জন বার্ট একবার বলেছিলেন, “কবিতা আমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।” বার্টের মতো আমিও বলি— কবিতা আছে তাই আমি বেঁচে আছি। আমার কাছে এর চেয়ে দিব্য সত্য আর কিছু নেই। বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। কবিতা আমাকে সুস্থ করে তোলে।
কবিতা লিখতে না পারা কবির জন্য অসুস্থতা। সে অসুস্থতা তো ছিলই। ২০১৮ সালে স্ত্রীর মৃত্যু, ২০১৯ সালে মায়ের মৃত্যুতে জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয়, তারপর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে না উঠতেই করোনার থাবায় আক্রান্ত হই। ২০২০ সালের মধ্য থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি এই এক বছরে তিন তিন বার করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাকে থাকতে হয়েছে আইশোলেশানে। এর মধ্যে জ্বর, চোয়ালে ক্ষত, ইউভিআইটিস, আর্থারাইটিস, গ্যাসট্রাইটিস, স্মৃতিবিভ্রম, নিউরালজিয়া, আইবিএস, হাসপাতালে ভর্তি, লাইপোমা অপারেশন। এত কিছুর মধ্যেও কবিতা আমাকে ছাড়েনাি। অসুস্থ শরীরে অদৃশ্য থেকে একটির পর একটি কবিতা এসেছে আমার কাছে। আর আমাকে অনন্ত শক্তি যুগিয়ে সাহসী করে তুলেছে, সুস্থ করে তুলেছে। এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলিনি।
আমার শরীরে অসুখ এলে আমি কবি হয়ে উঠি। এই কবি হয়ে ওঠাই বেঁচে থাকা। অর্থাৎ কবিতা থাকে তাই আমি বেঁচে থাকি। জীবনের বহু বিপর্যয়ে কবিতা আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। করোনাকালে একটির পর একটি কবিতা লিখেছি। যা দিয়ে আমার তিনটি কাব্যগ্রন্থ ‘সুবর্ণগ্রামে লকডাউন’, ‘যশোর রোডে দাঁড়িয়ে’ এবং ‘সক্রেটিসের সাথে’ প্রকাশিত হয়েছে। আর প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশক আটকে রেখেছেন আরও একটি কাব্যগ্রন্থ ‘কুড়িয়ে পাওয়া কবিতা’। দেশ-বিদেশের প্রায় দুইশত কবির কবিতা নিয়ে বত্রিশ ফর্মার করোনাকালের কবিতা সংকলন ‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময়’ এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছি। যা আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে করোনাকালে বেস্টসেলার হয়েছে। এর মধ্যেই হাইকু লিখেছি দুই শতাধিক। বিদেশী কবিতার অনুবাদও করেছি এ সময়ে। আর ফরমায়েসি বই আলোচনা, প্রবন্ধ,গল্প, লেখা তো আছেই। বারবার কবিতাই আমাকে বহুদূর এগিয়ে যেতে সাহস যুগিয়েছে।
সম্প্রতি মোটরবাইক এক্সিডেন্টে কলার বোন, সোলডার ক্যাভেটি ফ্রাকচারে মাসাধিককাল বিছানায় থাকতে হয়েছে। ঠিকমত ঘুমোতে পারিনি। কত রাত চেয়ারে বসেই কেটে গেছে! তারপরও কবিতা আমাকে ছেড়ে যায়নি। মরমী কবিতার অমৃতপুত্রগণ— কখনো শেখ শাদী, জালাউদ্দীন রুমী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, ফরিদউদ্দীন আত্তার, মীর তকি, মির্জা গালিব, বাহাদুর শাহ জাফর, ইকবাল এসে আমার উপর ভর করেছেন। ছোটো ছোটো পংক্তি ঝাঁক বেঁধে এসেছে আমার কাছে, কখনো জাগরণে, তন্দ্রাচ্ছন্নতায়,কখনো অচেতনে। একটি ঘোরে সুরা পানে যেন সাকীর সাথে একাকার হয়ে গেছি। ডান হাতের আঙুলে শক্তি নেই কম্পোজ করার বা কলম ধরার। ভয়েস কম্পোজ করে, কখনো বাম হাত দিয়ে একটু একটু করে ট্যাবে লিখে রেখেছি। এগুলো শের, দোঁহা, রুবাইয়াৎ, শায়ের বা গজল কোনোটাই নয়, সব মিলিয়ে নতুন কিছু। হয়তো এগুলো খসরু থেকে ‘খের’। স্বরবৃত্তে তৈরি হয়েছে ৪+৮+৬+৮+৬ মাত্রায় অন্ত্যমিলের এক নবতর দ্যোতনার পংক্তি শতক। সেই সাথে তিন, দুই চরণের দুইশত অণুকবিতা। মোট তিনশত অণু কাব্যের সমন্বয়ে এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে প্রকাশের জন্য ‘চোলাই কাব্য’। এসব শেষ হতেই এক সহৃদয় প্রকাশক ছাপতে চাইছেন নতুন প্রবন্ধের বই। কত গদ্য পড়ে আছে, বই তো করাই যায়! অতঃপর তৈরি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তকে নিয়ে ‘তিন ভুবনের তিন কবি’ বা ‘রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি। শরীরের ক্ষত, ফ্রাকচারজনিত ব্যথা-যন্ত্রণা-জ্বরে একদিকে চলছে এন্টিজেন, এন্টিবায়োটিক। সেই সঙ্গে কবিতার অব্যর্থ থেরাপি। সুস্থ না হয়ে উপায় আছে কি!
২.
কবিতা যে অসুখের নিরাময়, এটা আমার বহুদিনের লালিত অভিমত। কিন্তু এর পক্ষে এরই মধ্যে অনেক সত্য আবিস্কৃত হয়েছে। কয়েক বছর আগে জার্মানির বার্লিনের ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা হয়। পরে ২০১৭ সালে এই গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় অক্সফোর্ড একাডেমিক জার্নালে। সেখানে বলা হয়, কবিতার রয়েছে মারাত্মক জাদুকরি শক্তি।
কবিতার সঙ্গে থাকলে বা কবিতা পাঠ করলে, শুনলে আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটে। কবিতার ফিজিওসাইকোলজি এবং নিউরোসায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা উঠে এসেছে এই গবেষণায়।
জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইম্পেরিয়াল অ্যাসথেটিকসের একদল গবেষক জানিয়েছেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। তাঁরা বলেছেন, কবিতাই নাকি মানুষকে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করে। একটি সমীক্ষায় ১৩ জনকে এক এক করে পড়তে দেয়া হয় বিভিন্ন নথি, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সনেট ও তাঁদের প্রিয় কবিতা। শেষে দেখা যায়, প্রিয় কবিতাই তাঁদের সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করছে। সক্রিয় হয়েছে মস্তিষ্কের ডান পাশ, যা মানুষের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তোলে। এ তো গেল কবিতা পাঠের শুভ প্রতিক্রিয়া। আর এই কবিতা যে লেখেন, তিনি কবি; আর তিনিই সবচেয়ে বড়ো পাঠক। তাঁকে ক্রমাগত কবিতা কতখানি উদ্দীপ্ত করতে পারে, তা সহজে অনুমেয়।
জন মিল্টন একবার তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, “ক্ষত সারিয়ে তোলার ক্ষমতা আছে শব্দের।” তিনি তো কবিতার শব্দের কথা বলেছিলেন। সেটা হয়ত মনের ক্ষত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবিতা রোগ নিরাময়ে পালন করে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যার দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের সামনেই।
১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম ‘পোয়েট্রি ফার্মেসি’ খোলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক মিসেস ডেব্রাহ আমলা। এই ফার্মেসি থেকে রোগীদের ঘুমের ঔষধ, ভিটামিন ট্যাবলেটের পরিবর্তে কবিতা দেয়া হয় পথ্য হিসেবে। এ কাজের জন্য ডেব্রাহ তাঁর দেশে ‘ইমার্জেন্সি পোয়েট’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। করোনাকালেও ঔষধের বদলে কবিতা দিয়ে তিনি চিকিৎসা করে অনেককে সুস্থ করে তুলেছেন। সুখের কথা যুক্তরাজ্যে আগের তুলনায় কবিতার বই বিক্রির হার ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেই সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। ক্রমাগত লিখে গেছি। কখনও লিখতে পারিনি বছরের পর বছর ধরে। লিখতে না পারলেও কবিতার সঙ্গে থেকেছি, পড়েছি। কবিতা আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। গবেষণাধর্মী গদ্য রচনায় একটু সাফল্য এলে পত্র-পত্রিকা, প্রকাশকগণের চাহিদায় গদ্যের সৃজন বেড়ে গেছে, কিন্তু গবেষক নয়,গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক নয়; বরাবর চেয়েছি কবি হতে, কবি পরিচয়ে পরিচিত হতে।
কবিতা টেলিপ্যাথি হয়ে স্বপ্নে আমার কাছে ধরা দেয়। অধিকাংশ স্বপ্নে পাওয়া কবিতাগুলো নিয়েই তো প্রকাশিত হয়েছে আমার কাব্য ‘হৃদপুরাণ’।
অনেকেই ছেড়ে চলে গেছে। পর হয়ে গেছে বন্ধু, স্বজন । কিন্তু কবিতা আমাকে ছেড়ে যায়নি । কবিতা আছে তাই বেঁচে আছি। যেদিন আমার কবিতা থাকবে না, সেদিনই আমার মৃত্যু হবে।
———————–
১০ আগস্ট ২০২২
খসরু পারভেজ
কবি ও গবেষকখসরু পারভেজের জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২, যশোর জেলার শেখপুরা গ্রামে। সাহিত্য সাময়িকী ও ছোটকাগজ সম্পাদনা ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিষয়ে গবেষণায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। সংগঠক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন মধুসূদন একাডেমী ও পােয়েট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কবিতা- পালকখসা বলাকার আর্তনাদ, নিহত বিভীষিকা, নিরুদ্দেশে, মুক্তিযুদ্ধে কুকুরগুলো, ভালবাসা এসো ভুগোলময়, পুড়ে যায় রৌদ্রগ্রাম, ধর্ষণ মঙ্গলকাব্য, রূপের রিলিক, প্রেমের কবিতা, জেগে ওঠো প্রত্মবেলা, হৃদপুরাণ। গবেষণা: পদ্য: কবিতার ছন্দ, আমাদের শিল্পী এস এম সুলতান, আমাদের বাউল কবি লালন শাহ, এস এম সুলতান, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত।
পুরস্কার ও সম্মাননা : সুকান্ত পদক, মনোজ বসু স্মৃতি পুরস্কার, কণ্ঠশীলন সম্মাননা, বিবেকানন্দ পদক, মধুসূদন সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, জীবনানন্দ গ্রন্থাগার সম্মাননা।