ফেরদৌস নাহার: পুবের আকাশে উড়িয়েছেন পশ্চিমের ঘুড়ি

নাহার তৃণা

জানি না, বইটি না পড়ে শুরুতেই শুধুমাত্র উলটে-পালটে দেখার ভিত্তিতে অনেক ছবির ভিড়ে কবি শামসুর রাহমানের ছবিগুলো দেখে ক’জন পাঠকের মনে আমার মতো প্রশ্ন জাগবে- এই বইয়ের শিরোনাম এমন দেয়ার পেছনে কারণটা কী? তাদের জন্য উত্তর হিসেবে বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখাটুকু তুলে দেয়া: “এইসব গদ্যের জন্ম পশ্চিম গোলার্ধে। যেখানে পুবের বাতাস উড়ে যেতে যেতে পারি দেয় দু দুটি মহাসাগর-আটলান্টিক ও প্যাসিফিক। সেখানে বসে ফেরদৌস নাহার কবিতার পাশাপাশি লিখছেন গদ্য। সেসব থেকে নির্বাচিত আটটি লেখা নিয়ে পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য। গদ্যগুলো তিনটি পর্বে: চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে, কবিতায়।”

আটটি অধ্যায়ের নির্দেশক সুদৃশ্য ছবি সম্বলিত প্রচ্ছদ পেরিয়ে বইটা পড়া শুরু করতেই প্রথম অধ্যায়ে পাওয়া যায় সালভাদর দালির চিত্র প্রদর্শনীতে পৌঁছে যাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত বয়ান। প্রত্যেকটি অধ্যায় মনকাড়া শিরোনামে সাজানো। প্রথম অধ্যায় চিত্রকলা। যার পুরোটা জুড়ে আছেন সালভাদর দালি। শিরোনাম-

সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি

সালভাদর দালির অধ্যায়টি আবার ক,খ বর্ণাক্রমে বিভক্ত, ঞ-তে গিয়ে যার সমাপ্তি পড়েছে। হিথ্রো বিমানবন্দরে নেমেই ফেরদৌস নাহার হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ফ্রিতে পাওয়া রঙিন লিফলেট, ফ্লায়ারের ভেতর পেয়ে যান সালভাদর দালির এক চিত্রপ্রদর্শনীর খবর। প্রদর্শনীর নাম; দ্যা দালি ইউনিভার্স’। চলবে এক নাগারে ৫ বছর। প্রয়োজনে সময় বাড়ানোর তথ্যটুকুও জানিয়ে দেয়া হয়েছে বিজ্ঞাপনে। দালি কে নিয়ে এমন প্রদর্শনী গ্রেট বৃটেনে সেবারই প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এমন কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা হাতে পেয়ে স্বভাবতই শিল্পানুরাগী ফেরদৌস খুশিতে ডগমগ। হাতের নাগালে দালির আসল চিত্রকর্মের দেখা পাওয়ার বিরল সুযোগ হাতছাড়া করতে মন চায়নি তাঁর। সদ্যই বৃটেনে এসেছেন, এখনও দেশটার সার্বিক আতাপাতা সম্পর্কে তাঁর তেমন কিছু জানা হয়নি– কিন্তু এই রকম অবস্হায় দাঁড়িয়েও তিনি ঠিক করে ফেলেন দালির ছবি তিনি অবশ্যই দেখতে যাবেন। প্রদর্শনীর দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে তাল রেখে ফেরদৌসের উত্তেজনা বাড়তে থাকে– কখন দেখবেন বিখ্যাত মোঁচওয়ালা শিল্পীর অসাধারণ সব কাজ। ইতোমধ্যে নিজে গিয়ে একবার ঘুরেও এসেছেন প্রদর্শনীস্হল- কাউন্টি হল। এমন এক জাদুময় ভুবনে আনন্দ ভ্রমণে মেতে ওঠার জন্য মনের মতো একজন সঙ্গী থাকলে আর কী চাই। তার আয়োজনও ইতোমধ্যে করে ফেলেন, সঙ্গী হিসেবে কবি শামীম আজাদকে পেয়ে যান। যাকে বলে সোনায় সোহাগা একেবারে।

আগস্টের এক ঝকঝকে দিনে দুই শিল্পপ্রেমী বাঙালি ললনা পৌঁছে যান দালির চিত্র প্রদর্শনীতে। কাউন্টি হলে যাওয়ার ঠিক আগের দিনটিতে ফেরদৌস শামীম আজাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন- লরেডল হাউজে ব্রিটিশ সাউথ এশিয়ান পোয়েট্রি শুনতে। সেখান থেকে প্রখ্যাত মনোচিকিৎসক এবং কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের দু’জনকে। সাহিত্য জগতের তিন বাঙালি মনখুলে সেরাতে আড্ডায় মেতে ছিলেন। রাতভর ধুম আড্ডার আমেজ তখনও তাঁদের মন জুড়ে।

কাউন্টি হলে পৌঁছানোর পথে ফেরদৌস নিখুঁতভাবে কাউন্টি হলের আশপাশের বর্ণনা দিয়েছেন। এরপর দিয়েছেন শিল্পী সালভাদর দালির পরিচিতি। এই অধ্যায়ের পুরোটা ভ্রমণ জুড়ে লেখক একজন দক্ষ সূত্রধরের মতো একবার প্রদর্শনী- বা আশপাশের বর্ণনা দিয়ে গেছেন। আবার শিল্পী দালি এবং তাঁর শিল্প নিয়ে বলেছেন। মোটকথা প্রদর্শনীর পুরোটা ভ্রমণের পরিপূর্ণ যে ছবিটা পাঠককে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, শব্দে শব্দে সাফল্যের সাথেই সেটি আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। পর্বটি তাই একঘেয়ে বর্ণনা না হয়ে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। ওঁর বয়ানের হাত ধরে পাঠক জানবেন দালি – ফ্রান্স ও স্পেনের বর্ডার থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরের রিজন্স ক্যাটালোনিয়ার ফিগুয়েরেস শহরে ১৯০৪ সালের ১১ মে জন্ম গ্রহণ করেন। দালির এক বড় ভাই ছিল। তার নামও ছিল দালি। ভাইটা বাঁচেনি বেশিদিন। আজীবন দালিকে মৃত ভাইয়ের ছায়ায় পা মিলিয়ে চলতে হয়েছে। দালি একা নন তাঁর পরিবারও সেটাই বিশ্বাস করতো যে তিনি তাঁর মৃত ভাইয়ের ছায়া হয়ে পৃথিবীতে এসেছেন।

দালির হাতের আসল শিল্পকর্মগুলো পৃথিবীর নানা প্রান্তের মিউজিয়াম, ধর্নাঢ্য পরিবার থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছিল। যে কারণে ছিল অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্হা। তবে সেটা প্রদর্শনী বা আগত অতিথিদের জন্য মোটেও বাড়তি ঝাঙ্ঝাট তৈরি করেনি। এ ধরনের প্রদর্শনীতে সঙ্গত কারণে ক্যামেরা, ভিডিও ইত্যাদি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। যা ফেরদৌসের মনোবেদনার কারণ হয়েছিল। চোখে দেখা স্মৃতি আর নোটবুকে টুকে রাখা লেখা সম্বল করেই শিল্পী সালভাদর দালি সম্পর্কিত অনবদ্য একটি অধ্যায় লিখেছেন। যা সম্ভবত বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম দীর্ঘ প্রবন্ধ। নিষেধাজ্ঞার কারণে যদিও ফেরদৌস নাহার পাঠকের জন্য প্রদর্শনীর কোনো ছবি জুড়ে দিতে পারেননি বলে আক্ষেপ করেছেন। কিন্তু তাঁর বর্ণনা ভঙ্গি ভীষণ জীবন্ত, তাতে ছবির খামতি কিছুটা হলেও পাঠক ভুলে যাবেন বলেই ধারণা।

প্রদর্শনীর বর্ণনা দিতে দিতে আবার তিনি দালির বিগত জীবনে পাঠককে টেনে নিয়ে গেছেন। জানাচ্ছেন যৌবনে দালি মাদ্রিদের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রেসিডেন্সি দ্য স্টুডেন্ট-এর একাডেমি অফ ফাইন আর্টস এ যোগ দেন। সেখানে যাঁদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয় তাঁদের মধ্যে ছিলেন – বিখ্যাত কবি নাট্যকার ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েল- যাঁর সঙ্গে যৌথভাবে দালি পরবর্তীতে দুটো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। একটি অ্যান আন্দালুসিয়া ডগ(১৯২৮) এবং গোল্ডেন এজ(১৯৩০)। এক সময় দালি ঘোষণা দেন তার মেধা যাচাইয়ের যোগ্যতা একাডেমির কোনো অধ্যাপকই রাখেন না। তিনি একাই একশ- এই অবস্হা আর কী। এমন ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই একাডেমি ভালোভাবে নেয়নি- তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারকে থোড়াই কেয়ার করে সে বছরই তিনি প্যারিস চলে যান। সেখানে পাবলো পিকাসো এবং জোয়ান মিরোর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। দালির আঁকা অনেক ছবিতেই এই দুজনের প্রভাব লক্ষ করা গেছে।

এই অধ্যায়ের বয়ান থেকে পাঠক জানবেন-সমস্ত প্রদর্শনীটিকে সালভাদর দালির তিনটি মূল চেতনার রঙে সাজানো হয়েছিল। সেগুলো হলো:
ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং নারীত্ব(Sensuality and Femininity)
ধর্ম এবং পুরাণ(Religion and Mythology)
স্বপ্ন এবং উদ্ভট কল্পনা(Dreams and Fantasy)

সালভাদর দালির চিত্রজগতের বর্ণনার সমাপ্তি ঘটেছে শিল্পীর আঁকা শেষ ছবি : The Swallow’s Tail মধ্য দিয়ে। চিত্রকলার প্রতি ফেরদৌস নাহারের গভীর আগ্রহ যে কতটা তাঁর মর্মগত শিল্পী সালভাদর দালির অধ্যায়টি পাঠ করলে পাঠক সেটা মর্ম মর্মে অনুভব করবেন।

পরের অধ্যায়টি চলচ্চিত্র বিষয়ে। এই অধ্যায়ে ফেরদৌস তাঁর দেখা পছন্দের দুটো চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপ করেছেন। যার একটি ‘চেরি ব্লোসম’ অন্যটি ‘লেমন ট্রি’। ‘চেরি ব্লোসম’ সিনেমা দেখতে গিয়ে ফেরদৌস তার জাপানী কলম বন্ধু ইউরি কিকুচিকে গভীর মমতায় স্মরণ করেছেন। ডরিস ডোরে এই সিনেমার পরিচালক। চিত্রনাট্যও তাঁর নিজের লেখা। ‘চেরি ব্লোসম’ চলচ্চিত্রটি দেখার অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে ফেরদৌস এটির পরিচালক ডরিস ডোরের সযত্ন পরিচিতি দিয়েছে পাঠকদের জন্য। ‘লেমন ট্রি’ ইসরাইয়েলি পরিচালক এরান রিকলিসের নির্মাণ। লেখকের পছন্দের দুটি সিনেমাই চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে শুধু নয় সিনেমা প্রিয় সাধারণ দর্শকেরও সমাদর কেড়েছে। দুটি সিনেমা নিয়ে এই বইতে বিস্তারিত আলোচনা আছে। যারা এখনও এ দুটি দেখেননি, আমার ধারণা সিনেমা, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে বিশদ আলোচনা পড়ে অনেকেই সিনেমা দুটি দেখার আগ্রহ বোধ করবেন।

চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনার এই অধ্যায়ে আরো আছে মায়া ডেরেন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। মায়া ডেরেন কেবলমাত্র একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাই ছিলেন না, তিনি একাধারে কবি,- লেখক অভিনেত্রী ও আলোকচিত্রী হিসেবেও স্বনামধন্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি তাত্ত্বিক, চিন্তাবিদ, ও প্রচারক হিসেবে সুপরিচিত। বিংশ শতাব্দীর ৪০ ও ৫০ দশকে আমেরিকার নিউ আমেরিকান সিনেমা’র প্রচার ও প্রসারে অন্যতম প্রাণ প্রতিম ব্যক্তিত্ব মায়া ডেরেন। মায়া ডেরেন সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা ছিল না। এই পর্বটি পড়ে অচেনা মায়া ডেরেনকে জানার সুযোগ ঘটেছে। সে জন্য লেখকের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ।

কালো ঘোড়া সবুজ লোরকা:

শিরোনামে কবিতার অধ্যায়টি শুরু হয়েছে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে দিয়ে। এই অধ্যায়টিও প্রথম অধ্যায়ের মতো বর্ণাক্রমের সাজানো। পাঠক ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে ফেরদৌস নাহারের আন্তরিক বয়ানের নিবিড় মায়ায় জীবন্তভাবে খুঁজে পাবেন। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা। একজন সপ্রতিভ বালক থেকে তারুণ্যের রৌদ্রঘন দিনে পা রাখা। প্রথম কবিতার বই প্রকাশে কবিসহ পরিবারের বাকিদের আনন্দে জেগে ওঠার বয়ান পড়তে পড়তে লোরকাকে ভালো না বেসে উপায় থাকবে না যেন পাঠকের।

সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েলের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার চিলতে কাহিনি জানা যাবে। সালভাদর দালির ছবি এবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা সারা পৃথিবীতে পরিবর্তনের জোয়ার আনবে, এমন সম্ভাবনায় বোদ্ধামহল যখন উচ্ছ্বল- তখন তাদের বন্ধুত্বের ভাঙনটা শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনের জন্য নিদারুণ এক ঝাঁকুনি ছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দুজনের বন্ধুত্বের ভাঙনে পাঠক মনও কমবেশি বিষাদগ্রস্ত হবে। একই সাথে ভাঙনের কারণটা জেনে পাঠকমনে ক্ষোভের জন্ম নেয়াটাও বিচিত্র কিছু না। লোরকার ধারণা মতে, সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েলের ১৯২৮ সালে যৌথভাবে ‘এন আন্দালুসিয়া ডগ’ নামে যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন সেটি আসলে তাঁকে আঘাত করতেই তৈরি করা হয়েছিল। আন্দালুসিয়া ডগ নামের ১৬ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে স্যুরিয়ালিজমের আড়ালে মূলত লোরকার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি আক্রমণাক্ত ইঙ্গিত করা হয়েছে।

স্পেনের এই কবির প্রতি বাঙালি কবি ফেরদৌস নাহারের অকৃত্রিম ভালোলাগার অনুরণন শব্দ ফুঁড়ে শুনতে পাওয়া যায়। বড্ড অবেলায় লোরকাকে হারানোয় বিষণ্নতার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে চলা স্পেনকে শব্দে শব্দে তুলে ধরেছেন ফেরদৌস। একদা যে কবি চিৎকারে জানান দিয়েছিলেন – ‘স্পেন শোনো, নতুন দিনের নতুন কবি জন্ম নিয়েছে তোমার বুকে, আমি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা… আমি আন্দালুসিয়ার কবি… আমি পৃথিবীর কবি…’

সেই কবিকে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে স্বৈরাতন্ত্রের জান্তব শাসক গুলি করে হত্যা করে কবিতায়,নাটকে বিরুদ্ধ মতবাদ আর প্রথাবিরোধী যৌনতায় আস্হা রাখার অপরাধে। ১৯৩৬ এর ১৯ আগস্ট এল ভিজনার গ্রামের সিয়েরা নেভাদা পাহাড়ের পাদদেশের বধ্যভূমিতে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে হত্যা করা হয়। আহ! কতটা রক্তান্ত হয়েছিল সে রাতের স্পেন, আকাশে ফুটে থাকা কবির প্রিয়তম চাঁদ কে জানে!
‘প্রস্হান মানেই চলে যাওয়া নয়’। জান্তবের থাবা লোরকা’র প্রাণ কেড়ে নিলেও তাঁকে মুছে ফেলতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আজ এতটা বছর উজিয়ে স্পেনের সোনার ছেলে কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা শুধুমাত্র তাঁর জন্মভূমির চৌহদ্দিতে ‘জনগণের কবি’ হিসেবে পরিচিত নন। তাঁর সৃষ্টি কর্মের ঝলক ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তরে।

আটলান্টিক পাড়ের নিবিড় কবিতা:

এমন শিরোনামের হাত ধরে এসেছে কানাডার মূলধারার কবি রনা ব্লুমের সঙ্গে আলাপচারিতার বিবরণী। টরেন্টোর ডাউন টাউনের সুইট টুথ কফি শপে রনা ব্লুমের সাক্ষাৎ পাওয়ার উন্মুখ আগ্রহে ফেরদৌস তাঁকে দেয়া নিদির্ষ্ট সময়ের আগেভাগেই সেখানে পৌঁছে যান। প্রথমবার সাক্ষাতের সুযোগ মিস করায় দ্বিতীয়বার তিনি সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। রনা ব্লুমের সাথে ফেরদৌসের পরিচয় হয় টরন্টোর মূলধারার একটি জনপ্রিয় কবিতা পাঠের আসরে। প্রথম পরিচয়েই এই কবিকে ভালো লেগে যায়। পরিচয়ের সূত্রে মানুষ হিসেবেও যে রনা ব্লুম অতি চমৎকার এবং মানবতাবাদী সেটি ফেরদৌসের বুঝে নিতে দেরি হয়না। ভালোলাগাটা তাতে আরো মজবুত হয়। ইট কাঠের শহর মানুষের সংবেদনশীলতা শুষে নেয়, এই আক্ষেপকে দারুণভাবে ভুল প্রমানিত করে দেয় রনার সংবেদনশীল আচরণ। আলাপের নানা সময় আবেগে বুঁজে আসা কণ্ঠ, ছলছল চোখ সে সত্য ফেরদৌসকে জানিয়ে গেছে। ফেরদৌস নিজেও একজন মানবতাবাদী, সংবেদনশীল মানুষ। কাজেই সেদিন দুজনের বন্ধুত্বপূর্ণ আড্ডা অনেক কথা, বাংলাভাষা নিয়ে রনার আগ্রহ আর ব্যক্তিগত হাসি-কান্নার আলাপে গড়াতে সময় লাগেনি। বলাইবাহুল্য যার সূত্রধর হিসেবে সপাটে দূতালি করেছে কবিতা। সুইট টুথ কফি শপের সেদিনের সেই আড্ডা-আলাপের সবটা দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন ফেরদৌস।

কেতকীর সঙ্গে একদিন:

শিরোনামে স্পষ্ট এই পর্বটি কেতকী নাম্নী কারো সঙ্গে সাক্ষাতের আলাপ নিয়ে। ইনি বিখ্যাত বিদুষী কেতকী কুশারী ডাইসন। লেখকের ভীষণ পছন্দের একজন মানুষ। যিনি একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, রবীন্দ্র গবেষক। ১৯৮১-৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উপন্যাস ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’ দিয়ে ফেরদৌসের চেনা কেতকী কুশারীকে। তারপর মুগ্ধ পাঠক হিসেবে কেতকী সম্পর্কে নিরন্তর জানতে থাকা। কেতকীর সাহিত্য জীবন যেমন বহুবর্ণের দ্যুতিতে আলোকিত, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও সেরকম বর্ণাঢ্য।

ফেরদৌসের ভাষায়: “ভারতবর্ষের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের মাপকাঠিতে কেতকী কুশারী ডাইসন এক জলজ্যান্ত বিপ্লব। বিশেষ করে ষাট দশকের প্রারম্ভে কলকাতা থেকে বৃত্তি লাভ করে বিলেতের অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়া একজন প্রচণ্ড মেধাবী নারী। আবার সেখানেই বিবাহসূত্রে একজন সাহেবের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দেওয়া, একে সেসময়ের প্রেক্ষাপটে বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।”

ভীষণ পছন্দের গুণী এই মানুষটার সঙ্গে ফেরদৌসের সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে যায় ২০০৫ এর নভেম্বরে। সে সময় কেতকী টরন্টো ইউনিভার্সিটির নিউ কলেজের উদ্যোগে আয়োজিত রবীন্দ্র উৎসবে যোগ দিতে কানাডায় এসেছিলেন। কেতকী কুশার ডাইসন নামের বিদুষী মানুষটির প্রতি অনুরক্ত ফেরদৌস এই পর্বে তাঁর সম্পর্কে আদ্য-প্রান্ত পাঠককে জানাতে ভোলেননি।

‘পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য’ বই’এর শেষ পর্বটির শিরোনাম: ‘হৃদয় যাঁর পৃথিবীর আলো’

এই আলোর নাম শামসুর রাহমান। কবি শামসুর রাহমান। ফেরদৌস নাহারের প্রিয় রাহমান ভাই। বাংলাদেশের প্রধানতম কবির সঙ্গে কবি ফেরদৌস নাহারের প্রাণবন্ত পরিচয় পর্ব থেকে শুরু করে মৃত্যুর বিষাদময় খবর পাওয়ার বর্ণনা আছে এপর্বে।

২০০৬ এর ১৭ আগস্ট, ফেরদৌস নাহার তখন তাঁর আবাস ছেড়ে ভ্রমণে ছিলেন কানাডার ক্যালগেরি শহরে। সেখানে বসে প্রিয়তম কবি, সুহৃদ শামসুর রাহমানের মৃত্যুর খবর পান। স্মৃতিরা মিছিল করে তাঁর মনে ভিড় জমায়। বিষণ্নতার হাত ধরে দিন গড়ায়- কবির চলে যাওয়ার একমাস পেরিয়ে গেলেও ফেরদৌস তাঁর প্রিয় রাহমান ভাইকে নিয়ে একটি শব্দ লিখতেও ব্যর্থ হন। অথচ তাঁর সঙ্গে কত কত স্মৃতি রয়েছে। শব্দে যা তিনি সেই মুহূর্তে বয়ানে ব্যর্থ।

মধ্যে সেপ্টেম্বরে নৈঃশব্দ্যে মোড়া এক সন্ধ্যামুখী প্রহরে পুরনো গির্জার সিঁড়িতে বসে হঠাৎ তাঁর ভেতর প্রিয় কবির স্মৃতিতর্পণে শব্দেরা সমবেত হয়। শব্দে শব্দে এক অসাধারণ নৈবেদ্য সাজিয়ে প্রিয় রাহমান ভাইকে উৎসর্গ করেন- ‘কবির দুহাত ছুঁয়ে’। যা পাঠে পাঠকের মনও ছুঁয়ে যাবে সমান মুগ্ধতায়।

প্রিয় বেশ কয়েকজন কবি আছেন যাঁদের গদ্য শৈলীর বরাবরই মুগ্ধ পাঠক আমি। ফেরদৌস নাহার সে তালিকায় নিজ যোগ্যতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। ‘পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য’ এর মুগ্ধপাঠ শেষ হলো। খুব শিগগিরই এই লেখকের আরেকটি অনবদ্য গদ্য রচনা ‘কফি শপ’ পড়া শুরু করবো। ফেরদৌস নাহারের সুখপাঠ্য গদ্যের পাশাপাশি বইটিতে প্রচুর ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে যা পাঠকের জন্য বাড়তি পাওনা। ঢালাওভাবে বইটি নিয়ে কেবল প্রশংসা বাক্যই লেখা হয়ে গেল- খামতি বা খুঁতগুলো সামনে আনাই হলো না। আসলে, আনাই গেলো না। ভীষণ যত্নসহকারে রচিত এ-বইটি পরিশ্রম ও শিল্পগুণে যেমন নিখুঁত থাকায় সচেষ্ট ছিল, তেমনই পাঠকের পাঠরুচি গড়ে তুললেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

ইতোমধ্যে ‘পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য’র দুইটি সংস্করণ হয়েছে। প্রথমবার প্রকাশ করে আড়িয়াল প্রকাশনী, দ্বিতীয়বার ২০২০ অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে। অত্যন্ত সাবলীল ও রুচিস্নিগ্ধ প্রচ্ছদটি করেছেন মার্জিতা প্রিমা। বইটির সার্বিক পাঠক প্রিয়তা কামনা করছি।

 

নাহার তৃণা

জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।

Facebook Comments

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top