বজ্রসহ দুই ঘণ্টা ধরে বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজ বধির করে দিচ্ছিল সোফিয়াকে। এমন বৃষ্টি দেখে কোন কৃষক হয়তো এই মুহূর্তে খুশি মনে গাইতেন, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে!’
কিন্তু সোফিয়া কম্বলে শরীরটা পেঁচিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে। ভাবছে, যাকে সে কয়দিন আগে ধাক্কা মেরে ফেলে আসলো, তার গভীর কণ্ঠস্বর এবং তার গাঢ় হাস্যরস কেন সে মিস করছে? কেন মনে হচ্ছে সে আশেপাশে এখানেই কোথাও আছে! বৃষ্টির শব্দের সাথে মিহিস্বরে সে তার কথা শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে আর তার মুখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জলগড়িয়ে পড়ছে। সে তার গলায় ভোঁতা ছুরির শীতলতা অনুভব করছে এবং শুনতে পাচ্ছে একটি গভীর কণ্ঠ ফিসফিস করে বলসে,
‘অবশেষে আমার অভাব বোধ করলে?’
জানালার পাশে বিছানা থাকায় বাতাসের তীব্রতায় জলের ছিটে এসে সোফিযার মাথায় পড়তেই সে হুঁশ ফিরে পেলো। কী আবোল-তাবোল ভাবছিল! ডানে বায়ে তাকিয়ে দেখলো, নাহ! কোথাও কেউ নেই। কিছু নেই।
শুধু বাইরে থেকে একটা সুগন্ধ আসছিল। গন্ধটা শুঁকে সোফিয়া ভাবতে লাগলো, এর কী নাম দেয়া যায়?
বহুবছর আগে দাদি গত হবার আগে সোফিয়া জেনেছিল, আসলে বৃষ্টিদিনে মাটির সোঁদাগন্ধ বলতে আমরা যা জানি, তা মূলত মাটির নিজস্ব গন্ধ না।
সোফিয়া বলেছিল, তাহলে?
দাদি বলেছিলেন, এই গন্ধটাকে বলে পেট্রিকোর। ইসাবেল জয় বেয়ার এবং রিচার্ড থোমাস ১৯৬৪ সালে এই নামটা বের করেছিলেন। গাছের শুকনো পাতা থেকে একরকম তেল বেরিয়ে এসে তা মাটিতে মিশে থাকে। বৃষ্টি পড়লে সেটারই গন্ধ আমরা পাই। আরো একটা কারণ আছে, এ্যাক্টিনোমেসিটস্ নামক ব্যাকটেরিয়া যখন মাটিতে জিয়োযমিন উৎপাদন করে, তখনো বৃষ্টিএলে আমরা সেটার গন্ধ পাই।
সোফিয়া বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, দাদি! ইসাবেল জয় বেয়ার আর রিচার্ড থোমাস কে, তুমি জানো?
দাদি মুখ গোমরা করে বলেছিল, নাহ!
অস্ট্রেলিয়াল সাইনটিস্ট-ক্যামিস্টদের সম্পর্কে জানা না থাকলেও ক্লাস সিক্স পাস করা দাদি তাঁর নাতি-নাতনিদের কাছ থেকে টুকটাক অনেক কিছুই শিখতে চাইতো। সেটা-ই বা কম কী? বরং শেখার জন্য জানার জন্য প্রশংসা করা যায়। কিন্তু সোফিয়া সেদিন দাদিকে নিরুৎসাহিত করেছিল। কষ্ট দিয়েছিল। এর সপ্তাহ খানেক পরেই দাদি বার্ধক্যজনিত রোগে গত হন। হয়তো দাদি মনে কষ্ট নিয়েই বিদায় নিয়েছেন—এই ভাবনাটা সোফিয়াকে বেশ পীড়া দিতো, এখনো দেয় হুটহাট।
সোফিয়ার গা ঘেঁষে শুয়ে থাকা বিড়ালটা এবার নড়েচড়ে উঠে বসলো। ওর নাম সিফি। দিনের আলোতে সব ঠিকঠাক থাকলেও রাতের আলোতে তার যত সমস্যা। রাত হলেই চোখের অক্ষিপটে রড কোষের সংখ্যা সম্ভবত কমে যায়, তাই অন্ধকারে সিফিভালো দেখতে পায় না। সন্ধ্যা নামতেই চোখের তারারন্ধের পুরোটা না খুলে পিটপিট করে তাকায় আর সোফিয়ার গা ঘেঁষে থাকে।
আজ তার তাকানো কিছুটা অস্বাভাবিক। সে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে—সোফিয়ার দিকে নয়, তার পিছনে। সোফিয়া ধীরে ধীরে তার মাথাটা পিছনের দিকে ঘুরালো। পিছনে তাকাতেই তার চোখ স্বাভাবিক আকার ছেড়ে টার্সিয়ার্স এর মতো নড়াচড়া বন্ধ করেদিলো। বলা যায় বরফ টুকরোর মতো স্থির হয়ে গেলো। তারপর সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
সেকি! তুমি?
হ্যাঁ! অবাক হচ্ছো কেন? তোমাকে দেখতে এলাম।
বলেই রজত বিছানার পাশের চেয়ারটিতে বসলো। তার হাতে তখন সেই গাঢ় টলটলে কফির কাপটি ধরে আছে; যাতে শেষবার চুমুক দিয়েছিলো দু’জনে মিলে। সেই একই সাদা রঙা ‘Milena Face Mug’, যাতে আছে গোল গোল দুটো চোখ আর সরু একটি নাক। এই কফি কাপটি রজতের খুব পছন্দ ছিলো। সে বলতো, মিলেনার আকৃতির সাথে সোফিয়ার চেহারার বেশ মিল আছে।
– তুমি কেমন করে এলে? সোফিয়ার ঘোর তখনো কাটছে না।
-আমি বাসে চড়ে এসেছি।
-কিন্তু আমি তোমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম। ট্রেনটি দ্রত গতিতে চলছিল।
-সোফিয়া। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি জানো।
-কিন্তু আমি যে তোমাকে ধাক্কা দিলাম?
-তেমন কিছুই হয়নি। উঠো। আমরা ঘুরতে যাই।
-আমি এখন আর বাইরে বের হই না। ওরা আমাকে আটকে দিবে। তুমি জানো না, ওরা ফিসফিস করে বলছে, তোমাকে আমি ধাক্কা মেরেছিলাম। তারপর ট্রেনটা চলে এলো। এরপর তুমি তিন টুকরো হলে।
-সোফিয়া! আমি জানি সব। কিন্তু বলো তো, তুমি আমাকে শেষবার দেখলে না কেন? আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম—জানো তো!
-আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। রক্ত ঝরছিল। তুমি পড়ে ছিলে তিন খানে। আমি তাকাতে পারছিলাম না। তারপর কী হলো আমি জানি না। সত্যি কিছু জানি না।
সোফিয়া এবার কম্বলে শরীরটা আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো। তার কপাল, কান, ঘাড় বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। এমন করে শরীর কাঁপছে যেন মস্তিষ্কের থার্মো রেগুলেটরি সেন্টার তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে। সোফিয়া অস্থির চোখে চারদিকে দেখছে! সিসি তখনো তার গা ঘেঁষে নড়চড়া করছে। কিন্তু কী অদ্ভূত! রজত তখনো হাসি হাসি মুখে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সে তাকিয়ে দেখছেও না তার প্রিয় সোফিয়া কেমন করে বিছানায় দাপাচ্ছে! মৃত মানুষের কী অনুভূতি উপলদ্ধি থাকে? নাহ থাকে না। তবে সে কেমন করে এখানে এলো? এত কথা কী করে বলছে?
সোফিয়ার সমস্ত শরীর এবার অস্বাভাবিক রকমের ঝাঁকুনি দিতে শুরু করেছে। মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্সের স্নায়ুকোষগুলো অতিরিক্ত ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে শুরু করেছে। সোফিয়া সিসিকে খামচে ধরতেই মিউ মিউ শব্দ করে সিসি দৌড়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। সোফিয়া কিছু একটা খামচে ধরার চেষ্টা করছে! কিন্তু চারদিকে সব শূন্য, ঘরের কোন আসবাবপত্রও তার নজরে পড়ছেনা। কোথায় গেল সব? ড্রেসিংটেবল, চেয়ার, বুকসেল্ফ…কিছু নেই ঘরে। রজত! সেও নেই! সেই Milena Face Mug-সেটা কেবলপড়ে আছে মেঝেতে। সেই কাপ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে!
এবার তার বিছানা দুলতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে যেন বিছাটা দুলতে দুলতে এক সময় জানালা দিয়ে বেরিয়ে আকাশে উড়তে শুরু করবে। সোফিয়া ডাকছে…. সিসি! সিসি! বিড়ালটির কোন শব্দ নেই। ডাকছে, মা মা! কারো কোন শব্দ নেই।
হুট করেই সোফিয়া একটা গর্তে ঢুকে গেল। এই গর্তমুখের পরিমাপ কত হতে পারে? ১০০ মিটারের ও বেশি? এই কী সেই ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত’-—গর্ত?
সোফিয়া আর ভাবতে পারছে না। ধীরে ধীরে এবার তার শরীর শিথিল হতে শুরু করেছে! সমস্ত কাঁপুনি ঘাম যেন ক্লান্ত হয়ে আসছে! সোফিয়ার ঘুম পাচ্ছে খুব! খুব খুব খুব……!
সাদা চাদরে ঢাকা শরীরটা নড়ে উঠতেই ডাক্তার বলল, She is ok now! মিস আখতার মেয়ের পাশে বসেছিলেন। তিনি মাথা নাড়ালেন। ডাক্তার জানালেন, কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। কোন চাপ নেয়া যাবে না।
ডাক্তার ফিরে যেতেই মিস আখতার মেয়ের আরো কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে বসলেন। তারপর মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুলে বিলি কাটতে লাগলেন। ভাবতে লাগলেন, সেই ছোট্ট সাহসী দুরন্তপনা শিশু সোফিয়া হঠাৎ কেমন শান্ত হয়ে গেলো। সেই দৌড়ঝাঁপ, হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়া, সপ্তাহের শেষে শপিং-সিনেমা, কোন কিছুতেই উদ্যম নেই আর। এ যেন এক ভিন্ন সোফিয়া, যাকে দেখে রোজ মন ভারাক্রান্ত হয়, বিষাদে মন ছেয়ে যায়।
অথচ গতকাল তাকে একটা খুশির খবর দিবে বলে দৌড়ে বাড়ি ফিরেছিল মিস আখতার উকিলের কাছ থেকে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই পিলে চমকে গিয়েছিল সোফিয়াকে মেঝেতে দাপাতে দেখে। সে সময় যদি তিনি ঘরে না যেতেন, তবে কী হতে পারতো- তা ভাবলেই বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে তার।
হ্যাঁ! সোফিয়াকে বলতে হবে আজ, ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনে দাঁড়িয়ে রজত যে সোফিয়ার সাথে গলাগলি করে হাঁটতে হাঁটতে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিল, তার অস্পষ্ট ফুটেজের সাথে আরো দুইজনের সাক্ষি পাওযা গেছে। কাজেই সোফিয়া এখন স্বস্তিতে ঘুমাতে পারে।
এই দুর্ঘনার পর সোফিয়াকে নিয়ে মিস আখতারের গত নয় দিন, কী যে ভীষণ ভয়, আতঙ্ক আর কষ্টে কেটেছে! একটা রাতও ঘুমাতে পারেননি তিনি। চারপাশের ফিসফিস আওয়াজ তার কানেও এসেছে। সত্য কি মিথ্যা—এমন আওয়াজ ভয় জাগায়, বিপদডেকে আনে। সে ভয় কোনো না কোনো ভাবে মিস আখতারের ভেতরও হুঙ্কার তুলেছে।
সেফিয়া! ভাবনার ছেদ কাটিয়ে মিস আখতার ডাকলেন। সোফিয়া চোখ দুটো খুলে তাকালো মায়ের দিকে।
-কেমন লাগছে মা?
-আই এ্যম ওকে মা। সোফিয়া খুব স্বাভাবিকভাবে বলল। এরপর সোফিয়া সামান্য আড়মোড়া দিতে দিতে ওপাশ ফিরে ডান কাৎ হলো।
মিস আখতার লক্ষ্য করলেন, সোফিয়া তার পাশের চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে। অবাক হয়ে তিনি মেয়ের আরো কাছে গেলেন। দেখলেন, মেয়ে তার খালি হাত মুঠো করে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করছে। তারপর মুখের সামনে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটি ধরে চুমুক দেবার চেষ্টা করছে—যেন তার প্রিয় কপির কাপটিতে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে।
অথচ, চেয়ারটি খালি। সোফিয়ার হাতে কিছু নেই।
মিস আখতার খপ করে ধরে সোফিয়াকে ওপাশ থেকে এপাশ ফিরালেন। সোফিয়ার চোখ আবারো স্বাভাবিক আকার ছেড়ে অস্বাভাবিক হচ্ছে—টার্সিয়ার্স এর মতো নড়াচড়া বন্ধ হচ্ছো। মিস আখতার চিৎকার করে ডাক্তার—নার্সদের ডাকতে লাগলেন।
সোফিয়া হাসছে। সে এখনো মিলেনা ফেইস মগ-টি ধরে আছে।