প্রার্থনা: ক্ষয়
কতোটা শিশির মাড়িয়ে একটি সূর্যের বেড়ে ওঠা,
কতোটা অন্ধকার শুষে নিয়ে একটি চাঁদের জন্ম,
কতোটা গাঢ় হলে একটি রাত স্বার্থক হয়ে ওঠে!
ঝরে যাওয়া সমস্ত শিশিরের যত্নে
ল্যাপটানো অন্ধকারে ঘুমন্ত সারি সারি গ্রাম
এই হৃদয়খানি;
এখানে বাঁশের পাতায় খেলা করে বনেদি প্রেম,
কুহেলিকা বনে মধুচন্দ্রিমা যাপন শেষে
আয়োজন করে শুন্য সংসার,
উদাম দুয়ারে দখিনের হাওয়া নেই
তবু
শিশিরের প্রার্থনা
আঁধারের প্রার্থনা
গাঢ় রাতের প্রার্থনা
জমা হয় মন্দিরে।
সূর্য ও চাঁদের বাড়াবাড়িতে তাই আক্ষেপ নেই কোনও।
কেউ যায়, যাওয়ার অধিক
যে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, গেছে সে যাওয়ার অধিক-
আমি তার ছায়ার পেছনে ঘুরি—
ছায়াগুলো সন্দেহাতীতভাবে অদৃশ্য হতে হতে
কাঁচের শরীরে ঢুকে পড়ে
জলের অনশন ভেঙে এখানে ক্রমাগত কুয়াশাপাত-
ভাঁটফুলে, রক্তজবায়—
এখানে আলো ও অন্ধকারের প্রলোভন, মায়াপাখি ভোর-
আমাদের চোখে চোখে অস্তগামী নিমজ্জন
সমস্ত শোকের মুদ্রায় জলের ফোঁটা— বৃষ্টির মার্বেল!
ছায়ারাও এখানে মুখোশে ঢেকে রাখে মায়াবী শহর।
স্মৃতি বলতে কিছুই নেই
কারো কারো স্মৃতি বলতে কিছুই থাকে না, বিস্মৃতিও না।
জলের ভেতর শুয়ে থাকি, অথচ জল নেই,
জানলা খুলে চেয়ে দেখি— বাড়ি ফিরে গেছে উত্তরের হাওয়া
সময়ের বিপরীতে হেঁটে যাচ্ছে স্মৃতির উঠোন।
কারো কারো স্মৃতি থাকে না, থাকে না সঙ্গম শেষের ভোর,
রাতের দরজা খুলে নুয়ে পড়ে স্তন, সিগ্রেটের ধোঁয়া।
এ্যাস্ট্রেতে পড়ে আছে বাটিভর্তি জোছনা, নক্ষত্রের ঘ্রাণ
তারও কিছু স্মৃতি ছিল, পুড়ে যাওয়ার ইতিহাস,
জলের ভেতরে মুখ গুজে শুনি উষ্ণতার আর্তনাদ
স্মৃতিরা বিস্মৃত হলে ভেসে যায় জলঘুড়ি বাতায়ন
শিমুল তুলোর মত উড়ে যায় আমাদের স্মৃতির নামতা।
নিখোঁজ ডায়রী
নিজেকে অনেক কিছুই ভাবি—
এই ধরো মানুষ, নদী, পাহাড় কিংবা পাথর
ধরো ব্যথা, সংসার কিংবা তুমি
বুকের পাঁজরে এসে ভেঙ্গে যায় সমস্ত জলের ঢেউ
স্মৃতি থেকে ঝাঁপ দেয় নিখোঁজ ডায়রী- পোড়াগন্ধ,
সন্দেহের শরীর- নথিপত্র- লোনামুখ
নাভীর ভাজপত্রে পাপের সাইরেন— রাজকপাট
গাঢ় অন্ধকারে নির্ঘুম দেয়ালে নাচে রাত্রির তলপেট।
অলৌকিক অন্ধকার
খুলে দিয়েছি নিজস্ব দুয়ার— চলে এসো। ও আধারের পাখি!
এমন অমল আলো জ্বেলে কীভাবে মেলে আছো
অলৌকিক অন্ধকার— খন্ডিত ছায়া?
দৃশ্যের ভেতরে শুয়ে আছি- পরের দৃশ্য মনে নেই;
যতবার
নিরুদ্দেশ হই, এক নামে ফিরে আসে পুরনো সংলাপ
দুঃস্বপ্নের ভেতরে হেঁটে যাই! ও পৌরাণিক রাত-
কার নামে খুলে রাখো স্মৃতিঘর, নক্ষত্রের আয়না!
সমস্ত ঘরহীন
ঘরের ভেতর আরেক ঘর তুলে বসে আছি, দরজা বন্ধ-
তোমার আসা যাওয়ার পথে অবুঝ পত্রপল্লব, খিড়কি-
কবেকার কোন হাওয়ায় উড়ে গেছে সমস্ত জলের ঘুম
দেয়ালে কান পেতে শুনি পাথরের কান্না, গোপন পদধ্বনি
আঙুলে আঙুলে জলভরা নদী, অস্তগামী মুখের স্রোত
চোখে চোখে দৃশ্যের জমাট ফেনা, বিচূর্ণ ঘামঘুড়ি-
আমার ভেতরে উঠানামা করে বহুমুখী নারীর শরীর, শয্যা-
ওখানে জল নেই, শুয়ে থাকে ভোরের পানশি, শিশিরনামা-
যেখানে হাত রাখি, যে পথে যাই, ঘুরেফিরে একই পলায়ন-
ঘোরের ভেতর কেটে যায় উপোষী দুপুর, নর্তকীর ঘ্রাণ-
অবুঝ ধ্যানপত্রে ভেসে ওঠে যুগলবন্দী ছায়া, দূরের নির্ঘন্ট,
ঘরের ভেতর আরেক ঘর তুলে বসে আছি, সমস্ত ঘরহীন।
মালেক মুস্তাকিম
এই সময়ের একজন তরুণ কবি। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পেশায় সরকারী চাকুরে। সাহিত্য সাময়িকী ও ছোট কাগজে নিয়মিত লিখছেন।
প্রকাশিত কবিতার বইঃ ভুলের ভূগোল, ২০১৩; বিষণ্ণতাবিরোধী চুম্বনগুলি, ২০১৬; তোমার সাথে হাঁটে আমার ছায়া, ২০১৮; একান্ত পাপগুচ্ছ, ২০২১
[email protected]