রৌদ্র করোজ্জ্বল এক সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সারা দিনের জন্য। দলের বহর কম নয়। গিন্নি, আমি আর আমাদের বাবু। সাথে বাবুর বন্ধু নূর, রাহুল, শিহাব, ধ্রুবনীল এবং রুবাইয়াৎ। রাহুল বলল, আঙ্কল আজকের ভ্রমণটা কিন্তু স্পেশাল।
তাই নাকি! কি রকম স্পেশাল?
আজ আমরা জাহাজে করে যাবো ‘ম্যাকিনো আইল্যান্ড’। ই্ংরেজি বানানটা যদিও ‘Mackinac Island’ কিন্তু, এখানকার সবাই উচ্চারণ করে ‘ম্যাকিনো’। লেক হিউরন এর মাঝখানে বায়ু দুষণমুক্ত ছোট্ট একটা দ্বীপ। আয়তন প্রায় চার বর্গমাইল। তবে কোষ্ট এবং বাইরের জলাধার যুক্ত করা হলে ম্যাকিনো আইল্যান্ডের আয়তন দাঁড়াবে উনিশ বর্গ মাইল। রুবাইয়াৎ জানাল।
বাঃ তাই নাকি! তাহলে তো দারুণ জমবে আজকের জার্নি। লেকের ভিতরে জাহাজে করে ঘুরে বেড়াব। উৎফুল্ল হয়ে বলি।
আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে এসেছিলাম সরকারি একটি প্রোগ্রামে। আমার একমাত্র পুত্র অরণ্য মিশিগানের সাগিনো ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্রেডে পড়ে। শহরের নাম সাগিনো সিটি। নামেই সিটি, আসলে মিশিগানের প্রত্যন্ত এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক ছোট্ট একটা শহর। তবে পুত্রের দৃষ্টিনন্দন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটি বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ছাত্রদের পদচারণায় ক্যাম্পাস মুখর থাকলেও আমরা এসেছি সামার ভ্যাকেশনের সময়। ক্যাম্পাস তাই ফাঁকা, ফাঁকা সাগিনো শহরও।
ছেলের সাথে সময় কাটানোর জন্য সরকারি কাজের সাথে ছুটি নিয়ে এসেছি এক মাসের। সাথে আছে গিন্নি হাসি। ওয়াশিংটন ডিসির কাজ সেরে দুজনে উড়ে গিয়ে নামলাম মিশিগানের ডেট্রয়েট। বাবু আর তার বন্ধুরা মহা উৎসাহে আমাদেরকে রিসিভ করে নিয়ে গেল সাগিনো সিটিতে। উৎসাহের মূল কারণ, প্রতিবছরই সামারে আমি আমেরিকা আসি আর বাবু এবং তার বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বের হই। চলে যাই অনেক দূরে দূরে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত, শিকাগো, নিউইয়র্ক যখন যেমন সুবিধা হয়। ওরাও তাই সামারের ছুটিতে পরম আগ্রহে বসে থাকে আমার অপেক্ষায়।
তাহলে আজকের স্পেশাল ভ্রমণে সবার পোশাকও হোক স্পেশাল। তোমাদের সবার জন্য নীল-সাদা একই স্ট্রাইপের টি-শার্ট নিয়ে এসেছি ঢাকা থেকে। হাসতে হাসতে কথাটা বলে হাসি তার ব্যাগ খুলে একে একে বের করতে থাকে টি-শার্ট, সাথে সাদা ক্যাপ।
হৈ হৈ করে ওরা গেঞ্জি আর ক্যাপ বেছে নেয় ওদের সাইজ মতো। আমিও শিং ভেঙ্গে বাচ্চাদের দলে ঢুকে পড়ি। ওদের মতোই নীল-সাদা টি-শার্ট আর সাদা ক্যাপ পড়ে রেডি হয়ে গেলাম। দুটো গাড়িতে আমরা মোট আট জন। গাড়ি ছুটছে লেক হিউরনের দিকে।
কত মানুষের বাস ম্যাকিনো আইল্যান্ডে? যেতে যেতে জানতে চাই আমি।
২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী এই দ্বীপে স্থায়ী পরিবার ১২৮টি এবং জনসংখ্যা ৪৯২। বললো রুবাইয়াৎ।
সবই কি সাদা? জানতে চাইলাম আবার।
বেশিরভাগই সাদা আঙ্কল। প্রায় চুয়াত্তর ভাগ। নেটিভ আমেরিকান আছে প্রায় আঠারো ভাগ। সামান্য কিছু আছে এশিয়ান। তবে গ্রীষ্মকালে হাজার হাজার সিজনাল কর্মী এবং পর্যটকে এই আইল্যান্ড গমগম করে। এখানে আছে ভালো ভালো হোটেল। তার ভিতরে বিখ্যাত হোল গ্রান্ড হোটেল। বলল ধ্রুবনীল।
তবে আঙ্কল, ছোট্ট একটা দ্বীপ হলে কি হবে, ম্যাকিনো আইল্যান্ড কিন্তু কাগজে কলমে মিশিগান স্টেট এর একটি সিটি। সিটির একটি কাউন্সিলও আছে। কাউন্সিলের মেয়রও আছেন একজন। প্রতি বছর নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র নিযুক্ত হয়। বলল রাহুল।
তাই নাকি! এ যে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। হাসতে হাসতে বলি আমি। স্পেশালিটি কিছু আছে নাকি এই সিটির?
তা তো আছেই আঙ্কল। দ্বীপটির মূল বৈশিষ্ট্য হোল, এখানে যন্ত্রচালিত কোন গাড়ি চলে না। পরিবেশ যাতে কোনভাবেই কলুষিত না হয় সেজন্য আইন করে দ্বীপটিকে যন্ত্রচালিত যানমুক্ত করা হয়েছে। জানাল নূর।
তাহলে কি হেঁটে হেঁটে বেড়াতে হবে? উৎকন্ঠিত হয়ে বলে গিন্নি।
ইয়ং এবং উৎসাহী পর্যটকরা পিঠে ব্যাগপ্যাক ঝুলিয়ে পায়ে হেঁটেই গোটা দ্বীপ ঘুরে ঘুরে দেখে, সৌন্দর্য উপভোগ করে, বুক ভরে টেনে নেয় মুক্ত বাতাস। যাদের হাঁটতে কষ্ট, তাদের জন্য আছে ভাড়ায় চালিত বাইসাইকেল, ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা। দলে দলে লোকজন সাইকেলে ঘুরে বেড়ায় দ্বীপের এমাথা থেকে ওমাথা। বয়স্ক এবং হাঁটতে যাদের অসুবিধা, তারা ঘোড়ার গাড়িতে চলাচল করে। বলল শিহাব।
কি কি পাওয়া যায় এখানে? জানতে চাইলাম আগ্রহের সাথে।
ম্যাকিনো আইল্যান্ডের স্পেশালিটি হোল ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে তৈরি একধরণের নরম মিঠাই। নাম ‘ফাজ’ (Fudge)। ফাজ একধরণের সুগার ক্যান্ডি। চিনি, বাটার এবং দুধ একসাথে মিশিয়ে ২৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় জ্বাল দিয়ে বানানো হয় মন্ড। সেই মন্ড ঠান্ডা করে তৈরি হয় মসৃন এবং ক্রিম স্বাদের চতুষ্কোন আকারের ফাজ। ম্যাকিনো আইল্যান্ডে গড়ে উঠেছে বিশাল ফাজ তৈরির ইন্ডাষ্ট্রি এবং ব্যবসা। পর্যটকরা এখানে এসে ফাজ কিনে খায়, অন্যদেরকে উপহার দেবার জন্য কিনে নিয়ে যায়। এখানকার ফাজ এর পরিচিতি মিশিগান তো বটেই, সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আমেরিকা এবং কানাডা জুড়ে। ম্যাকিনো দ্বীপে আছে অনেক ফাজ এর দোকান। এক দমে বলে গেল ধ্রুবনীল।
তাহলে তো টেষ্ট করে দেখতে হয় কেমন খেতে ফাজ। আমেরিকান মিষ্টি বলে কথা।
তবে, আঙ্কল, একসময় এই দ্বীপ ছিল পশম ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। আর প্রতি বছর শিকাগো থেকে ম্যাকিনো পর্যন্ত ইয়ট রেস হয়। আয়োজন করে ‘শিকাগো ইয়ট ক্লাব’। আর একটি রেস অনুষ্ঠিত হয় পোর্ট হিউরন থেকে ম্যাকিনো পর্যন্ত। আয়োজক ডেট্রয়েট এর ‘বে ভিউ ইয়ট ক্লাব’। বাবু এতক্ষণে মুখ খোলে।
গল্প আর কথায় কথায় একসময় পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। গাড়ি গিয়ে থামলো স্টিগন্যাস পোর্টে। এটা একটা নতুন স্পটে।। এক ঘন্টা পর পর ছোট জাহাজের মতো ফেরি ছেড়ে যায় ম্যাকিনো আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। পার্কিং-এ গাড়ি রেখে আমরা চললাম ফেরির টিকেট কাটতে। এই স্পট থেকে ম্যাকিনো আইল্যান্ডে যেতে সময় লাগে আধাঘন্টার মতো।
সাদা রঙের দোতলা ফেরি। ফেরি চলতে শুরু করল রাজহংসের মতো ডানা মেলে। মনে হোল লেক নয়, যেন সমুদ্রের ভিতর দিয়ে চলেছি আমরা। পার্থক্য শুধু বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে না আমাদের ফেরির গায়ে।
গোটা আমেরিকা আর কানাডা জুড়ে আছে অনেক বড় বড় সুপেয় জলের লেক। তার ভিতরে সবচে বড় পাঁচটি লেকের নাম লেক সুপিরিয়র, লেক মিশিগান, লেক হিউরন, লেক এরি এবং লেক ওন্টারিও। পাঁচটি লেকের প্রত্যেকটির বেসিন আলাদা আলাদা হলেও প্রাকৃতিকভাবেই একটির সাথে অন্যটি যুক্ত। যেন দেহ আলাদা, প্রাণ এক। একসাথে মিলে লেকগুলো এমন একটা যোগাযোগের চেইন তৈরি করেছে যা চলে গেছে আমেরিকার মধ্য-পূর্ব এলাকা থেকে কানাডার সেন্ট লরেন্স নদী হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে। জলস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে সুপিরিয়র থেকে হিউরন এবং মিশিগান, সেখান থেকে দক্ষিণে এরি এবং সব শেষে অন্টারিওতে। গোটা লেকগুলোর মধ্যে ছোটবড় আইল্যান্ড আছে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার।
লেক মিশিগান এবং লেক হিউরন আবার পরষ্পরের সাথে এমনভাবে যুক্ত, মনে হয় যেন একটাই লেক। ৫টি লেক একসাথে মিলে ’গ্রেট লেকস্’ নামে পরিচিত। পাঁচটি লেকের বেসিন এবং জলধারার মোট যে আয়তন তার মধ্যে গোটা দুয়েক বাংলাদেশ অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে। আর সবগুলো লেকের বেসিন এবং সংলগ্ন উপরের জমি মিলিয়ে আয়তন হবে প্রায় গ্রেট বৃটেন এবং ফ্রান্সের সম্মিলিত আয়তন এর সমান। লেকগুলো বিস্তৃত আমেরিকা-কানাডার বর্ডার এলাকাজুড়ে। কানাডার অন্টারিও এবং আমেরিকার মিশিগান, উইচকনসিন, মিনেসোটা, ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, ওহিও, পেনসিলভেনিয়া এবং নিউইয়র্ক স্টেট এইসব লেক সংলগ্ন।
বৃহত্তম এই পাঁচটি লেক একত্রে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে সুপেয় জলের লেক এবং মোট সুপেয় জলের পরিমানের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ভূপৃষ্ঠের মোট সুপেয় জলের একুশ শতাংশ আছে এই লেকগুলোতে। যার মোট আয়তন ২৪৪,১০৬ বর্গ কিলোমিটার। মোট জলের পরিমান ২২,৬৭১ কিউবিক কিলোমিটার যা বৈকাল হ্রদ থেকে সামান্য কম। বৈকাল হ্রদে মোট জলের পরিমান ২৩,৬১৫ কিউবিক কিলোমিটার যা ভূপৃষ্ঠের প্রায় তেইশ শতাংশ সুপেয় জলের আঁধার।
‘গ্রেট লেকস’ এর বৈশিষ্ট্য বলতে গেলে সমুদ্রের মতো। প্রবাহমান বাতাস, ঢেউ, স্রোতধারা, গভীরতা এবং সীমানা দৃষ্টিগোচর না হওয়া ইত্যাদি সব সমুদ্রের গুণাবলী বিদ্যমান থাকায় এই লেকগুলো অভ্যন্তরীণ সমুদ্র নামেও পরিচিত। তবু এরা সমুদ্র নয়। কারণ এরা সরাসরি অন্য সমুদ্রগুলোর সাথে যুক্ত নয় আর লেকগুলোর জলও লবনাক্ত নয়। লেক সুপিরিয়র বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় এবং সুপেয় জলের লেক হিসেবে সবচেয়ে বড়। আর এককভাবে একটি দেশের মধ্যে লেক মিশিগান সবচেয়ে বড়।
লেকগুলো কিভাবে তৈরি হয়েছিল সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় চৌদ্দ হাজার বছর আগে ‘লাস্ট গ্লেসিয়াল পিড়িয়ড’ অর্থাৎ বরফ যুগের শেষে বরফের চাঁই এবং লেয়ার সরে যাবার পর বেসিনগুলো উন্মুক্ত হয় এবং বেসিনগুলো বরফগলা জলে পূর্ণ হয়ে থাকে। এখন এই লেকগুলো মানুষের যাতায়াত, চলাচল, ব্যবসা-বানিজ্য, মাছধরা এবং নানা জলজপ্রাণী ধারণ করে জীববৈচিত্র রক্ষা করে চলেছে।
ছোট ছোট ঢেউ ভেঙ্গে নীল জল কেটে এগিয়ে চলেছে আমাদের ফেরি। আমরা সামনের খোলা ডেকে বসে দেখতে থাকি চারপাশের অপূর্ব সব দৃশ্যাবলি। মাথার উপরে পাল্লা দিয়ে আমাদের সাথে উড়ে চলেছে সীগ্যল এর ঝাঁক। ঝিরিঝিরি বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর, ভরে যাচ্ছে মন। আশেপাশে ছোট বড় রঙ বেরঙের বোট, নৌকা, ইয়ট। কোনটা আসছে, কোনটা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে একসময় আমরা পৌঁছে যাই ম্যাকিনো আইল্যান্ডে।
ছেলেরা সবাই যার যার মতো একটা করে বাই সাইকেল ভাড়া নিয়ে নিল। হাসি আর আমি লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে উঠে বসলাম ঘোড়ার টমটম গাড়িতে। গাইড কাম গাড়ির চালক লাল-সাদা গাড়োয়ানের পোশাক পরা গোলগাল এক সুন্দরী কন্যা। ম্যাকিনো আইল্যান্ডের উপর লম্বা একটা বক্তৃতা দিয়ে শুরু করলো তার যাত্রা। চলতে চলতে ডাইনে বাঁয়ে দর্শনীয় যা আছে তা গড় গড় করে বলে যেতে থাকল সে। তুলে ধরতে লাগল পুরনো ইতিহাস। যেতে যেতে দেখলাম- সারে হিলস মিউজিয়াম, বাটারফ্লাই হাউজ, মার্কোয়েট পার্ক। পার্কের সবুজ ঘাসে ঢাকা লন দেখার মতো। দেখলাম স্কিপ রকস বা বীচ গ্লাস। দ্বীপের এই অংশের তীরবর্তী এলাকা পাথুরে। চকচকে বালুকাবেলা ঝকঝক করতে থাকে কাঁচের মতো।
গাড়ি গিয়ে থামলো আর্চ রক এর সামনে। পাথরের প্রাকৃতিক প্রাচীর। মাঝখানটায় বড় ফাঁকা। সেই ফাঁকা দিয়ে দৃষ্টি গিয়ে পড়ে লেক হিউরনের নীল জলে। প্রাচীরে ওঠার জন্য রয়েছে চমৎকার রেলিং দেয়া কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে গেলাম প্রাচীরের উপর। চোখ মেলে দেখলাম টিলা আর জঙ্গলের পাশ দিয়ে লেক হিউরনের অথৈ জলরাশি। অপরূপ সে দৃশ্য।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আমাদের ঘোরা শেষ হয়ে গেল। যেখান থেকে রওনা দিয়েছিলাম সেখানেই নামিয়ে দিল আমাদের। কিন্তু খুঁজে পাই না ছেলেদের। হাসি আর আমি আশপাশের দোকানগুলোর ভিতরে ঘুরে ঘুরে সময় কাটাতে থাকি।
একসময় দেখা মেলে ওদের। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, সবার জামা কাপড় ভেজা। জানতে চাই, কি ঘটনা?
তেমন কিছু না আঙ্কল। লেকের পানিতে সাঁতার কেটে এলাম একটু। সেজন্যই তো দেরি হোল আমাদের। নূর বলল।
ভীষণ স্বচ্ছ আর টলটলে জল বাবা। দেখলে তুমিও নামার লোভ সামলাতে পারতে না। বাবু হেসে বলে।
আঙ্কল চলেন খাওয়া-দাওয়া করি। তবে লাঞ্চ শেষে কিন্তু ‘ফাজ’ খেতে হবে মন ভরে। নইলে অবিচার করা হবে ম্যাকিনোবাসীর উপর। রাহুল বলল হাসতে হাসতে।
নিশ্চয়ই। অবশ্যই ‘ফাজ’ খাওয়াব তোমাদের। ইচ্ছেমতো খাবে তোমরা, যে যতগুলো পার।
আমি খোঁজ নিয়ে এসেছি আঙ্কল কোন দোকানের ফাজ আসল আর রিয়েল টেষ্টি। বলল ধ্রুবনীল।
মনে পড়ে গেল, একবার চট্ট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছি। কুমিল্লা এসে মহাসড়কের পাশে দেখি মাতৃভান্ডার এর বিশাল বড় শো রুম। খুশি হলাম এই ভেবে যে, কুমিল্লার বিখ্যাত রস মালাই এখান থেকেই নিয়ে যেতে পারবো। কুমিল্লা শহরের বাজারের মধ্যে মাতৃভান্ডার এর মূল দোকানে আর যেতে হল না। রস মালাই কিনে গাড়িতে ওঠার সময় দেখি শুধু একটা নয়, অনেকগুলো মিষ্টির দোকান রাস্তার পাশে। সবগুলোর নামই মাতৃভান্ডার। ঢাকা ফিরে সেই রসমালাই মুখে দিয়েই বুঝলাম, আসল নয় সেগুলো। স্বাদ এবং মান দুটোই অত্যন্ত নিম্নমানের।
ধ্রুবনীলের কথা শুনে মনে হোল, এই আমেরিকাতেও ফাজ কিনতে গিয়ে সেইরকম নকলের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা আছে নাকি আবার! মনের ভিতরে দ্বিধাদ্বন্ধ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি লাঞ্চ এর সন্ধানে। তারপর যাব ধ্রুবনীলের খুঁজে বের করা সেই ফাজ এর দোকানে।
ভেবেছিলাম, না জানি কেমন সুস্বাদু হবে ‘ফাজ’! মুখে দিয়ে সে মোহ ভঙ্গ হল আমার। আহামরি তেমন কিছু মিষ্টি নয়। এরচাইতে অনেক অনেক গুনে সেরা আমাদের বাংলাদেশের নলেনগুড়ের সন্দেশ, রসগোল্লা বা অন্য যে কোন মিষ্টি। তবে ‘ফাজ’ শুকনো বলে অনেকদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়।
এবার ফেরার পালা। রিটার্ন টিকেট কাটাই ছিল। আমরা উঠে বসলাম ফেরিতে। বিকেলের নরম রোদ এসে পড়েছে লেক হিউরনের স্বচ্ছ জলের উপর। ঢেউয়ের সাথে চিকচিক করে যেন নেচে নেচে ফিরছে সেই সোনালি রোদেরচ্ছটা। একরাশ ভাললাগার অনুভূতি নিয়ে আমরা ফিরে চললাম ঘরের টানে।
সুধাংশু শেখর বিশ্বাস
বিসিএস ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। সহকারী সচিব হিসেবে কর্মজীবন শুরু। মাঠ পর্যায়ে ছিলেন ইউএনও, এডিসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরডিএ, বগুড়ার পরিচালক। কাজ করেছেন উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। অবসর নিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। উচ্চতর পড়াশুনা করেছেন লন্ডনে। প্রশিক্ষণ, সেমিনার, সরকারি কাজে ঘুরেছেন ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, এশিয়ার বহু দেশ।
অবসর জীবন কাটে ঘোরাঘুরি আর লেখালিখি করে। লিখেছেন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের জীবনধারা নিয়ে গবেষণাধর্মী উপন্যাস ‘নমসপুত্র’। পেলেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। লিখলেন মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় নিয়ে ‘শরণার্থী’, গণ জাগরণ মঞ্চ নিয়ে ‘দ্রোহের দীপাবলি’। লিখে চলেছেন একের পর এক উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিগল্প, ভ্রমণ কাহিনী।জন্ম ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার প্রত্যন্ত বিলের মধ্যে মধুপুর গ্রামে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশব, কৈশোর কেটেছে খুলনা, যশোর, বরিশাল এলাকার বিভিন্ন জেলায়। স্কুল জীবন থেকেই যুক্ত ছিলেন ছাত্র রাজনীতি এবং ‘উদীচী’ ‘খেলাঘর’ এর মতো সংগঠনের সাথে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন অর্থনীতি বিষয়ে।
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনের। উপন্যাস (৪)- নমসপুত্র, নমস উপাখ্যান, শরণার্থী, দ্রোহের দীপাবলি। ভ্রমণ কাহিনী (৬)- ম্যাকেলিনা, হোটেল সিয়াম, সাগিনো ভ্যালি, ঘুরে দেখা আমেরিকা, হোয়াইট চ্যাপেল, মস্কোর ঘন্টা। গবেষণা গ্রন্থ (১)- বিলের জীবন: নমশূদ্রদের বার মাসের তের পার্বণ। ছোটগল্প সংকলন (১)- স্ট্যাটাস। স্মৃতিকথা (৩)- সোনালি ডানার চিল (শৈশব), সোনালি ডানার চিল (কৈশোর), সোনালি ডানার চিল (যৌবন)।