সবাই ওনাকে স্মৃতিমাসী বলেই ডাকতো চিরকাল — ঋতু, ঋজু, বৃষ্টি এবং তাদের মা-বাবারাও। সবারই তিনি স্মৃতিমাসী। আসলে ঋতু-ঋজুর দিম্মা, যিনি হচ্ছেন বৃষ্টির ঠাম্মা, তাঁর সম্পর্কে মামাতো বোন হন্ স্মৃতিমাসী। কিন্তু বয়সে তিনি ঋতুর মায়ের চেয়ে সামান্যই বড়ো। অতএব ঋতুদের প্রজন্ম তাঁকে দিদিমা-ঠাকুমা না ডেকে, ‘মাসী’ বলেই ডেকে এসেছে চিরকাল। কিভাবে যেন শেষপর্যন্ত ‘স্মৃতিমাসী’ — এই পুরো শব্দটাই ‘প্রপার নাউন’ বা ‘নামবাচক বিশেষ্য’ হয়ে গেছে। সবার তিনি স্মৃতিমাসী — মামাবাড়ীর কাজের মাসী আর রান্নার ঠাকুরেরও। সবকাজে তিনি সাহায্যকারিণী স্মৃতিমাসী। সব উৎসবের বাড়ীতে তিনি ভাঁড়ার আগলানো স্মৃতিমাসী।…
প্রায়ই আসতেন উনি মামাবাড়ীতে, কোনো উৎসব না থাকলেও — দিম্মার কাছে।
মুখে সবসময় একটা হাসি লেগে থাকতো ছোটখাটো চেহারার স্মৃতিমাসীর। পান-লিপস্টিক ছাড়াও স্মৃতিমাসীর ঠোঁট ছিলো লালচে গোলাপী, আর সেই ঠোঁটের ফাঁকে আটকে থাকতো একটা আলগা হাসি — ছোট ছোট দাঁতের সারি আর মিষ্টি দুটো গজদাঁতে মেশা। কেউ কড়া কথা বললেও হাসিটা মুছে যেতো না। খানিকটা যেন তোষামোদ মিশে থাকতো স্মৃতিমাসীর হাসিতে আর নীচু গলার কথাতে। সবাইকে খুশী করে চলতেন স্মৃতিমাসী। বাড়ীর ছোটবাচ্চা থেকে আরম্ভ করে, বুড়ো-বুড়ী সবাইকে। পরণে প্রায় সবসময়ই থাকতো সুতির সাদা খোলের লালপাড় শাড়ী। ঋতুর দিম্মার মতো কড়কড়ে মাড় দিয়ে, টানটান ইস্ত্রী করা, ধবধবে সাদা টাঙ্গাইল শাড়ী নয় — অতি ব্যবহারে মলিন, সস্তা সাবানে ঘরে কাচা, হলদেটে হয়ে আসা মিলের শাড়ী। সঙ্গে নীল, কালো, যাহোক্ একটা ব্লাউজ। কাঁধে একটা পুরোণো ঝোলা ব্যাগ। পায়ের চটিতে অসংখ্য পেরেকের কারুকুরি। হাতে শাঁখা-পলা আর একটা সরু লোহার চুড়ি। কানের লালপাথরের ছোট্ট দুলদুটোর পেছনে ছাড়া, সর্বাঙ্গে সোনাদানার আর কোনো চিহ্ণ ছিলো না। একবেণী করে বাঁধা রুক্ষ চুল পিঠে ফেলা। প্রসাধনহীন ফর্সা মুখে অযত্ন আর মেচেতার ছাপ।
তবু বোঝা যেতো যে স্মৃতিমাসী সুন্দরী। আরেকটু সঠিক ভাবে বললে, বোঝা যেতো যে স্মৃতিমাসী এককালে সুন্দরী ছিলেন। এখন প্রায় সবটাই ছাইচাপা হলেও, ছাইয়ের নীচে যা আছে সেটাও মাঝেসাঝে হঠাৎ করে ঝলক দিয়ে ওঠে।
ঋতুর দিম্মা প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন – “স্মৃতিটা ছিলো মামাবাড়ীতে সবচেয়ে সুন্দরী। মামার অতো আদরের মেয়ে…আর আজ তার কি দশা!”
বৃষ্টির অন্নপ্রাশন ছিলো সেদিন।
সব কাজের শেষে, স্মৃতিমাসী চলে গেলে, দিম্মার বোন ছোট্টিমা বললেন – “তুমি ওকে অতো লাই দিয়ো না তো, দিদি!…ও যখন বাড়ী যায়, হাতদুটো আর কাঁধের ঝোলাটার ভারে যেন চলতে পারেনা। ওর ব্যাগটা কোনদিন খুলে দেখেছো? সাধে কি আর অতোবড়ো একটা ঝোলা নিয়ে ঘোরে?”
দিম্মা বললেন—“কি যে বলিস্ তুই! অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে দু’টো লালপেড়ে শাড়ী দিয়েছি, সেটাই ব্যাগে নিয়েছে। আর বাড়ীর সবার জন্যে মিষ্টি আর খাবার তো আমিই দিয়ে দিলাম। ও খেতে চাইছিলো না। ছেলেমেয়েকে ফেলে খায়ই বা কিকরে? বাড়ীতে তো রোজ কাঁচকলা সেদ্ধ ডালভাত।…ওর স্বামীরও বলিহারি যাই! অফিসের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে তুই বৌ ছেড়ে চলে গেলি, ছেলে-মেয়ে দুটোকে যে জন্ম দিয়েছিস্ তা মনে পড়লো না একবারও? বিয়ের সময় তো ‘সুন্দরী বৌ’ বলে শ্বশুরবাড়ী থেকে কতো আদিখ্যেতা করলো, আর এখন? তাকিয়েও দ্যাখে না! কোথায় ছেলেকে বোঝাবে মন দিয়ে সংসার করতে, না ছেলে মুখ ঘোরালো তো শ্বশুরবাড়ী বৌকে পর করে দিলো। মেয়েটা যাবে কোথায়?….কি দেখে যে মামা ঐ মাকালফলের সঙ্গে স্মৃতির বিয়ে দিয়েছিলেন!”
ছোট্টিমা বললেন— “সে ওর কপাল…মামাকে দোষ দিয়ে আর কি হবে। পূর্ববঙ্গে তো স্মৃতির শ্বশুরবাড়ীর অনেক জমিজমা ছিলো…দেশভাগ না হলে গ্রামের বাড়ীতেও থাকতে পারতো স্মৃতি। মামীমা তখন নেই আর মামারও বেশী বয়সের ঐ শেষ সন্তান…বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া।”
দিম্মা বললেন— “…’নিশ্চিন্ত হওয়া’? একে বলে ‘বেড়াল পার করা’! আমাদের সময়ে হতো, তাই বলে এখন কেউ পড়াশোনা না করিয়ে চোদ্দ বছরে মেয়ের বিয়ে দ্যায়? ও তো আমার প্রায় মেয়ের বয়সী — খুকুর চেয়ে দশমাসের বড়ো।…খারাপ লাগে। দেশ তখন ভাগ হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে আছে — দেশের জমি দেখে কি হবে? পাত্র কলকাতায় কি কাজ করছে, মেসে থেকে কার সঙ্গে মেলামেশা করছে — এসব কিচ্ছু না দেখে শুনে…বয়সে দশ বছরের বড়ো স্মৃতির চেয়ে! মামা তো আর এলেন না পশ্চিমবঙ্গে, স্মৃতির দিদিরা কেউ কুটোটি দিয়ে বোনকে সাহায্য করে না — সব ব্যস্ত নিজেদের সংসার নিয়ে।”
ছোট্টিমা বললেন— “ওর দিদিদেরও তেমন অবস্থা নয় যে সাহায্য করবে। স্মৃতির শ্বশুরবাড়ীর লোকজন দেশভাগের পর নদীয়ার দিকে কোথায় যেন থাকে। স্মৃতি ওখানে গিয়েই বা কি করতো? এ তবু বরের রেলের কোয়ার্টার্সে থাকতে পারছে, ছেলেমেয়েদের কলকাতায় স্কুলে পড়াচ্ছে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে গেলে যাহোক্…।”
দিম্মা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন— “ঐ কোয়ার্টার্সে থাকতে দিয়ে, মাথা কিনে নিয়েছে চামারটা! স্মৃতি খুব দুঃখ করছিলো আমার কাছে একদিন…পড়াশোনা শিখলে ও-ও চাকরি করতে পারতো সেই মহিলার মতো, যে পয়সার জোরে ওর স্বামীকে কিনে রেখেছে। চেহারায় তো স্মৃতির ধারেকাছেও নয়, তবে পেটে বিদ্যে আছে আর বশীকরণ মন্ত্র জানা আছে। নাহলে চল্লিশ পার করা ঐ সাধারণ দেখতে মহিলার প্রেমে স্মৃতির বর হাবুডুবু খায়? সেই মহিলার কোয়ার্টার্সেই থাকে তো এখন স্মৃতির বর, রেলের পাসে পুরী-বোম্বে ঘুরে বেড়ায় টৈ-টৈ করে…. এদিকে স্মৃতি আর ছেলেমেয়েদুটো এর-ওর কাছে চেয়েচিন্তে…। স্মৃতিকে দিয়ে নাকি লিখিয়ে নিয়েছে যে ও-ই অনুমতি দিয়েছে ওর বরকে আবার বিয়ে করতে।”
ছোট্টিমা বললেন— “বিয়ে করেছে নাকি ঐ মহিলাকে?”
দিম্মা বললেন— “কিছু একটা করেছে! সেই মহিলাকেও তো সমাজে একটা কিছু বলতে হবে। তাছাড়া সরকারী চাকরি দুজনেরই — হিন্দু ম্যারেজ এ্যাক্টে কোনদিন স্মৃতি কেস করলে, দুজনকেই মুস্কিলে পড়তে হবে তো! তাই স্মৃতিকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া ঐপক্ষেও তো এক ছেলে হয়েছে…সম্পত্তি, টাকাকড়ি এসবের ব্যাপারও আছে। সোদপুরে নাকি জমি কিনেছে স্মৃতির বর আর ঐ মহিলা মিলে, পরে বাড়ী বানাবে। কোয়ার্টার্স তো যতদিন চাকরি, ততদিন। তারপরে বাড়ীতে উঠে যাবে আর সেই বাড়ী যাতে ঐ পক্ষের ছেলে পায় তার জন্যও আইনত একটা ব্যবস্থা করে রাখলো আগেই। চাকরি-বাকরি করা মেয়ে, আঁটঘাঁট বেঁধে কাজ করছে। স্মৃতিটা চিরকাল বোকাসোকা ভালোমানুষ থেকে গেলো। কি যে হবে ওর শেষ বয়সে!”
ছোট্টিমা বললেন— “স্মৃতির ছেলেমেয়েরা কতো বড়ো হলো?”
দিম্মা বললেন— “ছেলেটা হায়ার সেকেণ্ডারী দেবে এবার, পড়াশোনায় তো ভালোই বলে। মেয়ে ক্লাস টেনে…খুব ভালো গান করে মেয়েটা। রবিকিরণে গানের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। শনিবার আসে ক্লাস করতে এই পাড়ায়, মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে আমার সঙ্গে। ভারী মিষ্টি মেয়েটা।”
ছোট্টিমা বললেন— “কি করে যে চালাচ্ছে স্মৃতি!”
দিম্মা বললেন— “ঐ চালাচ্ছে এদিক সেদিক থেকে চেয়ে চিন্তে…বর দয়া হলে কখনো সখনো কিছু দ্যায়….আমিও দিই যখন যা পারি…স্মৃতির গয়নাগুলো তো সবই গেছে! মামীমার একশো ভরি সোনার গয়না ছিলো — নয় নয় করেও চার মেয়েকেই গা সাজিয়ে গয়না দিয়েছিলেন মামা, সঙ্গে দাবীর নগদ টাকা। ঐ এক নচ্ছারের জন্য সব নষ্ট হয়ে গেলো!”
দিম্মার আড়ালে স্মৃতিমাসীকে নিয়ে সবাই নানারকম কথা বলতেন।
ছোট্টিমার মেয়ে, ঋতুর কুট্টিমাসী, নাকি স্মৃতিমাসীকে এ্যাসপ্লানেডে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখেছেন — ভদ্রলোক যে কে তা কেউ জানেন না। দেখে নাকি মনে হয় অবাঙালী। দু’জনে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলেন।
দিম্মার ভাইয়ের বৌ, মামীদিদা, বলতেন— “স্বামীই যখন নেই, তখন এতো লালপাড় শাড়ী আর শাঁখাপলা পরা কেন রে বাবা?”
ঋজুর পৈতের দিন যখন বৃষ্টির গলার হারটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না, ঋতুর মামীমা তখন ফিসফিস করে ঋতুর মা’কে বলছিলেন— “দিদি, স্মৃতিমাসী…মানে ওনার এইসব হাতটান নেই তো!”
ঋতুর মা কিছু বলার আগেই অবশ্য বৃষ্টি এসে জানালো যে হারটা পাওয়া গেছে, আংটাটা বারবার চুলে আটকে যাচ্ছিলো বলে ও নিজেই বাথরুমে খুলে রেখে চান করেছিলো — পরে ভুলে গেছে, ঋতু দেখতে পেয়ে তুলে এনেছে।
স্মৃতিমাসীর ছেলে ইতিমধ্যে বি এস সি পাশ করে, ব্যাঙ্কে কাজ পেয়ে গেলো। প্রবেশনারী অফিসারের পরীক্ষা দিয়েছিলো, বি এস সির রেজাল্ট বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই হাতে চাকরি। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের অফিসার হয়ে, তাদের পাতিয়ালার অফিসে কাজে যোগ দিলো বল্টু।
স্মৃতিমাসীর একটু মন খারাপ — ছেলে অতদূর চলে যাবে।
দিম্মা কিন্তু খুব খুশী — স্মৃতিমাসীকে বোঝালেন যে ‘ব্যাটাছেলে যেখানে কাজ পাবে, সেখানেই যাবে। তাতে বাধা দিলে চলে? এবার সুদিন আসবে!…মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে না? হাতে টাকা চাই তো!’
স্মৃতিমাসী আর সেটা অস্বীকার করেন কি করে? মেয়ে মিষ্টু বাবার বাড়ীর লম্বা ধাঁচ পেয়েছে — যতো না বয়স, দেখায় তার চেয়ে বেশী। বিয়ের খোঁজ করতে হবে এবার।
এরমধ্যে একদিন ছোট্টিমা এসে এক খবর দিলেন।
দিম্মাকে বললেন—“স্মৃতির বর তো ফিরে এসেছে!”
দিম্মা অবাক— “কি বললি? ফিরে এসেছে?…তোকে কে বললো?”
ছোট্টিমা বললেন— “স্মৃতিই বললো। শ্যামবাজারের মোড়ে দেখা হলো আজ — মেয়ের বিয়ের বাজার করছে। হঠাৎ নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। রবিকিরণের গানের ফাংশানে মিষ্টুকে দেখে আর ওর গান শুনে, বাড়ী বয়ে এসে সম্বন্ধ করেছে তারা। ছেলে ডব্লিউ বি সি এস, ভালো কাজ করে। এখন নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড।”
দিম্মা বললেন— “সে নয় হয়েছে ভালো হয়েছে, মিষ্টুও তো গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেলো এবারে….বিয়ে দিলেই ভালো। কিন্তু স্মৃতির বর…তাইজন্যেই কি এতদিন ওর পাত্তা নেই? মাসছয়েক হয়ে গেলো, আসেনি। আমি ভাবছিলাম যে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেবো…”
ছোট্টিমা একটু হাসি মিশিয়ে বললেন— “বললো যে তোমার কাছে আসবে, অনেকদিন আসা হয়নি। নানারকম তালেগোলে সময় পায়নি। ওর সেই সতীন নাকি হঠাৎ মারা গেছে, প্রায় পাঁচমাস হলো। এদিকে তার ছেলেটা তো ছোট, ক্লাস এইটে পড়ে। কান্নাকাটি করে পাগল। কোথায় আর যাবে বেচারা, ‘আরেক মা’ থাকতে? স্মৃতির বর তাই ছেলেসুদ্ধ স্মৃতির কাছে এসে পড়েছে…..প্রথমে এক-দু’রাত করে থাকছিলো, শেষে ঐ কোয়ার্টার্স তুলে দিয়ে স্মৃতির কাছে চলে এসেছে এই মাস তিনেক হলো।”
দিম্মা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন— “সাধে আমি স্মৃতিকে বলি ‘বোকা’? নাকে ঝামা ঘষে দিতে হয় ঐ বরের…’আরেক মা’! বুড়ো বয়সে এখন ভাত রেঁধে দেবার জন্য স্মৃতিকে দরকার পড়েছে। তার সঙ্গে পরের ছেলে মানুষ করার ভার — আর স্মৃতি তাই ঘাড় পেতে নিয়ে নিলো! বলিহারি মেয়ের বুদ্ধি! বল্টু কলকাতায় থাকলে বাপকে ঢুকতে দিতো না।”
ছোট্টিমা এই প্রথম একটু সহানুভূতি দেখালেন স্মৃতিমাসীর ওপর, বললেন – “আসলে স্মৃতিকে যে অনেক দিক সামাল দিতে হচ্ছে, দিদি। মেয়ের বিয়ের সময় বাপ এসে না দাঁড়ালে এখনও আমাদের সমাজে পাঁচরকম কথা ওঠে। তাছাড়া স্মৃতির বরকে তো অন্য কোয়ার্টার্সটা ছেড়ে দিতে হলো ভদ্রমহিলা মারা যাবার পর, ও উঠবে কোথায়? নিজের কোয়ার্টার্সে ওকে থাকতে না দিলে, স্মৃতিকেই মেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হতো। ভাগ্যিস্ তার তিনমাসের মাথায় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো— মিষ্টুও নাকি একদম পছন্দ করছে না একবাড়ীতে বাপ আর সৎ-ভাইয়ের সঙ্গে থাকা।”
দিম্মা বললেন— “স্মৃতি জানে যে আমিও পছন্দ করবো না, তাই মুখ লুকিয়ে থাকছে।…বল্টু জানে?”
ছোট্টিমা বললেন— “বললো তো জানে! তবে বল্টুও এখন নিজের তালে আছে। এক পাঞ্জাবি মেয়ের সঙ্গে নাকি প্রেম করছে, তাকেই বিয়ে করবে বলেছে। মিষ্টুর বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, স্মৃতি বললো।…ও এখন আর কলকাতার ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না, দেখো!”
দিম্মা বললেন—“প্রেম করছে করুক, কিন্তু মা’কে বোনকে টাকা পাঠাচ্ছে তো? কতো কষ্ট করে বড়ো করেছে ওকে স্মৃতি…নিজে আধপেটা খেয়ে ওদের স্কুল-কলেজের টাকা জুগিয়েছে! ভদ্রঘরের মেয়ে তো আর
ঝি-গিরি করতে পারে না — সেটা বাদে আর সবই করেছে স্মৃতি।”
ছোট্টিমা বললেন— “টাকা বল্টু নিয়মিত পাঠাচ্ছে, স্মৃতি বললো। কিন্তু বিয়ের পর কি করবে কে জানে! কার কাছেই বা আর ক’দিন হাত পাতবে স্মৃতি, বলো? সব ভেবেচিন্তেই হয়তো ও বরকে আবার মেনে নিয়েছে! ওরই বা আর বয়স কতো…ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ হবে। জীবনটা তো কাটাতে হবে ওকে!”
দিম্মা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।
আস্তে আস্তে স্মৃতিমাসীকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো ঋতু। দিম্মার কাছে আর অতো আসতো না স্মৃতিমাসী, ঋতুও অতো ঘনঘন মামাবাড়ী যেতো না। নিজের স্কুল-কলেজ-বন্ধু এইসব নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। তারপর তো ওর নিজেরও বিয়ে হয়ে গেলো, দিল্লি চলে এলো। বিয়ের নিমন্ত্রিতদের লিস্টে স্মৃতিমাসী ছিলেন না — কারণ তার বছর পাঁচেক আগেই, মিষ্টুর বিয়ের দু’বছর পর, স্মৃতিমাসী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ওনার স্বামী নাকি দেখেন যে স্মৃতিমাসী ঘরে নেই। ভদ্রলোক অনেক খুঁজেছিলেন, পুলিশে খবর দিয়েছিলেন — কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। স্মৃতিমাসী যেন হঠাৎ উবে গেলেন। মিষ্টু তখন তার যমজ দুই ছেলে নিয়ে সবে গুছিয়ে বসেছে বহরমপুরের সরকারী বাংলোয়, বল্টু তার পাঞ্জাবী বৌ নিয়ে চণ্ডীগড়ে।….
দিম্মা মাঝে মাঝে স্মৃতিমাসীকে মনে করে দুঃখ করতেন; রেগে গেলে বলতেন— “ওর বর বদমাশটাই যতো নষ্টের গোড়া। নিজেই মেরে কোথাও ফেলে দিয়ে এলো নাকি মেয়েটাকে, কে জানে! যাইহোক, তাহলেও মেয়েটা বোধহয় শান্তি পেয়েছে। ঐ অপগণ্ডটার সঙ্গে থাকা মানে নরকবাস।”
দিম্মা চলে যাওয়ার পর, ‘স্মৃতিমাসী’ নামটাও হারিয়ে গেলো।
ক’দিন আগে দশবছরের ম্যারেজ এ্যানিভার্সারি সেলিব্রেট করতে দুবাই গিয়েছিলো ঋতু আর ওর বর অনিমেষ, কলকাতাতে মায়ের কাছে দুই মেয়েকে রেখে।
মেয়েগুলোকে ছেড়ে এসে মনটা খারাপ লাগছিলো ঋতুর, ওদের জন্য দু’দিন ধরে অনেক বাজার করলো। তৃতীয় দিনে সাইট সিইং-এর পর, অনিমেষকে বললো— “শোনো, মেয়েদের জন্য গলার দুটো হার নিয়ে নিই— কি বলো? সোনা এখানে সস্তা, আর মেয়েদের বিয়েতে তো লাগবেই এসব।”
অনিমেষ হেসে বললো— “যথা আজ্ঞা। তবে এখনই বলে রাখছি— সিলভার জুবিলি সেলিব্রেশনে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে এসো তুমি। তাতেও খরচা কম হবে এই গিল্ট-শপিং এর চেয়ে!”
ঋতু হাসলো।
গয়নার দোকানে একবার ঢুকলে যা হয়! এটা-ওটা দেখতে দেখতে অনেকটা সময় চলে গেলো।
ঋতুকেও একটা কিছু নিতে বললো অনিমেষ — বিবাহবার্ষিকী বলে কথা!
ঋতু দেখতে লাগলো পছন্দসই কি নেওয়া যায়, অনিমেষ ছেলেদের সেকশনে গেলো হাতের ব্যাণ্ড দেখতে।
দেখেশুনে একজোড়া ইয়ারিং বাছলো ঋতু — ডিজাইনটা একটু অন্যরকম।
ইয়ারিং দুটো পরে আয়নার মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলো, হঠাৎ চোখ পড়ে গেলো পেছনে।
উল্টোদিকের কাউন্টারে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক একটা ডায়মন্ড-সেটিং নেকলেস ওনার সঙ্গিনীর গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বলছেন— “ইউ মাস্ট টেক ইট ডিয়ার, আয়াম্ নট্ গোয়িং টু লিসন্ টু ইউ দিস্ টাইম। দিস্ ইজ্ আওয়ার ফিফটিন্থ…!”
ডবল আয়নার মধ্যে দিয়ে ছোটখাটো চেহারার মহিলার দিকে আড়চোখে তাকালো ঋতু।
মধ্যবয়সেও ভদ্রমহিলার চেহারায় বেশ চটক আছে।
পরক্ষণেই ঋতুকে অবাক করে, মহিলা স্পষ্ট গলায় পরিষ্কার বাংলায় বললেন – “রাকেশ, এই পনেরো বছরের মূল্য কি শুধু একটা ডায়মন্ড নেকলেসে ধরা যাবে? মোটেই না। তাহলে কি দরকার এতো দামী জিনিস কেনার?”
ভদ্রলোক মানিব্যাগ বের করে জিনিসটা প্যাক করে দিতে বললেন।
তারপর মহিলার দিকে তাকিয়ে হেসে ভাঙা বাংলায় বললেন— “কুছু বেশী দাম নয়, স্মৃতি! হামার কাছে তোমার দাম তার চেয়ে অনেক বেশী।”
আয়নার মধ্যে দিয়ে মহিলাকে ভালো করে আবার দেখলো ঋতু, অস্ফুটে বললো — “স্মৃতিমাসী?”
অনিমেষ এসে পাশে দাঁড়ালো— “নাঃ, ছেলেদের ভালো কিছু নেই।…তুমি কিছু বললে?”
“নাঃ!” নিজেকে সামলে নিলো ঋতু।…
দিম্মা কবেই চলে গেছেন, ছোট্টিমা-ও।
ঋতু স্মৃতিমাসীকে মনে রাখলেও, স্মৃতিমাসী নিশ্চয়ই দিম্মার নাতিনাতনীদের মনে করে রাখেননি। ছোটবেলার সেই ঋতুর ছবি দেখলে, এখনকার ঋতুর সঙ্গে কোনো মিলও খুঁজে পাবে না কেউ।
ঋতুরও ঠিকঠাক মনে আছে কিনা সব, তাই কি জোর দিয়ে বলা যায়?!
কবেকার কথা!
ঋতু অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললো— “চলো, হয়ে গেছে।”
তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে একটু সৌজন্যের হাসি হাসলো।
মহিলাও হাসলেন, নিয়ন আলোর নীচে কি যেন ঝলক দিয়ে উঠলো।
ঋতু তাকিয়ে দেখলো স্টেপকাট চুলের ওপর তোলা সানগ্লাস, প্যান্টের ওপর লম্বা ঝোলা শৌখিন টপ, ফর্সা মুখে দামী মেকআপ আর লিপস্টিক রাঙানো হাল্কা গোলাপী ঠোঁটের ফাঁকে ছোট ছোট দাঁতের সারির দু’দিকে দু’টো মিষ্টি গজদাঁত।
ডঃ শকুন্তলা চৌধুরীর জন্ম কলকাতায়, বড় হয়েছেন বি. ই. কলেজ ক্যাম্পাসের প্রফেসরস্ কোয়ার্টারে। পড়াশোনা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মসূত্রে বর্তমানে মিশিগানের বাসিন্দা। স্কুলজীবন থেকেই নিয়মিত লেখেন। বাতায়ন, পরবাস, ঋতবাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস।
শকুন্তলার লেখা গান ভিডিওতে পরিবেশন করেছেন রূপঙ্কর বাগচী, নচিকেতা চক্রবর্তী, কায়া ব্যাণ্ড। প্রকাশিত গ্রন্থ পৃথা (ঋতবাক প্রকাশনী)।