টোমাজ ট্রান্সট্রোমার প্রমাণ করলেন শুধু কবিতা লিখেই টিকে থাকা যায়

আবদুর রব

সাহিত্যে ২০১১ নোবেল বিজয়ী সুইডেনের কবি ও মনস্তাত্ত্বিক টোমাজ ট্রান্সট্রোমার প্রমাণ করলেন যে শুধু কবিতা লিখেই টিকে থাকা যায়। জয় করা যায় বিশ্বকে। ১৯৯৩ সাল থেকে বারবার নোবেল কমিটির বিবেচনায় আসলেও নিজ দেশের এই মহামূল্যবান পুরস্কারটি হাতে পেতে তাঁর লেগে গেল আরও প্রায় দুই দশক!

ট্রান্সট্রোমার ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল স্টকহোমে জন্ম গ্রহণ করেন। কাজ করতেন কিশোর অপরাধী, মাদকাসক্ত ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। কর্মক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম করতেন তিনি। বাকি সময়টা দু’হাত ভরে লিখেছেন। কবিতা। তবে শুধু কবিতা নয় অনুবাদ,অন্যান্য রচনাও আছে তাঁর।  পৃথিবীর ৬০টি ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট এমন যে শুধু কবিতা পাঠক নয় সাধারণ মানুষও তাতে আকৃষ্ট হয়। কোনো কঠিন শব্দ নয় তবু কী যেন ঘটে, ভিন্ন এক মাত্রা যোগ হয় তাতে। তাঁর কবিতার ব্যাপক অনুবাদ ও আলোচনা করে আমেরিকাসহ সারাবিশ্বে তাঁকে তুলে ধরেছেন তাঁরই কবি বন্ধু রবার্ট ব্লাই।

মানুষের মনের অপার রহস্য তাঁর কবিতার উপজীব্য। অধিকাংশ সময় নিজের অভিজ্ঞতার সাথে সঙ্গীত আর প্রকৃতির রূপের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতা। ইতিহাস, অস্তিত্বের প্রশ্ন আর মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন তিনি। একজন সুইডিশ সমালোচক বলেন: “তার কবিতা যেন ধর্মনিরপেক্ষ প্রার্থনা”।  বিনয়ী, ভণিতাহীন ট্রান্সট্রোমার সব সময় রাজনৈতিকে বিতর্ক এড়িয়ে চলেছেন, থেকেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।

১৯৯০ সালে স্ট্রোক হবার পর স্ত্রী মনিকার সাহায্য নিয়ে লেখালেখি করলেও বর্তমানে আংশিক প্যারালাইসিসে ভুগতে থাকায় তার লেখার প[রিমাণ একদম কমে গেছে। তবে তিনি থেমে যাওয়ার পাত্র নন। এক হাতে প্রতিদিন পিয়ানো বাজান। ক্লাসিক্যাল সুরের ঝড় তোলেন তাঁর পিয়ানোতে। আশি বছর বয়সী কবি ট্রান্সট্রোমার টিভিতে স্ত্রীর সাথে বসে নোবেল পুরস্কারের অনুষ্ঠান দেখার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফোনকল পেলেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি দুই শব্দে বললেন: ভেরী গুড।

সাহিত্য ক্যাফেতে প্রকাশিত হল কবির পাঁচটি কবিতার বাংলা অনুবাদ।

আরও ভিতরে

নগরীর প্রধান সড়কে
যখন সূর্য নেমে এসেছে।
ট্রাফিক ঘন হয়, গাড়িগুলো হামাগুড়ি দেয়।
যেন একটা শ্লথ ড্রাগন, ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়।
আমি সেই ড্রাগনেরই একটা অস্থি।
হঠাৎ লাল সূর্যটা
উইন্ডস্ক্রীনের ঠিক মাঝখানে
এসে টলটল করে।
আমি স্বচ্ছ
এবং লেখাগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে
আমার ভিতরে
অদৃশ্য কালিতে লেখা শব্দগুলো
যেমন পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে
কাগজটা আগুনে ধরলে।
জানি, আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে
নগরীর ভিতর দিয়ে
যতক্ষণ না বনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় হয়।
হাঁটতে থাক, উইসকনসিন থেকে আসা লোকটার পদচিহ্ন ধরে।
অন্ধকার হয়ে আসে, দেখতে কষ্ট হয়।
ঝরাপাতার নিচে পাথর।
একটা পাথর খুব মূল্যবান।
এটাই সবকিছু পাল্টে দিতে পারে
আঁধারকে আলোতে রূপান্তরিত করে দিতে পারে।
সমস্ত দেশটার জন্য এই একটাই সুইচ।
সবকিছুই এর উপর নির্ভরশীল।
দেখ, স্পর্শ কর…

(Tomas Tranströmer, Further In.Translated by Robin Fulton)

এপ্রিল ও নীরবতা

ঝরনাগুলো প্রাণহীন।
রেশমী-কালো নালা
আমার পাশ দিয়ে বয়ে যায় কোনো প্রতিফলন ছাড়া।
যা কিছু উজ্জ্বল
তা ওই হলুদ ফুলগুলি।
আমি ঢুকে আছি আমার ছায়ার ভিতরে
যেমন কালো কেসের ভিতরে থাকা ভায়োলিন
শুধু যে কথাটি বলতে চাই
তা জ্বলজ্বল করে নাগালের বাইরে
যেন রূপা
পনশপ—ব্যক্তিগত জিনিস রেখে যাওয়ার দোকানে।

(From The Sorrow Gondola. April and Silence.Ttranslated by Robert Bly )

সুর্যসহ ল্যান্ডস্কেপ

বাড়ির পেছন থেকে সূর্যটা উঠে এসে
দাঁড়ায় রাস্তার মাঝখানে
এবং আমাদের ঘাড়ের উপর নিঃস্বাস ফেলে
তার লাল বাতাস দিয়ে।
ইঞ্জবাক, আগামীকাল তোমাকে ছেড়ে চলে যাব
তখনও সূর্যটা মৃদু আলো ছড়াবে
ধূসর, অর্ধমৃত বনটায়
যেখানে আমরা কাজ করব, থাকব।

(From The Sorrow Gondola. Landscape with Suns.  Ttranslated by Robert Bly)

একটা মৃত্যুর পর

একদা শোক ছিল
চলে গেছে বহু আগে, ম্রিয়মাণ ধুমকেতুপুচ্ছ।
সে আমাদের  অন্তপুরে রাখে। টিভির ছবিগুলোকে ঝাপসা করে দেয়।
টেলিফোনের তারের উপর টলটলায়মান শীতল জলবিন্দুর ভিতরে স্থিত হয়।
তবুও কেউ  ধীরে স্কী করতে যেতে পারে শীতের সূর্যের ভিতরে
ব্রাশের মতো ঝুলে থাকা কিছু পাতা সরিয়ে।
পাতাগুলো যেন টেলিফোন ডাইরেক্টরির ছেঁড়া পাতা
নামগুলো গিলে খেয়েছে ঠাণ্ডা।
তবু শুনতে ভালো লাগে হৃদস্পন্দন
কিন্তু ছায়া যেন দেহ থেকে অধিক বাস্তব মনে হয়
সামুরাইকে দেখতে লাগে অকিঞ্চিতকর
তার বুকে কালো ড্রাগন আঁকা ধাতব পোশাকের পাশে।

(Tomas Tranströme. After a Death. Ttranslated by Robert Bly)

দম্পতি

ওরা বাতি নিভিয়ে দিলে সাময়িক সাদা ছায়া নেমে আসে
সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগে
যেন একগ্লাস অন্ধকারের ভিতর একটা সাদা ট্যাবলেট।
হোটেলের দেওয়ালগুলো কালো আকাশ বেয়ে উঠতে থাকে।
তাদের ভালবাসার ক্রিয়াকর্ম থেমে গেছে, এবং তারা ঘুমায়
কিন্তু তাদের সবচেয়ে গোপন চিন্তারা মিলিত হয় যখন দুটি রঙ মিলে
একে অপরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় স্কুল বালকের ভেজা পেন্টিং-এ।
এ গাঢ় আর নীরব। কিন্তু নগরী আজ ঘন সন্নিবিষ্ট
জানালাগুলো শীতল। বাড়িগুলোও কাছে এসেছে। তারা সমবেত,
অপেক্ষমান, একদল মানুষ, তাদের ভাবলেশহীন অবয়ব।

(Tomas Tranströme.The Couple. Translations by Robert Bly.)

বাংলা অনুবাদ: আবদুর রব

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top