কামরুল হাসানের ছোটগল্প: মধ্যবিত্ত বারান্দা

আলতোভাবে ঘুম থেকে স্বপ্নটা ছুটে যায়। বনের তৃণকার্পেট ছেড়ে পলায়নপর হরিণের পায়ের মতোই যেন ছুটে পালালো। আচ্ছন্ন ভাবটা বজায় রেখেই জামিল স্বপ্নটা পুনর্বার ফেরত পাওয়ার লোভে পাপড়িগুলো জোড় লাগিয়ে চোখ বুজে ফেলে। পায় না, কিছুতেই জোড় লাগে না ভাঙা কাচের মতো স্বপ্নের আয়নাটা। অনেক সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে এরকম অর্ধভাঙা স্বপ্ন মিলিয়ে ফেলে জামিল। ব্যর্থ হয়ে চোখ দুটো সেই বাস্তবতাতেই ফিরে এলো যেখানে স্বাতীর বিয়ে হচ্ছে পরশুর পরের দিন। ঘরের ভেতর সূর্য আড়কুড়ি কাটতে পারেনি, তাই জামিল বুঝতে পারে না সূর্য পশ্চিম আকাশের মই বেয়ে কতোখানি নেমে গেছে।

শুয়ে শুয়েই কিছুক্ষণ আগে হারানো অসম্ভব সুখের স্বপ্নটাকে স্মৃতির সুঘ্রাণ মিশিয়ে জাবর কাটতে থাকে। রোদ-ঝিলমিল নদীর মতো স্বচ্ছ ফুটে উঠছে সব কিছু। জমজমাট এক বিয়ের আসরে গাঢ় লাল রঙের বেনারসী-পরিহিতা বধূর আসনে বসা স্বাতীকেই প্রথম দেখেছিল জামিলের স্বপ্নের চোখ। সে বরযাত্রী দলের না কনেপক্ষের ছিল বুঝতে পারছিল না। বর পাওয়া যাচ্ছিল না। লোকজন ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, সে শুধু অপলক দেখছিল স্বাতীকে। ঘূর্ণাক্ষরেও জামিল টের পায়নি এটা স্বপ্ন। স্বপ্ন-ঢেউ এতোটা মননের তীর ছুঁয়ে যেতে পারে ভাবেনি সে। স্বপ্নের ভেতরই টের পেল জামিল স্বাতীকে সে ভালোবাসে । লোকজন হতাশ হয়ে ফিরে এল, বরকে পায়নি ওরা। সেই মুহূর্তে স্বাতী তার দীর্ঘ অবগুণ্ঠনের লাবণ্যে ঘেরা অনিন্দ্য মুখখানি তুলে দ্বিধাহীন একটি আঙুলে জামিলকে দেখিয়ে বললো, ওই তো বর।” আর কিছু মনে নেই তার। অভাবিত আবেগের স্বপ্নটা ওখানেই ভেঙে যায়। তবে কি বছর বছর ধরে স্বাতীর অন্তর তার দিকেই তুলে রেখেছে দ্বিধাহীন প্রেমআঙুল, ওই তো বর।”

ঝট্ করে বিছানা ছাড়ে জামিল । বিকেলের বারান্দাটা ওকে টানতে থাকে খুব। অন্যান্য দিন সময় কাটে না বলেই সে ওখানটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে মধ্যবিত্ত জীবনের সীমানা ও প্রসারকাতরতা দেখে । চোখের ওপর থির থাকে সেই জীবন যার অদৃশ্য দেয়াল তারও চতুর্দিকে। আজ চুম্বকটানে টানছে বারান্দা, বারান্দা মানেই আরও দুটি অনন্য বিকেলে স্বাতীর দেখা পাওয়া।

বারান্দা বললে ভুল বলা হবে, দীর্ঘ টানেলের মতো কলোনির পাশাপাশি বাসিন্দাদের সমষ্টিগত সম্পত্তি। অবিচ্ছিন্ন। সে তুলনায় স্বাতীদের দিককার কলোনির বারান্দাগুলো স্বতন্ত্র ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন। প্যারাবোলার মতো জলাশয়টিকে ঘিরে উঠেছে কলোনির প্রশস্ত দালানগুলো। সারাটা বছরই এ জলাশয়ে জল জমে থাকে, নোংরা, অপরিচ্ছন্ন জল। সেই জলে কলোনিবাসীদের পরিশ্রান্ত অবয়ব আর ব্যর্থতার ছায়া মিশে থাকে।

জামিল যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তখন বিকেল তার মধ্যবয়স পেয়েছে। বরাবর মিনু ভাবিদের বারান্দা, মিনু ভাবি দাঁড়িয়ে আছেন রেলিঙের ওপর হাত দুখানি ভাজ করে। তাকাতেই জামিলের চোখে মদির চোখ রাখেন আর হাসেন ইঙ্গিতময়। প্রতিদিনকার মতো আজো বেশ সাজগোজ করেছেন মিনু ভাবি। সারাদিন কালিঝুলি সংসারের বিবর থেকে বিকেলের এই প্রসাধিত বারান্দাই তার মুক্তি। দূর থেকে জামিল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে মিনু ভাবিকে খুব আকর্ষণীয় মনে হলেও, জামিল জানে কাছে গেলে ভুলটা সবারই ভাঙবে। স্বাতীদের বারান্দাটি শূন্য আর সেই মুহূর্তে জামিলের দৃষ্টি আটকে রাখার চেষ্টা করছেন মিনু ভাবি। সে সযত্নে এড়িয়ে গেলো এই দৃষ্টিচুরির খেলা। প্রথম থেকেই স্বাতীদের বারান্দায চোখ রেখেছে জামিল, বারান্দার নিজস্ব কোনো চোখ থাকলে সেটা হয়তো জামিলের এতগুলো আকুতিভরা চোখের চাউনির সম্মোহনে পড়ে যেত।
জামিল একে একে ওর নিত্যদিনের দেখা বারান্দাগুলো দেখতে লাগল। উত্তর দিকের দ্বিতীয় ব্লকটিতে জাহেদের নানি বৃদ্ধ স্বামীর সঙ্গে কথা বলছেন। বুড়োবুড়ি হয়তো অতীত জীবনের মাঝেই ডুবিয়ে রেখেছেন বর্তমানকে। খুব সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে ছিলেন জাহেদের নানি, তরুণী বয়সে যুবক গৃহশিক্ষক, মানে ওই বুড়োর হাত ধরে ছেড়ে এসেছিলেন উঁচু তলার সীমানা, সেই থেকে মধ্যবিত্ত জীবনের বাসিন্দা।

উপর থেকে নিচের দিকে নামছিল জামিলের দৃষ্টি। সে সময় বিপরীত কৌণিক দিক থেকে হাত উঠিয়ে তাকে ডাকছিল জানু। জামিল দেখতে বা শুনতে পেল না। আব্বাস আলীকে তার একলা বারান্দাটিতে দেখল সে। গত ক’টি দিন সমস্ত বাসাটি আব্বাস আলীর হৃদয়ের মতোই তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। বেচারার দুঃখময় মুখাবয়বের রেখাগুলো স্পষ্ট না দেখা গেলেও সন্ধ্যাআসন্ন জলবায়ুতে মেশানো তার অন্তরবেদনা টের পেল জামিল। প্রেসে একটা ছোট চাকরি করে আব্বাস, হাড়কিপটে বলে বন্ধুমহলে দুর্নাম আছে লোকটার। বিয়ে করেও একাই থাকত তার ফ্লাটে। বন্ধুরা গ্রাম থেকে বৌটিকে আনার জন্য বহুবার তাগিদ দিলেও সংসার গুছিয়ে তোলার অদ্ভুত যুক্তি দেখিয়েছে আব্বাস। শহরে বৌ এলে খরচ নাকি অসম্ভব বেড়ে যাবে, তখন দেখা যাবে নিত্যনতুন খরচের উপসর্গ। একে-একে, কষ্টে-সৃষ্টে টাকা জমিয়ে আসবাবপত্র বানাচ্ছিল আব্বাস আলী। মোটামুটি শৌখিন হয়ে উঠছিল তার সাধারণ সংসার। শূন্য ঘরে বৌকে নিয়ে আসার একটা প্রচণ্ড অনীহাও ছিল। পরবর্তী ঈদেই বাড়ি গিয়ে বৌকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল তার। কদিন আগে বেচারা খবর পায় মারা গেছে বৌটি, স্বামীর সাজানো সংসারে তার আর প্রবেশ হলো না, দূর গায়ে হয়তো অভিমান থেকেই মরে গেছে বেচারী। প্রাণহীন আসবাবগুলোর মতোই নিঃসঙ্গ পড়ে আছে আব্বাস আলী। মৃত বৌয়ের খবর নিয়ে গ্রাম থেকে ফেরার পরে পাঁচদিন সে ফ্ল্যাটের দরজা খোলেনি। পাঁচদিন নিঃসাড় কেঁদেছে।

সেই মুহূর্তে স্বাতী বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। জামিলের বিপরীত দিকে তাকিয়ে কী যেন আগ্রহ নিয়ে দেখছে সে। নজরবন্দি করার জামিলের ক্রমাগত চেষ্টাটি বহুক্ষণ ব্যর্থ হল। এই মেরুন-রঙের বিকেলটির সাথে ম্যাচ করে একটি মেরুন রঙের শাড়ি পড়েছে স্বাতী। অনেক অনেক বছর আগে স্বাতী আর জামিল যখন স্কুলে পড়ত সে সময় প্রায়শই ওদের পথে দেখা হত। কলোনি ছেড়ে লেকটির পার্শ্ববর্তী পথ ধরে স্বাতী আস্তে আস্তে হেঁটে যেত। জামিল ছেলে বলে সহজেই ওকে অতিক্রম করে যেতো। তবু ইচ্ছে করেই পেছন পেছন মন্থর হাঁটত জামিল, দু’পাশে বেণী-দোলানো স্বাতীর ঘাড়টা দেখতে ওর খুব ভাল লাগত।
একদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে জামিলের। সেদিন প্রবল বাতাস বইছিল খোলা লেকটার সবটুকু শূন্যতা নিয়ে বড় রাস্তায় বাতাসের ঝাপটা সরিয়ে এগুতে হচ্ছিল। বাতাসের প্রবল ঝাপটায় স্বাতীর ওড়নাটা বুক থেকে অনেকখানি সরে যায়। সে সময় বেড়ে উঠছিল স্বাতী, ওড়নাহীন বুকের একটা অনমনীয় সৌন্দর্য স্বাতীকে অন্যরকম করে তুলেছিল জামিলের চোখে।

ধীরে ধীরে বিকেলের রোদমাখানো শুভ্র গ্রীবাখানি ফেরায় স্বাতী। জামিলকে দেখে একটা খুশি খুশি লাবণ্য ছড়িয়ে পড়ছে চোখেমুখে। একটু রোমাঞ্চিত বোধ করছে জামিল। তার ইচ্ছে হল স্বপ্নের সোনালি কাহিনীটুকু একটা নীল খামে ভরে স্বাতীর কাছে পাঠিয়ে দেয়। পৌঁছামাত্রই স্বাতী তা ওর বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখবে।

জামিল জানে তার পঁচিশ বছরের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে হয়তো আরও পঁচিশ বছর ধরে এই বারান্দা ঝুলে থাকবে নোংরা দুর্গন্ধময় এক ডোবার ওপর । দুদিন পরেই স্বাতীদের বারান্দার দিকে চোখ ফেলতে কষ্ট হবে। একুশ বছর ধরে ওর প্রায় সবগুলো সুন্দর বিকেলকে এই প্রসারণহীন কলোনীর অস্বচ্ছল বারান্দায় আটকে রেখেছে স্বাতী ।

পায়রার পাখার উড্ডয়ন উল্লাস এখন স্বাতীর অন্তরে। আরও কয়েক সহস্র রোমান্টিক বিকেলের মতোই আজো স্বাতীর চোখ জামিলের চোখে ন্যস্ত। চোখ প্রত্যাশা আর নির্ভরতা চাইছে। নির্ভরতা পেলে এক অনুপম ডানা মেলে প্যারাবোলাসদৃশ্য ডোবাটির ওপার থেকে উড়ে এসে এপারের এই বারান্দায় ঠাই নেবে স্বাতী।

জামিল দ্রুত ঘরের ভেতর সরে আসে। স্বাতীর চোখের সম্মোহনে একটি ভুল প্রায় হতে যাচ্ছিল। এই শ্বাসরুদ্ধকর, আলোহাওয়াহীন বারান্দা থেকে স্বাতী, তুমি পালাও, পালাও।

 

কামরুল হাসান 

জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১, শরীয়তপুরে। তিনি মূলত কবি। অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ গদ্যকার হিসেবেও খ্যাত। আছে নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

ভারতের বিশ্বখ্যাত খড়গপুর আইআইটি থেকে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড ও এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কামরুল হাসান শিক্ষকতা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। কামরুল হাসান  দু’হাতে লেখেন। এপর্যন্ত ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি ছোটগল্প, ১টি প্রবন্ধ, ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থ, ২ টি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সমীর রায় চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে পোস্টমর্ডান বাংলা পোয়েট্রি ২০০৩ সম্পাদনা করেছেন।

[email protected]

 

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top