সারওয়ার চৌধুরী
যে-সকল ব্যক্তিগণের গবেষণার দৌলতে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ থাকা সত্বেও, এইবার সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রোয়েমার সাহিত্যে নোবেল দেয়ার ঘোষণাতে, তাঁর সম্বন্ধে কমটির তরফ থেকে বলা হয়- ‘through his condensed, translucent images, he gives us fresh access to reality’।
এই জমানার কবি’র উদ্দেশে, একই সাথে শিল্পসমালোচকদের উদ্দেশে এই কথা, মানে এই ’fresh access to reality‘ নিয়ে মাতামাতি ও বুঝাবুঝি জরুরী বিবেচনা করি। এমন বলা অসঙ্গত নয় যে, যুগ যুগ ধরে অসাধারণ প্রতিভাধর কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ’fresh access to reality‘ দেখবার বুঝবার দাওয়াতসহ প্রশ্নোত্তর চর্চা করে আসছেন। প্রকৃতিতে, মহাপ্রকৃতিতে নব নব জনম, নব উদ্ভাবন, নতুন সুর-রঙ-আলো-তরঙ্গ ফুটতে থাকা তো ’fresh access to reality‘। যে-ম্যাগনোলিয়া কিংবা রক্তজবা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে তার access to reality এর দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাকুলতা নিয়ে, তার জায়গায় নিত্য নতুন বোধের উদ্বোধন আসতে থাকাটাই বাস্তবতা সমীপে বাস্তবতা।
বাস্তবতার পুরাতন সিগনিফায়েডসকে, মানে পুরাতন অর্থকে নুতন অর্থ দেন যে-কবি তাঁর ভাষাকে নিজের পছন্দমতো ব্যবহার করে, এর শক্তিটুকুন ওই কবি কর্তৃক বুনন করা উপযুক্ত মনোহর চিত্রকল্প বা উপমা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে স্ফুট হয়। শিল্পের জন্য ‘মনোহর’ হওয়াটা কখনো ‘উপযুক্ত কি না’ প্রসঙ্গের বিচারকেও ছাড়িয়ে যায়। তখন একটি প্রশ্ন বাকী থাকে, চিত্রকল্পটি/উপমাটি সকলের মন হরণ করতে সমর্থ না-হলে? সহজ কথায়, সকলের না, অধিকাংশের হলে কেল্লাহ ফতেহ ধরা হয়। ধরলেই ধরা যায় না সকল কিছু। অন্যের হাত স্পর্শ করলেই মন স্পর্শ করা হয়ে যায় না। স্পর্শ কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিবৃতির সুযোগও নেয় মানুষ। কখনো মন হরণ না-হওয়া সত্বেও দেখানো হয় হরণ হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ‘সকল’ শব্দটা সময় সাপেক্ষেও। এই ক্ষেত্রে ‘সকল’ এর পরিমাণও কমে বাড়ে। পাঁচ বছর আগের ’সকল’র সংখ্যা আর পাঁচ বছর পরের ’সকল’র সংখ্যা সম পরিমাণের থাকে না।
উল্লেখ থাকে, গার্ডইয়ান সাংবাদিক জানান, ‘To win the Nobel prize, a writer has to have a readership in many parts of the world, and Tranströmer has been translated into 50 languages. One of the reasons he has been taken up by so many poets, translators and readers is that his poetry is universal and particular, metaphysical and personal.’
টমাস ট্রান্সট্রোয়েমারকে “buzzard poet ডাকা হয় এই কারণে যে তিনি অনেক উঁচু থেকে, সেই শিকারী পাখিটার মতো, বাস্তবতার উপর নজর রেখেছেন। তাঁর দৃষ্টি প্রক্ষেপণের মধ্যে মিস্টিক্যাল উপাদানও রয়েছে, এমন দাবী কিছু মেধাবী পাঠকের।
মিস্টিক/ম্যাজিক/স্পিরিচুয়াল ব্যাপারগুলোকে বরাবর বুঝাবুঝিতে না-পেয়ে মানুষ উত্ফুল্ল/উত্সাহিত কিংবা সুখবিরহরসভেজা হয় কেন? দেড় দুই বছরের শিশুর অস্পষ্ট ভাষা বিন্যাসের গান শুনে সাবালক মানুষেরা মুগ্ধ হয় কেন! শিশুটিইবা কী বুঝে আমোদিত হয়! অধরাতে বিলীন হওয়ার ভাবার্থ ধরা যায় কেমনে! ’যাহাতে ডুবিল মন তাহা জানিলাম কই’! অ-রূপেরে বুঝবার আগে তাতেও ‘ফ্রেশ এ্যাকসেস’ বুঝে নেয় মানুষ! ’যারে বুঝিয়া মন মজিল তারে না-বুঝিলাম ষোলআনা’। তাই বুঝি তারে বুঝে নেবার ব্যাকুলতা ভালো লাগে। তাহলে মিস্টিসিজমের প্রশ্নোত্তর চর্চাতে ‘ফ্রেশ এ্যাকসেস’ না হয়েও আমরা ধরে নেই ‘ফ্রেশ এ্যাকসেস’। হতে পারে এর কারণ বর্ণমালাদের দ্বারা নবতর ম্যাজিক্যাল বিন্যাস।
ট্রান্সট্রোয়েমার জানিয়েছেন মধ্যযুগের মিস্টিক Meister Eckhart এবং Augustin তাঁর চিন্তায় প্রভাব রেখেছেন। ২০০৭-এ Vi-magazine এর জন্যে Jenny Morelli কর্তৃক নেয়া সাক্ষাৎকারে টমাজ বলেন- “A mystic is someone who has seen God face to face. I’ve only seen his silhouette as he ran past me. And sometimes I’m not sure of that either.” তবু তাঁর অধিকাংশ কবিতায় যেটুক অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে তাতে মিস্টিসিজম রয়েছে, এমন বলছেন আলোচকেরা।
এবং Regardless of the poet’s reservations, critics often describe his works in terms such as “epiphany” and “secular prayer” উল্লেখ করা দরকার যে epiphany (ইপিফানি) মসিহি উত্সব যিশুর ডিভিনিটি নিয়ে হলেও অন্য অর্থ manifestation of a divine being.
’ফ্রেশ এ্যাকসেস টু রিয়েলিটি’ আমরা বাংলায় বুঝতে পারি- ’নতুনভাবে বাস্তবতাকে পাঠ/সম্পাদনা/বুঝে নেয়া/বোধ জাগানো/উন্মোচন করা’। অন্ধ কবি হোমারও মানবজাতিকে ‘ফ্রেশ এ্যাকসেস’ দিয়েছিলেন। সভ্যতার ইতিহাস যদ্দুর আমাদের জ্ঞানে নাগাল পায় এই পৃথিবীর, তার প্রতিটি পর্যায়ের, প্রতিটি অঞ্চলের শক্তিমান কবিরা ‘ফ্রেস এ্যাকসেস’ দিয়ে গেছেন। তালিকা দিলে মস্ত লম্বা হবে। এতে শেক্সপিয়র, ইয়েটস, জীবনানন্দ, কীটস, নজরুল, রুমী, সাদী, রবীন্দ্রনাথ, কাহ্নুপাদ, ভুসুকু পাদ, ইমরাউল কায়েস, গালিব প্রমুখ তো আছেনই।
টমাস ট্রান্সট্রোয়েমার কে পাবলো নেরুদা’র সাথে তুলনা করা হয়। সুইডিশ এই কবি’র কবিতাও পঞ্চাশাধিক ভাষায় অনুদিত। তবে বলা হয়, ’But if Neruda is blazing fire, Transtromer is expanding ice.’
তাঁর The Great Enigma (2004) বইটির একটি কবিতা নিম্নরূপ:
The Light Streams In
Outside the window, the long beast of spring
the transparent dragon of sunlight
rushes past like an endless
suburban train—we never got a glimpse of its head.
The shoreline villas shuffle sideways
they are proud as crabs.
The sun makes the statues blink.
The raging sea of fire out in space
is transformed to a caress.
The countdown has begun.
এই কবিতাটির শিরোনাম এবং শরীরে স্ফুট transparent dragon of sunlight’, ‘like an endless/suburban train’ এবং ’The raging sea of fire out in space/is transformed to a caress’ আমাকে একটা ধারণামণ্ডলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ট্রান্সপারেন্ট ড্রাগন অব সানলাইট দেখতে পারা খুব সহজ নয়।
ফ্রেশ এ্যাকসেস টু রিয়েলিটি’ যে বহুধা বোধমূলক অনুবাদ দেওয়া হয়েছে ; নিচের কবিতাটি সহ ইংরেজিগুলোর অনুবাদ পেলে আমারও ফ্রেশ এ্যাকসেস টু রিয়েলিটি’ ঘটতো । ধন্যবাদ।