অক্টোবর-সন্ধ্যা সত্যিই কিছু অতিন্দ্রীয় অনুভব বয়ে নিয়ে আসে। একটা তরতাজা আড্ডার বিকেল শেষে আমরা ভাবছিলাম নানা অনুষঙ্গ ভেদ করে একজন প্রকৃত কবির সাক্ষাৎ পেতে। যিনি বহুশ্রুত বহুপঠিত বা বহুচর্চিত নন অথচ যাঁর শক্তিশালী কবিতা একইসাথে সমসাময়িক এবং পাঠকমননে রাখে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। আমরা মানে প্লাটফরম নামে কবিতা পাঠের আসর শুরু করতে যাওয়া তিন কবিতাবন্ধু— শাহনাজ নাসরীন, সাকিরা পারভীন এবং সাবেরা তাবাসসুম। আমাদের অনুসন্ধান জারি ছিল তাঁকে খুঁজে বের করার। অবশেষে আমরা তাঁকে পেলাম। পর্যাপ্ত চা আর কুকিজের অসংখ্য গুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে, যার যার পাঠের পরিসর ঘাঁটতে ঘাঁটতে। তিনি কবি রুবী রহমান। বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে লিখছেন কবিতা, নানা সাহিত্য আড্ডা এবং কবিতার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন নিয়মিত এবং যার মৌলিক একক কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা তখন পর্যন্ত দুই। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাঁর একমাত্র পুত্র ইসলাম তমোহর এবং জীবনসঙ্গী কমরেড নূরুল ইসলাম। এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর প্রায় থমকে যাওয়া জীবন আবার শুরু করার চেষ্টা করছেন একমাত্র কন্যা মৌটুসী ইসলামের হাত ধরে। এই যাপন প্রক্রিয়ায় সঙ্গত করে গিয়েছে কবিতা ও রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। কবি রুবী রহমানকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলো, বলা যায়, সাকিরা পারভীনের লাগাতার প্রয়াসের জন্যে। ২০১৪’র ২২ নভেম্বর শাহনাজ নাসরীন, সাকিরা পারভীন ও সাবেরা তাবাসসুম তাঁকে নিয়ে কবিতা পাঠের আসর সাজাতে সমর্থ হলো অবশেষে।
তখন হেমন্ত এসে গেছে। শংকায় আচ্ছন্ন আমরা। কবিকে, কবির কবিতাকে যথার্থ মর্যাদায় উপস্থাপন করতে পারব কিনা সেটা মূল ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুশকিল হলো আমাদের আন্তরিকতায় ঘাটতি না থাকলেও প্রস্তুতিতে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। প্রথমত তাঁর কবিতাগ্রন্থ বাজারে সুলভ নয় একেবারেই। দ্বিতীয়ত ভয়াবহ ব্যক্তিগত দুর্যোগে তাঁর নিজের কাছে সংরক্ষিত কপিগুলো কোথায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কে জানে। তবু এই এলোমেলো ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় তিনি প্রায় উটকো এই ঝামেলাকে হাসিমুখে মেনে আমাদের জন্যে তাঁর দুটিমাত্র মৌলিক গ্রন্থ খুঁজে দিলেন। প্রস্তুতি নিতে তাঁর দুটো একক কাব্যগ্রন্থ যে জীবন ফড়িঙের এবং কান পেতে আছি, মৌমাছি’র জেরক্স কপি করিয়ে নিলাম। বলা বাহুল্য সেই প্রথম তাঁর কবিতার সাথে আমার নিবিড় পরিচয়।
২২ নভেম্বরের সেই অনুষ্ঠানটিতে তাঁকে পেয়েছি আমরা। তাঁর পাঠ, কবিতা নিয়ে তাঁর ভাবনা, দৈনন্দিন খুঁটিনাটি যাপন কী করে কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে— এসবের সাথে খানিকটা পরিচয় হয়েছিল। বলা যায় এর ভেতর দিয়ে তাঁর কবিতাকে পাওয়া শুরু হলো আমার। তারপর কবিতার প্লাটফর্মের সূত্রে তাঁর সাণ্ণিধ্য পাওয়ার সুযোগ ঘটেছে আরো। টের পেয়েছি, একজন সাধকের মতো জীবনকে দেখার তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী। দেখেছি বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রয়াস। এই লেখাটিতে দুঃসাহস করেছি বলা যায়। কবি রুবী রহমানের কবিতাকে যতটুকু অনুভব করতে, চিনে উঠতে পেরেছি, তার ভিত্তিতে তাঁর কবিতার পৃথিবী উন্মোচন করার প্রয়াস নিয়েছি। বেছে নিয়েছি তাঁর প্রথম একক মৌলিক গ্রন্থ ‘যে জীবন ফড়িঙের’। বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাই রুবী রহমানের কবিতাভুবনে।
যে জীবন ফড়িঙের
লিখছেন ষাটের দশক থেকে। কিন্তু একক কবিতার বই সাকুল্যে তিনটি। গড্ডালিকায় ভেসে ‘প্রোডিউস মোর, প্রোডিউস রাবিশ’-এর ঝাণ্ডা উড়িয়ে চলাদের কাতারে তিনি নেই। বলা যায় প্রায় সত্তর বছরের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিঃসঙ্গ তৈলচিত্রের আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর কবিতায়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে যা বিরল। প্রথম বই যে জীবন ফড়িঙের। প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। কতটা প্রস্তুতি আছে এ বইটির জন্যে, একবার ভাবুন। ষাটের দশকে যখন লেখা শুরু করেছেন সেই সময়কার কিছু কবিতাও মুদ্রিত আছে এখানে। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে লেখা কবিতাগুলো ঠাঁই পেয়েছে এ বইটিতে। আসুন, পাঠ করি আমার পছন্দের কিছু কবিতা ও সেগুলো নিয়ে আমার ভাবনা।
সত্যিই কি কবি মানুষের জীবন যাপন করেন? জীবনকে দেখার শত শত চোখ নিয়ে তার যন্ত্রণাবিদ্ধ প্রাণ। ভবিতব্যের চোখে চোখ রেখে ফড়িঙের মত পেছন-ডানায় উড়তে পারেন অনায়াসে স্মৃতিনিষ্ঠ বনভূমির দিকে। এ কি বর না অভিশপ্ত মোহরের খাজানা? এক জীবনে কবিও তা জেনে যেতে পারেন কিনা সন্দেহ। রুবী রহমানের প্রথম কবিতাগ্রন্থ যে জীবন ফড়িঙের। এতে মুদ্রিত রয়েছে তিন দশকের বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতা। কবিতাগ্রন্থটি কয়েকটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ— প্রথমত, তিনটি দশকে বাংলা কবিতার বিষয়বস্তু এবং সেগুলোকে ঘিরে কবির ভাবনা, চিন্তার ক্রমরূপান্তরের সাথে পরিচয় ঘটে পাঠকের। দ্বিতীয়ত, এর সাথে সাথে কবিতার বাঁক বদলগুলোও অবলোকন করা যায়। তৃতীয়ত, দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় কী করে কবিতা হয়ে ওঠে নারীর অনন্য অভিজ্ঞতার আলোকে সেটাকে দেখতে পারা। লেখালেখির শুরুতে কবিতাকে ঘিরে কবির যে চিন্তা-ভাবনা থাকে তা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়। সেটিকে পর্যবেক্ষণ করতে পারাটাও চমৎকার ব্যাপার।
রুবী রহমান বাংলা কবিতা লেখা শুরু করেছেন ইতিহাসের উত্তাল সময় বিশ শতকের ষাটের দশকে। দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় চলছে তখন। দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব নিজের ক্ষত সারাই করবার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত। প্রায় দুশো বছরের শাসন থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া ভারতবর্ষের চেহারা আরেকটু আলাদা। দগদগে ঘা-এর মতন র্যাডক্লিফ-রেখা বুকে নিয়ে বেঁচে ওঠার সংগ্রামে ব্যস্ত দুটো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। বাংলা খাবি খাচ্ছে এপারে ওপারে। এ দিকে ইউরোপ আমেরিকা প্রযুক্তির জয়যাত্রা, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, নারীমুক্তির আন্দোলন ও নানা মাত্রার শিল্প আন্দোলনে মাতোয়ারা। এমন প্রবল সময়ে বদলে যাওয়ার মুখে পড়ছে পূর্বনির্ধারিত ধ্যান-ধারনা, নিয়ম-কানুন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যেতে চাইছে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজ। পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যের কব্জায় থাকা শিল্প-জগত পেতে শুরু করেছে নারীর মননশীলতা ও আবেগের পরিচয়। কবি রুবী রহমান ও তাঁর কবিতা এই সময়ের সাক্ষী। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, রুবী রহমানের কবিতা সেই উত্তাল সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া উচ্চকিত সংগীত নয়। সদ্য যুদ্ধপীড়িত দেশের কবিরা আবেগের বাঁধ খুলে দু’ হাতে লিখছেন যেখানে, সেখানে তিনি আবেগের মুখে লাগাম টেনে দিয়েছেন। কবিতায় তিনি বরাবরই ভীষণ পরিমিত ও মিতবাক। হতে পারে ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা তাঁকে আবেগের শাসনে সহায়তা করেছে।
বলা যেতে পারে আধুনিক ইংরেজি কবিতার চরিত্রের মৌলিক গুণগুলোর অনেকটাই তাঁর কবিতায় দৃশ্যমান। যেমন ধরুন তাঁর লেখায় ভাবাপ্লুত হওয়ার বিষয়টি দূরেই থেকে গেছে। বিষয়বস্তু নির্বাচনে তিনি যথেষ্ট বিশদ। আবেগের লাগামও তিনি টেনে রাখতে জানেন। কোনো কিছু নিরীক্ষণ করার সময় খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হয়েছেন । এর পাশাপাশি একটা একাগ্র দৃষ্টি লক্ষ্য করা যায় কবিতায়। বিষয়বৈচিত্র্য একটা বিশেষ গুরুত্ব রাখে তাঁর কাজে। শব্দার্থ, দ্যোতনা, ধ্বনি, গঠন সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সতর্ক। ব্যক্তিজীবনের মতো কবিতায় তিনি মিতবাক, মিতব্যয়ী, অলংকার বর্জিত। বাইরের মেদ ছেঁটে ফেলার পক্ষপাতি তিনি। উচ্চকিত নন কোনো চূড়ান্ত মুহূর্তেও।
এবার তাঁর কবিতাকে পেশ করা যাক। শুরুতেই বলেছি দীর্ঘ সময়ের কবিতাযাপনে কবির ভাবনা চিন্তা ও কবিতার বাঁক বদল চোখে পড়ে নিবিড় পাঠকের। শুরুর দিককার কবিতার দিকে তাকাই একটু। ধরুন ১৯৬৬ সালে লেখা এই কবিতাটির কথা—
হাওয়ার খেলা মর্মে দিলি
দানের মতো ছবি;
অশেষ দূরের অসম্ভবে
কুটিরে প্রেম-সুখ।
ব্যর্থতা তুই বাজুবন্ধে কি আশ্চর্য চাবি!
হাওয়ার খেলা ছিনিয়ে নিলি
যাত্রাপথের ব্যথা,
আকাশ গৃহ ধুলোয় ধুলো
প্রশ্নেরই প্রলয়ে।
বেদনা তুই বেদনাতে লণ্ঠন জ্বালাবি?
(হাওয়ার খেলা, ১৯৬৬)
ভাবনার সুতোয় হাওয়ার দোলাচলে কবির আপ্লুত মনে বেদনাতেই বেদনার আলো জ্বালাবার মতো নরম স্পর্ধার একখানা ছবি পায় পাঠক। কবিতাযাত্রার অনাগত উদ্বেগ ও আশা মিশে আছে যেন প্রতি ছত্রে। জীবনের কষাঘাত তখনও খানিক অজানা এই কবিতার কাছে। এর প্রায় দশ বছর পরের কবিতায় বিষয়বস্তু হয়ে আসে কবির জন্যে নির্ধারিত উপেক্ষিত অকেজো জীবন। এক নিরেট বাস্তব।
যদি ক’টা টাকা পেয়ে যাই আমি কবিতা লিখে
বেশ হয়, তবে বেশ হয়;
পাল্টানো যায় মরা গাছে ঝরা পাতার মতন
তোমার প্রাচীন পাৎলুনখানা। সামলানো যায়
ছেলেটার ইশকুল-বিষয়ক খরচা ফি-সন
বেঁচে থাকবার উদযোগ ভুলে হঠাৎ করে
স্বপ্নের স্ট্রীটে যাওয়া যায়।
যদি কিছু টাকা পাওয়া যেত আহা কবিতা লিখে
বেশ হতো, হতো ভালো বেশ
বাজার হিশেবে ঝরতো আবার স্বস্তির সোনা
সংসার হতো ছিমছাম বেশ। ভিক্ষা দিতুম
বেগনি মেঘের হাত-পা-ছড়ানো খুশি ছকে-গোনা
তোমার-আমার জীবনকে মহা আড়ম্বরে
ভিক্ষা দিতুম অনিমেষ।
(যদি ক’টা টাকা, ১৯৭৫)
হতভাগ্য কবির জীবনকে মহার্ঘ্য করে তুলতে কবির এ রসবোধ। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রাজনৈতিক বাতাবরণ ঘোলাটে হয়ে এসেছে সে সময়ে। সাধারণের জীবনে যে অনিশ্চয়তা বাসা বেঁধেছে কবির জীবন তার বাইরে নয়। কষ্টক্লিষ্ট জীবন একটু বাড়তি উপার্জনের কথা ভাবেন প্রিয়তম কবিতার বিনিময়ে। যা কিছুতেই বিনিময়যোগ্য নয়, কবি করতে চাইছেন তারই সওদা! এর প্রায় আট বছর পরে লেখা কবিতায় চোখে পড়ে নিয়ত যুদ্ধমগ্ন জীবনের সারকথা—
একটিমাত্র জীবন আমার হাতে।
অর্ধেকেরও বেশিটা তার খরচা হয়ে গেলো
অপর অর্ধ নিয়ে এখন বল কোন সাহসে
মূর্খ জুয়ায় ছড়াই এলোমেলো।
‘জুয়া মানেই মূর্খ জুয়া’— শুদ্ধ হিতবাদ
অষ্টপ্রহর অনন্যোপায় পাহারাতে রাখে;
একটি তুচ্ছ ভোরের দোয়েল স্বপ্ন-মাখা চোখে
মাটাডোর-এর রুমাল নেড়ে ডাকে।
(একটিমাত্র, ১৯৮৩)
কবিতার গভীরে চোখ রেখে দেখি, হিতবাদ একটি নৈতিক তত্ত্ব। এতে বলা হয়, যুক্তিবাদী মানুষ তার সামাজিক বিষয়সমূহ নিয়ে সচেতন। যে বস্তু বা আচরণ বা নীতি বা সিদ্ধান্ত তাকে বেদনা বা যন্ত্রণা দিতে পারে বা দেয় বলে সে মনে করে তাকে সে এড়িয়ে যায়। আর যা তাকে আনন্দ দেয় বা দিতে পারে তাকে সে গ্রহণ করে। হিতোবাদ মনে করে দুঃখ বা যন্ত্রণাদানকারী কোনো বিষয় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে বাধ্য করা নীতিবিরুদ্ধ কাজ। তাই সামষ্টিকের জীবনে যা কল্যাণকর, সেটিকেই সমর্থন করার পক্ষে দাঁড়ায় মানুষ। এই মতবাদ অনুযায়ী মানুষ আদর্শের চেয়ে বাস্তবকে অনুসরণ করে বেশি। যদি তাই হয় তবে নিয়মঘনিষ্ঠ কবির জীবনে একটি ভোরের দোয়েল স্বপ্ন মাখা চোখে ডাকে ঠিকই তবে তার হাতে থাকে ম্যাটাডোরের রুমাল। বর্শার তীব্র ফলায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়ার আগে সে শোনায় মধুর শিস। জীবনকে দেখার এই অনুপম দৃষ্টি পাঠককে অভিভূত করে নিশ্চয়ই।
পর পর দুটো কবিতার উল্লেখ করব এবার। এক অনঙ্গজীবনের দ্বৈরথ হাজির প্রথম কবিতাটিতে। কবিতা কী করে কাটে প্রতি পলে, কী ভয়ংকর শুশ্রুষার অতীত সেইসব ক্ষত! শব্দের বিছানা জুড়ে জেগে থাকা হাঙরের দাঁত তবু কবি বলে যেতে পারেন— “তোমার অমল মুখে হাসিটুকু জেগে থাক সমাপ্তিরহিত।” জীবনের এই যেন পরম মন্ত্র।
তুমি এসো। তুমি এলে আমি
তোরঙ্গে তুলে রাখবো শব্দের বিছানা;
এতো নয় কোমল মখমল, নয় নরম বিশ্রাম—
শব্দের বিছানা জুড়ে জেগে থাকে হাঙরের দাঁত
অহং ও অপমান দুই প্রান্তে বসে টানে শাঁখের করাত।
তুমি এলে ভুলে থাকবো এই রক্তপাত
অপমানে কালো গৃহ আলোয় ভরাবো
গোলাপ না আনো যদি আক্ষেপ করবো না;
দাহ ও দুঃখের শত হাত দূরে রাখবো তোমাকে
কৃপণ শিশিরে যদি ক্যাকটাস ফোটে তো ফুটুক
তোমার অমল মুখে হাসিটুকু জেগে থাক সমাপ্তিরহিত।
(তুমি এলে, ১৯৮৬)
দ্বিতীয় কবিতাটির দিকে তাকাই। সভ্যতার হাজার কারুকার্যময় ছবি বিধৃত থাকে সময়ের পর্দায়। এক একটি ধাপ মোচড়ে মোচড়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে পৃথিবীতে জীবনযাপনের সূত্রগুলো। নিওলিথ সভ্যতায় মানুষ হাতিয়ারের পাশাপাশি ফলাতে শিখেছে শস্য, তৈরি করতে শিখেছে পোশাক, অলংকার। যুদ্ধের শিকারের জীবনে প্রবেশ ঘটেছে উদ্বৃত্তের, সাজসজ্জার, গোত্রপতির, অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার। ইতিহাসের পথে চক্রে চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে প্রদর্শনী শেষে কবি জানেন তিনি নিমিত্ত মাত্র। এতকিছু যাকে বলবার, দেখানোর, সে যেন খুব সাধারণ। ধুলোমাখা স্রেফ অন্নভূক একজন। সভ্যকার নানা ভুলচুকের মত এও এক নিদারুণ ভুল! পরিমিত শব্দে সারকথা বলে দিলেন কবি আবারো।
আমাকে দেখালে তুমি দিগন্তের অগ্নিবর্ণ মেঘ
মোমের আলোয় কনফুসিয়াস বলছেনঃ ওঁম শান্তি ওম…
ব্যাবিলনে জ্বলে উঠেছিলো কত নিওলিথ রাত
মেসোপটেমিয়া থেকে ছুটে গেছে অশ্বারোহী সাহসী মানুষ
নৈঋতের কোণ থেকে যে বাতাস ফুঁসে ওঠে তার খুঁটিনাটি
সভ্যতার কোনখানে মানুষের কত ভুলচুক
একবারও দেখলে না, আমি এই পৃথিবীর সামান্য মানুষ
লাল ধুলো পায়ে রোজ ঘরে ফিরি, স্রেফ অন্নভূক।
(আমাকে তুমি, ১৯৯০)
শুরুর দিকে বলেছি, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কবিরা লিখেছেন অসম্ভব আবেগে উজাড় হয়ে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রুবী রহমান তাঁর স্বদেশ ভাবনাকে কবিতায় এনেছেন সংযত ভাষায়। রাজনৈতিকভাবে সচেতন একজন সৃজনশীল মানুষ কী ভাবেন তার স্বদেশ নিয়ে সেটি দেখা যাক এবারে—
কি তুমি স্বদেশ!
আশৈশব মগজের কোষে বেড়ে-ওঠা স্বপ্ন লতাগুল্মময়
বাবার বিমল বাহু প্রেমিকের হিরণ্য বিশ্বাস
স্বদেশ তুমি কি ওই বর্ষীয়ান মজুরের রক্ত-ওঠা চোখ
ন্যুমার্কেটের মোড়ে মোট-বওয়া শিশুটির ঘাম
তার ফুটো পকেটের নিষ্পাপ মার্বেলে বেজে ওঠা ভায়োলিন?
বস্তির খিস্তিতে মেশা প্রান্তরের ফসলের শিস,
ক্রাচে-হাঁটা সৈনিকের চোখের ধূসর অবসাদ—
গাওঁ-ছুট্ রাখালের হারানো ব্যাকুল বাঁশি তুমি?
স্বদেশ কি তুমি বলো! তুমি এই বিশ শতকের
সারা গায়ে লেপ্টে থাকা দগদগে লাল কালো দ্বিধা
নাকি তুমি এশীয় সূর্যের নিচে একমাত্র বিশ্বাসের ভিত
আমাদের। দ্বিধা দ্বন্দ্বে মেশা এই কুরুক্ষেত্র জুড়ে
এই পচা হাজা চোখে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে
ভালোবাসা, স্বদেশ, তুমি তো ভালোবাসা!
(স্বদেশ, ১৯৮০)
লক্ষ্য করি, দেশভক্তির কোনো গদগদ কবিতা লেখেন নি কবি। তাঁর কবিতার এই পরিমিতি বোধ আমাকে ভীষণ টানে। দেশের আপামর জনগণ যারা সচল রেখেছে জীবনের চাকা তাদের রক্তে ঘামে ত্যাগে লড়ে যাওয়ার নৈমিত্তিক চেহারাটা তুলে ধরেছেন কবিতায়। বিশ শতকে দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ আর ধ্বংসের ভেতর নতুন জীবনের স্ফূরণ, নতুন মতবাদ, আন্দোলন। এক নবজাগরণের আভাস আর তার ভেতর দ্বিধার জেগে থাকা কাঁটা। এইসব প্রবল দ্বন্দ্বের মাঝেও যেটুকু প্রেম অবশিষ্ট আছে তা স্বদেশকে নির্মাণ করার জন্যে। সে-ই তো বিশ্বাসের ভিত— সে-ই তো ভালোবাসা।
তিনি জানেন কবির টেবিলে জমে নিশীথের স্বেদ ও শিশির। সে টেবিল জনসমুদ্র্রের দগ্ধ স্বপ্নে তেতে ফুঁসে ওঠে মগ্ন মধ্যরাতে। তিনি দ্বিধা নিয়ে জেগে থাকেন— জীবনের পৃষ্ঠপোষক কে, কবিতা না মাতৃসত্তা? জানেন নির্বিকার চেয়ে চেয়ে বিধ্বংসী বিবাহ দেখে যাওয়াও জীবন। নারীর দৈনন্দিন যাপন কী করে রুবী রহমানের কবিতার খাতায় উঠে আসে, বলছিলাম সে বিষয়েও। একজন নারীর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উন্মোচন করেন বিবাহিত সম্পর্কের নতুন দিক। মনে মনে গড়ে ওঠা সফল বিবাহের অলীক ছবি। নারী-পুরুষের এই কাঠামোবন্দি সম্পর্ক প্রতিদিনকার চেনাজানা, ঘটনা, নানা প্রবণতার সাথে পালটায়, নতুন মাত্রা লাভ করে। তাকে পরিচিত করান তিনি। একটু একটু করে অবদমনের ভাঁজ খুলে দেখে নেন বেঁচে থাকা সবুজ। সাদা পাতায় লিখে তাকে পরিবেশন করেন পাঠকের পাতে।
খ্যাতিটুকু গিলে খেতে দু’সপ্তাহ পুরোই লেগেছে;
এখন আমাকে তুমি মনে হয় অন্য চোখে দ্যাখো
পাশে এসে বসি যদি তুমি অন্য কাজে চলে যাও
আমার ভেতরে তুমি তোমার যে হাত রেখেছিলে
তার স্পর্শ বড় কম্পমান
তাহলে কি এত কাল চোখে চোখ রাখা ব্যর্থ হবে
কনে-দেখা আলোয় যে পাকাপাকি কথা হয়েছিলো
সব ব্যর্থ হবে!
রংবাজ যুবকের মতো বেপরোয়া
কাণ্ডজ্ঞানহীন পিছু-পিছু হাঁটা ব্যর্থ হয়ে যাবে?
মনে-মনে গড়ে ওঠা সফল বিবাহ
গিলে খাবে এক কণা খ্যাতি;
ধুলো কাদা ঝেড়ে-ঝুড়ে সাফ সুতরো হয়ে
তোমার চোখের দিকে তাকাতে কি আরো
তিনটি জীবন পার হবে!
(তোমার চোখের দিকে, ১৯৮৫)
‘যে জীবন ফড়িঙের’ বইটি এক কবির জীবনগাথা। যে কবি সমাজ, রাজনীতির মোড় বদলের সাথে সাথে কখনো চমকিত, হতাশ। প্রেম যেন এক অবদমনের নাম সে জীবনে। দৈনন্দিন জীবনে নিষিদ্ধ জানালায় দৃশ্যমান উন্মুক্ত প্রান্তর। গার্হস্থ্যজীবনের টুকিটাকি দিয়ে চিনতে থাকা গোটা জগতের মহান তত্ত্বসকল। নারীর জীবন যেন প্রকৃতই কবির জীবন। এক অনন্য সংযোজন এই দেখতে পারা—
আমার বুকের মধ্যে কিছু বাষ্প রেখেছিলো কেউ
রেখেছিলো শিল্প-জল— নিশীথের মতন প্রগাঢ়
গূঢ় বিস্ময় কেউ রেখেছিলো
রেখেছিলো মুগ্ধ চন্দ্রোদয়—
… … … … … ………………………………
তবু এই অপরাহ্ন জানে কেউ আসে
বড় দূর পথ অতিক্রম করে আসে
যা দিতে পারে না আর কেউ কোন দিন
শীতল কঠিন হাতে তাই নিয়ে একদিন আসে।
(এই অপরাহ্ন জানে, ১৯৮০)
ছয় দশক পরও এই কবিতারা সমকালের হয়ে আছে। কবি রুবী রহমানের প্রথম একক মৌলিক গ্রন্থ ‘যে জীবন ফড়িঙের’ আবেদন পরিপূর্ণ কবিতাপাঠকের জন্যে । কবিতার রহস্য, বঞ্চনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ভরে রাখে কবির জীবন। সে-জীবনের স্বাদ সকলের জন্যে নয়। তার অপেক্ষায় থাকে কোনো কোনো নিবিড় পাঠক। সেই পাঠকদের স্বাগত জানাই।
সাবেরা তাবাসসুম
কবিতা লেখা শুরু পিতা মোঃ সাইদুল হক ভুইয়ার অনুপ্রেরণায়। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই ১৪টি। ১৩টি মৌলিক কবিতা এবং একটি হিন্দী ও উর্দু কবি গুলজারের কবিতার অনুবাদ-গ্রন্থ। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় কাটে। চলচ্চিত্রের প্রতি রয়েছে তীব্র টান। সবকিছু্র বাইরে কবিতাই সাবেরার আরাধ্য ভূমি, পাশাপাশি অনুবাদ ও মুক্ত গদ্য লেখা তো আছেই।