ফোন বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। কতক্ষণ আগে ঘুমিয়েছিলাম মনে পড়ছেনা। ঘুমের মধ্যেই টের পাচ্ছি, বুঝতে পারছি যে পুরো বিছানা কাঁপিয়ে ফোন বাজছে, কিন্তু কিছুতেই জেগে উঠতে পারছিনা। যদিও শুরুতে বুঝতে পারিনি। শুরুতে দেখছিলাম নানাবাড়ির পুকুরের ধার ঘেঁষে হাঁটছি, ছোট ছোট ডালিম গাছ লাগানো অনেকগুলো। ডালিমের ফুলের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই খুব আগ্রহ ছিলো। টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখতাম, ফেয়ার এন্ড লাভলি, আয়ুর্বেদিক, ‘এতে আছে জাফরান ও দুধ যা ত্বককে করে সমানভাবে ফরসা’। জাফরান কোথায় পাওয়া যায় জানতাম না তখন। ততদিনে ডালিমের ফুল ফুটেছে। ফুলের ভেতর সুতোর মত লাল আঁশগুলো দেখে ভাবলাম এই বুঝি জাফরান। তার পরদিন রান্নাঘর থেকে দুধ চুরি করলাম, তার ভেতর ডালিম ফুলের আঁশ গুলিয়ে মুখে ডলাডলি করলাম। গোলানোর সময়ই সন্দেহ হয়েছিলো, কই, টিভিতে যেমন দেখেছি তেমন হালকা হলুদ রঙ তো হলোনা দুধটা। মুখে লাগানোর কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো চুলকানি। মুখ ভরে উঠলো মশার কামড়ের মত ফোলা ফোলা দাগে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, খুব ভয়। কাঁদতে কাঁদতে নানীকে গিয়ে ধরলাম, মা জানলে মার অবশ্যম্ভাবী। নানী আমার মত কালো ছিলো, মা ফরসা, নানার মত। তাই নানীকেই আপন মনে হত। কিন্তু আমি ফরসা হতে চাইতাম। মায়ের মত, নানার মত, সাবানের প্যাকেটের গায়ের মেয়েটার মত। আমাকে দেখে লোকে আমায় জিজ্ঞেস করত যে কেন মায়ের মত রঙটা পাইনি। আমি ভাবতাম, মনে করার চেষ্টা করতাম যে আমার রঙের ব্যাপারে ঈশ্বর আমার অনুমতি নিয়েছিলো কিনা। ডালিম গাছের সারিগুলো দুলছিলো আমার স্বপ্নে, পাশেই পুকুর, পুকুরে ঘাই দিচ্ছিলো পোনা মাছের দল, তার মাঝে সাতার দিচ্ছে কোহিনূর ফুপু। কোহিনূর ফুপু আমায় ডাকছিলো, আমি পেছনে সরছিলাম। পুকুর আমার ভয় লাগে, পানির নিচে থাকে গঙ্গিমা, গঙ্গিমা পায়ে শিকল দিয়ে টেনে নিয়ে যায়। কোহিনূর ফুপুকেও আমার ভয় লাগে। আমি কোহিনূর ফুপুকে ভালোবাসতাম, কিন্তু সে আমার ছোট্ট মাথাটা একদিন ডালের বাটিতে চুবিয়ে ধরেছিলো। আমি ভাত খাচ্ছিলাম, পেছন থেকে হঠাৎ চুলের মুঠি ধরে ডালের বাটিতে মুখ চুবিয়ে ধরার ব্যাপারটা ভয়ানক ছিলো। আমার নাক দিয়ে ডাল ঢুকে গিয়েছিলো। দৌড়ে এসে আমাকে বাঁচায় মদিনার মা, আমাদের বাড়িতেই থাকতো, পেটেভাতে কাজ করত। কোহিনূর ফুপু পাগল ছিলো, কোহিনূর ফুপু সুন্দরী ছিলো, দারুণ সুন্দরী, তুলা ফুলের মত। টেনে পড়ত তখন, স্কুল থেকে ফেরার পথে নাকি মোল্লা বাড়ির পুকুরঘাটে পা ধুতে গিয়েছিলো। গোবর লেগেছিলো পায়ে, পায়েও না, নতুন জুতোয়, ঈদে পাওয়া নতুন জুতো। কি নাকি দেখেছিলো পুকুরে, গাছের ছায়া নাকি দুলছিলো তাকে দেখে, কে যেন ডাকছিলো, হাত ধরে নাকি টেনে নিয়ে গেছে পুকুরের মধ্যে, তারপর থেকে পাগল। কেউ বলে মাসিকের সময় ছিলো, কেউ বলে খোলাচুল ছিলো, কেউ বলে কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, সালাম দেয়নি, তাই জ্বিন পিছু নিয়েছিলো। যাই হোক, কোহিনূর ফুপু আর ভালো হয়নি। নানাবাড়ির পুকুরে কোহিনূর ফুপুকে দেখার কোনো যুক্তি নেই। ফুপু কোনোদিন আমার নানাবাড়ি আসেনি। ফুপুকে বেশিরভাগ সময় ঘরে আটকে রাখতে হত প্রথমদিকে। গরগর শব্দ করত, মুখ দিয়ে লালা ঝরত, কাউকে চিনতে পারতোনা। আমি সেসব দেখিনি, শুধু শুনেছি। স্বপ্নে তাই যখন কোহিনূর ফুপু আমাকে পুকুরের মধ্যে ডাকতে থাকে, আমি ভয় পাই, আমার পায়ের নিচে মাটি কাঁপতে থাকে, আমি পেছনে সরতে থাকি, কিন্তু পা হড়কে পড়ে যাই, আমি গড়িয়ে যেতে থাকি পুকুরের দিকে, তারপর ঝুপ! হঠাৎ সব কালো, গভীরে চলে যাচ্ছি, শরীর কাঁপছে, বিছানা কাঁপছে, কিন্তু জেগে উঠতে পারছিনা। স্বপ্নের মধ্যেই বুঝছি যে সব কাঁপছে আমার ফোনের কাঁপুনিতে।
ফোন থেমে গেলো, আমি ঘুমের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে দেখলাম ফোন দিয়েছিলো মৌনিতা। একবারই দিয়েছিলো, কিন্তু ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিলো যেন অনন্তকাল ধরে ফোন বাজছে। আমি আর ফোন ব্যাক করলাম না, একবারে ক্লাসে গিয়েই জিজ্ঞেস করব। কি আর জিজ্ঞেস করব, আমি জানি এ কেন ফোন দিয়েছে, ঘুম হচ্ছেনা তাই। মৌনিতার ঘুমের সমস্যা প্রবল। মাথা গরম থাকলে আরও ঘুমাতে পারেনা। কাল মাথা গরম ছিলো, বেশ গরম ছিলো। ক্লাসে কথা কাটাকাটি হয়েছে খুব, কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মৌনিতা সবুজের দিকে ডাস্টার ধরে ছুড়ে মেরেছে, সবুজের গায়ে লাগেনি যদিও। ঝগড়ার উৎস পহেলা বৈশাখের ডেকোরেশন। সবুজ বলেছে ডেকোরেশনের জিনিসপত্র কিনতে ছেলেরা যাবে, আর মেয়েরা ডিপার্টমেন্ট ঝাড়ু – মোছা দিয়ে জিনিসপত্র আনার পর সাজাবে। মৌনিতা বলেছে দুটো কাজেই ছেলেরা মেয়েরা সবাই থাকবে, মেয়েরা বাজারেও যাবে আর ছেলেরা ঝাড়পোঁছেও থাকবে। সবুজ বলেছে মেয়েমানুষ বাজারে যাবার কি আছে। মৌনিতা বলেছে না যাবার কি আছে। সবুজ বলেছে জিজ্ঞেস করতে যে কোন মেয়ে বাজারে যেতে চায়, মৌনিতার মত ফাজিল নয় সবাই, পুরুষমানুষের ভিড় বাজারে, যেতে নাও চাইতে পারে।
আমি তখনই প্রমাদ গুণেছিলাম। মৌনিতা টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো, ডাস্টারটা তুলে ছুড়ে মেরে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। ডাস্টার সবুজের গায়ে লাগেনা, মৌনিতা হনহন করে ক্লাসের বাইরে চলে যায়। সবুজ আমার দিকে ফিরে বলে, “এতবড় কলেজে দেখো তো তোমার বান্ধবীর মত ফাজিল আর কয়টা আছে? সব জায়গায় ফাইজলামি!”
আমি কিছু বলিনা। একে কিছু বলে লাভ নেই। পুরুষ হওয়াটাকে এই ছেলে বিরাট একটা অর্জন বলে মনে করে। একবার ক্লাসের অনেকে মিলে ফুচকা খেতে যাওয়া হয়েছিলো। মিম এগিয়ে সবার জন্য ফুচকার অর্ডার দিতে যাচ্ছিলো, সবুজ বলে উঠেছিলো, “এই মিম, কই যাও? তুমি বসো, পুরুষমানুষ যাইতে দেও।” সামান্য ফুচকার অর্ডার দিতে কেন পুরুষমানুষেরই যেতে হবে আমাদের বোধগম্য হয়নি। সবাই সবুজের এই ব্যাপারগুলো কমবেশি এড়িয়ে যায়। এড়াতে পারেনা মৌনিতা, তাই ওর সাথে বরাবর সবুজের দ্বন্দ্ব। ওদের ঝগড়া আমাদের মাঝেমধ্যে বেশ বিনোদনের জোগান দেয়। একবার আমরা মেয়েরা সবাই ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম, সবুজ রিকশা থেকে নামছিলো। নামার সময় সম্ভবত রিকশার নিচের দিকে কোথাও সবুজের প্যান্টের কোণা হালকা আটকে গেছিল। সবুজ রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমরা কয়েকজন এগিয়ে যেতে নিলাম, মৌনিতা আমার হাত টেনে ধরে সবুজকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, “কই যাস? পুরুষমানুষ ডাক দে ওরে তুলতে, নইলে আবার রাগ করবে।” আমি বহুত কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। সবুজ অবশ্য নিজেই উঠলো, তারপর মৌনিতার দিকে এসে শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, “তোমারে যে ফাজিল বলি, সাধে বলিনা।”
মৌনিতা কপট চিন্তা দেখিয়ে বলে, “ব্যথা পাইছ? অবশ্য না, পুরুষমানুষের আবার ব্যথা কিসের?”
সবুজ কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর, একটা হাসি দিয়ে যেন কোনো শিশুর নির্বুদ্ধিতা দেখলো এমনভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায়।
আজ ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই সবার আগে সবুজের দেখা পাওয়া গেলো। বারান্দার বেঞ্চিতে বসে অন্য আরও ছেলেদের নিয়ে ডেকোরেশনের জিনিসপত্রের লিস্ট করছে বোধহয়। আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে বললো, “কি মিতু? বাজারে যাবা নাকি?”
আমি বুঝলাম না কাহিনি। তারপরও উলটো হাসি দিয়ে বললাম, “প্রয়োজন যদি হয় যাবোনা কেন?”
সবুজ বললো, “তাহলে যাও, ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞেস করো তোমার পাগল বান্ধবী আর তুমি ছাড়া আর কে কে যাবে মেয়েরা।”
আমি হেসে ফেলে মাথা হেলিয়ে ভেতরে গেলাম। গিয়ে দেখি শরীফ আর জিতু হাত নেড়ে নেড়ে মৌনিতাকে কি যেন বলছে। এই দুটাই আমাদের জুনিয়র, সবুজের মহাভক্ত। ভাই ভাই করতে করতে পারলে অজ্ঞান হয়ে যায়। ডিপার্ট্মেন্টের টিমের হয়ে ক্রিকেট খেলে। ওহ, ভালো কথা, সবুজও ক্রিকেট খেলে, বেশ ভালোই খেলে। জুনিয়র মেয়েরা সবুজকে খুব পছন্দ করে, সবুজকে দেখার জন্য রোদের মধ্যে মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সবুজ সুদর্শন, শ্যামলা, লম্বা, যদিও আমাদের পছন্দ নয়, আসলে যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা, তবে অন্য অনেকেরই ওকে ভালো লাগে শুনেছি। ব্যাগ রাখতে রাখতে জানতে পারলাম মৌনিতা নাকি কাল গিয়ে ডিন স্যারের কাছে নালিশ দিয়েছিলো। ডিন স্যার সবুজকে ডেকে যা বলেছে তার সারমর্ম এই যে মেয়েমানুষ একটু পাগলছাগলই হয়, তাদের খ্যাপাতে নেই। মৌনিতাসহ আর যে মেয়েরা চায় সবাইকে নিয়ে যেন সবুজ বাজারে যায়। কথাবার্তা সব শুনিয়ে শরীফ আর জিতু চলে যায়। মৌনিতা আমার দিকে ফিরে বলে, “শুনলিতো? কারে রেখে কারে কি বলব? ও যা ভাবে, কমবেশি সবাই তাই ভাবে, স্যারও তা ভাবে।”
আমি ওর হাত ধরে চুপ করে রইলাম। বেচারির মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ও প্রাণপণ চেষ্টা করে যাতে ওকে বা অন্য মেয়েদের কেউ শুধুমাত্র মেয়ে হিসেবে না দেখে। মানুষ কাজ করে যোগ্যতার প্রমাণ দেয়, কিন্তু কাজটাই যদি করতে না দেয়া হয় তবে আসলেই সমস্যা। অন্য বেশিরভাগ মেয়েদেরই তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই, তাই ওর প্রতিক্রিয়াগুলো বাড়াবাড়ি হিসেবে চোখে পড়ে। মেয়েরাও মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে যায়। এই কালই তো, নিঝুম বলছিলো, “আমরা কি বলেছি ওকে যে আমরা বাজারে যাব? ডিপার্টমেন্টের মধ্যে বসে আরামে কাজ করব, তা না, বাজারে যাব! যত্তসব পাগলা কাজ!”
বিকেল দিকে সবুজ আর অন্য ছেলেদের সাথে আমি, মৌনিতা, মিম আর রাকা গেলাম। মৌনিতা মুখ গোমড়া করেই রইলো। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। রঙিন কাগজের দোকানে ঢুকে কাগজ বাছতে বাছতে দেখলাম সবুজ বারবার মৌনিতার দিকে তাকাচ্ছে। মৌনিতা একদমই চুপ, দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাগজ বাছাতেই মন দিলাম। একটুপর আল্পনার জন্য রঙের দোকানে ঢুকতে গেলে সবুজ ইশারায় আমাকে কথা শুনতে বললো।
– তোমার পাগলা বান্ধবীর কি হইছে?
– কেন?
– না, কালকে তো একদম বাজারে আসার জন্য পাগল হয়ে গেছিলো, আজ একদম দেখে মনে হইতেছে জন্মবোবা।
– গিয়ে জিজ্ঞেস করো, তোমাদের ব্যাপার।
– ওবাবা! আমাদের আবার কি ব্যাপার!
আমি কিছু না বলে দোকানে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কি মনে করে ফিরে এসে বললাম,
– তুমি অনেক ইনসেনসেটিভ, সবুজ।
তারপর উত্তরের সুযোগ না দিয়েই দোকানে ঢুকে গেলাম। সবুজ কি বুঝলো জানিনা, ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে রইলো।
যেহেতু পহেলা বৈশাখ, সিদ্ধান্ত হয়েছিলো মাটির বাসন কেনা হবে৷ অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকে শিক্ষকেরা আসবেন, তাদের আপ্যায়নের জন্য। মাটির জিনিসপত্র বাজারের পেছনদিকে, কিছুটা হাঁটা পথ। আমরা হাঁটতে শুরু করব, ঠিক সেইসময় সবুজ মৌনিতাকে ডাক দিলো। মৌনিতা তাকালোনা, কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়লো, আমরা সবাইই অবশ্য দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।
– তোমরা আগাও, আমার ওর সাথে একটু কথা আছে।
মৌনিতার কপাল কুঁচকে গেলো। ও দাঁতে দাঁত চেপে সবুজের দিকে তাকালো।
– আমার তো তোমার সাথে কোনো কথা নাই। কেন আসছ কথা বলতে? পাগল ছাগলের সাথে কিসের কথা?
আমি দেখলাম মৌনিতার চোখ দিয়ে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আহারে বোকা মেয়েটা, কার ওপর কিসের অভিমান করে! আমি ওর দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবুজ আমাদের হাত ইশারায় সামনে আগাতে বলে কনুইয়ের কাছে থেকে মৌনিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো, সামনে এক লোক ডাব বিক্রি করছিলো, সেইদিকে। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, আমাদের চেয়েও অবাক ছিলো ছেলেরা। পল্লব বললো, “আমরা আগাই, ওরা আসবেনে। এই সুযোগে ঝগড়াঝাটি মিটমাট হইলেই ভালো।”
সবুজ মৌনিতাকে একটা টুল টেনে দিলো, নিজেও বসলো। মৌনিতা অন্যদিকে ফিরে তখনো কেঁদেই যাচ্ছে। সবুজ ডাবওয়ালাকে ইশারা দিলো একটা ডাব কেটে দিতে।
– শোনো, তুমি আমারে খালি ভিলেন মনে করো। যেই কাজ আমরা করে দিতে পারি, সেই কাজ করার তোমাদের তো দরকার নাই। তোমরা অন্য কাজ করো।
মৌনিতা হেঁচকি দিতে দিতে নাকের পানি মুছতে থাকে। তারপর মুখটা সামান্য ঘোরায় যাতে ওকে দেখা না যায়, কিন্তু ওর কথা শোনা যায়।
– সবাই মিলেমিশে কাজ করলেও তো সমস্যা নাই। তোমরা করে দিতে পারো মানে? আমরা সবাই ক্লাসমেট, সবাই পড়তে আসছি। কারো কাজ কেউ করে দিবে কেন? সবাই মিলে সব কাজ করব। অবশ্য কারে কি বলতেছি…
– কারে কি বলতেছ মানে? আমি কি কাজ করতে মানা করছি? শুধু বলছি মেয়েদের কাজ মেয়েরা করো…
– হ্যা, মেয়েদের কাজ কাগজ কাটা আর ছেলেদের কাজ মেয়েদের ছোট করা। তোমাদের কাজ তোমরা ভালোই করতেছ।
– কি আশ্চর্য! কি ছোট করছি তোমারে?
– তুমি ডিন স্যাররে বলোনাই আমি পাগল ছাগল?
– আমি বলছি নাকি? ডিন স্যার বলছে।
– তুমি তো এটাও বলোনাই যে, না স্যার, মৌনিতা পাগল না।
মৌনিতার হেঁচকি আরও বেড়ে যায়, সবুজ গালে হাত দিয়ে অসহায়ের মত বসে থাকে। ওদিকে ডাবওয়ালা ডাব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারছেনা কার হাতে দেবে, তারপর মৌনিতার দিকেই যায়।
– আপামনি। ডাব খান।
মৌনিতা চোখ মোছে।
– পানিটা গ্লাসে ঢেলে দেন।
সবুজ যেন প্রত্নতাত্ত্বিকের মত হঠাৎ ভাষা খুঁজে পায়।
– গ্লাসে কি খাবা! পাইপ দিয়া খাও। ভাই, পাইপ দেন একটা। পাইপ দিয়াই খাও।
মৌনিতা চুপ করে থাকে। ডাবওয়ালা পাইপ দিলে চুপচাপ ডাবের পানি খায়। সবুজ উসখুস করে। তারপর আস্তে আস্তে টুলটা নিয়ে মৌনিতার সামনে গিয়ে বসে।
– তুমি কান্না কইরোনা, আমি সরি বলতেছি। আমি আসলে কথাবার্তা নরমালিই বলি। তুমি হয়ত অন্যভাবে চিন্তা করো।
মৌনিতা মুখ তুলে এবার সোজাসুজি সবুজের দিকে তাকায়। সবুজ দেখে মৌনিতার চোখের পাপড়িগুলোয় পানি লেগে আছে, সকালের ঘাসে যেমন শিশির লেগে থাকে। একটা পাপড়ি ভেঙে ঝুলছে চোখের নিচের কোণায়। সবুজ আঙুল দিয়ে পাপড়িটা তুলে আনতে যায়, মৌনিতা মাথাটা পেছনে নিয়ে যেতে চায়। সবুজ হালকা ধমক দেয়।
– দাঁড়াও রে বাপ! আশ্চর্য তো!
ভাঙা পাপড়িটা তুলে এনে সে মৌনিতার হাতে দেয়। মৌনিতা হাতে পাপড়িটা নিয়ে বসে থাকে। সবুজের খুব মায়া হয় মেয়েটার ওপর। নিজের ওপর রাগও হয়। কি এমন কাজ করে সে যেটা একদম এই মেয়েটা করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে! শুধুশুধু মেয়েটার মনটা খারাপ করে দিয়ে এখন মলিন মুখটা দেখা লাগছে। সবুজ মৌনিতার বাম হাতটা ধরে, মৌনিতা চমকে তাকায়। সবুজ কি বলবে বুঝতে পারেনা, হাতটা নিয়ে ডাবের ওপর দিয়ে বলে, “দুই হাত দিয়ে ধরে খাও।”
ততক্ষণে আমাদের বাসন কেনা শেষ। ফিরে এসে দেখি মৌনিতা চুপ করে বড় বড় চোখে ডাব হাতে বসে আছে, আর সবুজ হাত পা নেড়ে নেড়ে কিসব যেন ভূগোল দিচ্ছে ওকে। আমার পেছনে খবির বললো, “কি ঘটনারে ভাই? হইতেছে কি?”
পল্লব জ্ঞানীর মত বললো, “হাবভাব ভালো না।”
রাকা অদ্ভুত একটা হাস্যকর মুখভঙ্গি করে বললো, “আমার কি! আমি একটা পোড়ামাটির মগ কিনতে পারছি, তাতেই খুশি।”
পরেরদিন সকাল সকাল সবাই ডিপার্টমেন্টে চলে এলাম। আজ সারাদিন কাজ হবে, সবার শেষে রাতে হবে আল্পনা। সবুজকে দেখলাম মৌনিতার আশেপাশেই একটু পরপর ঘোরাঘুরি করতে। মৌনিতা যা করছে তাতে হাত লাগিয়ে দুজন মিলেই করছে। পল্লবকে দেখলাম আমার মতই বিস্কুট খেতে খেতে এদের দুজনের কাহিনি দেখছে। আমি উঠে ওর দিকে গেলাম, ও বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে বললো, “প্রেম ঘটে গেছে রে।” বলে হাসতে লাগলো, আমিও হাসলাম। মুনিম এসে বললো, “কাল রাতে তো হেব্বি ফোনে কথা বলাবলি হইছে। মামা তো পুরা চেইঞ্জ। আজকে বলতেছে কালকে যে মুড়ি-বাতাসা খাওয়ানো হবে তা যেন মেয়েদের মধ্যে থেকে দুই-একজনকে নিয়া আমি আর সাফাত গিয়ে কিনে আনি।” পল্লব হোহো করে হেসে দিলো। “ডাক দে, ডাক দে ওরে,” তারপর বললো। পল্লবের প্যাকেট থেকে একটা বিস্কুট খেতে খেতে সবুজকে গিয়ে বললাম যে পল্লব ডাকছে। সবুজ উঠে গেলে আমি মুচকি হেসে বললাম, “মন ভালো?” মৌনিতা আমার দিকে তাকিয়ে তারপর চোখ নামিয়ে একটা অন্যরকম হাসি দিলো। জানিনা কেন, হাসিটা দেখে আমার একটা কদমফুল দেখার মত খুশি লাগলো। এই হাসি আমি দেখেছি, অনেক আগে, বহুদিনের পুরাতন হাসি। রফিক চাচা আসত আমাদের বাড়ি, কোহিনূর ফুপুকে দেখতে আসত। কি যেন গল্প ছিলো তাদের। কোহিনূর ফুপু কাউকে চিনতে পারত না। কিন্তু তবুও সে আসত। কোহিনূর ফুপু বাঁচেনি, রফিক চাচাও আর বিয়ে করেনি। তারপরও সে আসত, ফুপুর কবর দেখতে আসত, দোয়া পড়তো। রফিক চাচাকে বাবা একদিন বলেছিলো, “আর কতদিন, রফিক?” রফিক চাচা হেসেছিলো শুধু, সেই হাসি আমি দেখেছিলাম। সেদিন বুঝিনি, আজ বুঝেছি, কাউকে ভালোবাসায় বা কারো ভালোবাসা পাওয়ায় একটা গর্ব থাকে। পৃথিবীর নিস্তব্ধতা ভেঙে ভোরের মোরগের মত চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, দেখো! আমাকে কেউ ভালোবাসে, আমি কাউকে ভালোবাসি। আমি মৌনিতার গাল টেনে দিলাম। ভালোবাসায় রঙিন মানুষগুলোকে দেখতে ভালোই লাগে।
দিলশাদ চৌধুরী
জন্ম ১৯৯৯ সালের ২৭ এপ্রিল, বরিশালে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছেন বরিশালেই। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগে সম্মান তৃতীয় বর্ষে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের চাবিকাঠির সন্ধান পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। কাজ করছেন অণুগল্প, ছোটগল্প এবং অনুবাদ নিয়ে। লেখালেখি নিয়েই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা।
ReplyForward
|
Facebook Comments