মহি মুহাম্মদ
গাঙের কিনারে বসে, চোখ দুটিকে দূরে কোথায় ফেলে রাখে কুলসুম। খড়ি ওঠা ত্বকে নজর পিছলে যায়। চোখ দুটোতে তাকালে মনে হয় পুকুরে পদ্ম ভাসছে। তবে তাতে যত্নের ছাপ যদি পড়ত তবে তাকে কুঁড়ে ঘরে রাখা দায় হয়ে পড়ত। পুরানো ছেঁড়া কাপড়ে তার যৌবন লুকাতে পারে না দেখে মাঝে মধ্যে বাপটাই তার ওপরে খেঁকিয়ে ওঠে। কিন্তু খেঁকিয়ে উঠলে কি হবে কুলসুমের তো করার কিছু নেই। পুরুষদের অসহায় দৃষ্টি তার খারাপ লাগে না। মাঝে মধ্যে নদীর কিনারে এসে দূরে তাকিয়ে থাকে সে। ভালো লাগে তার । নদীর ওপারে গ্রামগুলো কেমন কালো রেখার মতো মনে হয়। মাঝে মধ্যে মনে হয় মস্তবড় এক অজগর একেবেঁকে শুয়ে আছে। কোনদিন সে গাঙের ওপাড়ে যায়নি। তার ইচ্ছে করে গাঙের ওপাড়ে যেতে। এই বৈলাতলি ছেড়ে অন্যকোথাও যেতে। কেমন মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হবে, কে জানে! লোকটার কি ষাঁড়ের মতো রাগ থাকবে, কিংবা বদ মেজাজ? কথায় কথায় গালি গালাজ করবে? ওর বুকের ভেতর অনেক আশা। জানে না সে আশাগুলো পূরণ হবে কিনা। বেলা বেড়ে গেলে তাকে গাঙের পাড় থেকে উঠতে হয়। সরু ধান ক্ষেতের আল ধরে মাঠ পেরিয়ে হিজল গাছের বন পেরিয়ে বৈলাতলি গ্রাম। অল্প একটু ভিটে। উঠোনে একটা ভাদিগাছ আছে। উঠোন বলতে এক চিলতে উঠোন। ঝাটা হাতে কুলসুমের এক লহমার কাজ। বাপ-বেটিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। তবে একেবারে যে মুখ বুজে পড়ে থাকতে পারে তা কিন্তু নয়, কারণ অকারণে যুবা কিংবা বুড়োদের বিশেষ নজর আছে এই ভেঙে পড়া নিঃস্ব রসুল মিয়ার বাড়ির উপর। আসলে বাড়ির উপর নজর আছে— এ কথাটিও ঠিক নয়। নজর আছে আসলে কুলসুমের উপর। সবাই একটু কথা বলতে চায়। অনেকে বলাবলি করে যে রসুল মিয়ার মেয়ে কুলসুমের এতো সুন্দর হওয়া ঠিক হয় নাই। তাই মাঝে মধ্যে রসুল মিয়ারও মনে হয় মেয়েটিকে পাতিলের কালি দিয়ে মেখে দেয়।
তবে গ্রামবাসী ভিন্ন কথা বলে। তারা বলে যে, রসুল মিয়ার মেয়ের চোখ লম্বা। তার ইচ্ছে যেন বুড়া জোয়ান কেউ তার কাছ থেকে ফিরে না যায়। এ কথার সত্যতা বিচার করতে গেলে অনেকেই দেখে যে দিনের কোনো না কোনো সময় কুলসুম কারো না কারো সঙ্গে কথা বার্তায় মশগুল। যার ফলে গ্রামবাসীদের সহজেই অনুমান হয় যে রসুল মিয়ার মেয়ে কুলসুমের স্বভাব চরিত্র খুব একটা সুবিধার না। যেহেতু কুলসুম সবার সঙ্গেই কথা বলে সেই সুবাধে বিশেষ কেউ কেউ নিজেকে তারা কুলসুমের মনের মানুষ তথা নাগর বলে দাবি করে। কিন্তু একদিন সব নাগরদের মুখে ছাই ছিটিয়ে রসুল মিয়ার কন্যার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। গ্রামের লোকেরা বলাবলি করতে থাকলো, হাসমত আলির এক পাও কব্বরে হান্দাইছে হেতে কইরছে কুলিরে বিয়া। হেতের ঘরো কুলি থাইকবনি! কদিন পরে দেআ যাইব হেতিয়ে দোয়ান খুলি বইছে।
যা হোক বুড়ো দোজবর হাসমত আলির বিয়ে হয়ে গেল। এর কিছুদিন পর মারা গেল রসুল মিয়া। ভিটা গেল অন্যের দখলে। বাপের কর্জ টাকা ফেরৎ দিয়ে ভিটা পাবার আশা কুলসুমের নেই। দেশে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। শহর থেকে মানুষ পিল পিল করে গ্রামে আসতে লাগলো। আবার গ্রামের মানুষ অনেকেই ওপারে। গ্রামে মাতুব্বর, দফাদার, মেম্বার, চেয়ারম্যানের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলল। গ্রামের হাইস্কুলের মাঠে মিলিটারি ক্যাম্প। যখন তখন চেয়ারম্যান আর রমজান মাস্টারদের আনাগোনা সেখানে। যুবকদের কেউ গ্রামে নেই। দু একজন যারা ছিল মিলিটারি ক্যাম্পে তাদের ঠাঁই হয়েছে। এদিকে হাসমত আলির শরীরের অবস্থা ভালো না। দাওয়ায় বসে কুলসুমকে খাওয়ার চিন্তা করতে হয়। কারণ আগের মতো কাজ-কাম নেই তাই খাবারের সংকটও দেখা দিয়েছে। তাই খাদ্যের সন্ধানে তাকে মাঠে পাট ক্ষেতের দিকে এগুতে হয়। ইচ্ছে কিছু পাট শাক তুলে আনবে। তাতে লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে কিছক্ষণ চিবুতে তো পারবে। মাঠে খা খা শূন্যতা। বহুদূর থেকে দু একটা গুলির শব্দ ভেসে আসে। থেকে থেকে এই শব্দ বাড়ে আর কমে। হাওয়ায় বারুদের গন্ধ। বাতাস পাটের কচি পাতার ওপর ঢেউ তুলে ছুটে যায়। পাটক্ষেতে নিরিবিলি কিছু শাক সে কোঁচড়ে তুলতে থাকে। হঠাৎ পেছন থেকে কারো করস্পর্শ কুলসুমকে সচকিত করে।
কিয়ারে কুলি শাকনি তুলছ?
হ মাস্টার কাগা
বুড়ার খবর কিয়া?
ভালা না।
তোর বুড়ার মউত আইয়ে নানি?
অন্যসময় হলে কুলসুম হয়তো এর সমুচিত জবাব দিতো কিন্তু এখন সময় খারাপ, তা মেয়েটি বুঝে গেছে।
সম হইলে আপনা আপনি অইব।
হাছা কইছত।
তখনও রমজান মাস্টারের একটা হাত কুলসুমের বাহু ছুঁয়ে। কিরে ঘরো খাওন দাওন আছেনি?
কত্তুন থাইকব? হেতানে কাম কইরতে পারে নি?
আহারে! রমজান মাস্টার জিভায় চুকচুক করে একটা শব্দ করে। ঠিক আছে ঠিক আছে তুই চিন্তা করিস না। ব্যবস্থা একটা করি হালামু । এবার কুলসুমের গাল টিপে দিয়ে রমজান মাস্টার বলল, আঁই থাইকতে আঁর কুলির খাওনের কষ্ট হইব, এইটা সহন যাইত ন। ঠিক আছে আঁর লগে আয়। এই বলে রমজান মাস্টার কুলসুমের কোমর জড়িয়ে পাটক্ষেতের ভিতর নিয়ে যায়। অনেকক্ষণ যাবৎ কিছু পাটগাছ অশান্তভাবে দুলতে থাকে। যখন পাটগাছগুলোর দুলুনি থামে তখন কুলসুম কাপড় থেকে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে আসে। পেছন পেছন রমজান মাস্টার লুঙ্গি পরতে পরতে আসে। কুলসুম আবার শাক তুলতে শুরু করলে রমজান ধমক দিয়ে বলে, আরে যা যা আর শাক তুলিছ না, তোর ঘরে আঁই অক্ষণে খাওন পাডাই দিতাছি। কুলসুম আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
দুপুরের আগে সত্যিই কুলসুমের ঘরে খাবার আসে। তবে শুধু খাবার নয়, সন্ধ্যের আগে মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে শকুনের মতো ছুটে আসে চেয়ারম্যান। কুলি চেয়ারম্যানের মানুষে পরিণত হয়। গ্রামে জরিনা,সখিনা,রাহেলার মতো অবস্থা কুলির নয়। কারণ জরিনা, রাহেলা, সখিনাকে চেয়ারম্যান আর রমজান ধরে ক্যাম্পে দিয়ে এসেছে মিলিটারিদের খেদমতের জন্য। কুলিও ক্যাম্পে যায় তবে অন্য সবার মতো নয়। কুলি রমজান আর চেয়ারম্যানের মানুষ হিসেবে ক্যাম্পে কাজ করতে যায়। আবার অনায়াসে চলেও আসে। যুদ্ধের দামামার মধ্যে হাসমত মরে গেলে কুলি আরেকটু ফুরফুরা হয়ে যায়। কুলি এখন আগের চাইতে অনেক বেশি রঙ্গ তামাশা করে। আগের চাইতে অনেক বেশি হাসি খুশি থাকে। বৈলাতলি গ্রামে রাত নেমে আসে যেন মনে হয় প্রেতপুরি। কোথাও কোন সাড়াশব্দ থাকে না। কুলসুমের ঘরটা এক কোণায় হওয়ায় ঐ দিকটা আরো বেশি নীরব হয়ে থাকে। তবে এই সময়ে কিছু অচেনা যুবক কুলির ঘরে এসে ঢোকে। তারা কুলির সঙ্গে ফিসফাস করে কথা বলে। কি কথা কুলির সঙ্গে বৈলাতলি গ্রামের মানুষজন তা কেউ জানে না। আর যারা জানে তারা ঘুণাক্ষরেও কারো কাছে তা গল্প করে না। মেম্বার, চেয়ারম্যানের মানুষ বিধায় কুলির অবাধে যাতায়াতে কেউ কোনো সন্দেহ না করলে কুলির মনের ভেতরে যে আকাঙ্ক্ষা গুমরে কাঁদে তার হদিস সে সহজেই করতে পারে বলে মনে করে। আর ঠিক তাই দেখা যায় খুব তাড়াতাড়ি বৈলাতলি আগত মিলিটারির সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। শুধু তাই নয় একদিন পালের গোদাসহ যখন বেশ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয় তখন আর গুটি কয়েকজন যারা অবশিষ্ট ছিল তারা তাড়াতাড়ি পলায়ন করতে উদ্ধত হয়। তবে যাওয়ার আগে আরো কিছু মানুষজন দিনের আলোয় গাঙের ধারে কুকুর, বিড়ালের মত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে গেছে। কি কারণে কিংবা কোন সংবাদের ভিত্তিতে তারা কুলির ঘরে সার্চ করে তা কেউ মালুম করতে পারে না। তবে কুত্তি মাগি, আরো অনেক অভিধায় সম্বোধন করে ওরা সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে কুলসুমকে খোঁজে। বেমালুম গায়েব। না, কোথাও কুলির সন্ধান পাওয়া যায় না। মেয়েটা গেল কোথায়? অনেকের ধারণা খারাপ মেয়ে কার না কার সঙ্গে ভেগেছে। যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে আর স্বাধীনতার নতুন আশ্বাদে অনেকেই ভুলেই গিয়েছিল কুলির কথা। কিন্তু না, কুলি আবারও অনেকের সঙ্গে একদিন গ্রামে উদয় হলো। সবাই বেকুব, একদম চুপ। কেউ আর কুলিকে ঘাটানোর সাহস পায় না । কুলি যেন বদলে গেছে। গ্রামের মানুষেরা অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখে। কিন্তু না, কুলির আচরণে আগের সেই কুরুচিপনা দেখা যায় না। তবে একদিন সুযোগ বুঝে রমজান মাস্টার আবার কুলির দিকে হাত বাড়ায়। কুলি রুখে দাঁড়ায়।
কাগু ভুলি যান হেই কুলিরে, খবরদার ভালা হইত ন। ভালা হই যানগই নাইলে আমনেগর বিচার আঁই করিয়ুম। আমনেগো হিসাব নিকাশ বহুত বাকি রই গেছে।
রমজান মাস্টার ভয় পেয়ে গেলেন। কুলির চেহারা তিনি এরকম আর দেখেন নি। চাইলেই যে মেয়েটিকে যত্রতত্র পাওয়া যেত আর দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর খোল নলচে পাল্টে গেল!
এরপর তো আর চুপ মেরে থাকা যায় না। যে কোন সময় বিপদ আসতে পারে। তাই রমজান মাস্টার চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। এক শুক্রবারে মুক্তিযোদ্ধা রহমত ভাইকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে দাওয়াত দেয়া হলো। রমজান মাস্টারও এলো। সেখানে সখিপুরের যুবকদের নৈতিকতা আর সমাজের জন্য উদিগ্ন হলেন তারা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য নিজেদের প্রয়োজনবোধে কঠোর হতে হবে। এই প্রত্যয়ে খারাপ মেয়ে কুলির ব্যবস্থা তারা তিন জনেই করে ফেললেন। সে রাতে বাঁশ ঝাড়ে মধ্যে একটা গর্ত খুড়া হলো। গর্তে দেয়া হলো খেজুর কাটা, দেয়া হলো বাঁশের মইঞ্চা খুটা। তারপর রাতের অন্ধকারে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন একটি মেয়েকে দুজন লোক তুলে নিয়ে এলো। তারপর সেই গর্তের মধ্যে ফেলে মাটিচাপা দেয়া হলো। এরপর থেকে কুলসুমকে আর কোথাও দেখা গেল না।
২.
কুলির মতোন তোরেও কিন্তু…কথাটি শেষ হয় না, তার আগেই বাঁশঝাড়ের ওদিকে কারো নড়াচড়া টের পেয়ে রমজান মাস্টার দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে। আর কিছুক্ষণ আগে বাতাসে ভাসিয়ে দেয়া কথাটি যারা শোনে তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
তোতন আর দুলালের গা হাত পা থর-থর করে কাঁপতে থাকে। অপরদিকে রমজান মাস্টার যার মুখ থেকে এরকম ভয়াবহ কথা উদগত হয়েছে সে তাদের দিকে না তাকিয়ে হন হন করে গ্রামের ভেতর হারিয়ে যায়। আর বৈলাতলি গ্রামের বাঁশঝাড়ের একটু আগে দুলাল আর তোতন ভ্যাবলার মতোন দাঁড়িয়ে থাকে। যদি কুলি মানে কুলসুমকে তারা না চিনতো তবে বোধহয় এ ধরনের অবস্থায় তাদের পড়তে হতো না। বৈলাতলি গ্রামে ঢুকতেই যে বড় রাস্তা সেটি ধরে সোজা এলে গ্রামের মুখে একটা বাঁশঝাড়। এখানেই রাস্তাটা দ’য়ের মত বেঁকে হারিয়ে গেছে গ্রামের বুকের ভেতর। আপাতত তারা এখন বাঁশঝাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। আর রমজান মাস্টার যাকে এই কথা বলেছে সেই ভূতে ধরা মেয়েটি তাদের পাত্তা না দিয়ে বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই তাদের মাথায় এলো তারা যদি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতো তবে রমজান মাস্টার কিসের জন্য তাকে এমন ভয় দেখাচ্ছিল তাহলে তারা অনেক তথ্য জেনে যেত। কিন্তু সালমা এখন তাদের ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে তাই দুলাল আর তোতন পরামর্শ করে এ ব্যাপারে কারো সঙ্গে আলাপ করা যায়। তোতন বলল, এ বেপারে আঙ্গো গেরামের গাজীভাই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। গেরামে কার স্বভাব কেমন, কার চরিত্র কি রকম, কার বউয়ের কি ঘটনা, কার ছেলের কি রটনা কিংবা কার সঙ্গে কার সখ্যতা আছে এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর দিতে পারে একমাত্র গাজীভাই। কিন্তু গাজীভাইয়ের সাক্ষাৎ পাওয়া মুশকিল।
যা হোক অনেক চেষ্টা তদবির করে গাজীভাইকে পাওয়া গেল হাটের করম আলির চায়ের দোকানে। সেখানে তিনি পাহাড়ের গল্প করছেন। প্রগতি খিসার বীরত্বের কাহিনি অনেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। তিনি তখন সেখানকার মাস্টার। দুলাল আর তোতন গিয়ে গাজীভাইয়ের পাশে বসল। ততক্ষণে তিনি গল্পের তুঙ্গে। ওদের বসতে দেখে তিনি বললেন, কিয়ারে তুরা যে বইয়ছ এইহানে। তোতন বলল, তো বইতামনা নি? আন্নে যেইহানে বইছেন হেইহানে আমরা বইতাম নাতো কনে বইব?
না, না হেই কতা কইনো, আসলে কইতাম চাইছিলাম যে তুরার উদ্দেশ্য কিয়া?
উদ্দেশ্য তো এককান আছে।
ঐ করম আলি চাচা তিনডা চা লাগান চাই। তোতন চায়ের অর্ডার দেয় আর গাজীভাই তার গল্পে অনুপ্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পর চা এল সঙ্গে গরম পিঁয়াজু। খেতে খেতে তারা নানান কথা বলে কিন্তু কিছুতেই কুলসুমের কথা তোলে না। তবে গাজীভাই দিলদরিয়া মানুষ। যখন কথার মধ্যে ঢুকে যান তখন হুশ থাকেনা। আর কথাও তিনি বলেন চমৎকার। কখনো শুদ্ধ বাংলায় আবার কখনো নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায়। দীর্ঘদিন পার্বত্য জনপদে কাটিয়ে এসেছেন তাই ওখনকার গল্প তার মুখেই লেগে থাকে। শুধু তাই নয়, অনেক মানুষও তার কাছে আসে। সবার সঙ্গেই তিনি হাসি মুখে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে তিনি বিড়ি ফুঁকেন। মাঝে মধ্যে উরুর মাঝখানের চুলকানিও তাকে ব্যতিব্যস্ত করে। কিন্তু তারপরেও তারমধ্যে একটা বাদশাহী আচরণ ফুটে ওঠে। যখন তিনি বিড়ি ফোঁকেন এত্তো আদর যে একবার না দেখলে তা ভাষায় বর্ণনা করে বোঝানো সহজ নয়।
বিনা হাটবারে করম আলির চায়ের দোকানে খুব একটা ভিড় থাকেনা। এখনো দু একজন মানুষ বসে আছে। কেউ চা খাচ্ছে আর কেউ বিড়ি ফুঁকছে। দুলাল চারপাশে চোখ বুলিয়ে আসত্দে করে গাজীভাইয়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, গাজীভাই আসলে কুলির ঘটনা কি আছিল?
গাজীভাই থমকে গেলেন। এদিক ওদিক চোখ বুলালেন, অচেনা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালেন। তারপর আসত্দে করে বললেন, এরই হুন, যেগিন গেছে গেছে। এইসব পুরানা কিসত্দা টানি আনি লাভ কী ক ?
ভাই, ভাই আন্নে এইরকম কইয়েন না। একটা কতা হুইনছি এইডার শেষ না দেহি ছাইরতাম ন। অন আন্নে ছাড়া এই, বৈলাতলি গেরামে কিয়াও এই কতা কইতে হাইত্তো ন। তোতন বিজ্ঞের মত গাজীভাইকে কনভিন্স করতে লাগলো।
এরই হুন, কুলি মানে কুলসুম আছিল একটা রাণ্ডি মাইয়া। হিগারে লই তুরা এইচ্চা জিগারও কিল্লাই আই বুইঝতাম পাইরতেছি না।
বুঝলাম গাজীভাই সহজে মুখ খুলবেন না। আর এদিকে করম আলির চায়ের দোকান আবার জমজমাট হতে শুরু করেছে। তাই আমরা তখনকার মত রণে ভঙ্গ দিলাম। গাজী ভাইকে বললাম, আমরা পরে আইয়ূম। আমরা কিছুতেই ছাইরতম ন। আন্নে মারেন, কাডেন যা করেন করেন, তারপরেও আমরা কুলির কাহিনি হুনুম-ই হুনুম।
একটু রাত নামতেই ওরা করম আলির দোকান থেকে বের হলো। আসলে তারা বের হয় না, বের হয় গাজীভাই। আর গাজী ভাইয়ের পিছু পিছু তারা দুজন। গাজী ভাই হাট থেকে বের হয়ে গ্রামের অন্ধকার রাসত্দা ধরেন। তোতন এই সময় অন্ধকারের বুকে শব্দের ছুরি চালায়।
এরই গাজীভাই কাম এককান তো ভুল করি হালাইছি।
কিয়া কইচ্ছৎ?
আন্নের লাই এক পেকেট আকিজ বিড়ি কিনছি।
আকিজ বিড়িনি কিনছৎ! কিনছস যন এক পেকেট সিগরেট কিনতি!
ভাই ভাই, ভুল হই গেছে, আন্নে মাফ করি দেন। কাইলগা আন্নেরে সিগরেটও কিনি দিমু।
হাছানিরে। এরই তুরা এতগ্গিন কিল্লাই যে করর আই বুঝতাম পাইরতিছি না।
দূরও গাজীভাই, তুঁই আর কতা বাড়াইও না।
আইচ্ছা ঠিক আছে। তুরা কুলির কতা জাইনতে চাস হেই কথার লাই আর দুই কতা হইতো নো।
আইচ্ছা গাজী ভাই আন্নে যে কইলেন কুলি রাণ্ডী আছিল, হেই কতা হাছানি?
হেই কতা হাছা নত মিছানি?
গাজীভাই খানিকটা রেগে ওঠেন।
না,না আসলে জাইনতে চাইছিলাম যে আন্নে কোনো কুলির কাস্টমার আছিলেন নি?
এরই বাঁইচালি করিছ না। আঁই কিন্তুক তোগোরে কোনো কতা কইতাম ন।
ভাই ভাই মাফ করি দেন, ভুল হই গেছে এইচ্ছা কতা আর কইতাম ন।
তারপর নীরবতা। গাজীভাই আকিজ বিড়ির নতুন প্যাকেট খোলেন। অন্ধকারে ফস্ করে দিয়াশলাই বিদ্যুতের ঝিলিক মারে। সেই আলোতে তিনটি মুখ পরস্পর চাওয়া-চাওয়ি হয়, তিনজোড়া চোখে কিসের আলো খেলে যায় তারা কেউ জানে না।
এরই তোতন হুন, হেসুময় দ্যাশে হুদিন আছিল না। চাইরপাশে নানা কতা-বার্তা হইতেছে। মুজিবেরে লই, স্বাধীনতা লই এই সব আর কি! আঙ্গো গেরামের রসুল মিয়ারে চিনতি নি তোরা? হেই রসুল মিয়ার মাইয়া আছিল কুলি, বুইছতনি! এরই তুরা কিন্তু হু, হ্যাঁ করিছ।
আইচ্ছা আইচ্ছা গাজীভাই আমনে চিন্তা করিয়েন না।
তো হেই রসুল মিয়ার মাইয়াগা আছিল বড় সোন্দর। এরই কুলির গার রং আছিল ভর্তার লান, বুইছতনি! গরিবের ঘরে আল্লা এই রঙ দিই রসুল মিয়ারে বেকায়দায় ফেলাই দিছিল। হেতে আর কি কইরব, মাইয়া ডাঙ্গর হইছে বেকে আকতা-কুকতা কয়। তাই হেতে মাইয়ারে বিয়া দেওনের লাই উডি পড়ি লাইগল। এদিকে দ্যাশের তন খারাপ অবস্থা, বুইছত নি! খারাপ অবস্থা মানে ঢাকার মাইদ্যে কাতারে কাতারে মানুষ মারি হালাইতেছে। বেবাকে যে যিনদি পারে ভাইগতেছে। আবার কেউ কেউ নিজেগো আখের গোছাই লইতো ছুইডতেছে। কিযে এক অবস্থার মাইধ্যে পড়ি গেলাম আর কওনের বাকি নাই, বুইছত নি! আমি কিন্তু হে-সময় রাঙ্গামাটি। তয় খবর বেক্কাইন কিন্তু অাঁই রাখিয়ের। তয় কি হইলো কুলির বাপে কুলির বিয়া ঠিক কইরলো। কারলগে জানসনি? বুড়া দোজবর হাসমতের লগে। তো কি হইলো, ঝামেলা চুকি গেল কুলির বাপের। ওম্মা বুড়া কতা কওন ছাড়া কদিন পরে ফুট্টুস করি মরি গেল। দোজবর হাসমত ছাড়া কুলির আর কেউ রইলো না। দ্যাশে তন যুদ্ধ লাইগছে কারো মনে সুখ আছে আবার কারো মনে নাই। বেকই ত বুঝস হে-সময় মেম্বর, চেয়ারমেন, হর্দার হেতাগো দাপট আছিল। জোয়ানকি মাইয়াপোলা কুলি বেকে কয় বুড়া দোজবর কুলিরে ভালা গরি খাইত পারে না, হেতারলাই বেকে লাইন মারে কুলির পিছে। আর বুড়া হাসমতের ও তো কিছু আছিল না। কদিন পরে হেই বুড়াও কুলিরে রাখি মরি গেল। তারপর কুলির আর চলে না। এ ও খাইতে দেয়, হেগিন খাই , মাইয়া কেমনে এতো ফুলি উডে আল্লা মাবুদ জানে। হেতিরে দেইকলেই বলে বেকে লাইন মাইরতো চায়। হেরবাদে যুদ্ধের মইদ্যে কুলিরে বেকে ব্যবহার কইরছে। আবার কেউ কেউ কয় কুলি বলে মুক্তিযোদ্ধাগো ইনফরমার আছিল। এই আরকি! রাইত-বিরাইতে কুলি বলে মিলিটারি খতম কইরছে। এই একএক জনে এক এক কতা কয় আরকি! যুদ্ধ শেষ হওনের পরে পোলাপাইনের চরিত্র ঠিক রাখনের লাই কারা কারা বলে কুলিরে গর্ত করি চাবা দিছে।
গাজীভাই আন্নে জানেন নি কারা কুলিরে চাবা দিছে?
গাজীভাই থম মেরে থাকেন। ঠিক সেই সময় তিন ব্যাটারিঅলা টর্চের আলো তাদের মুখে এস পড়ে। রমজান উচ্চ কণ্ঠে জানতে চায়, এই কে গারে এইনো। গাজী বলেন, কাগু আরাই না।
ও তোরা কিয়া করছ?
বাজারতুন আইতাছি।
চলে যায় রমজান। এরপর চলে যায় গাজী। তোতন আর দুলালও চলে যায়। সখিপুর গ্রামে দীর্ঘদিন পর আবার কুলসুমের কথা জানার জন্য তোতন আর দুলাল উঠে পড়ে লাগে। প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো তারা যেন খুড়ে খুড়ে সব আবিষ্কার করবে। তবে তারপর দিন কি কারণে গাজীভাই যেন সখিপুর ছেড়ে চলে যান। আর কিছু দিন পর সবাই জানতে পারে রমজানের ক্যানসার হয়েছে। বেশিদিন আর বাঁচবে না। শুধু রমজান নয় খালেক চেয়ারম্যান কি কারণে নিজেনিজে ফাঁসি খেয়ে ইহ জীবন সাঙ্গ করেছে। আর মুক্তিযোদ্ধা নিঃসন্তান রহমত ভাই আমগাছ থেকে পড়ে পিঠের নীল দাড়া ভেঙে দীর্ঘদিন বিছনায় কষ্ট পাচ্ছে।
যেদিন রহমতভাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সেদিন গ্রামে গাজীভাই এলেন। এর আগেই অবশ্য চেয়ারম্যান আর রমজান মাস্টার শেষ। তোতন আর দুলাল গাজী ভাইয়ের সন্ধানে এলো বিকেলের দিকে। গাজীভাই টকটকে চোখ নিয়ে ওদেরকে বললেন, তোরা কির্তি আইছস? গাজীভাই, আঙ্গো কইতে হইব কুলিরে কারা মাইরছে। আমরা জানি এই কতা একমাত্র আমনে জানেন।
গাজীভাই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসেন। এরই জানি ত, তোরা জানি আর কি কইরবি ক! বেকে ত মরি গেছেগই।
এরপর কুলসুমের গল্পটি ছড়িয়ে পড়ে। যে কুলসুম কোনদিন গাঙের ওপারে যায়নি, গাঙের ওপারে যাওয়ার জন্য যার ছটফটানি ছিল। মৃত্যুর পর তার গল্প গাঙের ওপারে মানুষ জানতে পারে শুধু তাই নয়, ওপার থেকে তার গল্প ক্রমশ ছড়াতে থাকে ছত্রিশ হাজার বর্গমাইল।
জুন ২০১১