প্রেম ও প্রতিবিম্ব
প্রেম এসে বলে তার নাম রৌদ্র,
এ কি কথা, সে তো মেঘের আড়ালে থাকে,
কেবল দুঃখের দিনে রামধনু হয়ে দেখা দেয়,
শুয়ে থাকলে বিষাদে সব রক্ত ঝরে পড়বার পরে
দেখা যায় সিঁড়ির পিছনে প্রেম কোনায় আঁধারে জ্বলে—
পুরোনো, ঠাকুরদার আমলের ঝুলকালিমাখা এক বাতি,
যাকে ফেলে দিলে কারোই আপত্তি হতো না,
কালো বিড়ালটা চিনে মাঝে মাঝে তার কাছে যেত—
আমি এত বোকা নই তাকে বিশ্বাস করব,
দুঃখের চাদর জড়িয়ে ফের শুয়ে পড়ি।
২
খর বায়ুস্রোতে মাঝে মাঝে বুদ্ধিমান হয়ে পড়ি।
রুদ্ধদ্বার খুলে যায়। নতুন অনেক কিছু জেনে যাই।
যেমন আমার বন্ধু প্রকাশের বাড়িতে আয়না নাই।
স্নানঘরে কেন দিনরাত জল পড়ে, আর তার মন
পড়ে থাকে অন্যখানে, বাড়ির পাশেই ছাপাখানা,
উলটো দিকে কাচের ফ্যাক্টরি, অপ্রকাশের সুযোগ
নাই, হয় বিদ্যা হয়ে সদা প্রকাশে কাতর হয়ে থাকো
অথবা কাচের কারখানায় ঘুরতে থাকো, সবখানে
যেন প্রতিফলিত, বাঁকছো, এক স্তর হতে অন্য স্তরে,
চন্দ্রকলায় ঘুরছো, ভাই প্রকাশ তথাপি কেন
কৃপণতা করে তুমি চুপ থাকো, কিছু বলছ না, কেন?
বৃষ্টি
বৃষ্টি শুরু হলে নানা ভয় মন চেপে ধরে—
কর্ণের রথের চাকাটা ভিজছে না তো জলে,
বনে যে আগুন পাতায় দেখেছি, তা কি নিভে যাবে?
ভাবতে ভাবতে আনমনে বের হয়ে যাই,
দেখি—পাশের বাসার সুদর্শনা লাল ছাতা নিয়ে হেঁটে যায়,
তাকে ঘিরে বাদকের দল বাজনা বাজায়, সে কাকে খুঁজছে,
(হয়তো আমাকেই), নানা স্থানে ইতস্তত কত বাদ্যযন্ত্র পড়ে আছে,
মেঘমল্লারের সুরই সবখানে ভাসছে, নিশ্চিত আজ কিছু দেখবই
কিছু দূর গেলে শস্যমাতাকে দেখব, মন ভালো হয়ে যাবে,
নিশ্চয় দেখব তার এক হাতে পাখি আর অন্য হাত হতে
শস্য জন্ম নিচ্ছে। বৃষ্টি আরো বাড়ুক, ভ্রমণপথে আরো
কত না-দেখা যে আজ দেখা হবে, ঘরে আর ফিরব কি?
২
বর্ষায় যে সুর বাজে তা লৌকিক গানের, যে
বাড়ি বাড়ি গিয়ে জেনে নেয় সুখ দুঃখের কথা,
নতুন বউটি তাকে বেড়ার আড়াল হতে বলে
স্বামী ভালোবাসে না, শাশুড়ি নিন্দামন্দ করে,
সাংবাৎসরিক খোরাকের টান আছে ঘরে,
দোকানে রঙিন টিভিতে সিনেমা দেখছে বড়োরা,
ছোটরা পাতার তির-ধনুক খেলছে সারা দিন,
সার্কাসের দল আসছে হাতির খেলা নিয়ে সামনেই,
দুর্গার খেলনাগুলি বাগানে তেমনি পড়ে আছে,
হাহাকার নিয়ে বায়ু বয়, বাত ব্যাধি বাড়ছেই।
মফস্বলে একদিন
নদী ঘুমায়, মাঝিপুত্রও ঘুমায়,
মালবহনের, রূপবহনের দায় কার?
দুপুরে গঞ্জের ঘাটে এসে একদম বোকা বনে গেছি।
হাটে কেনা নতুন সওদা—হাকিমপুরী জর্দার কৌটা,
মুন্সীগঞ্জের কাঁসার ঘড়াতে রাধা-কৃষ্ণ,
নকশিকাঁথাটায় নবাবি আমলের নারী
শুকপাখিটার সাথে কথা কয়ে যাচ্ছে,
একটা অসূর মূর্তিও ব্যাগটায় আছে।
রোদের তাপে নাকি জলের প্রস্তাবে
এরা জেগে উঠছে, তা বোঝার সময় কই,
আমাকে তো যেতে হবে কমলার কাছে,
তার জন্য কেনা তামাপাত্রটাও কাঁপছে,
আনাজ তরকারি, মসলার জন্যও চিন্তা কিছু হচ্ছে,
তবে জেগে-ওঠা যাত্রীদের পারাপারের ব্যবস্থা এখনি করতে হবে।
২
বাজারে সেলাইকলে রাঙা জামা তৈরি হয়,
বুড়া চৌকিদার রাতে কড়া পাহারায় রাখে।
ভোরে দেখি রোদ পরেছে সে-জামাখানি।
গায়েহলুদের সাজ কিনতে যে এলো বারোটায়,
তার কাঁধে এক ভাতশালিক বসেছে।
যে কন্যা বসল রাতে কলাপাতা, ধান-দূর্বা সাথে
হলুদের সাজ পরে,
তার রূপে উদীচীর সব আভা।
বিবাহ এখনো কিছু বাকি আছে।
রং
উত্তেজনায় কাঁপছি থরথর করে,
এবারে বসন্ত ততটা জটিল নয়,
গাছের সকল ডালে সরল ফুলেরা উঁকি দিচ্ছে।
সাদা রং চট করে বলবে না, ‘বুঝতে চাইলে রং,
অন্ধ হও, হাড়ের প্রদীপ নিয়ে যাও দেশে দেশে’।
লাল রং আয়নায় জ্বলে উঠে চোখ রাঙাবে না—
‘সাহসী হওয়ার চেষ্টা করো, রক্ত দাও’।
নীল ফুলগুলো কাঁদাবে না, হেসেই বলবে
‘আকাশের নীল নিয়ে গঠিত মানবমন,
সুদূরতার গান আর নীল বিষে ভরা’।
খামারে, বাগানে নানা প্রশ্ন নিয়ে যাব—
অস্তিত্ব, রঙের স্বাধীনতা, জবা ফুলের হিংসা
জেনে যাব এবার এমন আরো কত কী!
২
কিছু রং প্রতিদিনকার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখে জাত।
রবীন্দ্ররচনাবলির মলাটে একটা কচুরিপানার নীল
ফুল দেখা যায়, তার গান হতে জন্ম এর। উপহার
হিসাবে তোমাকে দেয়া প্রতিটি সামগ্রী আমি কিনে
আনি যে দোকান হতে, তার জানালা দিয়ে
ঈশ্বর দেখেন, চোখে হীরাপান্না জ্যোতি।
পদ্য
দাসেরে মনে রাখো মা, রাখো কচু পাতায় পানি,
মন দেশে রেখে বিদেশে পাঠাও দেহখানি;
খাটুক, কর্মের চেয়ে খাঁটি ধর্ম কোথা আছে,
বানাক সড়ক, সেতু দিয়ে মহামতি কত গেছে।
বল কম নয়, ছেলে ছন্দ কিছু কম জানে,
ধর্ম ও অধর্ম বায়ু বুক ভরে খুব করে টানে;
রাখো তাকে বেঁধে ভোরে ডালিমগাছের তলে,
চুরি করে রস খায়, তবু সত্যি কথাটাই বলে।
তাকে ছেড়ে দাও, যেখানে যাবার যাক,
পাথরে ফুটেছে যদি ফুল, তাকে খুঁজে পাক,
তবু রেখো না পর করে, অক্ষরে ভরসা করে
লিখুক না, ক্ষতি কি যদিও সাঁকোটা খুব নড়ে।
… …
কবি শিবলী সাদিক
কবি শিবলী সাদিকের জন্মস্থান স্বল্পমারিয়া, কিশোরগঞ্জ । শিক্ষা: বুয়েট (ঢাকা) ও য়ুনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, আমেরিকা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: জলকুমারীর প্রত্যাদেশ; অধিবিদ্যার ময়ূর; আলোকবর্ষ জুড়ে স্মৃতি এবং স্বরলিপি ও বাতিঘর ।