সাখাওয়াত টিপু
এই মোর দেহ হতে তুমি মোর বড়
তোমার যেই জাতি সেই মোর দৃঢ়
— শ্রী চৈতন্যভাগবত
উন আর বিংশ শতকের ভারতের প্রসিদ্ধ কলাবিৎ শ্রী নন্দলাল বসু। বাজারে চাউর, শ্রী বসু নব-ভারতীয় ঘরানার শিল্পী। তাঁহার অতি নামজাদা একখানা শিল্পকর্মের নাম ‘গরুড় স্তম্ভমূলে শ্রীচৈতন্য’। বসু মহাশয়ের শিল্পের বিচারসভায় ঢু মারিবার আগে আমরা মহাভারতের আদিপর্বের জ্ঞানকাণ্ড পাড়িব। আদি সওয়ালে ‘গরুড়’ কি পদার্থ?
মহাভারতের আদিপর্ব বলিতেছে, ঋষি কশ্যপ আর স্ত্রী বিনতার ছাওয়াল গরুড়। ইহা পক্ষীরাজ। দেবতা বিষ্ণুর বাহন। কশ্যপপত্নী বিনতা একদা দুই অণ্ড প্রসব করিলেন। তাঁহার একটি অকালে ভগ্ন হওয়ায় নিম্নাঙ্গহীন অরুণের জন্ম হয়। অপর ডিম্ব যথাকালে আরেক ছাওয়াল জন্ম দেয়। আদিকাণ্ড বলিতেছে তাঁহার নামই গরুড়। গরুড় গঠন অর্ধপক্ষী আর অর্ধমানব। শ্বেতবর্ণ মুখ। রক্তবর্ণ পক্ষ আর স্বর্ণাভ দেহ। পক্ষীর ন্যায় চোখ ও নখর। সেও এক এলাহি রটনা— অরুণ বিকলাঙ্গ হইয়া জন্ম লাভ করিয়া পূর্ব দেবের কাছে যান। আর গরুড় পক্ষীদের ইন্দ্রত্ব লভিলেন।
তো শ্রী বসুর শিল্পকর্ম আদপে রূপাগ্রাহী। কেননা রূপের স্বভাব অপরকে টানা। ইহার আরো দুই কুঠুরী স্বভাব আর অভাব। রূপের এহেন দুইভাবে আদম সন্তানকে শিল্পের বিচারসভায় হাজির করে। হাজিরানা মজলিশে আজ সেই তর্ক পেশ করিব। এহেন শিল্পকর্ম দেখিলে যে কেহ ভাবিয়া বসিতে পারেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একজন ‘আধুনিক’ বা ‘কলিযোগী’ সাধক। মহাপ্রভুর আবির্ভাব ও তিরোধান যেন উনিশ শতকের কোন একসময়ে নিষ্পন্ন হইয়াছে! যেন ঔপনিবেশিক নিঃসঙ্গভাব ও ভাববিচ্যুত সমাজের সাধক তিনি! তো নন্দলাল বসুর শিল্পের ভাষার ফরমায়েস কি?
বসুর ভাবচিত্রে প্রকাশ— গরুড় স্তম্ভমূলে শ্রীচৈতন্য একা বসিয়া আছেন। ক্লান্ত-স্বভাবের ভাবলেশহীন একুল-ওকুল দুই কুল হারানো মানব তিনি। ছবির গঠন পশ্চিমাশাসিত। কলিযুগের যে কোন দর্শকের কাছে তাহা বেআক্কেলে ঠেকাইবে না। কেননা কলিযুগে এহেন বিচ্ছিন্নতা অস্বাভাবিক নহে। ইহাতে ভক্তি নাই, যাহা আছে তাহার নাম— বিভক্তি। বিভক্তি মানে ভক্তি নহে। ভগ হইতে ভাগ হইয়া অপর ভগের নামান্তর মাত্র যাহা। তাহাতে আগা থাকে তো গোড়া নাই। নিছক বস্তুর রূপক ছবিকে আদল দিয়াছে। তো প্রশ্ন জাগিতেছে, কেন বসু মহাশয় কলিযুগের চিন্তার বলিতে শ্রীচৈতন্যকে স্থাপন করিয়াছেন?
শ্রীচৈতন্যের আর্বিভাব ১৪৮৬ ইসায়ি অব্দে। নদীয়ার নবদ্বীপে বাল্যকালে পণ্ডিত শ্রী গঙ্গা দাসের সংস্কৃত টোলে বিদ্যা লভিয়া নিজেই টোল খুলিয়া বসেন। পণ্ডিত বল্লভ আচার্যের কন্যা লক্ষ্মীর সহিত পরিণয়ের পর আপন টোলে আসর জমান। সেও এক মহাকারবার। তাহা আর নতুন করিয়া পাড়িতে চাহি না। তো বাইশ বয়সে চৈতন্যের পিতা গত হয়েন। তখন তিনি পিতার পিণ্ডদানের লাগিয়া গয়া তীর্থে যান। তাহাতে সাক্ষাৎ পান বৈষ্ণব সাধক ঈশ্বরপুরীর সহিত। কৃষ্ণ প্রেমে অপর দেখার সদ্ভাব তাঁহাকে নতুন মানব রূপে পরিণত করিয়াছে। গয়া হইতে নবদ্বীপে ফিরিয়া তিনি ভগবদ্ভক্তির নতুন ভাবের উদয় ঘটাইয়াছেন। তাহার ইতিহাস লইয়া দুইকথা পাড়িব। কি সেই ইতিহাস?
চৈতন্যের আবির্ভাবের পহেলা কালে সুলতানী আমলের বিদায়পালা চলিতেছে। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের উদয়কাল। আর সামন্তবাদী সমাজও পাততাড়ি গুটাইতেছে। সে সময় জমিদার বিদ্রোহ কায়স্থজাতির পতন আনিয়াছে। আর ইহাতে বাজিয়াছে জাতি সংগ্রামের নতুন রূপ। অন্তত বাংলার জমিনে ফলিয়াছে শ্রেণী-সংগ্রামের দুই রূপ। এক রূপে খোদ ব্রাহ্মণ, অপর রূপে শূদ্র। ইহাতে সকলেই মানিবেন, হিন্দু সমাজের এহেন ‘গোলমেলে স্বাধীনতা’ ভোগ করিবার রাস্তাও খানিক কণ্টকাকীর্ণ হইয়া পড়ে। বর্ণাশ্রমের রিক্ত দুয়ারও চক্ষুষ্মান হইয়া ওঠে। নবদ্বীপে ব্রাহ্মণদের কুটাভাষও তখন খোলাসা হইয়াছে। নানা ইতিহাসবেত্তার কলম সেই আভাস দিয়াছে।
নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যই গোড়া হিন্দুজাতি ধর্ম-বর্ণাশ্রমের মাথায় পহেলা কুঠারাঘাত করিয়াছেন। খোদ করি, সর্বজাতির সহিত আহার-বিহার করিয়া সনাতনীবাদের গোড়ামি ভাঙিয়া দিলেন। একদা নাম সংকীর্তনের অপারলীলায় তিনবার ‘হরিবোল’ বলিলেই সর্বদোষ খণ্ডন হইত। ইহা একধরনের সংস্কার। এহেন সংস্কার চল সমাজকে টিকাইয়া রাখিবার সংস্কার নহে। চল সমাজের ভেদাভেদকে ভাঙিয়াচুড়িয়া অপরাকার সকলেই একাকার করিবার পথ বটে। তো, হরি তো হরের আত্মা বা চিত্তহারক। এহেন ‘হরিবোল’— পহেলা রূপ প্রেমে ‘পড়া,’ অন্য রূপ প্রেমে ‘ধরা’। ‘পড়া’ মানে অপরের কাছে যাওয়া বা জানা আর ‘ধরা’ অর্থ অপরকে ধারণ বা মর্ত্য করা। দর্শনশাস্ত্র যাহাকে বলিতেছে ধর্ম। ‘ধর্’ ধাতু হইতে ধরাধামে যাহার বিকাশ। পড়া আর ধরা— এহেন দুই রূপে শ্রীচৈতন্য কি প্রেমের মজমায় মজেন নাই?
তবে নন্দলাল বসুর শিল্পকর্মে দুই রূপের খানিকটা খামতি আছে। যদি প্রশ্ন তুলিতে হয় তো বলিতে হইবে, মুর্চ্ছা আর মুর্চ্ছনার তফাৎ। অর্থ্যাৎ দেহের ভাবকে সওয়াল করিয়া মনের ভাবে পৌঁছা। সকলেই মানিবেন, মুর্চ্ছা মাত্রই ভাব। মুর্চ্ছা দুই পদের— অভাবের মুর্চ্ছা আর স্বভাবের মুর্চ্ছা। স্বভাবের মুর্চ্ছা খোদ বস্তুর অভাব হইতে সৃষ্ট। স্বভাব মাত্র কলিযুগীয় বা আধুনিকীয়। যাহা বসু মহাশয়ের কর্মে জায়মান। কোন কোন বালসুলভ বস্তুবাদীর চোখে ইহা বালাইবিশেষ। তাঁহাদের মত, মুর্চ্ছার আকার মৃগীরোগীর লাহান। খোদ বস্তু হইতে যাহার উদ্ভব। বলা যাইতে পারে, রোগীর মুর্চ্ছা ব্যক্তি আমির বালাই। তাই কি কাহারো কাহারো মতে শ্রীচৈতন্য ‘মৃগীরোগী’? এহেন মতাধারীরা সঙ্গীতের ‘মুর্চ্ছা’ বা ‘মুর্চ্ছনার’ বুঝিতে অপারগ। অপর পদে, অভাবের মুর্চ্ছার মতন মুর্চ্ছনার গঠন। কেননা অপর আত্মা বা ঋষির সহিত একাত্ম হইলে জগৎও তাহাকে বলিতেছে মুর্চ্ছনার। মানে ব্যক্তি আমির বিলোপের ভিতর দিয়া গঠিত হয় মুর্চ্ছনার। মুর্চ্ছনায় হারাইয়া যাওয়াই তো আকার আর সাকারের পরপদ নিরাকার পদ। কেননা ইহাতে এক পদ অন্য পদে পড়ে। আবার এক পদ অন্য পদকে ধরে। সেও এক পড়াপড়ি আর ধরাধরির মহামিলন। মিলনের আরেক কোঠা বিরহ। অপরের সহিত একাকার হইবার বিরহই তো মুর্চ্ছনা। কেহ কেহ ইহাকে লীলা বলিয়া থাকেন।
ভাববিদ্যা বলিতেছে, বস্তুর স্বভাব অপরের অভাব পূর্ণ করা। অভাব পূরণের নামই অপর বস্তুর অর্থ দান। ধরাকে সরা জ্ঞান করা। অন্তত প্রেমে মজিয়া যাওয়া। আবার প্রেমে ফিরিয়া পাওয়াও বলা যায়। বস্তুর স্বভাব কিন্তু বস্তুর অভাব নহে। কেননা ভাবের মুর্চ্ছা বা ভাব বস্তু হইতে আলাহিদা। অর্থ লইয়া বস্তুকে ডিঙাইয়া যাওয়া। যাহা বস্তুর বাইরের ভাব। আজ এই কলিকালে বলিতে হইতেছে, মুর্চ্ছনাই ভাষার গোপন কুঠুরি। অপর যেই আর্চনায় সামিল হয়েন। চৈতন্য কি সেই সাধনা করেন নাই?
বলিতে দ্বিধা নাই, বসু মহাশয়ের শিল্পকর্মে কলিযুগের সৌন্দর্যই বর্তমান। রেখাই তাহার সৌন্দর্যের সার। যেই কলি আদপে স্বভাবের মুর্চ্ছা রূপ। খানিক বিদেশ বিদেশ লাগিয়াছে। যাহা দেশ বা জাতি হইয়া উঠিতে অপারগ। বস্তু ধারণ করিয়া বস্তুতে তাহার পতন। তাঁহার শিল্পকর্মের স্বভাবে ইহা প্রতীয়মান। তাহাতে মুর্চ্ছনা অনুপস্থিত। জগৎ সংসারে সঙ্গীতে মুর্চ্ছনায় বিহার করেন নাই এমন খুব কম বাঙালসন্তান আছেন। তাহা নয় কি?
আধুনিক সমাজের আদমে আদমে বিচ্ছিন্নতার দুঃখ শ্রীচৈতন্যের কাঁধে তুলিব কিনা তাহাই আজ ভাবিবার বিষয়? শিল্পের এহেন কলাকৌশলকে বলা যাইবার পারে, দেহখানা শংকর, কারণ মগজ তো ঔপনিবেশিক। অন্তত ইউরোপীয়। নহে কি?
হায়, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য সহায়!