অবলাকান্ত কাঠগড়ায় উঠিয়াই কহিলেন — “আমি ‘মুখবই’ খেলিব না। হুজুর, ‘মুখবই’ খেলা বন্ধ হউক। নতুবা, খেলার নিয়ম বদল হউক। ‘মুখবই’তে ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিবার বা অন্য কিছু লিখিবার জায়গাটা তুলিয়া দেওয়া হউক।”
উকিল বলিলেন — “‘মুখবই’ লইয়া হুজুর কিছু করিতে পারিবেন না। উহা একটি খেলা যাহা বিদেশীরা তৈয়ার করিয়া, সারা পৃথিবীতে ছড়াইয়া দিয়াছে। হুজুর কি করিতে পারেন?”
অবলাকান্ত বলিলেন — “কেন? বিদেশীদের প্রদত্ত নাম পাল্টাইয়া যদি আমরা ডালহৌসী স্কোয়ারকে বিবাদী বাগ করিয়া দিতে পারি, তবে এই বিদেশী খেলার নিয়মকানুন পাল্টাইয়া কেন স্বদেশী নিয়ম বসাইতে পারিনা? আমরা এক্ষণে স্বাধীন দেশ!”
বিচারক বলিলেন — “তোমার খেলা লইয়া আলোচনা করিতে তোমাকে ডাকা হয় নাই, তুমি আসিয়াছ মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করিতে। সেই বিষয়ে কথা হউক।”
অবলাকান্ত বলিলেন — “হুজুরের আদালতে জনসাধারণ সুবিচার পাইয়া যায়, আর আমার কথা হুজুর শুনিবেন না?! …আমি তবে চলিলাম।”
উকিল দেখিলেন মহা মুস্কিল, সাক্ষী হাতছাড়া হইয়া যায়!
তাড়তাড়ি উঠিয়া কহিলেন — “আজ্ঞে, শুনিবেন বইকি!…হুজুর, দু’মিনিট?”
বিচারক গম্ভীর হইয়া কহিলেন — “দুইমিনিটের বেশী একটি দণ্ডও নয়।”
অবলাকান্ত বলিলেন — “আহা, কি শুনিলাম! হৃদয় জুড়াইয়া গেল। হুজুরের কি সুকোমল মন – কাহাকেও দুইমিনিটের বেশী দণ্ডভোগ করাতে চাহেন না!”
বিচারক আরও গম্ভীর হইয়া কহিলেন — “দণ্ড, পল – এইসবের অর্থ অবগত আছে?”
অবলাকান্ত মাথা চুলকাইয়া বলিলেন — “আজ্ঞে, আদালতে যখন আসিয়াছি তখন দণ্ড শব্দের অর্থ বুঝিয়াই আসিয়াছি। আর পল? ঐ পল আর টম মিলিয়া আমার জীবন দুর্বিষহ করিয়া দিয়াছে, তাই তো হুজুরকে বলিতেছিলাম…”
বিচারক আর কথা না বাড়াইয়া, কহিলেন — “কি বলিতেছিলে? দ্রুত বলিয়া ফেলো।”
অবলাকান্ত এইবার গলা খাঁকারি দিয়া সজোরে কহিলেন — “আজ্ঞে, আমি ‘মুখবই’ খেলিব না।”
বিচারক বলিলেন — “কেন খেলিবে না?”
অবলাকান্ত বলিলেন — “হুজুর, এক তো এই খেলার কোনো নিয়ম নাই। যাহার যাহা খুশী সে তাহাই ছুঁড়িয়া মারে দেওয়ালে। কেহ ছুঁড়িয়া মারে গোলাপফুল, তো কেহ ছুঁড়িয়া মারে নতুন বাড়ী-গাড়ী। কেহ ছুঁড়িয়া দেয় গদ্য-পদ্য-হাবিজাবি যাহার কিছুই বুঝিয়া উঠা যায় না। আবার কেহ ছুঁড়িয়া দেয় নিজের ছবি, পরিবারের ছবি – একেকদিন একেক সাজে সাজিয়া। তাহার উপর আবার এই সবকয়টিতেই আপনাকে ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিতে হইবে – বারংবার, প্রত্যহ। পূর্ণিমা নাই, অমাবস্যা নাই, জ্বরবিকার নাই, আমাশয় নাই – মানুষ দেওয়ালে কিছু না কিছু ছুঁড়িবে আর আপনাকে ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিতে হইবে। না যদি বলিলেন তো আপনাকে সকলের ‘খারাপ’ লাগিবে, আপনার দেওয়ালে সাক্ষাত ঈশ্বরের ছবি থাকিলেও কেহ ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিবেনা। কেহ কেহ আবার
হিং-এর ঝুড়ি লইয়া খেলিতে নামিয়াছেন। আড়চোখে তিনি দেখিবেন যে কাহার দেওয়ালে কয়জন ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিয়াছে। চারি-পাঁচটি হইলে তিনি উদারমনা হইয়া ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিয়া দিবেন এবং নিজের একশোটি ‘ভালো লাগিয়াছে’ দেখিয়া মিটিমিটি হাসিবেন। কিন্তু যদি চারিশতটি ‘ভালো লাগিয়াছে’ দেখেন, তখন পরম বন্ধুকেও তিনি ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিবেন না। তদুপরি…”
বিচারক কহিলেন — “তদুপরি কি? তদুপরি কিছুই না।…এই প্রসঙ্গ রাখিয়া আমরা এখন মামলা লইয়া আলোচনা করিতে পারি?”
অবলাকান্ত বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলিয়া কহিলেন — “কি বলিলেন – ‘কিছুই না’? আপনি কি অবগত আছেন যে তদুপরি কি হইতে পারে?…শুনুন তবে আমার কাছ হইতে। কর্ণেল বসুসাহেব ‘মুখবই’তে আমাকে ‘বন্ধু’ করিয়াছেন দেখিয়া আমি বড়োই আনন্দিত হইয়াছিলাম। উনি সাহেবমানুষ, পাইপ চিবাইয়া থাকেন। আমার একতলা বাড়ীটার উল্টাদিকে যে বহুতল আবাসন হইয়াছে, তাহার কোনো এক উপরতলার বাসিন্দা। উনার একটি লোমওয়ালা সারমেয় আছে – তাহার নাম পল। তাহাকে লইয়া উনি সকাল-বিকাল হাঁটিতে বাহির হোন, আমি দূর হইতে দেখি। তো এই বসুসাহেব একদিন দেওয়ালে পলের একটি দাঁতখিঁচানোর ছবি ছুঁড়িয়া মারিলেন। আমি তলায় লিখিলাম যে ‘ছবিটি বড়ো ভীতিজনক’। সত্য কথাই কহিয়াছিলাম, মিথ্যা বলি নাই। বিদেশে তো শিক্ষা লাভ করি নাই, তাই বলিতে পারিনা। তবে এদেশে তো ছোটবেলা হইতেই শিখিয়া আসিয়াছি যে ‘সদা সত্য কথা বলিবে। কদাপি মিথ্যা বলিবে না। সত্যের জয় সুনিশ্চিত।’ তাহাই করিয়াছিলাম। কিন্তু ঐ বিদেশী খেলায় পারঙ্গম বসুসাহেব, ক্রোধাণ্বিত হইয়া আমাকে ‘বন্ধু’ হইতে ‘শত্রু’ করিয়া দিলেন। অতঃপর প্রত্যহ পল-কে লইয়া তিনি আমার গৃহের সম্মুখ দিয়া হাঁটিতে শুরু করিলেন এবং দুঃখের কথা আর কি বলিব হুজুর, আমার গৃহের প্রবেশদ্বারটিকে পল তাহার শৌচালয় হিসাবে ব্যবহার করিতে শুরু করিল।”
বিচারক বলিলেন — “শুনিয়া বড়োই দুঃখিত হইলাম, কিন্তু এই মামলা তো আমার এজলাসে আসে নাই – তাই আমার ইহাতে করণীয় কিছু নাই।”
অবলাকান্ত বলিলেন — “আজ্ঞে হুজুর, সে মামলা আমি নিজেই সামলাইয়া লইতেছিলাম। বসুসাহেব পরেরবার যখন পলের একটি মুখ ভ্যাংচানির ছবি ছুঁড়িয়া মারিলেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে তলায় লিখিয়া দিলাম যে – ‘পল এই অঞ্চলের সর্বাধিক সুশীল এবং রূপবান সারমেয়।’ “
বিচারক অধৈর্য হইয়া কহিলেন — “তবে তো সমস্যার সমাধান হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে আমরা মামলা লইয়া আলোচনা করিব।”
অবলাকান্ত হাঁ হাঁ করিয়া উঠিলেন — “সমাধান? তবে আর বলিতেছি কি হুজুর? সমাধান দূরে থাক্, মামলা আরও বিগড়াইয়া গেল। বসুসাহেবের প্রতিবেশী দত্তসাহেব, আমার মন্তব্যটি দেখিয়া আমাকে ‘বন্ধু’ করিলেন। তাঁহারও একটি বড়োসড়ো সারমেয় আছে, নাম টম। তাহার চেহারা দেখিলে আমার অবশ্য তাহাকে টম না বলিয়া যম বলিয়া ডাকিতে সাধ যাইত – দূর হইতে দেখিলেই ভয়ে আমার জিহ্বা শুকাইয়া যাইত। সে যাহা হউক, কয়দিন পর দেখি দত্তসাহেব দেওয়ালে টমের একটি ছবি ছুঁড়িয়াছেন – সে চোখ বন্ধ করিয়া শুইয়া আছে। আমি ভাবিলাম আপদের শান্তি হইয়াছে। তলায় লিখিয়া দিলাম – ‘টম্ চিরশান্তির দেশে ঘুমাইয়া থাকুক’। বসুসাহেব আমার উপর খুব খুশী, আমার মন্তব্যটি পড়িয়া খুব হাসিলেন…মানে হাসিমুখের ছবি দিলেন আর ‘ভালো লাগিয়াছে’ জানাইলেন। বসুসাহেব আর দত্তসাহেবে যে রেষারেষি রহিয়াছে, আমি তা কি করিয়া জানিব হুজুর?…
দত্তসাহেব রাগিয়া উত্তরে লিখিলেন – ‘তাহার এখনো দেরী আছে।’
আমি তৎক্ষণাৎ আমার ভুল বুঝিতে পারিয়া লিখিলাম – ‘ঘুমের দেশেই তো চিরশান্তি মিলে, নতুবা এই পৃথিবীতে আর শান্তি কোথায়? আমি অন্য কোনো দূর দেশের কথা বলি নাই।’
বসুসাহেব রসিকতা করিয়া লিখিলেন – ‘বলিলেও ক্ষতি ছিল না – নিশ্চিন্তে পথ হাঁটা যাইত।’
দত্তসাহেব আরও রাগিয়া লিখিলেন – ‘কুরুচিপূর্ণ মনই এমন রসিকতা করিতে পারে।’
বেগতিক দেখিয়া হুজুর, আমি আমার লেখাটিকেই মুছিয়া দিলাম – কিন্তু দুই সারমেয়কে লইয়া দুই সাহেবের কলহ বাড়িতে বাড়িতে গেল। তারপর হুজুর, একমাসের মাথায় শুনিলাম টমের সত্যই পরলোক প্রাপ্তি হইয়াছে। আমি যারপরনাই লজ্জিত হইয়া পড়িলাম। অনেক ভাবিয়া, শেষে একটি ফুলের তোড়ার সঙ্গে শোকজ্ঞাপনের কার্ডে নিজের নাম লিখিয়া আবাসনের রক্ষীকে দিয়া দিলাম দত্তসাহেবের ঘরে পৌঁছানোর জন্য।”
উকিল এইখানে অবলাকান্তকে থামাইয়া বলিলেন — “বাহ্! এই তো আমরা চলিয়া আসিলাম আসল মামলার কথায়! আপনি তাহা হইলে অবগত আছেন যে দত্তসাহেব এবং তাঁর সারমেয়র প্রতি বসুসাহেব বিশেষরূপে বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন?”
অবলাকান্ত বিচারকের দিকে ফিরিয়া হাতজোড় করিয়া বলিতে লাগিলেন — “হুজুর, তাহার দুইদিন পরে দত্তসাহেব আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত – বসুসাহেবই নাকি টমের মৃত্যুর কারণ, আমাকে সাক্ষ্য প্রদান করিতে হইবে। ‘মুখবই’তে পলের চেয়ে টম্-কে বেশী লোক ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিয়াছিল, তাহাই নাকি বসু সাহেবের রাগের কারণ। আমি নাকি দেখিয়াছি ‘মুখবই’তে টমের মৃত্যুকামনা করিয়াছিলেন বসুসাহেব, অতএব আমি জানি যে পার্কে বিস্কুটের সঙ্গে বিষ মিশাইয়া বসুসাহেবই টমের দিকে ছুঁড়িয়া দিয়াছিলেন। তাহা খাইয়াই পরেরদিন টমের মৃত্যু ঘটে। আমাকে নাকি আদালতে এইপ্রকার বয়ান প্রদান করিতে হইবে।…
আমি কিছুই জানি না হুজুর। আমি বসুসাহেবকেও ভালো করিয়া চিনি না, দত্তসাহেবকেও ভালো করিয়া চিনি না। উহাদের সারমেয়দেরও জানি না আর কাহার সারমেয়কে যে বেশী লোকে ‘ভালো লাগিয়াছে’ বলিয়াছিল তাহাও জানি না। …হুজুর, আমি শুধু আমার নাম-ঠিকানা লিখিয়া জমা দিয়া ‘মুখবই’ খেলিতে গিয়াছিলাম – কারণ আমার সময় লইয়া আমি একা একা কি করিব বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। হুজুর, পাড়া-বেপাড়ার লোকে আমাকে ‘বন্ধু’ করিয়াছে বলিয়া আমার খুব আনন্দ হইয়াছিল। কিন্তু আমি এক্ষণে নাক মুলিতেছি কান মুলিতেছি হুজুর, অমন ‘বন্ধু’তে আমার আর প্রয়োজন নাই। আমি আর ‘মুখবই’ খেলিব না। আমি চলিলাম।”
এই বলিয়া, অবলাকান্ত কাঠগড়া হইতে নামিয়া হাঁটা দিলেন।
সাক্ষীর অভাবে মামলা ডিসমিস হইয়া গেল।
…
শকুন্তলা চৌধুরী
ডঃ শকুন্তলা চৌধুরীর জন্ম কলকাতায়, বড় হয়েছেন বি. ই. কলেজ ক্যাম্পাসের প্রফেসরস্ কোয়ার্টারে। পড়াশোনা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিয়ে এবং তথ্যবিজ্ঞানে পিএইচডি করার সূত্রে বিদেশগমন। কর্মসূত্রে বর্তমানে মিশিগানের বাসিন্দা। স্কুলজীবন থেকেই নিয়মিত লেখেন। সানন্দা, বাতায়ন, পরবাস, সাহিত্যকাফে, ঋতবাক এবং আরো বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস। শকুন্তলার লেখা গান ভিডিওতে পরিবেশন করেছেন শ্রীকান্ত আচার্য, রূপঙ্কর বাগচী, নচিকেতা চক্রবর্তী, কায়া ব্যাণ্ড।
প্রকাশিত গ্রন্থ পৃথা (ঋতবাক প্রকাশনী)।