গতকাল অনেক রাত জেগে লিখছিলাম। ফরাসী জানালার বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেখি রাস্তার ওপারের পথবাতিটির ম্লান আলো প্রানপণে আশেপাশের অন্ধকার সরাতে চেষ্টা করছে। সামনের বৃদ্ধাশ্রমের ছড়ানো বাড়ীটি আলো-অন্ধকারের মধ্যে একটি কালো বেড়ালের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে। পাশের রেডিওতে হাল্কাভাবে বাখ্ বাজছে। ভাবছিলাম উঠে এক কাপ কফি বানাবো কিনা।
তখনি —ঠিক তখনি বেজে উঠল সেই কথাটি। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এমন স্তব্ধতা আমার মাঝে আসে যখন আমি তিনটে জিনিস শুনি—সেই কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?, সেই যুগান্তকারী ভাষনের শেষ লাইন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবং সেই অবিস্মরনীয় কণ্ঠস্বর, ‘I have a dream’.
মনে পড়ল ১৫ জানুয়ারী রেভারেন্ড ড: মার্টিন লুথার কিং এর জন্মদিন। এই অনন্য সাধারণ মানুষটি আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন মাত্র ৩৯ বছর বয়েসে ১৯৬৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল। বেঁচে থাকলে আজ মানুষটির বয়স হত ৯৩ বছর। কিন্তু অতো বড় মাপের মানুষের জীবনকে তো কোন সংখ্যা দিয়ে তে পরিমাপ করা যাবে না, এবং তাঁর হ্রস্ব জীবনও তাঁর সুবিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধিত্ব করে না। ড: মার্টিন লুথার কিং তাঁর সময়ের চেয়ে বড়, তাঁর জীবনের চেয়ে বড়, এবং তাঁর স্বপ্নের চেয়ে বড়।
তাঁর সময়টা আমরা জানি, জানি তাঁর জীবনও। আর তাঁর স্বপ্নের কথা তো বিধৃত হয়েছে তাঁর সেই অভূতপূর্ব বক্তৃতায়। ড: মার্টিন লুথার কিংয়ের সময়টি ছিল বিভাজনের, বৈষম্যের, অবিচার আর অত্যাচারের। ভাবা যায় ষাটের দশকেও বর্ণবাদ জেঁকে বসেছিলো যুক্তরাষ্ট্রে, জীবনের সর্বস্তরে বিভাজিত ছিল কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গেরা? বৈষম্য, অবিচার ও অত্যাচার ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনের গল্প।
তাঁর নিজের জীবন? মানবাধিকার পক্ষে আর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছিল সারাজীবনের। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের জন্যে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। এবং সে সংগ্রাম আর কাজের প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করেছেন অহিংস আন্দোলন। তাঁর সুললিত ভাষণে মুগ্ধ ও উদ্দীপ্ত করেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষকে। শান্তি এ সাম্যের ক্ষেত্রে তাঁর অভাবিত কাজের জন্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন মাত্র ৩৫ বছর বয়েসে ১৯৬৪ সালে।
ড: মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্নের সবচেয় দাঢ়্য উচ্চারণ তাঁর ‘I have a dream’ ভাষণটি। দীর্ঘ পথযাত্রার শেষে ওয়াশিংটনে প্রদত্ত সে ভাষণটি তিনি শুরু করেছিলেন এই বলে যে, ‘মুক্তির ঘোষণা স্বাক্ষরিত হওয়ার একশ বছর পরেও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গরা মুক্ত নন’ বক্তৃতার মাঝামাঝি এসে ব্যক্ত করেছিলেন এ বাসনা যে, সময় এসে গেছে, গণতন্ত্রের আকাঙ্খাগুলো পূরণ করার, সময় এসেছে বিভাজনের অন্ধকারময় উপত্যকা থেকে রৌদ্রস্নাত বর্ণবাদমুক্ত ন্যয্যতার পথে আসার, সময় এসেছে সব মানুষের জন্যে সাম্যের বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার’।
আমার মনে হয়, আজকের যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে, তাঁর পরিপ্রক্ষিতে এ কথাগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের আজ বড় প্রয়োজন ঐ মাপের একজন পথনির্দেশকের। ড: মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘I have a dream’ বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আর একটি কথা আমার বড় প্রিয়। ঐ যে যেখানে তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীর সব মন্দ কাজের জন্যে দুর্জনদের দুষ্কর্মই শুধু দায়ী নয়, সুজনদের নিশ্চুপতাও সমানভাবে দায়ী’। সারা বিশ্বের জন্যে এ এক বিপুল অর্থবহ কথা।
কতক্ষণ আত্মমগ্ন হয়ে ছিলাম, মনে নেই। চমক ভাঙ্গলো যখন রেডিওতে ড: মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই কথাগুলো
‘I have a dream that my four little children will one day live in a nation where they will not be judged by the color of their skin but by the content of their character. I have a dream today.’
ভাবলাম, কতদূর—আর কতদূর যেতে হবে তাঁর এই স্বপ্নটি পূরণের জন্যে? প্রায় ৬০ বছর তো হয়ে গেলো, ‘কেউ কথা রাখে নি’।
সেলিম জাহান
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.