অভ্যুদয়
স্টিমারের যে হুইসেল শুনে ঘর ছেড়েছিলাম তা আজও শুনতে পাই।
সেদিন সে যেতে বলেছিল আর আজ সে কেবলই ডাকে।
কিন্তু যে পাখির বাসা আমি ভেঙে এসেছিলাম তা আর
কোনোদিন গড়ে দিতে পারব না।
যে প্রেমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তাও আর রক্ষা করতে পারব না।
যে খেলার সাথীদের বলেছিলাম
তোদেরকে ছেড়ে কোথাও যাব না,
তাদের মুখের দিকে আর তাকাতে পারব না।
কথা রাখিনি বলে।
যে স্কুল ঘরটায় আমি ইতিহাস আর
নটবর স্যারের হাতে মার খেতাম তা আর
কোনোদিন দেখব না ।
শুনতে পারব না তার বেতের সপাং সপাং আওয়াজ।
প্রাইমারিতে হেডমাস্টার ছিলেন মোহাম্মদ আলী স্যার।
সাত্তার স্যার আসতেন শোলালিয়া গ্রাম থেকে।
শাহাবুদ্দীন স্যারের বাড়ি ছিল স্কুলের পাশেই।
তার ভাগ্নে কি কারণে আত্মহত্যা করেছিল
তা আজো জানি না। তবু তার মুখটা
আজও দেখতে পাই।
স্কুলের পাশে হালিমাদের বাড়ি,
আমরা একসাথে পড়তাম।
সে ছিল পরিণত, আমাদের চেয়ে বড় ছেলেদের সাথে
তার ওঠাবসা।
শুধু হালিমা নয়, অন্যান্য মেয়েরাও ছিল তার মতো।
তাই হালিমাদের বিয়ে হয়ে যেত,
ওরা আর স্কুলে আসত না।
মনসুর ছিল ভীষণ দুষ্টু,
মারামারি-কাটাকাটি ছাড়া কথা নেই।
আক্কাজ দর্জির ছেলে আনার আলি ছিল বড় শান্তশিষ্ট।
চুল খাড়া খাড়া, তেল চপচপে।
ঠোঁট কালো। কেউ কেউ ভাবতো হয়তো বিড়ি খায়।
মিরেপাড়া পার হয়ে এলে কাঠের একটা ভাঙা সেতু ছিল।
তাই সেতুর পাশ দিয়ে খাল পার হতো
ছেলেমেয়বুড়ো সবাই। স্বাভাবিক ভাবে।
সেই স্বাভাবিকতায় আমিও বাঁধা পড়ে আছি আজও।
সেই সেতু পার হলে বা পাশে পড়ে
আবু সরদারের বাড়িসহ আরও কিছু বাড়ি।
ডান পাশে ধানের ক্ষেত।
আর্শ্বিন-কার্তিক এলে ধানের গন্ধে ভরে উঠত চারিদিক।
ধানের পুজো হত। গীত হত নক্সি কাঁথার মাঠের
“আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান,.
সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান”।
ছোটো ছোটো ব্যাঙ বড়শিতে গেঁথে
লম্বা তল্লাবাঁশের ছিপ দোলাতে দোলাতে দেখতাম
হঠাৎ শোলমাছ খাবলে ধরত সেই ব্যাঙ।
আহা সেই উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলো আর পৃথিবীতে
কোনোদিন ফিরে আসবে না।
আমার নানা ছিলেন ভোজনরসিক,
খেতে ভালো বাসতেন। দিনে দুবার খেতেন।
সকালে গোসল করে গরম ভাতে ঘি
আলুভর্তা আর দুএক ভাগের তরকারি দিয়ে।
দুপুরে আর খেতেন না।
সন্ধ্যায় খেয়েদেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়তেন।
ষাট-সত্তরের এই সাধারণ কাহিনীর ভিতর
দক্ষিণের একটা গ্রামবাংলা লুকিয়ে আছে।
নদীর পাশ দিয়ে ওয়াপদার বাঁধ আছে।
রাত্রে সেই নদীর জলে ফসফরাস জ্বলে ওঠা আছে।
সারিসারি কেওড়ার গাছ আছে।
গ্রামবাসীদের চুরি করে হরিণ শিকারের গল্প আছে।
টোটা আছে বন্দুক আছে।
ম্যালেরিয়া আছে কুইনাইন আছে ।
আমীন ডক্তারের মিক্সার আছে।
কসিম মোড়ল আছে।
বক সিগারেট আছে।
তিন তাস আছে।
ধান কাটা আছে।
বংশ পরম্পরায় কাইজা আছে।
বোমা আছে। ঢাল আছে, সড়কি আছে।
জোয়ারের জলে ভেসে চলা মরা গরু আছে।
তার উপর বসে শকুনের মাংস খাওয়া আছে।
মুচিদের গ্রাম ডুবে যাওয়া আছে।
লঞ্চ আছে, মাল ওঠানামা আছে।
কুলিদের হাঁকডাক আছে।
টাবুরে নৌকার পাল তুলে চলা আছে।
মাঝিদের গুণটানা আছে।
বড় বড় নৌকায় চেপে ফরিদপুরের দাওয়ালে,
ছাতা সারাইয়ের লোক আর কুমারদের
মিলিত বাণিজ্যযাত্রা আছে।
ধান কেটে ধান নেওয়া আছে, ছাতা সারাই আছে।
মাটির পাতিল দিয়ে ধান নিয়ে নৌকো ভরা আছে।
শীতকাল আছে, লাল চাদর আছে।
আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহানো আছে।
গাছ থেকে রস পেড়ে খাওয়া আছে।
ঝোলাগুড় আর পাউরুটি আছে।
কলের গান আর রেডিও আছে।
এইটা স্মৃতিকথা হতে পারত।
চরের কাঁদায় হেঁটে হেঁটে
বেড়ে ওঠার কাহিনী হতে পারত।
চাঁদ আলী মাঝির অন্ধত্ব আর নদী পারাপারের কাহিনী হতে পারত।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আর শক্তি প্রদর্শনের কাহিনী হতে পারত।
মাঠ থেকে গ রু আনার কাহিনী হতে পারত।
গরুর ক্ষুরে মেটেচাখাদের বাসা বেধে ডিম পাড়া হতে পারত।
সেসব কিছু না হয়ে এক অন্তর্ধানের কাহিনী হয়ে গেল।
হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ শুকিয়ে গেল।
পুকুর ঘাটের শেওলা ধরা ভাঙা সিঁড়ি হয়ে গেল।
ইসমাইলের গোল কাটতে গিয়ে বাঘের মুখ থেকে
যুদ্ধ করে ফিরে আসার কাহিনী হয়ে গেল।
যেন এক বড় যুদ্ধের আগে একটা প্রতীকী যুদ্ধ আর
ভবিতব্যের ইঙ্গিত হয়ে রইল।
পচিশে মার্চের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের পরে
যুবক ছেলেরা বাড়িতে না বলে যুদ্ধে গেল।
খালবিলে অনেক অনেক চিংড়ে আর
ট্যাংরা ধরা পড়তে লাগল।
হিন্দুদের গ্রামগুলো শূন্য হইয়ে গেল।
মাঝে মাঝে পাকিসৈন্যদের গানবোট এসে
গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে যেতে থাকল।
মুক্তযোদ্ধারাও লোকালয়গুলোতে
তাদের ক্যাম্প খুলতে শুরু করল ।
রাজাকার আল বদর খতম শুরু হলো।
সমান তালে বাড়িঘরও পুড়তে লাগল।
আগুনের লেলিহান শিখার ভিতরে
পুড়তে পুড়তে একটা নতুন দেশের অভ্যুদয় হলো।
আবদুর রব
কবি, অনুবাদক, অনলাইন ম্যাগাজিন সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ। জন্ম ৩০ জুন ১৯৬১ সালে। পৈত্রিক নিবাস যশোর। বর্তমান বসবাস ঢাকায়। একটি আন্তর্জাতিক কন্সাল্ট্যান্সি ফার্মে কর্মরত। ৩৫টি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
শৈশব থেকে লেখালেখির শুরু। এ পর্যন্ত দশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘পূর্ণ প্রাণ যাবো’। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: কে ঘুমায় কে জাগে (১৯৯৪); রূপান্তরের গান (২০০৩); আপেলসূত্র (২০১৪), বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় (২০২০), নুড়ি পাথ রের ছায়া (২০২৩) ও নির্বাচিত কবিতা (২০২৪)। এছাড়া ছোটদের জন্য চীনা গল্পের তিনটি অনুবাদ গ্রন্থও আছে। এগুলো প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় অনুবাদ কবিতার বই ‘বৃষ্টির ভেতর এক গলিপথ’। বেশকিছু ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন তিনি।