শীতকালীন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
রুটিন-বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে যুদ্ধের এই প্রস্তুতি আমার বেশ লাগছিল। সত্যিকার যুদ্ধ তো আর নয়! এ হচ্ছে যুদ্ধের মহড়া! হঠাৎ করে সাইরেন বেজে ওঠে না। দেশজুড়ে ব্ল্যাকআউট হয় না। এখানে অ্যাটম বোমার আতঙ্কও নাই! আর দুর্ভাবনা কীসের!
এই যুদ্ধ-প্রস্তুতি-পর্ব ঘর থেকে শুরু হল। প্রকৃত যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধ প্রশিক্ষণের যে তোড়জোড় দেখছি সেও কম কিছু নয়। আমি একে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ বললেই কর্তা সিরিয়াস হয়ে যায়! যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের শক্তির জায়গা এড়িয়ে গিয়ে বলি,
–খেলাটাও তো একরকম যুদ্ধ! সেখানেও প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে হয়! তাই না?
এই প্রস্তুতি বিষয়ে আমি মে মাস (আমাদের বিবাহের মাস) থেকেই কর্তার মুখে শুনে আসছি। বার বার বলতে শুনেছি, –আমি ডিসেম্বর মাসে ক্যান্টনমেন্টে থাকব না, মাঠে থাকব।
শুরু হল কর্তার বিছানা-বালিশ, জামা-জুতা ও অস্ত্র-শস্ত্র গুছানো। তার একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি হচ্ছে তিন ফুট বাই দুই ফুট একটা কালো ট্রাঙ্ক। তার উপর সাদা রং দিয়ে কর্তার নাম ও পদবি লেখা। ট্রাঙ্কটাকে এই পর্যন্ত আমি কবজা করতে পারিনি। যখনই আমি জিজ্ঞেস করেছি,
–ওটার মধ্যে কী আছে গো?
কর্তার একই জবাব, তেমন কিছু না। আমার নিজস্ব কিছু জিনিস-পত্র।
আমি একটা শব্দের উপর জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করি,
–পত্র?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে কর্তা মিটিমিটি হাসে। বলে,
–এটাই আমার বিবাহপূর্ব সংসার!
কর্তার হাসি দেখে তার বিবাহপূর্ব সংসারের প্রতি আমার কৌতূহল ও ঔৎসুক্য আরও বেড়ে যায়। মনুষ্য চরিত্র! কিন্তু প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এতদিন ধুলাবালির মাঝে ট্রাঙ্কটি স্টোররুমেই পড়ে ছিল৷ ট্রেনিং-এ যাবার প্রাক্কালে ব্যাটম্যান আর কর্তা দুজনে যত্নসহকারে ট্রাঙ্কটি এমন ভাবে নিয়ে এলো যেন এর মধ্যে আলিবাবার রত্নভাণ্ডার রাখা আছে। আমিও মহা কৌতূহল নিয়ে দেখার জন্য বসে পড়লাম। দেখা যাক, প্যান্ডোরার বাক্স থেকে কী বের হয়! প্রেমপত্র, ছবি, ডায়েরির পাতায় শুকনো ফুলের পাপড়ির বদলে বের হল একটা কালো প্যান্ট, একটা সাদা শার্ট, জলপাই রঙের হেলমেট, তিনটা রেজিমেন্টাল টাই আর বেশ কিছু বই–যেগুলো কর্তা স্কুল জীবনে নানান প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিল। একটা বই হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করছি, যদি কোনো প্রমাণ হাতে আসে। আমার গোয়েন্দাগিরির তৎপরতা ও পরবর্তী ব্যর্থতা দেখে কর্তা হো হো করে হেসে উঠল।
–তুমি কী ভেবেছিলে?
–ভেবেছিলাম তোমার বিবাহপূর্ব সংসারের গোপন-তথ্য আজ উদ্ধার করব! এ যে দেখছি আগেই সব সরিয়ে ফেলেছ! মিলিটারির হাঁটুতে বুদ্ধি, এ তো আর বলা যাচ্ছে না!
আত্ম প্রশংসায় তৃপ্ত কর্তা বলল,
–হাঁটুতে বুদ্ধি লোকে হিংসা থেকে বলে, বুঝলে! আমাদের মতো হাঁটুর শক্তি সিভিলিয়ানের নেই তো, তাই এসব বলে শান্তি পায়!
আমি আর বিশেষ তর্কে গেলাম না। হাঁটুতে বুদ্ধি থাকার কোনো নমুনা দেখছি না। দেখতে পাচ্ছি ইউনিটে প্রতিদিন প্রায় দু-মাইল দৌড়াতে হয়। আঠারো মিনিটে দুই মাইল, দেড় ঘণ্টায় নয় মাইল দৌড়ে ফিজিক্যাল ফিটনেসের পরীক্ষা দিতে হয়! এই দৌড়-ঝাঁপ দেখে কী করে বলি মিলিটারির হাঁটুতে বুদ্ধি? বুদ্ধি মাথায় না থেকে হাঁটুতে থাকলে এতদিনে পালিয়ে বাঁচত!
আমি কর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
–আচ্ছা তুমি এই বইগুলো বাড়িতে না রেখে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াও কেন?
কর্তা মোলায়েম করে বইগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, –কী বলো! তুমি বুঝবে না এই বইগুলো আমার কত প্রিয়। এইগুলোই তো আমার অর্জন! কত স্মৃতি এক একটা বইয়ের সঙ্গে জড়িত! বাড়িতে রাখলে কে কখন হাতে করে নিয়ে চলে যায় তার কোনো ঠিক আছে! জীবনভর এগুলো আমার সঙ্গেই থাকবে।
ছুটির দিনেও অফিস রানার এসেছে কর্তার ফিল্ডসার্ভিস ম্যাচিং অর্ডার রেডি করতে। উহু! এই রানার সুকান্ত ভট্টাচার্যের চিঠি নিয়ে ছুটে চলা রানার নয়। সামরিক অফিসে পিয়নকে রানার বলে! এবং অবশ্যই সে একজন সৈনিক। এসেই শুরু করে দিয়েছে পিতল পালিশ করা। বিগ প্যাকে ইউনিফর্ম ও হেলমেট রাখার সময় রানারের হাত থেকে হেলমেট নিয়ে কর্তা মাথায় পরে হেলমেটের স্ট্র্যাপ পরীক্ষা করতে করতে আমাকে বলল,
–একটা খুব মজার ঘটনা মনে পড়ল!
আমি গল্পের গন্ধ পেয়ে মহা উৎসাহে জিজ্ঞেস করলাম,
–মজার ঘটনা! কী হয়েছিল?
কর্তাকে তার ক্যাডেট কলেজ কিংবা মিলিটারি বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলে খুব উৎসাহের সঙ্গে কথা বলে৷ অন্য বিষয়ে হ্যাঁ-না দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে চায়। যদিও আমার সঙ্গে পেরে ওঠে না। আমি ছিনেজোঁকের মতো লেগেই থাকি। যাই হোক কর্তা মজার ঘটনা বলা শুরু করল।
কর্তা তখন মিলিটারি অ্যাকাডেমির ক্যাডেট। এটা প্রশিক্ষণ এলাকার ঘটনা। সকাল বেলা বি-এচলন-এ(Bechlon) গিয়েছে সেকশনের জন্য নাস্তা আনতে। মেনু ছিল পুরি হালুয়া আর চা। এক হাতে নিলো দশজনের পুরি-হালুয়া (প্যাক করা) আরেক হাতে মেসটিনে চা নিতে হবে।
এখনো সামরিক বিষয় অনেক কিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যায়। অনেক শব্দ ও বাক্য বুঝতে পারি না। কর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
–মেসটিন কী?
–মেসটিন হচ্ছে মালটি-পারপাস একজোড়া এলোমোনিয়ামের ছোটো পাত্র। দেখতে অনেকটা রেক্টেংগুলার টিফিন-বক্সের মতো। একপাশে ফোল্ডিং হ্যান্ডেল থাকে। রান্না থেকে শুরু করে খাওয়া সবই এটাতে সেরে নেওয়া যায়। এই মেসটিন সবসময় স্মলপ্যাকে সঙ্গে রাখতে হয়।
তখন বয়স কম ছিল। মাঝে মাঝে মাথায় উদ্ভট কাণ্ড ঘটানোর ইচ্ছা জাগত!
হঠাৎ মাথায় এলো মেসটিনে চা না নিয়ে হেলমেটে নিয়ে যাই। অনেকখানি একসঙ্গে নেওয়া যাবে। মাথা থেকে হেলমেট খুলে নিয়ে বললাম,
–এটাতেই চা দাও।
এক হাতে হালুয়া-পুরি আরেক হাতে হেলমেটে চা নিয়ে ফিরছি, কাঁধে রাইফেল। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়! ফেরার পথে টার্ম কমান্ডারের সামনে পড়ে গেলাম। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
–তোমার হেলমেট হাতে কেন?
–সেকশনের চা নিয়ে যাচ্ছি স্যার।
–তোমার মেসটিন কোথায়?
–স্মলপ্যাকে আছে স্যার।
–মেসটিনে চা নাওনি কেন?
–স্যার।
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নাই।
টার্ম-কমান্ডার ধমকের সুরে বললেন,
–পুট অন ইয়োর হেলমেট।
–ইয়েস স্যার, বলে চা সহ হেলমেট মাথায় পরে নিলাম।
কর্তার গল্প শুনে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল! চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করি!
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,
–গরম চা নিজের মাথায় নিজে ঢেলে দিলে? কেমন লাগল?
–শীতের দিনে গরম চা বেশ আরামই লাগল! হুকুম হলে তো করতেই হবে।
সামরিক হুকুম। নড়চড় নেই, করতেই হয়। আমার তখন মনে পড়ল–
কাজী নজরুল ইসলামের ‘ব্যথার দান’ উপন্যাসে পড়েছিলাম,
“হঠাৎ এই মস্ত জঙ্গলটায় আসতে হল। কেন এ রকম পিছিয়ে আসতে হল তার এতটুকুও জানতে পারলুম না! এ- মিলিটারি লাইনের ঐ-টুকুই সৌন্দর্য! তোমার ওপর হুকুম হল, ঐ কাজটা কর! কেন ও-রকম করব? তার কৈফিয়ত চাইবার কোনো অধিকার নেই তোমার। বাস্ – হুকুম! –যতক্ষণ তোমার নিঃশ্বাস আছে, ততক্ষণ কাজ করে যাও, যদি চলতে চলতে তোমার ডান পায়ের ওপর মৃত্যু হয়, তবে বাম পা পর্যন্ত চলো।”
প্রস্তুতি পর্ব দ্বিতীয় দিনও জোরকদমে চলল। হোল্ডঅল নামানো হল। হোল্ডঅল পেতে ভিতরে তোষক তার উপর সাদা ধবধবে চাদর, বালিশ, ফৌজি খড়খড়ে কালো কম্বল ভাঁজ করে বিছানা তৈরি হল। কর্তার হোল্ডঅল শয্যা দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
–তাঁবুতে ক্যাম্প খাটের উপর এই হোল্ডঅল পেতে ঘুমাও ?
কর্তা অবাক হয়ে উলটে আমাকেই প্রশ্ন করল,
–ক্যাম্প খাট কোথায় পাব? তাঁবুর ভিতর মাটিতে গ্রাউন্ডসিটের উপর হোল্ডঅল পাতা হয়। আর সিনিয়ার অফিসারদের জন্য তাঁবুর ভিতর মাটি কেটে উঁচু করে তার উপর হোল্ডঅল পেতে দেয়া হয়।
আমার ধারণা ছিল তাঁবুর ভিতর নিশ্চয় সবার জন্য ক্যাম্প খাট থাকে। ফোল্ডিং ক্যাম্পখাট, ক্যাম্পস্টুল আমি সিনেমায় দেখেছি! যদিও আমার সিনেমা-লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা কর্তাকে বললাম না। শুনে হাসবে আর আমাকে খেপাবে, বলবে,
–তুমি কি ভেবেছ ফৌজি জীবন সিনেমার মতো?
মিলিটারিকে বিয়ে করে, আমার কৌতূহলের শেষ নাই। জিজ্ঞেস করি,
–আর সৈনিকদের জন্য কি একই ব্যবস্থা?
কর্তা মাথা নেড়ে বলে,
–না না, ওদের জন্য হোল্ডঅল ইস্যু করা হয় না। ওরা মাটিতে গ্রাউন্ডসিটের উপর কম্বল বিছিয়ে ঘুমায়।
–শীতের সময় মাটিতে শুয়ে ঠাণ্ডা লাগে না?
–নাহ্! হোল্ডঅলের মধ্যে কম্বল জড়িয়ে দিব্বি ঘুমাই।
আমি আবারও জানতে চাই,
–আর সৈনিকরা, যারা গ্রাউন্ডসিটের উপর ঘুমায়?
–সৈনিকরা দশজন করে বড়ো একটা তাঁবুতে থাকে। অনেক লোক একসঙ্গে থাকলে এমনিতেই তাঁবু গরম হয়ে যায়। শয্যা-পর্ব এভাবে শেষ হল। এবার তৈরি হবে বিগপ্যাক ও স্মলপ্যাক। একে একে কর্তা লিস্ট মিলিয়ে সব প্যাক করল। কর্তার কাছ থেকে লিস্ট নিয়ে আমিও পড়ছি। লিস্টে একটা নাম টুর্নিকেট ছাড়া সবকিছু আমার চেনা। জিজ্ঞেস করলাম,
– টুর্নিকেট কী?
কর্তা টুর্নিকেট হাতে নিয়ে বলল,
–বনে-জঙ্গলে সাপে কামড়ালে এই যে সরু দড়ি দেখছ এটা দিয়ে ক্ষতস্থানের উপরে বেঁধে দেয়া হয়। যাতে রক্ত উপরের দিকে যেতে না পারে। আরেকটা এই ছোটো কাঠিটা ওটার ভিতরে ঢুকিয়ে চেপে ধরে, কাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দড়ির বাঁধন শক্ত করা হয়। এরপর ব্লেড দিয়ে কেটে বিষাক্ত রক্ত ফেলে দিতে হয়।
আমি শিউরে উঠে বললাম,
–কী ভয়াবহ কাণ্ড! ওখানে সাপও আছে?
–বনে-জঙ্গলে সাপ, পোকামাকড় তো থাকবেই। আমরাই বরং ওখানে অনাকাঙ্ক্ষিত!
–বাহ্! অনাকাঙ্ক্ষিত বললে! মাঝে মাঝে তুমি চমৎকার বাংলা শব্দ বলো!
–হুঁ। আমাকে বাংলায় আনাড়ি ভেবো না৷ ইন্টারমিডিয়েটে আমি বাংলায় সিক্সটি নাইন পেয়েছিলাম!
কর্তা যাবার আগের দিন আর এক কাণ্ড! সাপের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়ির পিছনে বনজঙ্গল কাটা হচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে হইচই শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি ব্যাটম্যান ছুটতে ছুটতে আসছে। ভাবলাম সাপ দেখে ভয় পেয়েছে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, –ম্যাডাম বাড়ির পিছনে একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে!
আঁতকে উঠে বললাম,
–লাশ? কার লাশ?
–জানি না। ঘাস কাটতে গিয়ে একটা গর্তের নীচে মাটি সরিয়ে দেখে লাশ!
কথা শেষ করেই আবার দৌড়ে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে থাকি। ফোনের শব্দে সংবিৎ ফিরল। কর্তার কল। তার কোনো কথা শোনার আগেই আমি এক নিঃশ্বাসে ঘটনাটা বললাম। আমার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনেও কর্তা ভাবান্তরহীন কণ্ঠে বলল,
–আমি দেখছি।
কিছুক্ষণ পর মিলিটারি পুলিশ নিয়ে কর্তা হাজির। আশপাশের লোকজনকে সরিয়ে দেয়া হল। ঘাস কেটে মাটি খুঁড়ে বের করা হল লাশ নয়, শুকনা সাদা খটখটে এক ভাঙাচোরা কঙ্কাল! সেই কঙ্কালকে কাপড়ে জড়িয়ে তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হল।
পরদিন কর্তা চলে গেল তার উইন্টার কালেকটিভ ট্রেনিংগ্রাউন্ডে। এদিকে আমার রাতদিনের ঘুম হারাম! চোখ বন্ধ করলেই সেই কঙ্কালের অবয়ব দেখি। তার চিকন চিকন আঙুল চোখের সামনে নাচতে থাকে! এই সময়টায় আমাকে একা থাকতে হচ্ছে!
তার উপর আশেপাশের জল্পনা-কল্পনা শুনতে শুনতে ভাবছি ঢাকায় চলে যাব কিনা! কিন্তু এই কঙ্কাল রহস্যভেদ না করে যেতেও ইচ্ছে করছে না। ঢাকায় গেলে কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না।
পাশের বাড়ির ভাবি চা খেতে এসে বলে গেলেন,
–মনে তো হয় অল্প বয়সী মেয়ে ছিল! কেউ খুন করে মাটি চাপা দিয়েছে!
বুঝতে পারলাম না কেন উনার মনে হল অল্পবয়সী মেয়ে!
আরেক ভাবি বললেন, আমার মনে হয় একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মি কাউকে খুন করে এখানে পুঁতে রেখেছে!
আর আমার মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথের কঙ্কাল গল্পের সেই নারী মুখ!
প্রতিদিনই কর্তার সঙ্গে কথা হয়। কথা বলার প্রথম প্রসঙ্গই কঙ্কাল নিয়ে থাকে। জানতে চাই,
–কোনো খোঁজ-খবর পেলে? কে ছিল? কঙ্কাল দেখে তো মনে হয় অনেকদিন আগে খুন করা হয়েছে! জানো, অনেকে বলছে এটা কোনো মেয়ের কঙ্কাল।
কর্তা বলল,
–না, কঙ্কালের গঠনটা বেশ লম্বা ধরনের। বাঙালি মেয়েরা এতটা লম্বা হয় না। দেখা যাক, তদন্ত চলছে!
তোমার ভয় লাগছে?
–হুঁ, ভয় পাচ্ছি কিছুটা।
–ঢাকায় চলে যেতে চাও?
–না। আমি জানতে চাই কঙ্কালটা কার?
সাতদিন পর কর্তা বলল,
–কঙ্কালের রিপোর্ট এসেছে।
আমার হার্টবিট বেড়ে গেল।
–কার কঙ্কাল?
–আমাদের এই বাসাটায় আগে একজন ডাক্তার থাকত। এই কঙ্কালটা ছিল তার অস্থিবিদ্যা শিক্ষার হাতিয়ার। বিয়ের পর ভাবি এই কঙ্কালকে সহ্য করতে পারছিলেন না। বেচারা ডাক্তার কঙ্কালটাকে বাগানের পিছনে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। তোমরা পারো বটে! কত যে গল্প বানিয়ে ফেলেছ এটাকে নিয়ে! এবার ভয় কমেছে?
বলেই কর্তা হো হো করে খুব হাসলো!
বাবলী হক
বাবলী হকের জন্ম পঞ্চাশের দশকে ঢাকা শহরে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পুরোনো ঢাকায়। কৈশোর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। ছোটোদের পাতায় ছড়া ও কবিতা দিয়ে শুরু। সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালী সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বের হয় প্রথম উপন্যাস। তারপর চলে গিয়েছিলেন অন্তরালে। দীর্ঘ তিরিশ বছর পর ২০১৫ তে স্মৃতির পটভূমিতে লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আম্বিয়াদাদি ও তার বিড়ালেরা’। আবার ফিরে এলেন লেখালেখির জগতে। ‘অষ্টপ্রহর আনাগোনা’ তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও তিনি মূলত গদ্য লেখেন কিন্তু কবিতা পড়তে ভালোবাসেন। প্রিয় কবির তালিকাও দীর্ঘ। প্রিয় লেখক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা চৌধুরী ও কবিতা সিংহ। বৃষ রাশির জাতিকা এই লেখকের শখ—ভ্রমণ ও বাগান করা।