নাহার তৃণা
বিশ্বসাহিত্যের ঘনিষ্ঠপাঠক মাত্রই জানেন ডায়াসপোরা লেখকশ্রেণী বিশ্বজুড়ে ধারাবাহিকভাবে সাহিত্যজগতে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। অসংখ্য প্রতিভাময় লেখকে সমৃদ্ধ ডায়াসপোরা সাহিত্যজগত। ভি.এস. নাইপল, সালমান রুশদি, কেতকী কুশারী ডাইসন, চিনুয়া আচেবে, খালেদ হোসেইনি, নুরুদ্দিন ফারাহ, কাজুও ইশিগুরো, ঝুম্পা লাহিড়ী, মনিকা আলী, আঘা শহিদ আলী, বাপসি সিধুয়া প্রমুখ নামের পাশে আরো একটি নাম বিশেষ সম্মানে সম্প্রতি উচ্চারিত হচ্ছে—নামটি হলো আব্দুলরাজাক গুরনাহ। যিনি একজন ডায়াসপোরা লেখক। ডায়াসপোরা বাংলায় যা শরণার্থী। জন্মভূমি ছেড়ে যে কোনো কারণে এই শ্রেণীগোষ্ঠী একসময় ভিনদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাঁরা নিজের নিজের প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। লেখক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক মোজাফ্ফর হোসেনের ‘দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য’ বইটিতে ডায়াসপোরা সাহিত্য এবং তত্ত্ব বিষয়ে বেশ স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছে: ‘ডায়াসপোরা পরিস্থিতিতে বাস করছেন অর্থাৎ কোনো কারণে নির্বাসনে থেকে বা জীবিকার অন্বেষণে নিজ দেশ ছেড়ে ভিনদেশে বাস করছেন এমন পরিস্থিতিতে কোনো লেখক যে সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করেন সেটিই ডায়াসপোরা সাহিত্য।’ এবং— “ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্বে কিছু বিষয় প্রণিধানযোগ্য, যেমন: গৃহত্যাগ করা, নিজ-বাসভূমের জন্য নস্টালজিক হয়ে পড়া, নতুন ভূমিতে একাকীত্ব বোধ করা, সমঝোতা করা, নতুনভাবে নিজের আত্মপরিচয় নির্মাণ করা, দুই দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভেতর আটকে পড়া; প্রভৃতি। এসব কারণে ডায়াসপোরাকে বলা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ-উত্তর (post-nationalism) কাল।”
ডায়াসপোরা সাহিত্য উপাদনগুলোর নজির উল্লেখিত লেখকদের লেখাজোকা পাঠের মাধ্যমে আমরা পেয়ে থাকি। বলা যায় বিশ্বসাহিত্য এঁদের লেখালেখিতে বহুদিন ধরে সরগরম। ডায়াসপোরা সাহিত্যিক হিসেবে উল্লেখ্যদের মধ্যে তিনজন এরই মধ্যে সাহিত্য দুনিয়ার সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নোবেল’ অর্জন করেছেন। আবদুলরাজাক গুরনাহ চতুর্থ সাহিত্যিক হিসেবে সেই তালিকার নতুনতম সংযোজন।
যদিও শুধুমাত্র ‘নোবেল’এর নিক্তিতে একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যগুণ বিচার করতে বসলে ব্যাপারটা অন্যায্য হবে। কেননা এমন অনেক পৃথিবী বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিক আছেন যাঁদের ভাগ্যে নোবেল পুরস্কারের শিকেই ছিঁড়েনি। লিও তলস্তয়, আন্তন চেখভ, হোর্হে লুইস বোর্হেস, ফ্রান্ৎস কাফকাসহ অনেক গুণী সাহিত্যিক নোবেল পাননি। তাতে তাঁদের সাহিত্যকীর্তির কোনো ক্ষতিসাধন হয়নি। বরং বিশ্বসাহিত্যের দুনিয়ায় তাঁদের কীর্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত এবং পঠিত হয়ে আসছে। একথা তো সত্যিই যে নোবেল পুরস্কার প্রদানের পেছনে শুধুমাত্র সাহিত্যগুণ, বা জনপ্রিয়তা মাপা হয়না— ভূ-রাজনৈতিক নানা হিসাব নিকাশ তার সাথে জড়িত। ওরহান পামুকের নোবেল প্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতা তেমন একটা উদাহরণ। যে কারণে প্রতিবার বহুল প্রচারিত কিছু নাম আজও নোবেল প্রাপ্তদের তালিকার বাইরেই থেকে গেছে। যাঁদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি অন্যতম বলা যায়। এই তালিকায় আরো কিছু নাম যেমন: লুদমিলা উলতস্কায়া, নগুগি ওয়া থিয়োং, সালমান রুশদী, জন ব্যানভিল, লাসলো ক্রাসনাহরকাই, মার্গারেট আ্যাটউডদের নাম প্রতি বছর কমবেশি উচ্চারিত হয়ে আসছে। দুহাজার একুশের সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার আগেও নামগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে কমবেশি। কিন্তু সাহিত্যমোদীদের হিসাব উল্টে দিয়ে যাঁর নাম ঘুণাক্ষরেও ভাবা হয়নি এমন একজনকে এ বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এতে যেন ডায়াসপোরা লেখকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকেই বলিষ্ঠভাবে অনুমোদন দেওয়া হলো।
আবদুলরাজাক গুরনাহ আন্তর্জাতিক সাহিত্য আসরে পরিচিত নাম হলেও বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে বহুল চর্চিত কোনো নাম নয়। বরং অনেকেই তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে মুখ চাওয়া- চাওয়ি করেছেন, এ আবার কে বাবা! ভাব নিয়ে। বিশ্বসাহিত্যের বিশাল কর্মযজ্ঞের সবটা আমাদের নখদর্পণে না থাকায় এমন বিড়ম্বনা। সাহিত্য দুনিয়ায় আব্দুলরাজাক গুরনাহ হঠাৎ আগত কোনো আগন্তুক নন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নিজস্ব পরিমণ্ডলে বসে লেখালেখি করে চলেছেন। Judyannet Muchiri একজন গর্বিত আফ্রিকান যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, কবি এবং গল্পকার। আব্দুলরাজাকের‘ আফটারলাইভস’ উপন্যাস নিয়ে দুজনের দীর্ঘ আলাপচারিতা প্রকাশিত হয় আফ্রিকান ইন ওয়ার্ডসে। এর ভূমিকায় একজন শক্তিমান ঔপন্যাসিক হিসেবে গুরনাহর লেখাজোকা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতটা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে তার উল্লেখ রয়েছে। পুরস্কারের দৌড়ে গুরনাহর কয়েকটি উপন্যাসের অর্ন্তভুক্তির কথাও এখানে উল্লেখ করা হয়। যেমন: ‘প্যারাডাইজ (Paradise)’ বুকার এবং হুইটব্রেড পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টের তালিকায় ছিল। বাই দ্য সী (By the Sea ), বুকারের জন্য লংলিস্ট এবং লসএ্যাঞ্জেলস টাইমস বুক এয়ার্ডের শর্টলিস্টে ছিল, ডিটারশন (Desertion ), কমনওয়েলথ রাইটার্স এয়ার্ডের শর্টলিস্টভুক্ত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গন গুরনাহর যথেষ্ট কদর করেছে, এই ধারণার বিপরীতে আব্দুলরাজাকের সাথে দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত এডিটর আলেকজান্দ্রা পিঙ্গেল (Alexandra Pringle) বলেছেন: “He is one of the greatest living African writers, and no one has ever taken any notice of him and it’s just killed me.” কাজেই বোঝা যাচ্ছে বার কয়েক বুকারের মতো পুরস্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হলেও সেটি না পাওয়াকে অনেকে গুরনাহর সাহিত্যকর্মের প্রতি অবিচারই মনে করেছেন। কেননা সাহিত্য জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে গুরনাহ যদি বুকারের মতো সম্মানজনক পুরস্কারটি পেতেন তবে তাঁর পরিচিতি বর্হিবিশ্বের সীমানা পেরিয়ে বাঙালি মহলেও জোরেশোরে ছড়াতো তাতে সন্দেহ নেই। নির্লজ্জতা হলেও সত্যি, পুরস্কারপ্রাপ্তি লেখক সাহিত্যিক থেকে শুরু করে যে কারো জন্যই প্রচার-প্রসারের একটা বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। গুরনাহর বোদ্ধা বা জহুরি পাঠকশ্রেণি তাতে তেমন মাথা ঘামান বলে মনে হয় না। পুরস্কার বা প্রচার প্রসার নিয়ে আব্দুলরাজাক নিজেও তেমন ভাবিত নন। নিজস্ব জগতে বসে একজন একনিষ্ঠ একাডেমিয়ান এবং ঔপন্যাসিকের ভূমিকা পালন করে এসেছেন এতদিন, এমনটাই তিনি পছন্দ করেন। ২০২১-এর নোবেল পুরস্কার কে পেতে যাচ্ছেন সেটা নিয়ে তাঁর মধ্যে কৌতূহল থাকলেও সেটা তাঁর স্বভাবজাত সংযমের গণ্ডির মধ্যেই ছিল। পুরস্কারটি তিনি নিজেই পেয়েছেন এমন খবরেও তিনি সংযত প্রতিক্রিয়া জানান। মজার ব্যাপার হলো পুরস্কার প্রাপ্তির খবর যখন সুইডিশ একাডেমির স্হায়ী সেক্রেটারি Mats Malm ফোন করেন গুরনাহকে জানিয়েছিলেন তখন তিনি ধরেই নিয়েছিলেন কেউ বুঝি তাঁর সঙ্গে কৌতুক করছে। এ নিয়ে তাঁর অকপট ভাষ্য: “thought it was a prank, I really did.”
আবদুলরাজাকের সাহিত্যমেধার স্বীকৃতি হিসাবে সুইডিশ একাডেমি থেকে বলা হয়: “The Nobel Prize in Literature 2021 was awarded to Abdulrazak Gurnah “for his uncompromising and compassionate penetration of the effects of colonialism and the fate of the refugee in the gulf between cultures and continents.” অর্থাৎ আবদুলরাজাক গুরনাহ ঔপনিবেশিক শাসনের কুপ্রভাব অনমনীয় মনোভাব নিয়ে যেভাবে তিনি ক্রমাগত তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন তার স্বীকৃতি হিসেবেই তাঁকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান Anders Olsson দ্য নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটে আবদুলরাজাক গুরনাহর সাহিত্যকর্ম নিয়ে চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। গুরনাহকে পাঠের আনন্দময় অভিজ্ঞতা বর্ণনার পাশাপাশি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের সুখপাঠ্য বিশ্লেষণ আছে এতে। এই লেখার শেষ প্যারাতে গুরনাহর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে চমৎকার সারকথা ফুটে উঠেছে :
“Gurnah’s dedication to truth and his aversion to simplification are striking. This can make him bleak and uncompromising, at the same time as he follows the fates of individuals with great compassion and unbending commitment. His novels recoil from stereotypical descriptions and open our gaze to a culturally diversified East Africa unfamiliar to many in other parts of the world. In Gurnah’s literary universe, everything is shifting – memories, names, identities. This is probably because his project cannot reach completion in any definitive sense. An unending exploration driven by intellectual passion is present in all his books, and equally prominent now, in Afterlives, as when he began writing as a 21-year-old refugee.”
আব্দুলরাজাক গুরনাহ নিজের শ্রম-মেধায় আজকের অবস্হানে পৌঁছেছেন। তারপরও তাঁর অনেক পরিচয়ের মধ্যে এটাও একটা পরিচয় যে তিনি একজন শরণার্থী। ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ জাঞ্জিবারে ১৯৪৮ সালের ২০ ডিসেম্বরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আব্দুররাজাকের বয়স যখন ১৮ বছর, সময়টা ‘৬০ দশকের শেষ, তখন বাধ্য হয়েছিলেন স্বদেশ ছেড়ে পালাতে। সে সময় তিনি একজন শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজাল থেকে ১৯৬৩ সালে জাঞ্জিবার শান্তিপূর্ণ ভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু সে শান্তি খুববেশি দিন টিকসই হয়নি। জাতিগত রেষারেষি চরমে ওঠে দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট আবেদ কারুমের সময়কালে। জাঞ্জিবারকে বিপ্লব-খুন জখমের ভেতর দিয়ে যেতে হয় তখন। নিপীড়ন, গণহত্যার খড়গ নেমে আসে আরব বংশোদ্ভূত নাগরিকদের উপর। গুরনাহর পরিবার ভুক্তভোগী নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত হওয়ায় জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। সন্তানের জীবন বাঁচাতে পরিবার তাঁকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ১৯৮৪ সালের আগ পর্যন্ত স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি গুরনাহর পক্ষে। সে সময় মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। নিজে একজন শরণার্থী বলেই তাঁর বুকের ভাঁজে লেপ্টে থাকা স্বদেশের পাশাপাশি শরণার্থীদের জন্যে মমতা জেগে থাকে। শাসনক্ষমতার হানাহানিতে উলুখাগড়ার মতো পাকে পড়া সাধারণ জনগণ, উপনিবেশবাদ, আর বিশ্বজোড়া অসহায় শরণার্থীদের নিয়ে তিনি বরাবরই সোচ্চার— সহানুভূতিশীল। সাহিত্য দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অজর্নের সময়টিতেও তিনি শরণার্থীর বিষয়টি স্মরণ করতে ভুলেননি। নোবেল প্রাইজ আউটরিচের পক্ষ থেকে এডাম স্মিথের সঙ্গে ফোনে সাক্ষাৎকার দেবার সময় কথোপকথনের এক পর্যায়ে শরণার্থী বিষয়ে সহৃদয় বক্তব্য রাখেন। শরণার্থী মানেই যে বোঝা নয়, সুযোগ পেলে তারাও নিজেদের প্রমাণে সক্ষম একথাও স্পষ্টভাষায় জানাতে ভুলেন নি। এডাম স্মিথের ভাষায় গুরনাহর বক্তব্য এভাবেই উঠে আসে: “A kind of miserliness,” is how Abdulrazak Gurnah describes the attitude of some in Europe to refugees. After all, he says, “Europeans streaming out into the world is nothing new” and he suggests those seeking succour also be seen as “talented, energetic people, who have something to give.”
তাঁর প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের আখ্যান জুড়ে আছে দেশহারা— শিকড়চ্যুত মানুষের অস্তিত্বের সংকট, জাতিগত সংঘাত, বিশেষ করে আফ্রিকান অঞ্চলের রাজনীতি, ঔপনিবেশিক ইতিহাস, শরণার্থী জীবনের দুর্দশা—হাহাকার। মাতৃভাষা সোয়াহিলি হলেও লেখার মাধ্যম হিসেবে তিনি ইংরেজিকে বেছে নিয়েছেন। যা তার জাতিগোষ্ঠীর কাছে খুব একটা সমাদর পায়না। কিন্তু আব্দুলরাজাক সব সময়ই তাঁর পেছনে ফেলে আসা স্বদেশ- আফ্রিকা ভূখণ্ডের হাসি-কান্না-বঞ্চনা সমূহকে নিজের ভেতর ধারণ করে এসেছেন। তাঁর আফটারলাইভস উপন্যাস প্রসঙ্গে “ These stories have been with me all along…” এমন বক্তব্য দিলেও এটি কার্যত তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যজীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা বাস্তবতা। নিজের সফলতার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কারটিও তিনি সেই ভূখণ্ড এবং তার জনগণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। ফেলে আসা জীবনের ছায়া শুধু তাঁর কাহিনির শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে না; তিনি নিজেও যেন সেইবৃত্তেই বসবাস করেন। জন পি. মারকুয়ান্ডের “মূল থেকে সরে গিয়ে যে যেখানেই যাক না কেন, মূলের প্রতিই থাকে তার তীব্র আকর্ষণ।” বক্তব্যটি আব্দুলরাজাক গুরনাহর ক্ষেত্রে বড়বেশি সত্যি বলে মনে হয়। তাঁর সাহিত্যকীর্তিতেও এই সত্যের অনুরণন শোনা যায়।
তিয়াত্তর বছর বয়স্ক আব্দুলরাজাকের লেখালেখির সংখ্যা খুববেশি নয়। এ পর্যন্ত তিনি দশটি উপন্যাস এবং একটি মাত্র গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর লেখালেখির গ্রাফ পর্যালোচনা করে এটা স্পষ্ট যে, প্রথম দুটি উপন্যাস ভিন্ন বাকি আটটি উপন্যাসের জন্য তিনি পর্যাপ্ত সময় নিয়েছেন। প্রচার-প্রচারণার হুড়োহুড়ি কিংবা সস্তা জনপ্রিয়তার ইঁদুর দৌড়ে তিনি ভাসতে আগ্রহী ছিলেন না, গ্রাফ থেকে সেটাও বোঝা যায় বৈকি।
প্রথম উপন্যাস মেমোরি অফ ডিপারচার (Memory of Departure – London : Jonathan Cape, 1987)’ এর প্রধান চরিত্র ওমর, যে একজন শিকড়চ্যুত মানুষ। নিজের চারপাশে নিরন্তর হানাহানি-রেষারেষি আর চরমতম দারিদ্র্য দেখে দেখে যে ক্লান্ত। অসহনীয় সেই বলয় ছেড়ে ভাগ্য পালটানোর জন্য সে পালিয়ে অন্যদেশে চলে যায়। অতীত ভুলে নিজের স্বপ্নকে আকার দেবার যাত্রায় নতুন করে মধ্যে জুড়ে বসে দেশহীন মানুষের অস্তিত্ব সংকটের দ্বন্দ্ব। এই নিগূঢ় অনুভূতির ধারাবাহিকতা তার অন্যান্য উপন্যাসেও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
গুরনাহর চতুর্থ উপন্যাস ‘প্যারাডাইজ’। লন্ডনের খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্হা হামিশ হ্যামিলটন( Hamish Hamilton) ১৯৯৪ সালে উপন্যাসটি প্রকাশ করে। ‘প্যারাডাইজ’ উপন্যাসটি লেখক হিসেবে তাঁর জাত চেনায়, আন্তর্জাতিক বোদ্ধা পাঠকমহলের সমাদর কুড়াতে সক্ষম হয়। বোদ্ধা মহলের অনেকেই ‘প্যারাডাইজ’কে পোলিশ-বৃটিশ লেখক জোসেফ কনরাড (Joseph Conrad) এর হার্ট অফ ডার্কনেস (Heart of dearkness) উপন্যাসটির সাথে তুলনা করেছেন। এই উপন্যাসের বীজটি ১৯৯০ এর দিকে পূর্ব আফ্রিকার একটা রিসার্চ ট্যুর থেকে বিকশিত হয়। দারিদ্র্য আর ভাগ্যের নির্মম শিকার এক আফ্রিকান বংশভুত তরুণ ইউসুফের দ্বন্দ্বসঙ্কুল জীবন-যাত্রার ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্যারাডাইজ উপন্যাসে। এটি যেমন একটি মর্মন্তুদ প্রেমের উপন্যাস, পাশাপাশি ঔপনিবেশবাদ বিশেষত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকশক্তির দ্বারা নির্যাতিত, শোষিত আফ্রিকার গল্পও।
ইউরোপীয়ান ঔপনিবেশিক শক্তি জার্মান কীভাবে গুরনার জন্মভূমি জাঞ্জিবারে অন্যায়ভাবে থাবা বসিয়েছিল। দেশটির পুরুষদের বাধ্য করেছিল জার্মান বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে, সে কাহিনির প্রাঞ্জল বর্ণনা আছে এখানে। উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র ইউসুফ যে বাধ্য হয় তার ভালোবাসার মানুষ আমিনাকে ত্যাগ করে জার্মান বাহিনীতে যোগ দিয়ে তাদের হয়ে স্বদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে। মর্মান্তিক আর দ্বন্দ্বময় এই আখ্যান আব্দুলরাজাক তার নিজস্ব আকর্ষক ভাষাভঙ্গির মাধ্যমে বয়ান করেছেন। আব্দুলরাজাক গুরনাহর উপন্যাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো— সচরাচর পাঠক মনের ভাবনার সাথে সঙ্গত না দিয়ে বিপরীত দিকে হেঁটে যাওয়া। অর্থাৎ পাঠক তার কাঙ্ক্ষার প্রতিফলন তাঁর উপন্যাসে প্রায়শই দেখতে ব্যর্থ হন। অতপর সুখে শান্তিতে তাহারা বাস করিতে লাগিলোর’ এমন প্রত্যাশার বিপরীতে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই তিনি তাঁর পাঠককে নিরাশ করেন—যা আব্দুলরাজাক গুরনাহর লেখার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলা যায়।
১০ অক্টোবর ২০২১ সংখ্যার নিউইয়র্কারে ক্রিস্টেন রুপেনিয়ান (Kristen Roupenian) তারঁ ‘দ্য ইম্প্যাক্ট অফ আব্দুলরাজাক গুরনাহ’স নোবেল প্রাইজ’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্যারাডাইজ উপন্যাসটি পাঠের অভিজ্ঞতা এবং উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। রুপেনিয়ানের বয়ানেই সেটি শুনে নেয়া যাক: “… I sank into “Paradise,” Gurnah’s historical novel of colonial East Africa, published in 1994, like a person who still knew how to read for pleasure. My clearest memories of the book have to do with its sensory richness, its flashes of eroticism, and the protagonist’s dreamy interiority—”
এ পর্যন্ত তাঁর দুটো গল্প পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে। এ দুটো গল্পের একটিতে শরণার্থী জীবনের স্মৃতি রোমন্থন আছে; আছে নিজের অবস্হানকে অন্যের চোখে সম্মানজনক করে তোলার মেকি চেষ্টা। অন্যটিতে আছে বন্দীত্ব ভুলে ভালোবাসা পাওয়ার চিরন্তন আকুলতা। একটি গল্পের নাম ‘খাঁচা( Cages)’ অন্যটি ‘মাই মাদার লিভড অন অ্যা ফার্ম ইন আফ্রিকা (My Mother Lived on a Farm in Africa)’।
খাঁচা গল্পের প্রধান চরিত্র হামিদ, ছোট্ট একটা দোকান চালায়। সূর্য ওঠার সাথে সাথে দোকানের ঝাপ উঠায় রাতের শেষ খরিদ্দারটি না আসা পর্যন্ত সেই ঝাপ নামে না। দোকানের ছোট্ট চৌখপির বাইরের জগত সম্পর্কে তার তেমন জানাশোনা নেই। মাঝে মাঝে তার মনে হয় দোকানটা বুঝি একটা খাঁচা, আর সে তাতে বন্দী। একঘেয়ে বন্দী জীবনে আনন্দে হয়ে দেখা দেয় হোটেলের পরিচারিকার কাজে নিযুক্ত রুকিয়া নামের একটি মেয়ে। যে তারই মতো ভাগ্যান্বেষণে এই ছোট্ট শহরতলিতে সাময়িকভাবে এসেছে।
‘মাই মাদার লিভড অন অ্যা ফার্ম ইন আফ্রিকা গল্পে মুনাহর মেয়ে খাদিজা, যে চাই মা তাকে কাদি নামে ডাকুক— অন্তত বন্ধুদের সামনে। মুনাহর ছেলে জামালও আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসানো কৈশোর পেরোনো এক তরুণ। খাদিজা ওরফে কাদি বন্ধুদের সাথে একদিন তাদের বাড়িতেই ‘আউট অফ আফ্রিকা’ সিনেমাটি দেখতে বসে। সিনেমার চরিত্র ক্যারেন ব্লিক্সেনকে বার বার বলতে শুনে ‘আফ্রিকায় আমার একটি খামার ছিল’
বন্ধুদের কাছে নিজেদের দাম বাড়াতে বলে বসে আফ্রিকায় আমার মায়েরও একটা খামার ছিল। শিশুসুলভ আপাত এই মজাটি কেন্দ্র করে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনাহ তার বিগত জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে। মেয়ের বড়াই করে বলা খামার বাড়ির গল্পের সাথে সেই জীবনের যে আকাশ পাতাল তফাত সেকথা বলতে চেয়েও সন্তানের মুখ ছোটো হবার ভয়ে তার মাতৃহৃদয় থমকে যায়। বিগতদিনের স্মৃতির বয়ানে জানা যায় তার অতীতে মুখ গুঁজে থাকা করুণ এক কাহিনি।
আব্দুলরাজাক গুরনাহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়েছেন কিনা জানা নেই। তাঁর বেশ কিছু সাহিত্যালোচনা পড়ে মনে হলো শিকড়চ্যুত-দেশহারা মানুষগুলোর জন্য তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির পাঁজর ঘেঁষে যেন জেগে আছে রবিবুড়োর চিরন্তন সেই বাণী : “সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোনো শোনো— শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।”
আঠারো বছর বয়সে যে মানুষটি জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবার-ঘর-জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, আজ তিনি তিয়াত্তর বছর বয়স্ক সফল এক মানুষ। দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডের কান্টারবেরির কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের এমিরিটাস অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনায় জড়িত ছিলেন। বেশিদিন হয়নি তিনি অবসর নিয়েছেন। নিরাপদ আশ্রয় আর আরাম-আয়েশে থেকেও ভুলে যেতে পারেননি তাঁর অতীত স্মৃতি, প্রিয় স্বদেশকে। জন্মভূমি তাঁর বুকের ভাঁজে লেপ্টে থাকে। সেই ক্ষ্যাপা বাঙালি কবির মতো হয়ত তিনিও সন্তর্পনে নিজেকে শোনান— “সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।”
শিকড়চ্যুত মানুষের প্রতি গভীর মমতা রাখেন আব্দুলরাজাক, তাদের হয়ে কলম ধরেন। অস্তিত্বের সংকটে ভোগা মানুষের প্রতি যাঁর কলম স্নেহার্দ্র, নিঃসন্দেহে তাঁর সাহিত্য মহতী সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি হারাতে বসেছে বলে আমরা যারা আক্ষেপ করি—তাঁদের জন্য, শিকড়চ্যুত তাবত মানুষের জন্য আব্দুলরাজাক গুরনাহ এক আশাবাদের নাম। ২০২১-এ সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তিতে পৃথিবীর সকল শুভবুদ্ধি আর শিকড়চ্যুত মানুষের পক্ষ থেকে আব্দুলরাজাক গুরনাহকে অভিনন্দন ভালোবাসা।
নাহার তৃণা
জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।