১৭ .
আমাদের বিয়ের খবর একটা ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছিল, কিছু কিছু ঘটনাও পরে ছাপে ওরা। আমি ওদের মত করেই বলার চেষ্টা করছি আসলে। ওই ম্যাগাজিনগুলো আমার কাছে এখন আর নেই। অদ্ভুত ছিল, সত্যমিথ্যা মিশিয়ে ইচ্ছামত গালগল্প ছেপে দিত। যাই হোক, আমি শার্লটকে ফোন করে জানাতে গেলাম যে আমি ওর প্রস্তাবে রাজি। লো’কে নিয়ে চলে এসো, ধুমধাম করে বিয়ে হবে। ক্যাম্পে ফোন করতে জানা গেল শার্লট ওখানে লো’কে পৌঁছে দিয়েই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে আধাঘন্টা আগে। ওপাশে লো’কে পেলাম। আমি ওকে আমার সিদ্ধান্তটা জানালাম। মনে হচ্ছিল ওর মনোযোগ নেই ঠিক। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। আমি আবার বললাম, ‘ডলরিস, আমি তোমার মা’কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ব্যস্ত ভঙ্গিতে জবাব এলো, ‘ও আচ্ছা!’ এরপর খিলখিল করে হেসে দিল, বলল, ‘কবে বিয়ে করছ?… দাঁড়াও… এক সেকেন্ড…’ এপাশ থেকে শুনতে পেলাম ও কার সাথে যেন কথা বলছে জোরে জোরে। গলা শুনে মনে হল বেশ আনন্দেই আছে। ভাল তো! কয়েকঘন্টার ব্যবধানেই এই হ্যান্ডসাম হামবার্ট নামের প্রেমিকের কথা ভুলে গেছে সে। এসবে আর কী যায় আসে? আমি তো ওকেই পেতে চলেছি।
বিকেলবেলা বসেছিলাম। প্রচুর ড্রিংক করে ফেলছিলাম। একটার পর একটা, তারপর আরেকটা। জিন আর আনারসের জুস মিশিয়ে। এটা আমার বেশ পছন্দের ড্রিংক, আনারস জুস এবং জিন একসাথে। দিগুণ শক্তি পাই শরীরে। আমি নিজেকে সময়টা ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলাম। বারান্দায় বসে বাইরের দিকে খেয়াল করছি।
একটা কুকুর ওইপাশের বাড়ির পুরনো সূর্যঘড়িটার কাছে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। ললিতাকে ভাবলাম। জিনের প্রভাব আর ললিতার চিন্তায় এতটাই নেশগ্রস্থ হয়ে গেলাম যে খোলা চোখেও প্রায় পড়ে গিয়েছিলাম চেয়ার থেকে। একটা পুরাতন বেড়া আমাদের বাগান আর প্রতিবেশীর ফালতু ভাগাড়ের মাঝখানে পার্থক্য করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাসগুলো অদ্ভুত সবুজ। ম্যারিয়ন আর ম্যাবেল, দুই বালিকা, দুই নিমফেট পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এদেরকে দিয়ে আমার কী করার আছে? আমার তো শুধু ললিতাকে চাই।
১৮.
যখন একটা শহরে স্ত্রী মাত্র দুবছর ধরে থাকে আর স্বামীর একমাসও হয়নি, যেখানে স্বামীর চিন্তার জন্য সময়ই ছিল অল্প, তখন বিয়েটা আর কেমন হবে? যেন কোনো শোকসভার মতই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। না আমি কোনো বরদের পোশাক পরেছিলাম, না শার্লটের হাতে ছিল কোনো প্রার্থনার বই। আমাদের বিয়ে অথচ ললিতাকে পর্যন্ত আসতে বলা হল না। আর সে আসবেই বা কেন? ক্যাম্প কিউএ গিয়ে সে ভালই আছে। বরং এখানেই ও খারাপ থাকত।
আমার নিজস্ব ইচ্ছাগুলো শার্লটের সাথে মিলেমিশে গেল। এমনকি আমার নিজস্ব সময় বলেও কিছু থাকল না। কারণ ও ছিল খুব বেশি সঙ্গপ্রিয়। যদিও নিজের মনকে বা কান্নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না সে, তবু ও ছিল এক কথার মানুষ।
যাই হোক কিছুদিনের মধ্যেই আমার সাথে স্ত্রীর মত সহজ হয়ে গেল শার্লট। ও খুব ভাল বাইবেল পড়তে পারত। এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করে বসল ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস ব্যাপারটা নিয়ে। আমি শুধু বললাম, এই ব্যাপারে আমি আসলে সম্পূর্ণই মুক্তমনা, ঈশ্বরকে নিজের ভিতরে ধারণ করি। ধর্মগুরুদের চেয়ে মহাজাগতিক আত্মায় আমার আগ্রহ বেশি। ও ওর হাতের আঙ্গুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল যে আমার আত্মীয় স্বজন বা পূর্ব-পুরুষরা কী ছিল! আমার বাবা সংশয়বাদী ছিলেন, আমার দাদা ছিলেন তুর্কী। পুরোটা বলার পরে জিজ্ঞাসা করলাম এখনো কি ও আমাকে বিয়ে করতে চায় কিনা! শার্লট বলল যে এটা কোনো সমস্যাই না। তবে যদি আমার মধ্যে কখনো দেখে যে খ্রিস্টান ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই তাহলে সে আত্মহত্যা করবে। কথাটা আমাকে নাড়া দিল; কারণ সে সত্যিই তাহলে আত্মহত্যা করবে। এককথার মানুষ ও, প্রচণ্ড জেদী।
যদিও ও খুবই বিনয়ী ছিল। আমার সাথে কথা বলার সময় যদি ঢেঁকুর তুলত তবু ‘দুঃখিত’ বলে ফেলত। আর ওর বান্ধবীদের সামনে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিত মি. হামবার্ট বলে। ভাবলাম আমার কিছুটা জনপ্রিয়তা হয়ত ওকে সুখী করবে। আমাদের যেদিন বিয়ে হল সেদিন রামসডেলের একটি পত্রিকায় আমার ইন্টারভিউ এলো, সাথে আমার এবং শার্লটের ছবি। ছবিটাতে শার্লটের একটা ভ্রু উঁচু আসছে, আর ওর নামের বানান ভুল করে লিখেছে ‘হ্যাজার’। এই ভুলগুলো থাকার পরও ও দুর্দান্ত খুশি।
ওর নাগরিকতা নিয়ে কিছুটা সমস্যা ছিল। সেটা আমাকেই সমাধান করতে হয়। আর নতুন করে কাগজ বানানোর সময় আমি আমার নামের পাশে লিখেছিলাম ‘লেখক এবং অভিযাত্রী’। মি. ম্যাককুর ভাই যখন এসব লিখে নিচ্ছিল তখন জিজ্ঞাসা করল আমার কী কী বই বেরিয়েছে। বললাম, ‘অনেক বইই বেরিয়েছে, অনেকগুলোগবেষণাধর্মী, ময়ূরের উপরে আছে, রংধনুর উপরে আছে, এছাড়া বিভিন্ন কবিদের উপরে আছে।’ আরো লেখা হল, শার্লটের সাথে আমার কয়েক বছরের পরিচয়। এবং আমি ওর প্রথম স্বামীর দূর সম্পর্কের আত্মীয় হই। এছাড়া তেরো বছর আগে আমাদের সম্পর্ক ছিল এরকম কিছুও লিখতে চেয়েছিল। শেষমেশ আর লেখা হয়নি। সামাজিক এই তথ্যগুলো একটা মিথ্যামুক্ত থাকুক অন্তত!
এই অদ্ভুত গল্পের আরো ঘটনা বলি। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল, এই যে ভাড়াটিয়া থেকে গৃহকর্তা হবার স্বাদ, এটা ঠিক কীভাবে অনুভব করছি আমি? শুধু কি তিক্ত বিস্বাদ? প্রশ্নগুলো যদিও মজা করে করা হয়েছিল তবু আমি বেশ শান্তভাবেই জবাব দিলাম। বললাম, না। কিন্তু আমার ভিতরে তখন যেন শার্লটকে খুন করার জন্য ছুরি নিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। ওর হাতে হাত রাখার আগ মুহূর্তে মনে হল ও কতটা নিম্নশ্রেণির মানুষ। নিজের সন্তানকে হিংসা করে, একগুঁয়ে, অভিমানী, চার্চ ও কিতাবের উপর ওর অন্ধবিশ্বাস। আমি কিনা এরকম একটা মহিলাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি! ওর হাতে যখন হাত রাখলাম তখন যেন ললিতার ঘর থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘না! প্লিজ, না!’
শার্লটের ভিতরে পরিবর্তন খেয়াল করলাম। ও সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে ওর মুখে কোনো হাসি কল্পনাও করতে পারিনি এখন সেখানে চমৎকার একটা হাসি লেগেই থাকে। ওর আচরণ দেখে ভাল লাগল। একজন আদর্শ প্রেমিকার মত, স্ত্রীর মত। আবার মাঝে মাঝে মনে হত ও নিজেকে ‘লো’ বানানোর চেষ্টা করছে। আসলে মা মেয়ের মধ্যে তো বায়োলজিক্যাল মিল থাকবেই।
আমার মনে হচ্ছিল মেয়েই তার মায়ের খেয়াল রাখছে। এটা যেন একটা সাদা পাকস্থলী ধীরে ধীরে একটা ছোট মাছকে গিলে খাচ্ছে। ওর এই সযত্নে ডাই করা চুল, ওর শরীরের স্পর্শ, গন্ধ, বিছানায় ওর স্বাদ সবকিছুতেই যেন ললিতার স্পষ্ট ছাপ। মনে মনে বলি, ললিতার বয়সে সেও এক ললিতা ছিল। একদিন আমার ললিতাও এর মত হয়ে যাবে। তারপরে একদিন ললিতার মেয়েও একজন ললিতা হয়ে জন্মাবে, এবং সেও এরকম হয়ে যাবে। আমি আমার ললিতার পুরনো সংস্করণ দেখতে পাই শার্লটের মাঝে। অবশ্য শার্লট ওর ছোটবেলার ছবিগুলো আমাকে দেখিয়েছে। সেই একই পা, একই গলার হাড়, মুখের গড়ন, একই নাক। যেন ও ছিল লোটেলিতা বা ললিসেন।
এসব ভেবে আমি ওর ভিতরে ললিতাকে খুঁজে ফিরি পাগলের মত। রাতের বেলা বিছানায় আমি না পাওয়ার মাঝে তবু ওর সেই নিমফেট গন্ধ খুঁজে ফিরি।
আমি সহজ করে বোঝাতে পারব না ও কতটা কোমল ছিল। বেচারী কতটা যত্নশীল ছিল আমার প্রতি। সকাল সকাল উঠে আমার জন্য নাস্তা তৈরি করত। তারপর পাশের চেয়ারে বসে একমনে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। আমি তখন নাস্তায় ব্যস্ত। এমনভাব করতাম যেন আমার ভালবাসাটা খুব নীরব এবং প্রবল। ওকে তখন মনে হত কোনো সুন্দর করে আঁকা চিত্রকর্ম। আমার রোজগার খুব বেশি ছিল না। তবু সেটা ওর রোজগারের সাথে একত্র করলে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে। এসব নিয়ে অবশ্য ও খুব বেশি ভাবত না। ওর চোখে আমার টাকার প্রতিফলন মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম। ওর আর আমার ব্যাংক একাউন্ট একত্র করে টাকা জমানোর কথা বলেছিল একবার।
কিছুদিনের মধ্যে আমার মনে হল আমাদের এই অল্প কিছুদিনের শারীরিক মিলন যেন আসলে বহু বছর ধরে চলে আসছে। কারণ বেচারীর ভিতরে এমন এক গৃহিণীসুলভ আচরণ এসে গেল সেটা আমার জন্য যথেষ্ট ভাবনার। ওর ভিতরে আমি ললিতার স্বাদ খুঁজে বেড়াই। কিন্তু ও যদি এরকম আচরণ করে তাহলে কীভাবে সম্ভব? হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল পুরো বাড়ির আসবাব সব পরিবর্তন করে নতুন কিছু কিনবে। যেই বলা সেই কাজ। সবকিছু নতুন কেনা শুরু করল। পুরনোগুলো বিক্রি করে তার সাথে আরো কিছু টাকা ভরে তারপর কেনাকাটা শুরু করে দিল। এমনকি এতদিনের স্মৃতিজড়িত আমার বারান্দার চেয়ার, যেটাতে বসলে এখনো আমি ললিতাকে বাস্তব অনুভব করি সেটাও পরিবর্তন করল। চেয়ারটার সাথে আমার অনেক আবেগ জড়িয়ে ছিল। এমনকি যেই সোফাটার সাথে আমার সবচেয়ে গাঢ় আনন্দের স্মৃতি জড়িত সেটারও রঙ পরিবর্তন করে ফেলল। অথচ ওই সোফাটাতে বসে আমি যে ললিতাকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম তার স্বাদের কোনো মূল্যই দিল না সে। জানালাগুলো পরিষ্কার করল, ছিটকিনিগুলো নতুন কিনল। নতুন বাথটাব কিনল, বাথরুমের চেহারাও পালটে ফেলল। এমনকি যে উপন্যাসগুলো পড়তে দেখেছিলাম সেই প্রথম দিন, সেগুলোও পরিবর্তন করে নতুন বই নিয়ে এল। ওর ভাবটা এমন যে, ‘তোমার বাড়িটাই মূলত তুমি।’ এর প্রতিটা জিনিসই আমাকে চিনিয়ে দেয়। ফলে ওর রুচিমত সব পরিবর্তন শেষে দেখা গেল সবকিছুতেই মেয়েলি ছাপ।
শার্লটের পরিচিত খুব বেশি কেউ ছিল না রামসডেলে। একজন ডেন্টিস্ট আছেন, কাছেই থাকেন, মোটামুটি পরিচিত। আশেপাশের আরো কয়েকজনের সাথে পরিচয় আছে। ইদানিং দেখি সামনের বাড়িটার মহিলার সাথেও তার নিয়মিত আলাপ হয়। মাঝে মাঝে টেলিফোনে কয়েকজনের সাথে আলাপ করতে দেখি। এদের মধ্যে আছে মিসেস গ্লেইভ, মিসেস শেরিডান, মিসেস ম্যাকক্রিস্টাল, মিসেস নাইটস এরকম আরো অনেকেই। এদের সাথে তবুও খুব যে যোগাযোগ ছিল এমন না। তবে এক দম্পতি ছিল, তাদের সাথে শার্লটের বেশ ভাল যোগাযোগ।
ভদ্রলোকের নাম ফারলোস, সম্প্রতি চিলি থেকে ব্যবসা করে ফিরেছেন। মিসেস চ্যাটফিল্ড, ম্যাককুস আরো কয়েকজনের সাথে আমাদের বিয়েতেও এসেছিলেন। জন ফারলোস লোকটা মধ্যবয়সী, বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী। দেখে মনে হবে নিয়মিত খেলাধুলা করেন উনি। খেলার সরঞ্জামাদি বিক্রিই তাঁর ব্যবসা। এখান থেকে চল্লিশ মেইল দূরে পার্কিংটনে তাঁর অফিস। এক রবিবারে বনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম ভদ্রলোকের সাথে। উনি আমাকে বন্দুক চালানো শেখালেন। মুচকি হেসে জানালেন, উনি পার্ট টাইম ওকালতিও করেন। শার্লটের কিছু বৈধ সম্পর্কের কেসেও তিনি সাহায্য করেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম জিন, বিয়ের আগে কাজিন ছিলেন তাঁরা। তাঁর স্ত্রীর বর্ণনায় শুধু বলব, বেশ লম্বা, তারও শরীর বেশ মেদহীন, বুকের স্তন দুটো তীক্ষ্ণ, মুখটা স্বাভাবিকের চেয়ে বড়, লালচে। ভাল ছবি আঁকেন ভদ্রমহিলা। তাদের একটা মেয়ে আছে স্কুলপড়ুয়া। নাম রোসালিন। দেয়ালে ওর একটা আঁকানো ছবি ঝুলছে।
জন ছবিটা দেখিয়ে বললেন, ‘আমার রোসালিন।’
‘কোথায় সে?’
‘ক্যাম্প করতে গেছে বান্ধবীরা মিলে।’
‘ওর স্কুল?’
‘ছুটি চলছে।’ হেসে বললেন ভদ্রলোক, ‘আপনার মেয়ে ডলরিসের সাথেই আছে ক্যাম্পে।’
আমার তখন লো’র কথা মনে পড়ল। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। শুধু ভাবতে পারলাম আমার লো ক্যাম্প থেকে বাড়িতে ফিরে আসছে হাসিমুখে, সেই বাদামী চুল, সেই শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে।
রনক জামান
কবি ও অনুবাদক ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১, মানিকগঞ্জে জন্ম। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : অগ্রন্থিত ওহী [তিউড়ি, ২০১৯] এবং ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা [অনুপ্রাণন ২০১৬]