাণময় রূপকে উপমায়
গ্রামভরা দেশে শহরের ভয়মূর্তি আনে ।
৩
লোকঠাঁসা দেশে আশ্চর্য জনবিরল এই গ্রাম
জনশ্রুতি সকলে মরিয়া ভূত, কিছু গেছে বিদেশের পেটে
শহরের রিং রোডে, গুলশান লেকের কিনারে
জ্ঞাতিভাই, জ্ঞাতিবোন কেউ কেউ আছে
ভাবি কোথায় লুকাল এই গ্রামবাসী, শস্যের ভেতরে ইঁদুর
মাঠের আঁড়াল নেই, আকাশের পৃষ্ঠা সব খোলা
জঙ্গলের আব্রু তারা বহুকাল পূর্বেই চড়িয়েছে চুলার চিতায় ।
এখন হা হা শূন্য প্রান্তরের বিস্ময়বোধক চিহ্ন ঐ শীর্ণ মানুষেরা!
৪
গ্রামের মুখখানি পুরনো প্রেমের মত ভুলে গেছি
ঈশ্বরতাড়িত পথে চকচকে মিনারের সারি
নির্ভুল নিশানা টাঙ্গানো, ভূতগ্রস্থ গ্রামের চোয়াল
একদা কমনীয় ছিল কান্তিময় প্রেমিকার মুখ
বহু বন্যায় পা দুটি ফুলে গেছে, খরায় শুষ্ক হল ঠোট
নামগুলো শিখে নিতে হবে এখন গ্রামের পথে
মুখস্থ হেঁটে হেঁটে দীঘিপায় সমস্ত জেনেছি
করুণকান্তির মত যে রৌদ্র চিহ্ন ফাগুনের
আজো নির্ভুল লেপ্টে আছে গ্রামের কপোলে
প্রকৃতি স্নেহার্দ্র আজো, মানুষ ভূলেছে প্রিয়স্থান
মানুষ নিয়েছে ঠাঁই শহুরে কবরে ।
৫
এই গ্রাম আমি কী করে লিখি, এই জ্যোৎস্নাভরা মাঠ
এই দুরন্ত ঘূর্ণির পিঠে টালমাটাল সব রাজ্যপাট
পাহাড়ের পাশে পড়ে থেকে আকাশের মুখচ্ছবি ধরে
ঐ দ্যুতিময় তারাদের উল্টোপিঠে শুয়ে আছে এই গ্রাম
হাঁস আর মাছদের নিয়ে নিমগ্ন ভীষণ ।
এই প্রেম আমি কী করে লিখি, এই কামনাময় মাঠ
এই দুর্দমনীয় আবেগের হাতে উল্টে-পড়া সাজানো সংসার
বাস্তবের পাশে পড়ে থেকে স্বপ্নগ্রামের মুখচ্ছবি ধরে
ঐ অনুজ্জ্বল দিনাতিপাতের উল্টোপিঠে শুয়ে আছে এই প্রেম
স্মৃতিময় হৃদয় আর ব্যর্থতা নিয়ে বিপন্ন কাতর !
৬
মাসুদ খানের এই গ্রাম, দিবারাত্রির কুড়িগ্রাম
যেন এক আশ্চর্য প্লানেটোরিয়াম,
উপুড় করা আকাশের ছাদ, বৃত্তাকার দিগন্তের ফাঁদ
খৈয়ের মতন যেথা নক্ষত্র চিত্রিত ।
ব্রাত্য রাইসুর এই গ্রাম, চৈতগ্রীষ্মের সুধারাম
যেন এক অসুস্থ স্যানাটোরিয়াম,
টাঙ্গানো মেঘদের ঘরে প্রাতঃসেবা গুঞ্জরণ করে
আকাশ দর্পণে থৈহীন বরষা বিম্বিত !
কামরুল হাসান
জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১, শরীয়তপুরে। তিনি মূলত কবি। অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ গদ্যকার হিসেবেও খ্যাত। আছে নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
ভারতের বিশ্বখ্যাত খড়গপুর আইআইটি থেকে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড ও এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কামরুল হাসান শিক্ষকতা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। কামরুল হাসান দু’হাতে লেখেন। এপর্যন্ত ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি ছোটগল্প, ১টি প্রবন্ধ, ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থ, ২ টি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সমীর রায় চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে পোস্টমর্ডান বাংলা পোয়েট্রি ২০০৩ সম্পাদনা করেছেন।
এই বৃষ্টি ভেজা সকালে আপনার গ্রাম সিরিজ কবিতাগুলি এক স্নিগ্ধ অনুভূতি এনে দিল! ভালো থাকবেন সবাই!