কানামাছি: নাহার তৃণা


সুমনের বিস্ফোরিত চোখজোড়ার পলকহীন দৃষ্টি সহ্য করতে পারেনা মুরাদ। সরে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ায়। বেশি সময় নাই ওদের হাতে। সুমনের বাবা থানা পুলিশের হুমকী নিশ্চয়ই খামোখাই দেয়নি। এই জায়গার খোঁজ পাওয়ার আগেই দ্রুত তাদের সরে পড়া চাই। আপাতত গা ঢাকা দিতে হবে কিছুদিনের জন্য। পরিকল্পনা মতো কাজ না হওয়ায় এখন নিজেদের প্রাণ নিয়ে টানাটানি। অথচ কী নিখুঁত ছিলো ওদের পরিকল্পনা। মোটা অংকের টাকার টোপ হিসেবে সুমনকে মুরাদ আর ওর গুটি কয়েক বখে যাওয়া বন্ধু মিলে তিনদিন আগে উঠিয়ে এনেছিলো।

সুমনের বাবা শহরের নাম করা ব্যবসায়ী। একনামে ঢাকার সবাই তাকে চেনে। এরকম পরিবারের ছেলের জীবনের বিনিময়ে লাখ পাঁচেক টাকা হাতের ময়লা ধরেই ওরা সুমনকে উঠিয়ে আনার ছকটা কেটেছিলো। সুমন বন্ধু হওয়াতে ওদের প্ল্যানটাকে প্রাথমিকভাবে সার্থক করতেও তেমন বেগ পেতে হয়নি। সুমন অতিমাত্রায় সাদাসিধে ধরনের আর বন্ধু বাৎসল। বন্ধুদের উপর বিশ্বাস ছিলো অগাধ। যার চরম মূল্য তাকে জীবন দিয়েই দিতে হলো। মুরাদরা কী ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলো, সুমনের বাবা ভেতরে ভেতরে এতটাই হাড়কেপ্পন। সন্তানের চেয়ে টাকাই বড় হলো তার কাছে। সামান্য কটা টাকার জন্য ব্যাটা নিজের একমাত্র ছেলেকে পুছলো না! অবিশ্বাস্য।


সকাল থেকে মজিব মিয়ার শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে। চোখ বুঁজে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু কোনো উপায় নাই। গাড়ি নিয়ে আজ বের না হলেই নয়। হাতে একদম সময় নাই। আগামি পরশু ছেলের ভর্তির টাকা জমা না দিতে পারলে, মুজিব মিয়ার এতোদিনের কষ্ট জলে ভেসে যাবে। ভাবনাটা আসা মাত্রাই ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তার যা হয় হবে, কিন্তু আজ সিএনজি নিয়ে তাকে বেরতেই হবে। একটা সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, সেটাকে কোনভাবে ফস্কানো ঠিক হবে না। মুজিব মিয়ার মানসপটে মুরাদের অভিমানী মুখটা ভেসে ওঠে।

দুই মেয়ের পর একমাত্র আদরের ছেলে মুরাদ। বরাবরই লেখা পড়ায় ভালো। স্কুল-কলেজের দুটো পরীক্ষাতেই এ প্লাস পাওয়া ছেলে। গত বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় পাশ দেবার পরও, মুজিব মিয়া সময় মতো টাকা জোগাড়ে ব্যর্থ হওয়ায় মুরাদের মেডিকেলে ভর্তি হওয়া হয়নি। সেই ব্যর্থতার শোক মুজিব মিয়ার বুকে জিওল মাছের অস্তিত্ব জানান দেবার মতো নিরন্তর ঘাই দিয়ে গেছে। সুযোগ পেয়েও ভর্তি হতে না পারার ক্ষোভ আর অভিমানে মুরাদ ঘর ছেড়ে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলো। বহুদিন সে পরিবারের ছায়া মাড়ায়নি। দিন দশেক আগে ছেলে নিজেই এসে জানিয়ে গেছে, যদি মুজিব মিয়ার পক্ষে হাজার দশেক টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়, তবে এবছর এক বড়ভাইয়ের সুপারিশে তার মেডিকেলে ভর্তির ব্যবস্হা করা সম্ভব। অশিক্ষিত বাবার পক্ষে বুঝে নেওয়া সম্ভব হয় না, অসৎ সঙ্গে পড়ে নেশার টাকা জোগাড়ের পথ হিসেবে ছেলে তাকে বোকা বানিয়ে টাকা আদায়ের উসিলা করেছে মাত্র।

ছেলেকে ডাক্তার বানাতে না পারার কষ্টটা এবেলা মুছে ফেলবার তাগিদে মুজিব মিয়া প্রায় জান বাজি রেখে গত সাতদিন পাগলের মতো দিনরাত সিএনজি চালিয়েছে। সিএনজি থেকে হাজার পাঁচেক তুলতে হবে, বাকি টাকা হারুন মুন্সীর কাছে সুদে জোগাড়ের বন্দোবস্ত হয়েছে। আজ সিএনজি নিয়ে বেরোতে না পারলে পাঁচ হাজার পূর্ণ হবেনা…..ভাবনাটা মুহূর্তেই মুজিব মিয়ার শারীরিক অস্বস্তিটা ভুলিয়ে দেয়। দ্রুত বেরিয়ে পড়ে গ্যারেজের উদ্দেশ্যে।

৩.
সুমনের প্রাণহীন শরীরটা ওভাবে ফেলে রেখে ওরা যে যার মতো পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়ে। মুরাদ আপাতত কেরানিগঞ্জে গিয়ে গা ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে গুলিস্তানের মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়।

গ্যারেজ থেকে সিএনজি নিয়ে গুলিস্তানের মোড় পৌঁছানো মাত্রই প্রথম যাত্রীর দেখা পেয়ে যায় মজিব মিয়া। গন্তব্য জানবার তাগিদে মুখ বাড়াতেই অস্হির হাতে সিএনজি থামতে বলা যাত্রীটির কণ্ঠ চিড়ে অস্ফুট শব্দ বেরোয়- ‘বাবা’!

 

নাহার তৃণা

জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top