জাতে সেফাতে সেফাতে জাত
দরবেশে তাই জানিতে পায়
লালন বলে কাঠ মোল্লাজী
ভেদ না জেনে গোল বাধায়।
– লালন ফকির
মার্কিন মুলুকের একদল সমালোচক—যারা উৎসাহে ও উল্লাসে পশ্চিমা সাহিত্যের বাইরের জগতে ছুটে চলেছেন তাদের সাহিত্য পিপাসা মেটানোর জন্য—কথায় কথায় ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’ বা ‘জাদুবাস্তববাদ’ পদটি ব্যবহার করেন। ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য”? তা ওই জাদুবাস্তববাদই। ভাবটা এমন যে, বাস্তবে জাদু মেলে তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এই। অথবা ধরে নেয়া হয় যে, ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এ এক আলাদা দুনিয়া আছে, যেখানে জাদুকরররা পয়দা করেন একটার পর একটা কাহিনী কিংবা যেখানে মন্ত্রের শক্তি পশ্চিমা বিজ্ঞানের যুক্তিকে মুখ ভেংচায় কিংবা যেখানে ঝাড়ফুঁক-জাদু-টোনা নিমিষেই সাহিত্যের বিষয় হয়ে ওঠে।
বলা দরকার, ওইসব সমালোচক বর্ণবাদী হতে একেবারেই নারাজ। ‘আমি বর্ণবাদী? সে তো খুবই অপমানজনক তিরস্কার!’—এমনই একটা কথা উদ্ধৃত করে বর্ণবাদ অস্বীকার করার বর্ণবাদী পাঁয়তারাকে নির্দেশ করেছিলেন তিউনিশিয়ার ইহুদি তাত্ত্বিক আলবেয়ার মেমি তার গুরুত্বপূর্ণ বই ‘রেইসিজম’-এর প্রায় শুরুতেই। মেমি অসাধারণ দক্ষতা সহকারে বর্ণবাদের বিভিন্ন প্রকার, প্রকরণ ও প্রকাশকে ধরেছেন, যেমন তিনি শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী না হওয়ার আকাঙ্খাকেও বেশ চমৎকারভাবে আলোচনা করেছেন তার ওই বইটাতে। আর আমাদের অনুমান করতে মোটেই কষ্ট হয় না যে, আগেভাগেই মেমি ওইসব সাদা সমালোচকের চেহারাও চিনে নিয়েছিলেন।
না, তারা বর্ণবাদী হতে চান না। তারা তৃতীয় বিশ্বের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান; ওইসব মানুষের আর্ট-কালচারকে বুঝতে চান, রামায়ণ-মহাভারতে তাদের আগ্রহের কোনো ঘাটতি নাই। সত্যি কথা বলতে কি, তাদের আগ্রহ ব্রাজিল থেকে বাহামাস কিংবা পুর্তোরিকো থেকে প্যালেস্টাইন পর্যন্ত টুরিস্টের মতোই উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় এবং তারা সুযোগ পেলেই অপরের সংস্কৃতিকে সম্মান করার জন্য ওকালতিও করেন বটে। মার্কিন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নিয়ে তারা প্রবন্ধও ফাঁদেন এবং ‘মাল্টিকালচারালিজম’-এর কথা বলে বলে মুখে ফেনাও তোলেন। আর সেই সুবাদেই বলেন ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’-এর কথাও।
কিন্তু কি এই ‘মাল্টিকালচারালিজম’? এর বয়ানটার আসল জন্মস্থান হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই মাল্টিকালচারালিজম এর মোদ্দা কথাটা এভাবে বলে নেয়া যায়ঃ পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিকে নিজের কায়দায় স্বীকৃতি দিয়ে ও সম্মান জানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ ‘মূলধারা’র বা সাদাদের সংস্কৃতির ভেতরেই অন্যদের সংস্কৃতিকে জায়গা করে দিতে হবে। এই ‘মাল্টিকালচারালিজম’ নিঃসন্দেহে উদারপন্থি। আর উদারপন্থি বলে উদরপন্থিও বটে। অর্থাৎ সে ঔদার্যের ভান করে নিজ উদরে পুরতে চায় মেলারকমের খাবার। অন্য কথায়, শক্তিশালী সংস্কৃতি গিলে খাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সংস্কৃতিকে। বাস্তব দুনিয়ায় জারি-থাকা অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক যা বিভিন্ন সংস্কৃতির ভেতরের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এবং যেসব সম্পর্ক উৎপাদনে শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য এবং লৈঙ্গিক বৈষম্য হরহামেশা ভূমিকা রাখে, সেসব বিষয়কে ধামাচাপা দেওয়ার চমৎকার উদারপন্থি এবং উদরপন্থি কায়দার আরেক নাম ‘মাল্টিকালচারালিজম’—সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের মিলনমন্ত্র। হ্যাঁ, মিলন কথাটা শুনতে ভালোই। কিন্তু কার সঙ্গে কার মিলন? এবং কিভাবে? এসব প্রশ্নও তোলা জরুরি ওই মিলনের মর্মার্থ বোঝার স্বার্থেই।
সেই প্রশ্নগুলো তুলেছেন বেশ কিছু লড়াকু লেখক ও তাত্ত্বিক। তুলেছেন অ্যাকটিভিস্টরাও। এ প্রসঙ্গে বলা যাবে আদিবাসী আমেরিকান তাত্ত্বিক-শিল্পী-অ্যাকটিভিস্ট জিমি ডারহাম-এর কথা, যেমন বলা যাবে সদ্যপ্রয়াত কালো কবি-নাট্যকার-তাত্ত্বিক-অ্যাকটিভিস্ট আমিরি বারাকার কথাও। তারা আরও অনেকের সঙ্গেই ‘মাল্টিকালচারালিজম’কে সাদাদের এক কৌশলী, নব্য-বর্ণবাদী প্রকল্প হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তারা এও মনে করেন, ‘মাল্টিকালচারালিজম’ও–উত্তরআধুনিকতার মতোই—পুঁজিতন্ত্রের সাংস্কৃতিক লজিক হিসাবেই কাজ করে।
ওই মাল্টিকালচারালিজমেরই দোহাই পেড়ে সাদা সমালোচকদের একটা বড় দল ‘জাদুবাস্তববাদ’ কথাটা চালু রেখেছেন। কথাটা তারা ব্যবহার করেন শুধু সাম্প্রতিক লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের চরিত্রায়নের জন্যই নয়, আফ্রিকা ও এশিয়ার সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তারা ওই বর্গটা প্রয়োগ করেন বারবারই। তুলনামূলক সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসাবে সাহিত্য-সমালোচনায় তুলনার গুরুত্বকে কখনো খাটো করে দেখি না। কিন্তু তুলনার নামে যদি ভেদ ও তফাৎকে আড়াল করে অর্থাৎ এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ঐশ্বর্য ও বৈচিত্র্যকে খারিজ করে সাহিত্যের একপেশে ছাঁচ বা আদল তৈরি করা হয়, তাহলে সেখানে ঘটে এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাস। যেভাবে সেই বিখ্যাত ইয়েল ডিকন্সট্রাকশনিস্ট হ্যারল্ড ব্লুম থেকে শুরু করে শানিন শ্রোয়েডার পর্যন্ত একদল পশ্চিমা সমালোচক তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যের জাদুবাস্তববাদের পেছনে ছুটেছিলেন, তাতে মনে হয় জাদুবাস্তববাদের একটা বিশেষ ছাঁচ দিয়েই কেবল ওই সাহিত্যের চরিত্রায়ন সম্ভব। ওইসব সমালোচকের কেউ কেউ ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ সাহিত্য বলে বিশ্ব সাহিত্যের যে ধারাটাকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে ওই জাদুবাস্তববাদকেই বিবেচনা করেন।
তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য নিয়ে তত্ত্ব ফাঁদতে গিয়ে তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমিসন একটি ভয়াবহ, এমনকি প্রাচ্যবাদী সাধারণীকরণ ও সরলীকরণের খপ্পরে পড়েছিলেন। যদিও সংস্কৃতি-সমালোচনার ক্ষেত্রে জেমিসনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে এবং যদিও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে প্রবল ডানপন্থি কূট সমালোচনার মুখেও মার্কসবাদী সমালোচনার একটি দ্বান্দ্বিক ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন প্রায় চার দশক ধরে এবং যদিও এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে তার আগ্রহ প্রচুর এবং ক্ষেত্র বিশেষে তার ব্যুৎপত্তি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবুও তার একটি বহুল-আলোচিত প্রবন্ধ ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড লিটারেচার ইন দ্য এরা অফ মাল্টিন্যাশনাল ক্যাপিটাল’-এ জেমিসন তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যের একটি বিশাল, সামূহিক নন্দনতত্ত্ব খাড়া করতে গিয়ে ওই অঞ্চলের সমস্ত সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হিসাবে ‘ন্যাশনাল অ্যালেগরি’কে চিহ্নিত করেছেন, যেন ওই বৈশিষ্ট্য দিয়েই এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার গোটা সাহিত্যটাকে খপ করে ধরা যাবে। কিন্তু গোটা সাহিত্যই? ঠিক এই প্রশ্ন তুলেই অবশ্য ভারতের মার্কসবাদী সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক এজাজ আহমেদ তার ‘রেটোরিক অব আদারনেস’ শিরোনামের একটি দুর্দান্ত প্রবন্ধে জেমিসনীয় তৃতীয় বিশ্ব সাহিত্যতত্ত্বের আস্ফালনের একটা জুৎসই জবাব দিয়েছেন। বুঝিয়েছেন এই কথাটাঃ না, ভাই জেমিসন, আপনার ন্যাশনাল অ্যালেগরি দিয়ে আমাদের এই বিশাল অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় সাহিত্যের চরিত্র আপনি মোটেই ধরতে পারবেন না। আর ‘নেশন’ নামের যে বর্গটা জেমিসন চালু রেখেছেন, তা তো এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে ‘শ্রেণি’র একচ্ছত্র আধিপত্যবাদী বিকল্প হতে পারে না। অবশ্য পরে তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য প্রসঙ্গে জেমিসন তার অবস্থান খানিকটা পাল্টিয়েছেন।
কিন্তু এও ঠিক যে, জেমিসন ও হ্যারল্ড ব্লুমরা একই সঙ্গে যান না। তবে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা সমালোচকদের একটা বড় দল প্রাচ্যের সাহিত্য খুঁজতে ও পাঠ করতে গিয়ে এক ধরনের আধিপত্যবাদী অবস্থান থেকে সেই সাহিত্য নিয়ে ছাঁচ, ছক, ঘোর, অভিভব, এমনকি রোম্যান্টিক রূপকল্প তৈরি করার সংস্কৃতি জারি রেখেছেন। এমনকি নিয়ত ভাল’ থাকা সত্ত্বেও এবং তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের প্রশংসা করতে গিয়েও উদারনৈতিক সমালোচকদের অনেকেই সাহিত্য-সমালোচনার ভেতর দিয়েই নিজের সঙ্গে ‘অপর’-এর একটি অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি করতে থাকেন। সমালোচনার এই ধারাতেই জাদুবাস্তববাদ এখন তৃতীয় বিশ্বকে চেনার একটা সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক কোডে রুপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে উপনিবেশবাদের সঙ্গে বর্ণবাদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে সংহত করার ক্ষেত্রে, বা উপনিবেশবাদের বিস্তারকে সহায়তা ও বৈধ করার ক্ষেত্রে, পশ্চিমা নৃতত্ত্বের যে একটা নোংরা ইতিহাস আছে, তা খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, জাদুবাস্তববাদ নিজেই এক ধরনের উপনিবেশবাদী ‘নৃতাত্ত্বিকতা’র ঘোর তৈরি করেছে। আবারো ফলাফল ওই বিভাজনজ্ঞাপক ধারণাটাঃ পশ্চিমে আছে লজিক, পূবে ম্যাজিক! সঙ্গত কারণেই জাদুবাস্তববাদের আলোচনায় উপরে চিহ্নিত বিষয়গুলো খেয়াল করা দরকার।
২
জাদুবাস্তববাদ তাহলে কেবল পশ্চিমা সমালোচকদের হাতেই সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক কোড হিসাবে চালু থেকেছে? মোটেই নয়, যদিও ঐতিহাসিকভাবে জাদুবাস্তববাদ কথাটা এসেছে ওই পশ্চিমা মুলুক থেকেই। তাহলে আখ্যা হিসাবে জাদুবাস্তববাদের একটা সংক্ষিপ্ত রেখালেখ্য এখানে পেশ করা যাক।
১৯২৫ সালে জর্মন শিল্পসমালোচক ফ্রানজ রো সর্বপ্রথম ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদুবাস্তববাদ কথাটা ব্যবহার করেন শিল্পকলার এক বিশেষ শৈলীর চরিত্রায়ন প্রসঙ্গে। রো তার এক বইয়ের শিরোনামেই জাদুবাস্তববাদ বর্গটা ব্যাবহার করেছেনঃ জর্মনে Magischer Realismus। মিউনিখের একদল আঁকিয়ে এক্সপ্রেশানিজমের বাহুল্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বা সেই বাহুল্যে অতিষ্ঠ হয়েই বস্তুনিষ্ঠতাকে এবং নৈর্ব্যক্তিকতাকে তাদের কাজে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন এবং বস্তুনিষ্ঠতাকে যেন একটি অস্বাভাবিক জরুরি অবস্থার মতো ঘোষণা করলেন জোরেশোরে। তাদের শৈলী বর্ণনা করতে গিয়েই রো ওই জাদুবাস্তববাদ কথাটা ব্যবহার করেন। এই জাদুবাস্তববাদে ‘বাস্তব’ আছে ঠিকই–দারুণ মাত্রাই বটে–কিন্তু সেই খানে কোনো জাদু নাই।
পরে বিশ শতকের চল্লিশের ও পঞ্চাশের দশকের কিছু মার্কিন আঁকিয়ের শৈলীকে বোঝাতে গিয়ে রো-এর অনুসরণে আবারো ব্যবহার করা হলো জাদুবাস্তববাদ কথাটা। এসব চিত্রকরের মধ্যে পল ক্যাডমাস, ইভান অলব্রাইট এবং জর্জ টুকারের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়।
এছাড়া ১৯৪৩ সালে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সে প্রদর্শনীর নাম দেয়া হয়েছিলো ‘অ্যামেরিকান রিয়ালিস্টস অ্যান্ড ম্যাজিক রিয়ালিস্টস’। সেখানে জাদুবাস্তববাদী আঁকিয়ে হিসাবে যারা বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়লেন তারা হলেন এডওয়ার্ড হপার এবং চার্লস শীলার। এখানে আরেকটা তথ্য জরুরিঃ বিশ শতকের বিশের দশকে ইতালির একটি বিশেষ নান্দনিক-সাহিত্যিক আন্দোলন—’স্ত্রাচিত্তা’ যার নাম—ওই জাদুবাস্তববাদ কথাটাকে বিশেষভাবে ব্যবহার করেছে। এই আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি মাসিমো বনতেমপল্লি উনিশ শতকের সনাতন ফর্ম ও শৈলী ভাঙতে গিয়ে বাস্তবতার এক নতুন আয়তন আবিষ্কার করতে উৎসাহী হলেন এবং সে প্রসঙ্গেই আবার চালু হলো জাদুবাস্তববাদ বর্গটি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, গত শতকের বিশের দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত মোটামুটি এই সময়ে ইউরোপে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাদুবাস্তববাদ বর্গটি একটি বিশেষ আদল এবং অভিমুখ অর্জন করে। বলা দরকার যে, চল্লিশের দশকে প্রায় পুরোটা সময়ে অস্ট্রিয়ার ঔপন্যাসিক জর্জ সাইকো তার কথাসাহিত্যে যেসব আখ্যান ও বয়ান ব্যবহার করা শুরু করলেন এবং যেগুলো, সাইকোর নিজ ভাষ্য মোতাবেক, বাস্তবটার পরিচিত ও প্রচলিত উপস্থাপনাকে বিভিন্ন মাত্রায় ও আয়তনে প্রতিসরিত করেছে, সেসব আখ্যান ও বয়ানকে আবারো জাদুবাস্তববাদী বলা হলো।
কিন্তু এই ইউরো-মার্কিন জাদুবাস্তববাদ শিল্পকলা ও কথাসাহিত্যে কি ধরনের বিন্যাসের উদ্বোধন ঘটাল? সাবেকি বিন্যাস চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে নান্দনিক রাজনীতিকে কোন্ জায়গায় নিয়ে গেল এই ইউরো-মার্কিন জাদুবাস্তববাদ? এসব প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। আর তাদের উত্তর খুঁজতে গেলে ইউরোপীয় সাহিত্যিক আধুনিকতাবাদের সঙ্গে তখনকার ঐতিহাসিকভাবে জারি-থাকা ফাইন্যান্স পুঁজির সম্পর্কটা ধরা দরকার।
অবশ্যই বলা যাবে যে, একদিকে পুঁজিবাদ এবং আরেকদিকে তার সাংস্কৃতিক প্রকল্প হিসাবে চালু-থাকা মূলধারার ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ অনেকটা হাত ধরাধরি করেই ব্যক্তির নাগরিকতা ও নাগরিক ব্যক্তিকতাকে বিভিন্ন ধাঁচের বয়ানী চেহারা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সাহিত্য-শিল্পে এই ব্যক্তিকতা একাকী আসে নাই মোটেই; পুঁজি যেসব বিচ্ছিনতা তৈরি করে সেগুলোর অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ আধুনিকতাবাদী জর্মন, ফরাসী, অস্ট্রীয় এবং ইংরেজি সাহিত্যে বিভিন্ন পরিমানেই দেখা যায়। এই বিচ্ছিন্নতা ব্যক্তিকতাকে, বিশেষ করে নাগরিক ব্যক্তিকতাকে, একই সঙ্গে জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং সত্তাতাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছে। দ্রুত এভাবেও বলা যায়ঃ ব্যক্তি তার বিচ্ছিনতায় ব্যক্তি হয়ে উঠে। আর নগর হচ্ছে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির ঠাস বুনোন এমনি এক মাত্রায় যে, বিচ্ছিন ব্যক্তিকে আবার আলাদাভাবে চেনা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদ যে নগরগুলোকে তৈরি করেছে এবং যে নগরগুলো পুঁজিবাদের জন্য ‘স্পেস’ একই সঙ্গে সম্প্রসারিত ও সংকুচিত করেছে, সেই নগরগুলো ধারণ করে আছে একই সঙ্গে নামহীন, অবয়বহীন এবং বিচ্ছিনতায় বিশিষ্ট ও এমনকি অনন্য হয়ে-ওঠা ব্যক্তিবর্গ। বিষয়টা একধরনের সংকটকেই নির্দেশ করে বটে। সংকটের এই চিত্রটা বিভিন্নভাবেই এবং বিভিন্ন মাত্রায় আমরা লক্ষ্য করি পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক প্রকল্পগুলোতে। যেমন সাইকোর কাজেই লক্ষ্য করি সেই সংকটের আবর্তে ঘুরপাক-খাওয়া ব্যক্তির উদ্বেগ এবং সেই সংকট অতিক্রম করার আকাঙ্খাও। আর এই আকাঙ্খাই ওই ইউরো-মার্কিন জাদুবাস্তববাদের একটি—যদিও একমাত্র নয়—গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
এই আকাঙ্খার সঙ্গেই সম্পর্কিত হয়ে থাকে অন্ন জগত নিয়ে কল্পনা। নাগরিক ব্যক্তিকতার বিচ্ছিনতা অতিক্রম করার তাগিদেই একদল ইউরো-মার্কিন জাদুবাস্তববাদী চিত্রকর শুধু বুর্জোয়া আধুনিকতাবাদের শাসনকেই অস্বীকার করতে চান নাই ( যা আমরা পরাবাস্তববাদেও খানিকটা লক্ষ্য করি), তারা তাদের কল্পনাকেও ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন কায়দায়। এই কল্পনায় এমনকি আফ্রিকাও উঠে এসেছে, তবে ইউরোপকে বাদ দিয়ে নয়। “হাঁ, সংকটে আক্রান্ত হয়ে ইউরোপের বিদ্রোহীরা আফ্রিকাকে আলিঙ্গন করে ঠিকই, কিন্তু তাতে আফ্রিকা যে ইউরোপের সমকক্ষ হয়ে উঠে তাতো ভাবার কারণ নাই”–এই কথাটা একসময় বলেছিলেন আমার বন্ধু কালো জ্যাজ সঙ্গীতকার কেলভিন মনরো। কথাটা ইউরো-মার্কিন জাদুবাস্তববাদীদের কারো কারো বেলায় বেশ খাটে। বিশেষ করে অস্ট্রিয়ান কথাসাহিত্যিক জর্জ সাইকোর ক্ষেত্রে। তার রচনা ন্যারেশানস-এ আমরা বিভিন্ন ভাঙা ভাঙা চিত্রকল্পে যে আফ্রিকাকে উদ্ভাসিত হতে দেখি, তা ওই ইউরোপীয় কল্পনার তোড়েই একই সঙ্গে রহস্যময় ও নীরব হয়ে থাকে। মানতেই হবে যে, জাদুবাস্তববাদীর কল্পনা ও প্রতিক্রিয়া যতই তীব্র ও সীমানাবিধ্বংসী হোক না কেন, ইউরোপ শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় আধিপত্যবাদী চেহারা নিয়েই অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকে। আলিঙ্গনেও আধিপত্য থাকে বটে।
আসলে ইউরো-মার্কিন জাদুবাস্তববাদ একটি নান্দনিক-সাহিত্যিক প্রকল্প হিসাবে পুঁজিবাদ ও আধুনিকতাবাদী বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বকে খানিকটা চ্যালেঞ্জ করলেও শেষ দৃষ্টান্তে সেই প্রকল্প বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের প্রতাপশালী বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নাই। নাগরিক ব্যক্তিকতার সংকটকে অতিক্রম করতে গিয়েও ওই ব্যক্তিকতাকেই সে ইউরোপ নামে হাজির করেছে। এবং এই প্রকল্পের খানিকটা প্রাচ্যবাদী সুরতও আমাদের দেখে নিতে বেগ পেতে হয় না।
৩
কিন্তু জাদুবাস্তববাদের তৃতীয় বিশ্ব সফরের ইতিহাসটা কি? লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে এই বর্গ প্রয়োগের বিষয়টা খানিকটা ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। বিষয়টা খোলাসা করার আগে কয়েকটি তথ্য সামনে আনা দরকার।
জাদুবাস্তববাদের সনাতন আখ্যানে বলা হয়ে থাকে যে, লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো সাহিত্যিকের কাজকে বোঝাবার জন্য ভেনিজুয়েলার সমালোচক আর্তুরো উসলার-পিয়েত্রি ‘জাদুবাস্তববাদ’ বর্গটিকে ব্যবহার করেন চল্লিশের দশকে। শুধু ব্যবহারই করেন নাই, উসলার-পিয়েত্রি বর্গটিকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন। আর যার উপন্যাসকে সামনে রেখে উসলার-পিয়েত্রি জাদুবাস্তববাদ কথাটা জোর দিয়েই সামনে এনেছেন, তিনি হচ্ছেন ব্রাজিলের প্রভাবশালী ঔপন্যাসিক-কবি-সমালোচক ম্যারিয়ো দ্য আন্দ্রাজ, যিনি ১৯২৮ সালে তার বিখ্যাত মাকুনাঈমা শিরোনামের উপন্যাস রচনা করে ব্রাজিলের সাহিত্যের মানচিত্রই বদলে দেন। এই উপন্যাস খানিকটা আত্মজৈবনিক হলেও তাকে শেষ পর্যন্ত আত্মজৈবনিক বলা যাবে না, কেননা এ উপন্যাসে ধারণ করা হয়েছে ব্রাজিলীয় ইতিহাসের মেলা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়কে। আর এই সব অধ্যায়ে বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন ভাষ্য নানা ধরণের সুরে ও স্বরে নির্মাণ করা হয়েছে এমনি এক তীব্রতায় যে, বাস্তবতার কোনো সনাতন আদল এখানে অনুপস্থিত। এই “মানভ্রষ্ট,” বহুমাত্রিক কিন্তু ইতিহাস-স্পন্দিত বাস্তবতা পশ্চিমের আলোকায়ন প্রকল্পের যুক্তিশৃঙ্খলার পুলিশিকে বিভিন্নভাবেই বুড়ো আঙুল দেখায়। আর এই “বাস্তবতার” ঔপন্যাসিক চিত্রায়নকে নির্দেশ করতে গিয়েই আর্তুর উসলার-পিয়েত্রি ব্যবহার করেন জাদুবাস্তববাদ পদটি।
কিন্তু পদ হিসাবে জাদুবাস্তববাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে তখনি যখন গুয়াতেমালার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাসিক মিগেল আঙ্খেল আস্তুরিয়াস তার নিজের কাজের বিষয় ও শৈলীকে বর্ণনা করতে গিয়ে প্রয়োগ করেন জাদুবাস্তববাদ কথাটি। আস্তুরিয়াসের বিখ্যাত দ্য ব্যানানা ট্রিলজি-কে দৃষ্টান্ত হিসাবে সামনে আনা হয়, যে কাজে বাস্তবতার ঐতিহাসিকতাকে নতুন এবং চিত্রকল্পময় আদলে ধরার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এখানে এও বলা প্রয়োজন যে, কিউবার ঔপন্যাসিক আলেহো কার্পেনতিয়ের ১৯৪৯ সালে তার প্রভাবশালী উপন্যাস দ্য কিংডম অব দিস ওয়ার্ল্ড-এর প্রায় শুরুতে “লো রেয়াল মারাভিয়াসো” বা “মারভেলাস রিয়্যালিটি” কথাগুলো ব্যবহার করে জাদুবাস্তববাদ পদটির বয়ানী উত্থানের একটি উস্কে-দেয়া ঐতিহাসিক মুহূর্ত রচনা করেন। শুধু তাই নয়, পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু সমালোচক আর্জেন্টিনার সেই প্রভাবশালী পৃথিবীখ্যাত লেখক হর্হে লুই বর্হেসের একাধিক কাজের চরিত্রায়নে জাদুবাস্তববাদ বর্গটি ব্যবহার শুরু করেন। তবে বর্হেসের যে কাজটিকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে চিহ্নিত করেছেন কেউ কেউ, তার শিরোনাম “দ্য ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি অব দ্য ইনফেমি” (বর্তমান রচনায় আমি এ পর্যন্ত যেসব জর্মন ও হিস্পানি কাজের কথা উল্লেখ করেছি, তাদের শিরোনাম ইংরেজি অনুবাদেই রাখা হয়েছে।)
কিন্তু বর্হেসকে প্রথম জাদুবাস্তববাদী লেখক হিসাবে চিহ্নিত করার বিষয় নিয়ে লাতিন আমেরিকায় এবং অন্যত্র অনেক ধরনের বিতর্ক রয়েছে। এছাড়া লাতিন আমেরিকার বাইরে আরেক প্রেক্ষাপটে জর্মন-চেক ঔপন্যাসিক ফ্রানজ কাফকাকে প্রথম জাদুবাস্তববাদী লেখক হিসাবে উপস্থিত করার রেওয়াজ তো আছেই। তার বিখ্যাত ‘মেটামরফসিস’ গল্পকে অসংখ্যবার জাদুবাস্তববাদী কাজের প্রথম নমুনা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা খানিকটা লাতিন আমেরিকার সমালোচনা সাহিত্যে এবং প্রধানত ইঙ্গ-মার্কিন-ইউরোপীয় সমালোচনায় লক্ষ্য করা যায়।
তবে বিশ শতকের ষাটের ও সত্তরের দশক দুটিতে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের যে পর্বকে যথার্থই বিস্ফোরণের পর্ব হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, সেই পর্বে জাদুবাস্তববাদ বর্গটি চালু হয় আরো জোরেশোরে এবং পশ্চিমে তার অবাধ সফরও শুরু হয়, যদিও পশ্চিমে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য বা ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ সাহিত্য প্রসঙ্গে কথায় কথায় জাদুবাস্তববাদ পদটি ব্যবহার করার অভ্যাস তৈরি হয় আশির ও নব্বইয়ের দশকেই। এই বিষয়ে আর কিছু বলার আগে ফিরে আসি লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের বিস্ফোরণ প্রসঙ্গে।
এ বিস্ফোরণের ইতিহাস বৈচিত্র্যময় এবং ঘটনাসমৃদ্ধ। বর্তমান রচনার পরিসরে উপন্যাসের এই বিস্ফোরণ পর্বের একটি সংক্ষিপ্ত মানচিত্রও তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে কয়েকজন ঔপন্যাসিকের নাম অনায়াসেই উল্লেখ করা যায়, যাদেরকে একাধিক সমালোচক (অবশ্যই লুইস পারকিনসন জামোরা এবং ওয়েন্ডি ফারিস সম্পাদিত ম্যাজিকাল রিয়ালিজম সংকলনটির অন্তর্ভুক্ত সমালোচক ও তাত্ত্বিকদের কথা সহজেই বলা যায়) ওই বিস্ফোরণ-পর্বের প্রতিনিধি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এরা হলেন মেক্সিকোর হুয়ান রুলফো ও কার্লোস ফুয়েন্তেস, পেরুর মারিও বার্গোস লোসা, কিউবার হোসে লেয়ামা লিমা ও আলেহো কার্পেন্তিয়ের এবং অবশ্যই গুয়াতেমালার মিগেল আঙ্খেল আস্তুরিয়াস। এদের কাজ অবশ্যই একধরনের নয়; বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা লক্ষ্য করা যাবে এদের উপন্যাসে। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে এদের তাৎপর্যপূর্ণ মিল আছে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ধ্রুপদি বাস্তববাদের ইউক্লিডীয়-নিউটনীয় কার্য-কারণের আলোকায়ন-প্রকল্প-বাহিত রৈখিকতা ও নৈর্ব্যক্তিকতাকে বর্জনের মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার তাবৎ বাস্তবতাকে এবং ইতিহাসকে উপন্যাসে তুলে ধরার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রয়াসে।
তবে অবশ্যই বলতে হবে, এই বিস্ফোরন-পর্বের একধরনের শীর্ষবিন্দু চিহ্নিত করেছে যে ঢাউস উপন্যাসটি, তা হচ্ছে কলম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড। ১৯৬৭ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে তা নিজেই বিস্ফোরণের চেহারা নেয়; সারা লাতিন আমেরিকায় তো বটেই, পশ্চিমের কিছু কিছু অঞ্চলেও উপন্যাসটি সাড়া জাগায়। আসলে দক্ষিণ আমারিকার কাল্পনিক শহর মাকোন্দোয় বুয়েন্দিয়া পরিবারের একশ’ বছরের ইতিহাসকে বিভিন্ন মাত্রায়, অবয়বে, অনুষঙ্গে, আখ্যানে, বয়ানে, চিত্রকল্পে, ঘটনায় ও স্মৃতিকে ধারণ করার মহাকাব্যিক আয়তনের যুগান্তকারী সাহিত্যিক-নান্দনিক-রাজনৈতিক উদ্যোগ হিসাবে গার্সিয়া মার্কেসের এই উপন্যাসটিকে অবশ্যই বিবেচনা করা চলে। এবং এই ইতিহাস অবশ্যই কলম্বিয়া ও লাতিন আমেরিকার ইতিহাস বাদ দিয়ে নয়। এই ইতিহাসে প্রেম-ভালবাসা-ঘৃণা, দুর্যোগ, যুদ্ধ, সংগ্রাম, সংস্কার, কুসংস্কার, রাজনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি, নন্দনতত্ত্ব, আলকেমি, পশ্চিমা বিজ্ঞান, জাদু-টোনা, ধ্বংস ও নির্মাণ সবই আছে। এ কারণে লাতিন আমেরিকার একাধিক সমালোচকওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড-কে লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক মহাকাব্য হিসাবে বিবেচনা করেছেন।
১৯৮২ সালে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার পর ওই উপন্যাসসহ তার প্রায় সব কাজেরই কাটতি বেড়ে যায় এবং চলতে থাকে জাদুবাস্তবাদ পদটির তুমুল প্রয়োগ। বছর কয়েক আগে পেশ-করা কিছ সাহিত্য-জরিপে দেখা গেছে যে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে জাদুবাস্তববাদ বর্গটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের বিস্ফোরণ-পর্বের অন্যান্য প্রতিনিধির কাজের ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সালমান রুশদির মিডনাইটস চিলড্রেন আর তৃতীয় স্থানে রয়েছে জর্মন ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাসের দ্য টিন ড্রাম। উল্লিখিত জরিপগুলো জাদুবাস্তববাদী উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত অন্যান্য কাজের একটি ফর্দ পেশ করে এভাবেঃ বেন ওকরির দ্য ফ্যামিশড রোড, তাহার বেন জেলুনৌনের দ্য স্যান্ড চাইল্ড, মাইকেল ওনদাতজের ইন দ্য স্কিন অব এ লায়ন, ইয়াসুনারি কাউয়াবাতার ওয়ান আর্ম, টোনি মরিসনের বিলাভেড ইত্যাদি। পশ্চিমা লেখকেরও একটা ফর্দ দিয়েছে ওইসব জরিপঃ ইতালো কেলভিনো, মিলান কুণ্ডেরা, উমবের্তো একো, হুবার্ত ল্যাম্পো ও হোসে সারামাগোসহ উইলিয়াম ফকনার। কিন্তু গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসই সবার আগে।
অবশ্যই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং তার কাজ বর্তমান রচনার বিষয়বস্তু নয়।এছাড়া আমি এখানে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের বিস্ফোরণ-পর্বের কথা উল্লেখ করলেও তার ইতিহাসের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে আমি জাদুবাস্তববাদ পদটির প্রয়োগের ইতিহাস খানিকটা বিবেচনায় রেখে জাদুবাস্তববাদকে রাজনৈতিক নিরিখে দেখতে আগ্রহী। কারণ লাতিন আমেরিকায় জাদুবাস্তববাদের উত্থানের পর্বে উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনীতির বিষয়টা ছিল স্পষ্ট করেই, যদি আমরা কিউবার আলেহো কার্পেন্তিয়ের এবং হাইতির লড়াকু লেখক জাঁক স্তেফেন-অ্যালেক্সিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে আবারো বিবেচনা করি। বলা দরকার, সাম্প্রতিক পশ্চিমা সমালোচনায় এবং এমনকি উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনাতেও এদের বক্তব্য হয় উপেক্ষিত থেকেছে, নয়তো তাকে নিছক আত্মপরিচয়ের সাংস্কৃতিক কাজের সনাতন ধারায় দ্রবীভূত করে পশ্চিমের মাল্টিকালচারালিজম প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এও সত্য যে, জাদুবাস্তববাদ বর্গটি এতই পিচ্ছিল হয়েছে এবং বাজারের ঘষা পয়সার মতো চেহারা নিয়েছে যে, এক পর্যায়ে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নিজের কাজকে মোটেই জাদুবাস্তববাদের আলোকে দেখতে চান নাই।
৪
তাহলে কি এই জাদুবাস্তববাদ? বাস্তবতা ও জাদুর সংমিশেলে যা পাই, তাই জাদুবাস্তববাদ? অথবা জাদুবাস্তববাদ সেই বাস্তবতাকে নির্দেশ করে, যা বাস্তবতার ভেতরে জাদুকে এমনভাবে ধারণ করে যে, জাদুকেও বাস্তব বলে মনে হয়? কিংবা জাদুবাস্তববাদ কি ‘বাস্তব’ ও ‘অবাস্তব’ এবং ‘সত্য’ ও কল্পনার সনাতন যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোকে ধসিয়ে দেয়? একটি উপন্যাসে লোককাহিনী, গাথা, রুপকথা, প্রবাদ, প্রাচীন বচন, ভূতের গল্প, কিংবদন্তী ইত্যাদি ব্যবহার করলেই কি জাদুবাস্তবাদ পাওয়া যায়? উত্তরে অনেকেই ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। আর এই ‘হ্যাঁ’-কে বিবেচনায় রাখলে বা গ্রহণ করলে যেসব কাজকে সাধারণত জাদুবাস্তববাদী বলে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলোর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য একেবারেই যে অধরা থেকে যাবে, তা কিন্তু নয়।
তবে এভাবে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতাকে আপনাআপনি স্পষ্ট করা যাবে তা মোটেই বলা যাবে না। তাহলে সেই রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতাকে খানিকটা ধরার জন্য আমরা যেতে পারি আলেহো কার্পেন্তিয়ের এবং জাঁক স্তেফেন-অ্যালেক্সিসের কিছ পর্যবেক্ষণের কাছে।
কার্পেন্তিয়ের তার ‘অনুপম বাস্তবতা’র ধারণাকে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি দিতে গিয়ে খুব সচেতনভাবেই ধ্রুপদী ইউরোপীয় বাস্তববাদের রাজনীতিকে আমলে রেখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাইতি’র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে—লড়াকু কালো আদমিদের উপনিবেশবাদবিরোধী ইতিহাসকে—খেয়ালে রেখেছেন এবং তার বহুমাত্রিক কিন্তু ইতিহাসে ময়লা-হয়ে-থাকা চেহারা ও চরিত্রকে ধরতে গিয়েই তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, একজন বালজাক বা একজন ডিকেন্স-এর বাস্তববাদ দিয়ে হাইতির বা কিউবার বা লাতিন আমেরিকার বাস্ততবতাকে ধরা মানেই নান্দনিক উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়াকে জোরদার করা। এই প্রসঙ্গে কার্পেন্তিয়ের অনেকটা কেপ ভার্দের বিপ্লবী কালো তাত্ত্বিক আমিলকার কাব্রালের মতোই উৎসে ফেরার আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু উৎসে ফেরাটাই—বা মার্কসের ভাষায় “র্যাডিকাল” হওয়াটা (মার্কস বলেছিলেন যে, র্যাডিকাল হচ্ছে সে, যে বিষয়ের মূলে বা উৎসে হাত রেখে বিষয়কে ধরার চেষ্টা করে)—যথেষ্ট নয়। ফেরার চেয়েও জরুরি হয়ে থাকে আবারো গড়ার কাজ আর এই নির্মাণ পশ্চিমা বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বকে বা খোদ উপনিবেশবাদকে কেবল যে চ্যালেঞ্জ করবে তা নয়, বরং এই নির্মাণ সমাজের রুপান্তরের স্বার্থেই সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক করে তুলবে। এই ধরনের একাধিক ইঙ্গিত কার্পেন্তিয়েরের একাধিক কাজ থেকেই পাই বটে।
এবার আসি জাঁক স্তেফেন-অ্যালেক্সিস প্রসঙ্গে। তিনি হাইতির একজন লড়াকু লেখক ঔপন্যাসিক-তাত্ত্বিক-অ্যাকটিভিস্ট। জাদুবাস্তববাদ নিয়ে একটি রচনাই লিখেছেন তিনি। এর শিরোনাম ‘অব দ্য ম্যাজিকাল রিয়ালিজম অব হেইশিয়ানস’ অথবা ‘হাইতিবাসীর জাদুবাস্তববাদ’। রচনাটি প্রকাশিত হয় ব১৯৫৬ সালে। এই রচনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে জড়ো করা যাক। প্রথমত, যাকে হাইতির জাদুবাস্তববাদ বলা হচ্ছে, তা একই সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অবস্থানের নাম। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন ও অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞ্যানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের স্বার্থে ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ নির্মাণের কাজকে গুরুত্ব দেয়। তৃতীয়ত, হাইতির জাদুবাস্তবাদ ও জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণের কাজে একই সঙ্গে যায় এই অর্থে যে, সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে হাইতির অধিকাংশ মানুষের–অর্থাৎ হাইতির কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের—জীবন-সংলগ্ন যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান ও অনুশীলন উপেক্ষিত থাকে বা এমনকি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, সেগুলোকে সামুহিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ফিরিয়ে এনে তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে পরখ ও সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে জাদুবাস্তববাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চথুর্তত, হাইতির জাদুবাস্তববাদের ‘জাতীয়’ স্থানিক বিভিন্নতাকে মোটেই উপেক্ষা করে না। বরঞ্চ তা স্থানিক বৈচিত্র্যকে জায়গা করে দিয়েই ঐক্যের জায়গা খোঁজে। পঞ্চমত, হাইতির জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণে জাদুবাস্তববাদের ভুমিকা পালনের সঙ্গে সরাসরি সামাজিক বিপ্লবের যোগ রয়েছে এই অর্থে যে, বিপ্লবকে এগোতে হলে তাকে অবশ্যই জনগোষ্ঠীর মাটি-কাদা-জলের সঙ্গে এবং মনোজগতের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হতে হবে। এই যুক্ততার কাজ স্তেফেন-অ্যালেক্সিসের মতে লড়াকু সংস্কৃতির কাজই বটে।
সব শেষে “সাংস্কৃতিক রাজনীতি” বর্গটা নিয়ে কিছু কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই বর্গটাকে এর মধ্যেই এমনভাবে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে যে, একটি পর্যায়ে বর্গটা “সংস্কৃতি”র রাজনীতির এলাকা থেকে দূরে সরে এসেছে, যদিও সেই প্রসঙ্গে লড়াকু তাত্ত্বিক আন্তনিও গ্রামসির নাম বারবারই জপ করে তারও বিরাজনীতিকীকরণ ঘটানো হয়েছে । সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিরাজনীতিকীকরণের এই হাল-হকিকত নিয়ে যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের সময়ের অন্যতম দার্শনিক অ্যালান বাদিউ নিজেই, এবং গোটা সংস্কৃতি’র একটা নতুন তত্ত্ব তৈরি করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি, যে তত্ত্বের ফ্রেমওয়ার্কেই সংস্কৃতির রাজনীতিকে তুমুলভাবেই রাজনৈতিক করে তোলা যায়।
আর বাংলাদেশে জাদুবাস্তববাদের সাংস্কৃতিক রাজনীতি? সেটি আরেক প্রসঙ্গ। তা নিয়ে পরে একটি আলাদা প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা আছে। তবে এতটুকু তো বলাই যায়ঃ পশ্চিমের বা পশ্চিম-বাহিত যে কোনো তত্ত্ব-ধারণা- মতাদর্শকে এই সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের যুগে বিভিন্নভাবেই যাচাই করে নেওয়া দরকার।
আজফার হোসেন