রেজাউদ্দিন স্টালিন
ভাস্কর্য
এমন একটা জায়গায় এসে আরজ আলী দাঁড়িয়েছে
সে জায়গাটার নাম দ্বন্দ্ব। জায়গাটা জ্যামিতিক হিসাবে
বিন্দু কল্পনায় বৃত্ত । আরজ আলী
ইচ্ছে করলে ফিরতে পারে— বাড়ির দিকে।
আর না ফিরতে চাইলে দিগন্তের পর দিগন্ত কিংবা
নীলের পরে নীল অথবা নদীর পর নদী। এরপর
আর বাড়ি ফেরার জো- নেই,: অসম্ভব মায়া
অসম্ভব কুহেলী, চোখ ধাঁধানো ইন্দ্রজাল: জাদুর পর জাদু।
কি চায় আরজ আলী— সব আছে সব, যা থাকলে
একজন মানুষ ইশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শেখে।
আরজ আলী ফেলে এসেছে তার প্রিয় সন্তানের
আধো আধো বোল, স্ত্রীর সলাজ বাঁধা আর একটা
ছোট চোখের মতো চেয়ে থাকা বাড়ি। কি-করবে
সে— যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে দেহের ধনুক, ভেঙে যেতে
চাইছে বুকের উপাখ্যান। আর মাত্র দু’এক মিনিট তারপরই
শূন্যতা তারপরই প্রত্যাবর্তন কিংবা তারপরই
ট্রেনের টঙ্কার।
আরজ আলী ভাবলো তার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়োজন;
এতোদিন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো দুঃখ, এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী
সে নিজেই। তার আর কোথাও যাওয়া হলো না—
না বাড়ির দিকে না দিগন্তের। ঐ বিন্দুর ওপরই
দাঁড়িয়ে রইলো: কত বর্ষা, বজ্রপাত, কত হিংস্র শীত
দিনের পর দিন তার মাথার উপর বসে রইলো।
আরজ আলী দাঁড়িয়ে— দীর্ঘ হ’লো
আরজ আলী দাড়িয়ে- দাঁড়িয়ে স্মারক হ’লো
এক সময় ভাস্কর্য।
লোকেরা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বলে— আরজ আলী—
ঐ লোকটা ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো।
মৃত্যু
ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো যে আরজ আলী
সে এখন নিজেরই প্রতিদ্বন্দ্বী। নুন আনতে
পান্তা শেষ, কিন্তু অনিঃশেষ তার স্বপ্ন।
টগবগে ঘোড়ায় দ্বিগ্বীজয়ী বীর, দেখে
নেবে শত্রুদের। কত বোমারু বিমানের
বাজখাই, বারুদে বারুদে সঙ্গম
আর রক্তের সুরুয়া ভেজানো পোড়া রুটি।
তাতে কি, মশালের পর মশাল জ্বালিয়ে
আরজ আলী অন্ধকারে অতন্দ্র প্রহরী।
মৃত্যুর মর্মন্তুদ আর্তস্বর, শিশুর কান্না আর
অসংখ্য অভুক্ত আত্মজার বিলাপে বিচলিত সে;
কিন্তু উদ্যত তার আঙুল।
ঐ যে দিগন্ত ওকে ধ্বংস করবে কে,
ঐ যে মাইলের পর মাইল মরু সমুদ্র
তার দখলে নেবে কোন্ ফারাউ?
আরজ আলী পাখি উড়তে জানে,
ইকারুসের অবাধ্য সে ভেসে বেড়াতে
চায় সূর্যের স্রোতে। নিয়তির পায়ে-পায়ে
মাছির মতো ভনভন্ ক’রে; ফিরে এসো আরজ আলী—
আত্মসমর্পণ করো, তোমার স্বপ্নগুলো আমাদের দাও।
তবু অনড় সে দু’হাতে নিয়তিকে তাড়ায়,
সরিয়ে দিতে চায় দুর্যোগের মেঘ , দাঁড়িয়ে
আঁকতে চায় নিজের পদতলে যতটুকু মানচিত্র
ঠিক তারই মধ্যিখানের ছবি।
শক্তি ক্ষয় হয়ে আসে, দৃষ্টি ঝাপসা,
যত দূার দেখা যায় ততদূরে মৃত্যুর মিছিল—অফুরন্ত
ভরসা পায় আরজ আলী মৃত্যু মানেই বাঁচা,
যে মরতে জানে সেই বাঁচে এবার সে নিশ্চিন্ত ।