নাজনীন খলিলের একগুচ্ছ কবিতা

চাঁদ ডুবে গেলে

আমাদের একটা ছায়াঘর ছিল-
খুব রোদ্দুরের দিনে চুপচাপ পাতাঝরার শব্দ শোনার জন্য

তখন
আবছা-ম্লান নীহারকণার মতো স্বপ্নেরা উড়ে উড়ে যেতো চারপাশে।

আমি রাতকে বলেছি আরও কিছুটা সময় থেমে যেতে ;
নীলজোনাকীরা যেটুকু সময়
সোনালী আগুন জ্বালিয়ে রাখে মুঠোর ভেতরে।
ঝিঁঝিঁপোকারা কথা দিয়েছিল কণ্ঠে তুলে দেবে গুনগুন গুঞ্জরনের
ঝিনিকিঝিনি সুর।
খুব ভীরুতায় রাত বললো–
সেও থাকতে পারেনা চাঁদের পাহারা ছাড়া ;
চাঁদ ডুবে গেলে
সেও চলে যাবে।

থেমে গেল নক্ষত্রের সব কোলাহল।

চাঁদ ডুবে গেলে রাত নিভে যায় ।
কেন যে…………….

 

ছুরিটা ঝুলে আছে শূন্যে

মমিঘরে রাখছি তুলে নরম পাপড়িগুলো।

কিছুতেই মাতাল হবোনা আজ আর
ভাবতেই, দুই পা টলোমলো ;ভুল হলো নাচের মুদ্রায়।

যে সব তীক্ষ্ণফলা শূন্যে ঝুলে থাকে ; শূন্যেই মানানসই,
ঝলসানো রোদে শুধু রংধনুর বিভ্রম তৈরি করে ; লক্ষ্যভেদী নয়।
ট্রাপিজের খেলা দেখি ধুন্ধুমার সার্কাস ঘরে
দড়ির এমাথা ওমাথা ঘুরে ঘুরে
সেই শুরুতেই ফিরে আসা ! ‘খেল খতম, পয়সা হজম’ ।

হিমঘরে তৈরি আছে ঠান্ডা কফিন
চকমকি পাথর
এবং
ধারালো তলোয়ার।

শীতলনিদ্রায় যাবার আগে জেনে নিতে হবে
তীরগুলো কি শুধু পাখির বুকের মাপেই তৈরি হয়।

 

ফেরাটা সহজ নয়

অপেক্ষায় ছিল তিনরঙা তিনটি বিস্ময় এবং উলটে যাওয়া একটি চেসবোর্ড।

অবজ্ঞার ঢেউয়ের ভেতর ডুবসাঁতার কাটছিল যে মাছ,
সেও তো পেরিয়ে গেল অর্ধেক নদী।
সন্তরণপটু মাছেরাও ধরা পড়ে নিকিরির সুনিপুণ জালে।
ট্রলারটা এগিয়ে আসছে মাঝনদীর দিকে……………

একটা ছেঁড়াখোঁড়া বারোয়ারি মেঘ উড়ে এসে জলে ছায়া ফেলে, প্রতিচ্ছায়া খুঁজে;
আকাশেরও কম নয় আয়না-বিলাস।

বাড়ীটা ভীষণ ডাকে;
টিনের চাল বেয়ে নেমে আসা ঝুরোঝুরো ঝুলে থাকা শ্বেতকরবীর ঝাড়।
বাড়ী ভাবলেই
কলকলস্বরে বয়ে যায় স্রোতস্বিনী-কুশিয়ারা, সুরমা-সুন্দরী।
বাতাসের তরঙ্গে কাঁপে সবুজ ধানের ক্ষেত।

ফেরা তো সহজ নয়;
একবার মানচিত্র ভুলে গেলে।
কতবার ভাবি-
পথের দু’পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে আসা নুড়িগুলো আবার
কুড়াতে কুড়াতে একদিন ঠিকই ফিরে যাবো…

 

মেঘমল্লার বাজে

বাজে
মৃদঙ্গ। মেঘমল্লার। ময়ূর পেখম।।
কাম্যবৃষ্টি ঝরে।
বাঁশীতে বাঁধা ছিল মেঘমল্লারের সুর ;

তুই চাইলি বলে…
হাজার একর আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামিয়ে দিলাম।
তুই কেন ভিজলি না তবু?

হায় পিপাসার্ত মানুষ!
বরফের চাঁই ভেবে আগুন জ্বালায় সাদা পাথরের নীচে;
পাথরে পাথর ঘষে।
আর কখনো কখনো
এই পাথুরেধোঁয়া থেকেই ছড়িয়ে পড়ে ধুপ-সুগন্ধীঘ্রাণ
উড়ে আসে গন্ধবিভোর চকোরেরা ;
আগুনের আঁচে ছাই হয়।

খরার উজানে যেতে যেতে ছুঁয়ে ফেলি সমুদ্রের ঢেউ।
নোনাজলে গোড়ালি ডুবে গেলে,
চাইলাম, আকাশ আবার ফিরিয়ে দিক
সাগরের শুষে নেয়া জলকণারাশি।

আমার বাঁশীটা দিয়ে দিলে…

তুই কি এমন বৃষ্টি নামাবি?

 

অপেক্ষা

একটি গোধূলি এসে ভীষণ নাড়িয়ে দিল কড়া;
যেন আকাশের কাড়া-নাকাড়া বেজে গেল
ঝুমবৃষ্টির শিঞ্জিনীর সাথে।

আরও কিছুটা সময় বাকী আছে শুধু
হেলিওসের ঘোড়াগুলো মাঠ পেরলেই
আস্তাবলের পথে,
নিকষ রাতপর্দায় ঢেকে যাবে সব।
রক্তচোষা বাদুড়ের পাল
ঢুকে যাবে নিরীহ ভেড়ার খোঁয়াড়ে।

কমলা আকাশ চিরে উড়ে যায় সাদা বলাকার ঝাঁক
উদাসীপাখার সুরে মন আনচান করে ওঠে বড়ো;
পেয়ালায় ঢেলে নেই সোনালী অমৃত;
তীব্রনেশালু এই রঙ্গমেলায়
আমিও নাহয় মাতালই হলাম…

সাততালা বাড়ির ছাদে
সীমাহীন বৈরাগ্যে বসে আছে
একটি কালো-দাঁড়কাক।
বাড়ী ফেরার যেন কোন তাড়া নেই।
বাসাটা কি একা?
আর কেউ নেই?

ভোরের অপেক্ষায় আছে রক্তশূন্য মেষগুলো

 

নীল ফিঙ্গে

বিকেলটা যখন খুব মৃদু পায়ে হেঁটে আসছিল
জলতরঙ্গের গুনগুন আবেশের মতো ;
মনে পড়লো অস্তরাগের কথা।

যে নদীর স্রোতে দোলে মেঘমালা কালোকাজলের মতো ;
ঢেউয়ে ঢেউয়ে নাচে মেঘভারানত আকাশের ছবি ;
আমিও সে নদীর নাম রেখেছি-কাজল নদী।

দীর্ঘবিষাদমগ্ন দুপুরের পরে
অপেক্ষায় থাকে স্নিগ্ধ জল ছলছল নদীকলস্বরা।

নদী যাচ্ছে বিকেলের কাছে…
নাকি বিকেলটাই এগিয়ে আসছে !

আজ সারাদিন কেটে গেল একটা নীল ফিঙ্গের খোঁজে ;
এই একটা নাম দিনভর বেজে বেজে গেল। জুড়ে রইল।

সে কোথায় থাকে?

খুঁজবো?

 

বিঁধে আছে তীর এবং ভাঙ্গা কাচের টুকরো

পায়ে বিঁধে গেছে ভাঙ্গা কাচের টুকরো
রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে ড্যান্স-ফ্লোরে…

নাচঘরে কেন এমন ছড়িয়ে দিয়েছ চূর্ণকাচ,
পাপড়ির নীচে গোলাপের কাঁটা?

আমার তো জানাই ছিল
পার্সিগালিচার নীচে রক্ত এবং কাচের টুকরো; দুটোই লুকনো যায়।

রোজ ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি
সমস্ত শরীর জুড়ে বিঁধে আছে ঈর্ষার ছোট ছোট তীরগুলো।
যখন বিভোরঘুমে
বুকের ভেতরে পাখি, প্রজাপতি আর ঘাসফুল তুলে রাখি;
কেউ ভালবেসে দিয়ে যায় তীর-উপহার।

ইদানীং খুব সচেতনে
মানুষের ভাঁজকরা মুঠোর দিকে তাকিয়ে দেখি
কখন কোন ফাঁকে গুপ্ত-নখরগুলো বের হয়ে আসে।

 

এক মাঠ বৃষ্টির ভেতর

দীর্ঘশ্বাসের অবশেষটুকু রেখে, দূর-দিগন্তে ছায়াটা মিলিয়ে যায় ;
কুয়াশার মতো অস্পষ্ট ধারাজলের ভেতরে।

কী যে প্রখর ফুটেছে জারুল-সোনালু !পাতাগুলো লাজনম্র আবছা হয়ে আছে।
তীব্র কৃষ্ণচূড়া ; আকাশের নীচে সামিয়ানা পেতে অপেক্ষায় আছে
যেন এখুনি শুরু হবে বর্ষা-মাঙ্গলিক
মেঘমল্লারের তালে তালে, নেচে যাবে একশ ময়ূর;
লাল-মখমলে
মেঘের অশ্রুগুলো টুপটাপ মুক্তোর মতো ঝরে গেছে আজ সারাদিন।

ফিরে আসে বৃষ্টিদিন,
কদমকেতকীর রাত ।

প্রবল উল্টেপাল্টে যায়,
খুলে যায় স্মৃতির সোনালীপাতাগুলো।
গভীরগোপন খামগুলো চন্দনসুগন্ধী কুঠরিতে অস্ফুটে কথা বলে ওঠে।

একটা যতিহীন সুদীর্ঘপথ হেঁটেছি কেবল ছায়ামগ্নতার ভেতরে ;
দরোজার বাইরে ছিল সুর্যশিখার পথ ;
স্বপ্নের ঘোরে কেউতো খোঁজে না রোদতপ্ত দিন !

আজ কি দুঃখদিন?
অঝোরধারা চিরে উড়ে গেল একটি শালিক ;
জুড়িটা কোথায় গেল কোথাও পাইনি খুঁজে।
চিলেকোঠার পাশে জড়সড় ভিজেকাক।

আজকে নাহয়
এক মাঠ বৃষ্টির ভেতরেই ছড়িয়ে দিলাম রোজনামচার ছেঁড়া-পাতাগুলো।

 

নাজনীন খলিল

জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে, বাংলাদেশের সিলেটে।
পড়াশুনা সিলেটেই, সরকারী মহিলা কলেজ এবং মুরারীচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ(এমসি কলেজ) থেকে স্নাতক।
লেখালেখির শুরু ৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে। তখন থেকেই রেডিও বাংলাদেশ সিলেটের একজন নিয়মিত কথক, গ্রন্থক এবং উপস্থাপক। সেই সময় থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনারও কাজ শুরু। সাহিত্য-সংস্কৃতি মাসিক ‘ সমীকরণের’ নির্বাহী-সম্পাদক হিসেবে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সিলেট থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনধারা নামে একটি পত্রিকার প্রকাশক এবং সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখির বিষয়বস্তু মূলতঃ কবিতা এবং কথিকা।

প্রকাশিত কবিতার বই:পাথরের সাঁকো; বিষাদের প্রখর বেলুনগুলো; ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ; একাত্তর দেখবো বলে (ব্রেইল,যৌথ);গুপ্তপধানুকী অথবা মাংসবিক্রেতা।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top