কামরুল হাসানের দীর্ঘ কবিতা: বাঘ ও হরিণী উপাখ্যান

বয়স হলে বাঘের হরিণপ্রীতি খুব কমে যায়,
বাঘ আর শিকারে কি সেভাবে তাকায়?
যেভাবে দেখতো যৌবনে হরিণীর চকচকে দেহ
হরিণী গাত্রের রেখা বাঘমনে জাগাত বিদ্রোহ!
এখন বয়সকালে বাঘ বসে কেবল ঝিমোয়
চারপাশে কত যে বর্ণ নিয়ে হরিণ সেঁধোয়;
বাঘ আর পারে না তাকাতে
কমে গেছে জোর, থেমে গেছে থাবার বিক্রম
নখগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে
বাঘ আজ থাকে গাছে গাছে।

হরিণী হয়না বুড়ি, হরিণীর অনন্ত যৌবন
যৌবনে ধরা পড়ে বাঘে,
হরিণ ফুঁসতে থাকে রাগে, হরিণীর প্রবল যৌবন
গর্ব এই কতবার যৌবনে বাঘ এসে সঁপেছে হৃদয়
হরিণীর পিছু পিছু ধেয়ে গেছে বাঘের কনভয়।
দিয়েছে ভীষণ ডাক গর্জনে কেঁপেছে জঙ্গল
সুন্দর নয়না পিছু কত ভৌত বাঘের দঙ্গল
হরিণী চপলা পায়ে দৌড়ে গেছে ক্ষেত্র নক্ষত্র জগৎ
বাঘ ছোটে ম্রিয়মান ক্ষয়মান ধুলোর সম্বত।

চারপায়ে উড়ে গেছে হরিণীর দল
এখন কান্না শুধু বাঘের সম্বল।

প্রান্তরের ঘাসে ঘাসে বাঘ খুব দিয়েছে গড়াগড়ি
হরিণী উড়িয়া গেছে ঊর্ধ্বাকাশে একদল পরী!
বাঘেরও চিত্রিত দেহ বাঘেরও রূপ রয়েছে অতিশয়
তবু বাঘ হরিণীর পিছু ধেয়ে হয়েছে নিঃসংশয়
যখন যৌবন ছিল হরিণীরা ফেলেছে তপ্তশ্বাস
বনাঞ্চলে বাঘ আজো মূর্তিমান ত্রাস।

এখন বয়স্কালে বাঘ করে করুণ নেত্রপাত
হরিণেরা দূর থেকে দেখে বাঘের সম্পাত
নাক্ষত্রিক রূপ নিয়ে কত বাঘ রয়ে গেছে দূর ছায়াপথে
তাদের ডোরার রেখা মিশে গেছে বৃক্ষ জগতে।
এখন বনে বনে বাঘ হল মহাকায় ভয়ের আকার।
প্রান্তরে ছড়ানো ছিল তারা প্রান্তরের রুদ্র বক্ষ জুড়ে
কত দৌড়-ঝাঁপ, কত ভয়ার্ত চীৎকারে
এখনো বাঘের মনে ঢুকে আছে হরিণীর সুপ্ত যৌবন
বাঘ এক ঘোরতর বন।
আদিগন্ত ছড়ানো সবুজে চকচকে হরিণী রোদ্দুরে
বাঘ সোনালী স্বপ্ন নাকি ছড়ায় বিভ্রম থরে বিথরে।

বাঘের যুগ সরে গিয়ে এসে গেছে হরিণী অধ্যায়
হরিণীর আয়ত চোখে বাঘ আজো দেখে বনভূমি
হরিণীর দীপ্তিপূর্ণ বনে বাঘ দেখে জঙ্গল আর দখলে তো নেই
বনে বনে জনে জনে বাঘদের আত্মমগ্ন করুণ আলাপ
বনে বনে হরিণীরা দিয়েছে মস্ত ঝাঁপ।
আজ বনে বনে জনে জনে রটে গেছে বাঘের কাহিনী
বাঘের হত্যালীলা বাঘের সন্ত্রাস
কেউ কি জেনেছে বাঘেরা ফেলেছে কত নীরব দীর্ঘশ্বাস
হরিণীর শান্ত চোখ হরিণীর মস্ত হৃদয়
কেউ কি জেনেছে হরিণীর অর্ন্তগত ভয়?

কত হরিণ নেচেছে মন্দিরে, কত বাঘ শুয়ে থেকে ঘাসে
দেখছে আকাশগঙ্গায় হরিণীরা উড়ে যায় শুধু
দেখেছে যৌবনকাল উড়ে যায় ধূ ধূ
দেখেছে অধীর গভীর ঋতু জেগে থাকে জাগর ডাঙ্গায়
তাদেরই কিছু ছাপচিত্র রয়ে গেছে বাঘদের গায়
তাদের আনন্দলীলা অবাক ভ্রমনহেতু বিভ্রম জাগায়
বনে বনে রয়ে গেছে কত কত রহস্যের তীর
হরিণীরা মন্দ্র আজ মন্ত্রবেগে ধেয়ে চলে সামন্ত অধীর!

ঐ মহালোকে দলে দলে বাঘ আজ হচ্ছে জড়ো
তাদের ডোরার চিত্রে প্রান্তরের রূপ থরোথরো
তাদের শিকার সব প্রাণ পেয়ে কম্পমান দাঁড়ায়
এখনো জগতের ভয় ঊর্ধ্বলোকে তাপিত তাড়ায়
এখনো বিস্মৃত জগতের স্মৃতি ভীষণ কাঁদায়।

দ্বিমুখী ক্ষুধার তেজে বাঘ আজ দ্বিধান্বিত খুব
বাঘিনী তার মেলে আছে বিপুল যৌবন
হরিণীর ক্ষুরধার যৌবনের রূপ বাঘিনীরা কবে যে হারায়
হরিণ ও বাঘিনী মিলে হতে পারে অন্য এক প্রেমের বাথান
মাংস রিরংসার টানে শরীরের প্রাণাধিক টান!

পৃথিবীর পথে-রথে বন ছেড়ে দলে দলে বাঘ
বর্ণ পাল্টে ফেলে প্রহরান্তের একান্ত সদ্ভাব
জঙ্গলের প্রতুল অতুল বৃক্ষে তুলে বসন্ত নিদাঘ
নিতান্ত তামাশা তুলে ডেকে আনে গভীর প্রভাব।

বাঘের সামন্তযুগ বহুকাল আগে গেছে চলে
মহাকাল এনেছে সমুখে টেনে হরিণের ঢল
তরল যাত্রার ধ্বনি পরম মাত্রার শাখা তোলে
বয়স্ক রাজার মতো সেও শক্তিহীন নির্বাসন কোল।

আজ জঙ্গলের অজস্র ফটোকপিয়ারে মুদ্রিত হতে থাকে
বাঘের যৌবনচিত্র, বাঘের বিক্রম
যাদুঘরে বাঘ প্রদর্শনীর পড়ে গেছে ধূম
কেননা বাঘে আজ অতিশয় নিপতিত ঘুম
নিপাতনে সিদ্ধ যত বাঘের ব্যাকরণ
পৌরাণিক গল্পদের একমাত্র থিমেটিক ঋণ।

হরিণী পৃথিবী ঘিরে বাঘদের ভয়মত্ত ঝাঁপ
হরিণ গিয়েছে চিরে ভয়ঙ্কর কল্পনার খাঁপ
হরিণ হেনেছে বাঘে করুনার অধীর সম্পাত
বাঘেরা কখন ছিল বনভূমে সৌন্দযের্র পাত?

দেখেছি সেবিকাদলে হরিণীর নম্র নেত্রপাত
বাঘের আকাঙ্ক্ষা বোঝে, তবু ঢালে মদির প্রপাত
যখন বাঘেরা উড়ে চলে মেঘের তলদেশে
হরিনী সুধার খোঁজে চুর হয়ে যায় ব্রক্ষ্রদেশে।

বালির সৈকতে যায়, উঠে পড়ে জাভার পর্বতে
কেননা মৈনাক গিরি হারিকিরি মালয় সাগরে
সূর্যস্নানে গাত্রখোলা হরিনীরা রোদের চাবুক
সুনির্মল ছদ্মবেশে চিত্রময় হরিণও ভাবুক।

তাদের ডোরার রূপে ভিন্ন দেশে উড়ে আসে বাঘ ও হরিণ
দৌড় ভুলে থাবার একান্ত কাছে কাঁপছে সঙ্গীণ!
কেননা জঙ্গলের কিছু রীতি রয়ে গেছে সুভদ্র সমাজের রূপ
বাঘের মুদ্রার ধ্বনি কানে বাজে আর হরিণীরা সাজে অতিরূপ।

আহার পাল্টে গেছে পৃথিবীর কতরূপ খাদ্যের বাহার
কত যে বিভ্রম ঘটে হরিণী ও বাঘের খামার
অক্লান্ত আশ্লেষে উঠে চুমু খায় ভয়ার্ত কামুক
প্রভাত যমুনা যদি শুদ্ধ করে করুণার বুক।

হরিণীরা কত রূপে সাজে
বাঘ আজ বহুরূপী অলস বিভাসে
হরিণীরা মেলে রাখে কতরূপী লুপ্ত সুপ্ত ভাঁজ
বাঘেরা তন্দ্রার শেষে যখন দরাজ
হরিণ সঙ্গোপনে খেয়ে যায় মধু
কেননা বাঘের রূপে চিত্র তরিৎময় প্রান্তর, উত্থানরহিত ধূ ধূ।

এ্যালুমিনিয়মের পেট চিরে বাঘদল নেমেছে বালিতে
মৎসকন্যার দেশে ঘুরে ঘুরে আসে প্রেম নিতে
একান্ত ক্ষুধার কাছে পৃথিবীও কত গদ্যময়
আনকোরা পদ্যের গান হরিণীর জেগেছে নিশ্চয়!

প্রভাতে সন্ত খুব রাত্রি হল বাঘের অধ্যায়
রাত্রির যামে কুঞ্জে কুঞ্জে হরিণ লুকায়
কেবল নধর নিতম্বখানি খুলে রাখে ভুলে
যখন লুকানো মুখ বাঁশপাতা ফুলে
চোখ মুঁদে হরিণী বুঝেছে বুঝি জগৎ অচল
হরিণীর অসতর্কতা আজ বাঘের সম্বল।

ঐ যে দিয়েছে লাফ হরিণী উড়াল
ঐ যে দিয়েছে লাফ বাঘের ভয়াল
কোন চিত্রে ধরা পড়ে কোন ক্ষুধা প্রবল ধবল
বনভূমে ঐ যুদ্ধে পাখি-টাখি উধাও সকল।

বিপনীর শান্ত ভীড়ে, ব্যাগ্র ব্যাঘ্র সারি
বাঘ গিয়েছে ছুটে হরিণীর ছায়াময় বাড়ি
বাঘ দেখেছে তুলে হরিণীর চিত্রময় শাড়ি
বাঘেরা উন্মাতাল, হরিণীর প্রাণপন পাড়ি।

বিদেশী এসেন্সের ঘ্রাণে আরো কামাতুরা
বাঘের শৌর্যে ঝরে চৈত্রের নিদারুণ খরা।

সাদা পৃষ্ঠা বাঘের বিষাদ
হরিণী চিত্রিত খুব বর্ণময় স্বাদ
বর্ষার বাংলাদেশে হরিণীরা করুণ নিষাদ
কান্নার দেশে বাঘদের নিপাট লুকানো খাঁদ।
হরিণীরা ভয়হীন বসে আছে বাঘের ডেরায়
বাঘ যে চন্দ্রভূক সেই তর্কে বাঘকে শাসায়!
বলে তূর্য অতীতের তীর তূণ হেনে
এনেছ অনেক ভীতি, গল্পের সহজ প্রতীতি!
আজ তুলে রাখো
আহ এই মঞ্চতলে প্রেমরীতি মাখো।

সত্যি হল হরিণীরা বাঘের প্রণয়
বাঘ যে হরিণী ঘ্রাণে কত প্রাণময়
হরিণী প্রজন্মে আজ ভরে গেছে বাঘের জঙ্গল
ঈশ্বর অঙ্কিত পথে জপতপ হরিণীর দল।

বাঘ এক পৌরাণিক প্রভূ
হরিণীরা দিয়েছে উড়াল
প্রভুর পায়ের কাছে পড়ে থেকে কতকাল কেটেছে সময়
হরিণীরা মত্ত বায়ূবেগে এসে পড়ে বাঘের প্রাসাদে
আর বাঘেরা দলে দলে ছেড়ে গেছে স্বর্ণ সিংহাসন
হরিণীর জন্য তারা কেঁদেছে প্রাণপন
বাঘ ও হরিণ মিলে বনে বনে কতটুকু জাগাল উদ্ভাস
মানব মনের কাছে রয়ে গেল কত রহস্যের আভাস
কত বর্ণ রুয়ে গেছে হরিণীর পিছু নেয়া ত্রাস।
হরিণী জেনেছে তার পিছু নেয়া বাঘ নয় অন্য কোন ভয়
বাঘও জেনেছে ঐ সমুখে ছোটে হরিণী নয়, অন্য কোন জয়।

 

কামরুল হাসান 

জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১, শরীয়তপুরে। তিনি মূলত কবি। অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ গদ্যকার হিসেবেও খ্যাত। আছে নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

ভারতের বিশ্বখ্যাত খড়গপুর আইআইটি থেকে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড ও এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কামরুল হাসান শিক্ষকতা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। কামরুল হাসান  দু’হাতে লেখেন। এপর্যন্ত ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি ছোটগল্প, ১টি প্রবন্ধ, ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থ, ২ টি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সমীর রায় চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে পোস্টমর্ডান বাংলা পোয়েট্রি ২০০৩ সম্পাদনা করেছেন।

[email protected]

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top