ছোটবেলায় খ্রীষ্টমাস আসতো খুব সন্তর্পণে। পরীক্ষা শেষে, ছুটির দিনে, লিণ্ডসে স্ট্রিটের বাঁকে।…
তারিখটা ২৫শে ডিসেম্বর হলো কি না হলো, তাই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। নিউ মার্কেটের মধ্যে ঢুকলেই মনে হতো স্বপ্নরাজ্যে চলে এসেছি। চীনে লন্ঠন, সাজানো দেবদারু গাছ আর সুগন্ধি কেকের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা গ্রেট ইস্টার্ণ-এর পালবাবু — এইসব মিলিয়ে খ্রীষ্টমাসের যে ছবিটা মনের মধ্যে দাগ কেটে বসে আছে, তার সঙ্গে যীশু বা তাঁর কুমারী মায়ের যোগ অতি সামান্য। কিন্তু অনুভূতিটা ছিল অসামান্য। তারিখ-ধর্ম-দেশের সীমানা ছাড়ানো সে এক অন্য খ্রীষ্টমাস, অন্তহীন ফেস্টিভিটি।
পরে তাকে আর কোথাও খুঁজে পাইনি, ফ্রাঙ্কেনমুথ মিশিগানের এর বিখ্যাত “অলওয়েজ্ খ্রীষ্টমাস”-এর দোকানেও না।…..
এখন খ্রীষ্টমাস আসে সাড়ম্বরে! থ্যাঙ্কসগিভিং-এর পর থেকেই তার পদধ্বনি শোনা যায়। শপিং মল-গুলো অপূর্ব সাজে সেজে অপেক্ষারত — এ’ আবার অন্য আরেক আবাহন।
মনে পরে এদেশে আমার প্রথম খ্রীষ্টমাসের কথা।
দেশের দুর্গাপূজো মিস্ করে মনটা খারাপ হয়ে আছে, বইমেলা-ও মিস্ করবো জানি। দেশে ফোন আর চিঠি লেখা বেড়ে গেছে — ফেসবুক আর হোয়াটস্ এ্যাপ্ তো তখন দূর অস্ত!
নতুন বৌকে খুশী করতে আমার স্বামী সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে, শহর ঘোরাচ্ছে, ছুটির দিনে হাইওয়ে ধরে লং-ড্রাইভে নিয়ে যাচ্ছে। শপিং করতে আমি একেবারেই ভালোবাসি না, তাই শপিং মল ছেড়ে আর সব এন্টারটেইনমেন্ট-এরই ব্যবস্থা করছে বেচারা।
২৪শে ডিসেম্বর নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাব এক বাঙালী ভদ্রলোকের বাড়ী — খ্রীষ্টমাস ইভ্-এর পার্টি শেষ হবে খ্রীষ্টমাস ডে’র মুখদর্শন করে। বিদেশের বাঙালী খ্রীষ্টমাস পার্টি’র সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয় হবে। কাউকেই প্রায় চিনি না সেখানে, কিন্তু না গেলে সোশ্যাল এটিকেট বজায় থাকে না…..আর খ্রীষ্টমাস ইভ্-এ বাড়ীতে বসে করবোই বা কী? সুতরাং দেশের বন্ধুদের মিস্ করতে করতে এদেশের প্রথম খ্রীষ্টমাস পার্টি’র জন্য তৈরী হতে লাগলাম। খালি হাতে তো আর খ্রীষ্টমাস পার্টি’তে যাওয়া যায় না — যাওয়ার পথে গিফ্ট কিনে নিয়ে যাব ঠিক হল। শহরের প্রায় সব দোকানই খ্রীষ্টমাস ইভ-এর সন্ধ্যেতে খোলা থাকবে — লোকে ‘লাস্ট মিনিট শপিং’ করতে সেখানে ঢুঁ মারবে।
সন্ধ্যার মুখে শপিং মল-এ ঢুকলাম…..শাড়ী আর কোট নিয়ে একটু জড়োসড়ো। দরজা দিয়ে ঢুকে দু’পা এগোতেই চোখ আটকে গেল মল-এর মধ্যবর্তী ফাঁকা গোল চত্বরে রাখা পঁচিশ ফুট উঁচু ঝলমলে খ্রীষ্টমাস ট্রি’টির দিকে। যেমন তার সাজসজ্জার বাহার, তেমন তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। মৃদুমন্দ ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে কানে এলো খ্রীষ্টমাস ক্যারোল— “হ্যাভ এ হলি জলি খ্রীষ্টমাস…..ইটস্ দ্য মোস্ট ওয়ান্ডারফুল টাইম অফ্ দ্য ইয়ার….আই উইশ ইউ এ্য মেরী খ্রীষ্টমাস এ্যাণ্ড এ্য হ্যাপি নিউ ইয়ার!”
মনে হলো যেন শপিং মল্-এ নয়, কোন্ ‘ওয়ান্ডারল্যান্ডে’ ঢুকে পড়েছি। রেলিং দিয়ে ঘেরা ছোট আইল্যান্ডের মতো জায়গাটাতে রয়েছে কটা রেনডিয়ার, তুষারের ওপর রাখা স্লে, সান্টাক্লসের কুটির এবং লালজামা পরিহিত শুভ্রশ্মশ্রু স্বয়ং সান্টাক্লস।….যদিও জানি যে সবই সাজানো, তবু বহুদিন পরে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো পরীক্ষা-শেষে ডিসেম্বর মাসের সেই নিউমার্কেট দর্শন — স্বপ্নের-মতো-সত্যি ছিলো তার প্রতিটি কোণ।
কি যে গিফ্ট কেনা হল তা আর মনে নেই। আনমনে গাড়ীর দিকে এগোচ্ছি — হঠাৎ মনে হল গায়ে মাথায় কি যেন পড়ছে!
– “তাড়াতাড়ি পা চালাও, স্নো পড়ছে।” আমি আমার স্বামীর কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম
– “বলো কী? স্নো পড়ছে? সত্যি?”
– ” মিথ্যে বলবো কেন? কিন্ত দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার চুল ভিজে যাবে।” (তখন আমার আজানুলম্বিত চুল ছিল!)
নিকুচি করেছে সাজের….চুল ভেজে ভিজুক, তা বলে কি পশ্চিমের তুষারপাত ভালো করে দেখবো না? আমি রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লাম।….
ছোট্ট ছোট্ট তুলোর বল আকাশ থেকে নেমে আসছে নিঃশব্দে, হাতের মুঠোয় ধরতে না ধরতে গলে উধাও। রাতের আকাশ জ্বলজ্বল করছে এক অদ্ভুত আলোয়। দু’হাত বাড়িয়ে সারা শরীরে-মনে এক নতুনকে অনুভব করতে করতে হঠাৎ মনটা ভীষণ ভালোলাগায় ভরে গেলো!
আমি এই ভিন্দেশী খ্রীষ্টমাসকে ভালোবেসে ফেললাম….. “মহারাজ, এ কী সাজে এলে হৃদয়পুরমাঝে!”
অবশেষে আমার শখ মিটেছে জেনে আমার স্বামী আমাকে গাড়ীতে তুললেন। প্রায় আধঘন্টা ড্রাইভ করে গন্তব্যে পৌঁছনো গেল। সবাই ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে ‘নতুন বৌ’কে অভ্যর্থনা করলেন।
“দেশের খবর বলো…….মন খারাপ করছে বোধহয়…..প্রথম প্রথম হবে, তারপর দেখবে এখানেই মন বসে যাবে, আমরাই সব আত্মীয় হয়ে যাব…..কলকাতায় কোথায় বাড়ী?…..ক’ ভাই বোন?……বাঃ, হাতের বালার ডিজাইনটা খুব নতুন তো…….পি. সি. চন্দ্র বুঝি?…..কলেজে পড়াচ্ছিলে?….ওমা, এইটুকু মেয়ে….এখন কি করছো?…..” ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের ভীড়ে ডুবে যেতে যেতে বুঝলাম যে ওনারা আজ ‘ঘরের বাইরে ঘর’ বানিয়ে নিয়েছেন পাকা গাঁথুনি দিয়ে; খুব কৃতজ্ঞ বোধ করলাম যে সম্পূর্ণ অপরিচিতা আমার জন্যে কত অনায়াসে সে’ঘরের দরজা খুলে দিলেন।
এইসময় বাড়ীর কর্তা এলেন ড্রিঙ্কস্ সার্ভ করতে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “তুমি আজকে চীফ গেস্ট, কি নেবে বলো? ওয়াইন দেবো একটু?” আমি বললাম
– “না, মানে….কোক্-ই ঠিক আছে।”
– “সে কী কথা? আজকের দিনে কেউ কোক্ নেয় নাকি?” আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাঁক পাড়লেন
– “কি রে? তুই কি বালিকা বধূ বিয়ে করে এনেছিস নাকি?…তুমি বি. ই. কলেজ-যাদবপুর পার হওয়া মেয়ে, ড্রিঙ্ক করতে পিছিয়ে যাচ্ছো?” আমি পড়লাম মহা মুস্কিলে! কি করে বোঝাই যে ড্রিঙ্ক করতে আমার কোনো শাস্ত্রীয় বাধা নেই, কিন্তু তেমন কোনো টানও নেই। মনে পড়ে গেল এক অত্যন্ত গুরুজনের কথা, উনি বলেছিলেন
– “দেশেই সবাই ড্রিঙ্ক করছে এখন কথায় কথায়, বিদেশে তো আরো করবে। কিন্তু অকারণে নেশার দাস হয়ো না, সংযমের চেয়ে বড় শক্তি নেই।” আমি মনস্থির করে ফেললাম। একটু হেসে বললাম
– “না, কোক্-ই দিন। জল হলেও হবে।” ভদ্রলোক আর জোর করলেন না। একটু খারাপ লাগলো আমার, কিন্তু দেখলাম উনি কিছু মনে করলেন না — তাতে আমি স্বস্তি পেলাম।
…..আজ পর্যন্ত নিজের দাদার মত ভক্তি করি ওনাকে। যখনই দেখা হয় উনি আমাকে ড্রিঙ্কস্ সার্ভ করতে আসেন, আর আমি হাসতে হাসতে ওনাকে মনে করিয়ে দিই যে আমি এখনো আমার অভ্যাস পাল্টাইনি, বিশেষ করে পার্টি’তে তো নয়ই!…..
সবাই ইতিমধ্যে হাতে ড্রিঙ্কস্-এর গ্লাস নিয়ে বসে পড়েছেন, সামনের টেবিলে চিজ্-সেলারী-আঙুর, কাজুবাদাম আর মাছের চপের অফুরান ভান্ডার। আমি একটু ফুরসত পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। ঘরের কোণে সাজানো আছে একটা মাঝারি মাপের খ্রীষ্টমাস ট্রি। তার নীচে গিফ্ট রাখা। সবার জন্যেই কিছু না কিছু আছে — মধ্যরাতের পর খোলা হবে।
মহিলারা প্রায় সবাই সুন্দরী — সৌন্দর্যর পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে ঘর করতে এসেছেন। মহার্ঘ্য শাড়ী গয়নায় আরো অপরূপা। দু-একজন তো বয়সে আমার মা বা মাসীর সমান, কিন্তু সবাইকে ‘দিদি’ বলাই এখানকার নিয়ম। খুব সতর্ক আছি যাতে মুখ ফসকে ‘মাসী’ না বেড়িয়ে যায়!
ভদ্রলোকেরা প্রায় সবাই ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়ার, কেউ বা অধ্যাপক…মুখে সাফল্যের প্রত্যয়। ড্রিঙ্কসের গুণে কিনা জানি না, সকলেই অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। জোকস্-এর ফোয়ারা ছুটছে। কিন্তু বেসামাল হয়ে কেউ মাতলামি করছেন না। মদ্যপান বলতে দেশে যা বোঝায়, বা তখন যা বোঝাতো, তার সঙ্গে কোন মিলই নেই।
ইতিমধ্যে খাবার ডাক পড়লো। কিচেনে-এ গিয়ে আইল্যাণ্ডে-এর ওপর সাজানো ডিশ-এর সারি দেখে বুঝলাম যে শুধু রূপে না, গুণেও এঁরা কম যান না! পোলাও, কাবাব, নান, ইলিশ মাছের ঝাল, পাঞ্জাবী তরকা, ফুলকপির তরকারী, তন্দুরী চিকেন, পাঁঠার মাংস…কি নেই সেখানে? সাজানো এবং পরিবেশনার কায়দায় পাঁচতারা হোটেল হার মেনে যাবে। তার পরে ডেজার্ট — বাড়ীতে বানানো জিলিপী আর কমলাভোগ।
ইতিমধ্যে বেসমেন্ট থেকে উঠে এসেছে ছেলেমেয়েদের দল। – “মম্, হোয়্যার ইজ্ আওয়ার্স?”
গৃহকর্ত্রী হাত তুলে ছোট কিচেন টেবিল-টা দেখিয়ে দিলেন। সেখানে সারি দিয়ে রাখা পাস্তা, ব্রেড রোলস্, হ্যাম, মীট্ পাঈ, বীন্ ক্যাসারোল্, স্যুইট পোট্যাটো, কেক ইত্যাদি।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো
– “সব আপনি রেঁধেছেন ?”
গৃহকর্ত্রী আমার গাল টিপে দিয়ে বললেন
– “আর কে রাঁধবে বলো? এখানে আমরাই কুক, আমরাই ময়রা, আমরাই সব। কাজের লোক তো আর নেই দেশের মতো।”
আমি বললাম
– “ওরে বাবা, আমি তো ভাবতেই পারছি না!”
উনি হেসে বললেন
– “ক’দিন যাক, তুমিও দেখবে সব করছো এইরকমই!”
কত যে সত্যি বলেছিলেন সেটা এখন বুঝি। বছর ঘুরতে না ঘুরতে আলুপরোটা থেকে বিরিয়ানি, ধোসা থেকে লালদই-গোলাপজামুন সব বানাতে শিখে গেলাম। আমার বাবা আমার হাতের বিরিয়ানি আর মিষ্টি দই খেয়ে বলেছিলেন
– “দোকানের চেয়ে একশোগুণ ভাল।”……আমার রান্নার সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট —তবে কিছুটা হয়তো বা পক্ষপাতদোষে দুষ্ট!
আমাদের বাড়ীতে গত বছর খ্রীষ্টমাস ইভ্-এর পার্টি এ্যারেঞ্জ করতে করতে সেই সব পুরোনো কথা মনে পড়ছিল।…..
কতো খ্রীষ্টমাস এলো আর গেলো। আমার পড়াশোনা শেষ হল, একে একে দুই মেয়ে এলো আমাদের সংসারে, আমার আজানুলম্বিত চুল হ্রস্ব হলো, আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, দুই পৃথিবীর দূরত্ব কমাতে কমাতে নিজের মনে এক সমণ্বয় তৈরী করে নিলাম… খ্রীষ্টমাস কিন্তু আমার মনে সেই অপরূপ সাজেই রয়ে গেলো। ছুটিতে কলেজ থেকে ঘরে-ফেরা মেয়েদের সঙ্গে হাতে হাতে খ্রীষ্টমাস ট্রি সাজাই আর গিফ্ট মুড়তে মুড়তে আনমনা হয়ে শুনি ফ্যামিলি রুম্-এর সাজানো আলোগুলো জ্বলছে-নিভছে গানের তালে তালে – “রুডল্ফ দ্য রেড-নোজড্ রেইনডিয়ার হেড এ ভেরি শাইনি নোজ্…”
এবারের খ্রীষ্টমাস পার্টিতে একজন নতুন অতিথি ছিলো — দেশ থেকে সদ্য আসা একটি বাঙালী মেয়ে। সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনীয়ার, আমাদের অফিসেই কাজ করছে একটি ইন্ডিয়ান কোম্পানি-র হয়ে। শহরে বেশী কাউকে এখনো চেনে না — আমার নিমন্ত্রণ খুব উৎসাহের সঙ্গে এ্যাকসেপ্ট করে নিলো। আমাকে খুব সপ্রতিভ ভাবে জিজ্ঞেসও করলো যে ওর বয়ফ্রেণ্ড-কে নিয়ে আসতে পারে কিনা।
আমি বললাম – “অবশ্যই”!
তারপর খুব আলগোছে প্রশ্ন করলাম যে ‘বয়ফ্রেণ্ড কি এখানে অনেকদিন’?
মেয়েটি অকপটে অনর্গল বলে গেলো
– “ না দি’, ও তো ফ্লোরিডা-তে এসেছিল ফার্স্ট অফার নিয়ে, গতবছরে। আমি এই বছর ভিসা পাওয়ার পর, ও কথা বলে চেঞ্জ করে নিল এখানে। ও আর আমি নতুন এ্যাপার্টমেন্ট-এ মুভ্ করলাম, আর ঠিক তারপরেই ওর বাবা-মা বললেন যে ওনারা বেড়াতে আসবেন দু’মাসের জন্য…কী যে মুস্কিল দিদি! আমি সেই ক’দিন এক্সটেন্ডেড স্টে-তে থাকলাম। ওনারা চলে যাওয়ার পর আবার এপার্টমেন্ট-এ ফিরলাম।”
আমার খুব মজা লাগলো মেয়েটির কথায়। যে দেশকে আমি ছেড়ে এসেছিলাম বহুদিন আগে, সে দেশ যে আর ঠিক তেমনটি নেই সেটাও বুঝলাম। জিগেস করলাম
– “এতো কান্ড কিসের জন্যে? ওনারা জানেন না বুঝি?”
মেয়েটি বললো
– “জানেন… আমরা তো কলেজে ক্লাসমেট ছিলাম, সবই জানেন। কিন্তু এই লিভিং টুগেদার-এর ব্যাপারটা ঠিক জানেন না। ওরা কলকাতায় সেটেলড্ কিন্তু আসলে রাজস্থানের লোক, ওদের বাড়ী বড্ড কনজারভেটিভ; আমাদের বাড়ীতে অবশ্য সবাই আন্দাজ করছে – কেউ কিছু বলেনি। আমার মা-বাবা কিছু বলবেন না।”
আমি বললাম
– “তা’ বিয়ে করে নাও না, ঝামেলা চুকে যাবে?”
মেয়েটি একটু থেমে থেকে বললো
– “বড্ড রেসপন্সিবিলিটি এসে যাবে দি’, এখন আমি ফ্রি…তখন শুধু ও না, ওর মা-বাবাও কতো কিছু এক্সপেক্ট করবেন! না ফুলফিল করতে পারলে আননেসেসারি ড্রামা হবে…..দেখি তো সব….নট্ শিওর আই এ্যাম্ রেডি ফর্ দ্যাট্।”
আবার বুঝলাম আমার কলকাতা কত দ্রুতগতিতে পাল্টেছে — আমরা এতকথা ভাবতাম না, এরা ভাবে। এ’দেশে বড়ো-হওয়া আমার মেয়েরাও কি তাই ভাবে? ট্রু গ্লোবালাইজেশন্ ? নাকি আমার মনে-আটকে-থাকা কলকাতার একটুকরো আমি ওদের মধ্যে দিয়ে দিতে পেরেছি?…..
নির্দিষ্ট দিনে মেয়েটি এলো বয়ফ্রেণ্ড-কে সঙ্গে নিয়ে। হাতে একটা ওয়াইন বোটল্।
খুব কিউট কাপল্, সহজেই মিশে গেলো সবার সঙ্গে। হৈ-চৈ করে খাওয়া-দাওয়া, গিফ্ট ওপেনিং, সব হলো।
মেয়েটি যাওয়ার সময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো
– “থ্যাঙ্ক ইউ দি’, খুব ভালো লাগলো। কলকাতাকে মিস্ করছিলাম ক’দিন ধরে…তোমার রান্না ইলিশ মাছ খেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো।”
আমার মনে পড়ে গেল আরেকজনকে…সদ্য দেশ ছেড়ে আসা সেই মেয়েটিও প্রথম খ্রীষ্টমাস পার্টি-তে গিয়ে ইলিশমাছ খেতে খেতে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল এক নতুন আন্তরিকতার বৃত্তে।
আমাদের মনের সব অনুভূতিকে যিনি কথা আর সুরে অমর করে গেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথ একদিন বলেছিলেন
– “সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধা জননী / রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি।”
আজ বাঙালী মানুষ হয়েছে, দেশে-বিদেশে জয়ধ্বজা উড়িয়েছে, “চরণতলাশ্রয়ছিন্ন” বহু মৃণালেরা আজ সেই জয়ধ্বজায় হাত রেখেছে…তবু বাঙালী বাঙালীই রয়ে গেছে। ইলিশমাছ-ভাত না খেলে তার খ্রীষ্টমাস পালন হয় না!
সেটা কি নিন্দের? আমার তো মনে হয় না। এই বাঙালীয়ানায় দুর্বলতা নেই, প্রত্যয় আছে। এই বাঙালীয়ানা বছরের পর বছর দূরকে টেনে নিচ্ছে আন্তরিকতার বৃত্তে, গড়ে তুলছে ঘরের বাইরে ঘর। এই বাঙালীয়ানা খ্রীষ্টমাস-এর দিন ক্র্যানবেরী পাঈ-এর পাশে অনায়াসে সাজিয়ে রাখছে জিলিপী-কমলাভোগ।
… তাই বোধহয় দেশে-বিদেশে বাঙালীর খ্রীষ্টমাস আজো এতো ইউনিক্ — অনন্য!
শকুন্তলা চৌধুরী
ডঃ শকুন্তলা চৌধুরীর জন্ম কলকাতায়, বড় হয়েছেন বি. ই. কলেজ ক্যাম্পাসের প্রফেসরস্ কোয়ার্টারে। পড়াশোনা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিয়ে এবং তথ্যবিজ্ঞানে পিএইচডি করার সূত্রে বিদেশগমন। কর্মসূত্রে বর্তমানে মিশিগানের বাসিন্দা।
স্কুলজীবন থেকেই নিয়মিত লেখেন। সানন্দা, শনিবারের আসর, ইরাবতী, বাংলা ওয়ার্ল্ডওয়াইড, বাতায়ন, সাহিত্যকাফে, পরবাস, ঋতবাক এবং আরো বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস। শকুন্তলার লেখা গান ভিডিওতে পরিবেশন করেছেন রূপঙ্কর বাগচী, নচিকেতা চক্রবর্তী, কায়া ব্যাণ্ড। প্রকাশিত গ্রন্থ পৃথা (ঋতবাক প্রকাশনী)।
খুব ভালো লাগলো।
khoob bhalo laglo Shakuntala…din din..aro bolishtho hocche.