ফেরদৌস নাহার
তৃতীয় পর্ব দ্বিতীয় পর্ব ।। প্রথম পর্ব
ক.
১৯২৯ সালে প্যারিসে দেখা হলো গালা এ্যালুয়ারের সঙ্গে। বিখ্যাত ফরাসি স্যুরিয়ালিস্ট কবি পল এ্যালুয়ারের স্ত্রী। খুব দ্রুত দালির সঙ্গে তৈরি হলো তার সম্পর্ক। গালা এ্যালুয়ার হয়ে উঠলেন দালির প্রেম-প্রেরণা। এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে সালভাদর দালি গালা এ্যালুয়ারের প্রতি চরমভাবে আকর্ষিত হলেন। জন্মগতভাবে রাশিয়ার নাগরিক গালার আসল নাম এলেনা ইভানোভনা ডিয়াকোনোভা। বয়সে দালির চাইতে দশ বছরের বড়ো। দালির জীবনে গালার ভূমিকা বিশাল। সারাজীবনে নানা সময়ে দালিকে প্রবল মানসিক বিপর্যয় হাত থেকে আগলে রেখেছেন তিনি। দালিকে তার সকল পাগলামি ও অপরিণত মৃত্যুর হাত থেকে আড়াল করে গেছেন। ১৯২৯-এ পরিচয়ের পর থেকে একসঙ্গে বসবাস করলেও ১৯৩৪-এ সামাজিকভাবে বিয়ে করেন। ধর্মীয়ভাবে ১৯৫৮ সালে আবারো বিয়ে করেন তারা। সালভাদর দালির জীবনে গালার ভূমিকা স্ত্রী ছাড়াও প্রধান নিয়ন্ত্রক ও মেন্টর হিসাবে উল্লেখ্য। তার আর্থিক, শৈল্পিক ও যৌন জীবনে গালা ছিলেন সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এছাড়া দালির অসংখ্য ছবি ও ভাস্কর্যের মডেল হিসাবে তার অভাবনীয় উপস্থিতি ছিল প্রশ্নাতীত। গালা স্পষ্টই দেখতে পেয়েছিলেন সালভাদর দালির মাঝে বিরাজমান এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভাবান শিল্পীকে। যে শিল্প সৃষ্টির সম্রাজ্যে আর সবার চাইতে প্রবল ও পৃথক। এমন কী তিনি প্যারিসে শিল্পী হিসাবে দালির আসন গড়ে তোলার প্রথম পর্যায়েও তাকে অকৃত্তিমভাবে সহযোগিতা করে গেছেন, যা-কিনা আজীবন অব্যহত ছিল।
অসংখ্য লিথোগ্রাফ, জলরঙ ও কোলাজের সমাহার পুরো দেয়াল জুড়ে। ১৯৫৭তে আঁকা স্প্যানিশ ক্ল্যাসিক কাহিনী Don Quixote-এর বেশ কিছু লিথো-ইলাস্ট্রেশন দেখলাম। এ-সব লিথোগ্রাফে দালির পরিমিত রঙের ব্যবহার একধরণের স্নিগ্ধতা প্রকাশ করে। The milky way-তে হালকা রঙের ঘূর্ণির মাঝে মানুষের অবয়ব শিল্পীর নিজস্বতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। আবার লাল রঙ ব্যবহার করে ম্যাডনার প্রতিকৃতি- সহসাই বিস্মিত করে সৃষ্টিশীল প্রাচুর্যে। দালি তার আঁকা ছবিগুলোতে খুব কড়া রঙের ব্যবহার দেখাননি, তবে বেশ কিছু উজ্জ্বল রঙ ছবিগুলোর তাৎপর্যকে করে তুলেছে প্রাণময়। তবে তা কখনই বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে উগ্র হয়ে ওঠেনি। এখানেই সালভাদর দালির শিল্পবোধের পরিণত পরিভ্রমণ, যা কিনা আরদশজন শিল্পী থেকে তাকে ভিন্ন করেছে।
La Pieuvre, ১৯৭০-এ তৈরি একটি স্যুরিয়ালিস্টক ভাস্কর্য। অক্টোপাস এসে সময়কে(ঘড়ি) জড়িয়ে ধরেছে, সাদা পাথরের সমুদ্রসৈকত তারই পাশে পড়ে আছে একটি চাবি। চাবি ও সময়ের যোগসূত্র খুঁজতে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, সালভাদর দালি তার অসংখ্য ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মে সময়কে ধরে রাখতে চেয়েছেন এক নিবিষ্টতায়। যে সময় বয়ে যায় আপন গতিতে, যে সময় কারো নাগালের মাঝে ধরা দেয় না, তাকেই বার বার ফিরিয়ে এনেছেন নানা ফর্মে। এ যেন অদৃশ্য কিছুকে আপন হাতের মুঠোয় পুরে স্থায়ী রূপ দেবার পরাবাস্তব অভিযান। তাই হয়তো আমরা পেয়েছি সময়কে চরিত্র করে তার সঙ্গে মিশে থাকা অসংখ্য মূর্ত-বিমূর্ত ঘড়ির উপস্থিতি। যার অনেকগুলোই পেয়েছে কালজয়ী শিল্পের সম্মান।
The horse saddled with time- ব্রোঞ্জের তৈরি একটি ছুটন্ত ঘোড়া। অবশ্যই গতানুগতিক ঘোড়ার চেয়ে ভিন্ন তার অবয়ব। দালির পরাবাস্তবতার ঘোড়া, যার পিঠে জিন হিসাবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে একটি ঘড়ি। ঘোড়া, দালির ইমেজের একটি ফেমাস ধারা। যা দিয়ে বুঝানো হয়েছে সমগ্র জীবনের অভিযানকে। এখানে চালকের বসবার স্থানটি ঘড়ি দিয়ে পূরণ করা হয়েছে স্বপ্ন-ইচ্ছার প্রবহমানতা বুঝাতে। ঘোড়া বহন করছে ভার ও প্রাত্যহিকতা, তাই তার পিঠে জিনের পরিবর্তে মূর্ত হয়েছে ঘড়ি, This surrealistic animal can not be ridden by man, for it is time who is the rider Salvador Dali.
দেখেই বুঝে নিলাম, এ-তো সুতোয় ঝুলন্ত নিউটনের সেই আপেল। নাম Homage to Newton- ১৯৬৯ এ তৈরি। এটি একটি ছোট ভাস্কর্য, তবে একই থিমের উপর আরও একটি কাজ দেখলাম, বিশাল ছয় ফুট উঁচু। কালো ও সোনালি রঙ করা ধাতু দিয়ে গড়া Discover of the law of gravity। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী আইজেক নিউটন তার বিখ্যাত মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের আপেল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন স্পেন দেশীয় শিল্পী সালভাদর দালির সৃষ্টিতে।
খ.
I strongly protest! I claim my place in the after- life with the persistence of memory —Salvador Dali.
১৯৩১ সালে আঁকা তার The Persistence of Memory বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্যুরিয়ালিস্ট চিত্রকর্মের অন্যতম। স্বপ্ন ও হেলুসিনেশন এই ছবির প্রধান আকর্ষণ হলেও এখানে দালি তার ফেলে আসা জন্মভূমি ক্যাটালোনিয়া’র ল্যান্ডস্ক্যাপের বিমূর্তরূপ খুব মিহিন তুলিতে তুলে এনেছেন। এছাড়া তিনটি গলে যাওয়া ঘড়ির উপস্থিতি দিয়ে সময়ের প্রবল অসংগতিকে বুঝিয়েছেন। নিজেকে এঁকেছেন মাটিতে পড়ে থাকা অস্তিত্বের মাঝে, যার পিঠেও রয়েছে সময়ের ভার। এই বিখ্যাত চিত্রটি নিয়ে নানান ব্যাখ্যা রয়েছে, কিন্তু যে-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় তা-হলো, তার আঁকা ছবি তার দেখা স্বপ্নেরই চিত্রায়ণ। মাত্র দশ বাই তেরো ইঞ্চি দৈর্ঘ-প্রস্থের এই কাজ সম্পর্কে দালি বলেন- Hand painted dream photographs ।
Tarot; knight of sword- একটি বিখ্যাত জলরঙ ইলাস্ট্রেশন সিরিজ। এই জলরঙের সাথে দালি মিশিয়েছেন কোলাজের রহস্যময়তা, যা কিনা অন্য আবেদন নিয়ে সহসাই উন্মুক্ত করে ফেলে শিল্পীর ভয়ঙ্কর ক্ষমতাকে। সালভাদর দালির এ-ধরণের এক একটি কাজ যেন এক একটি ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রকাশ।
বিশাল প্রদর্শনী কক্ষে কয়েকটি চেয়ার পাতা রয়েছে, দেখতে দেখতে কেউ যদি পরিশ্রান্ত বোধ করেন, যেন বসতে পারেন। ভাবলাম, কিছুক্ষণ বসে একটা দূরত্ব থেকে দালির শিল্পকর্মগুলো দেখি। সহসা চোখ চলে গেল খানিক দূরে, দেখলাম, কবি শামীম আজাদ মেঝেতে বসে পিলারে হেলান দিয়ে হাঁটুর উপর খাতা রেখে লিখছেন। এমন একটি প্রদর্শনীতে এসে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ কিছু নোট নেবেন না তাতো হতেই পারে না। আমরা অনেকক্ষণ হয় যে যার মতো দালির শিল্পকর্ম উপভোগ করছিলাম। এতক্ষণে শামীম আপাকে দেখতে পেলেও ডাক দিয়ে তার চিন্তাভঙ্গ করলাম না। সকালে বাড়ি থেকে বের হবার আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী পরে দালির এক্সিবিশন দেখতে যাব, বলতো? বললাম, স্প্যানিশদের মতো করে সাজো, শত হলেও সালভাদর দালি বলে কথা, একটু অন্যরকমের না হলে চলবে কেন! শামীম আপা সানন্দে নিজেকে সাজালেন অন্য এক সাজে। একটি গাঢ় ল্যাভেন্ডা রঙের লঙ ড্রেসের সাথে চুল বাঁধলেন চূড়ো করে, বাহুতে পরলেন সাপের মতো প্যাঁচ দেয়া বাজুবন্ধ। নিমেষে অন্যরকম, এ-যেন বাংলাদেশের কবি শামীম আজাদ নন, স্পেন দেশীয় কেউ। তার ট্যাঙ হওয়া উজ্জ্বল ত্বকের রঙ যেন তাকে আরো বেশি করে স্প্যানিশ করে তুলেছে। এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো, আরে! আমাকে আবার দালির হেলুসিনেশন এসে ভর করল নাতো! বেশ তো ভাবনার ডালপালা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে! অনেকক্ষণ দালির সঙ্গে রয়েছি- হলেও হতে পারে। কবি শামীম আজাদকে আপন মনে থাকতে দিয়ে আবারও শুরু করলাম দালির সঙ্গে আমার যাত্রা।
এতো বিশাল আয়োজন কোনটা রেখে যে কোনটা দেখি! চোখ-মন দুই-ই অস্থির, দিশেহারা। লক্ষ্য করলাম অনেক দর্শক অথচ পিনপতন নীরবতা। এরই মধ্যে শামীম আপা আমাকে হাত ইশারায় ডাক দিলেন। সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়। আলফ্রেড হিচককের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র স্পেলবাউন্ড (Spellbound) এর বিখ্যাত স্বপ্নদৃশ্যে ব্যবহৃত বিশাল সেই পেইন্টিংখানা। পুরো ক্যানভাসটি দোতলার দেয়াল থেকে নিচে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। যা কিনা প্রায় একতলার মেঝে স্পর্শ করেছে। সম্পূর্ণ ক্যানভাসটি একসঙ্গে দেখা যায় না। বেশখানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে তবেই উপলব্ধি করা যায় একে। ১৯৪৫ এ হলিউডের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক আলফ্রেড হিচককের চলচ্চিত্র স্পেলবাউন্ড- এর স্বপ্নদৃশ্যের পরিকল্পনা ও সেট ডিজাইন করা হয় সালভাদর দালির আঁকা এই তৈলচিত্র দিয়ে। হলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা গ্রেগরি পেক এই অসাধারণ দৃশ্যটিতে অভিনয় করেছেন। যেখানে দর্শক দেখতে পান, দালির মনমুগ্ধকর সৃষ্টকর্মের সঙ্গে চিত্রায়িত সিকোয়েন্স। যা শিল্পীর সহস্র অসাধারণ দুর্লভ অভিজ্ঞতা দিয়ে তৈরি স্যুরিয়ালিজমের চূড়ান্ত প্রতীক ও প্রকর্ষ। এই ছবিতে এগারোটি চোখের সমাহার রয়েছে। বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখ নয়টি, একটি রক্তাক্ত আর অন্যটি বুঁজে আছে। চোখের মণিগুলো সবুজাভ। সে এক প্রকাণ্ড ব্যাপার! চলচ্চিত্রটি যদিও সাদাকালোতে নির্মিত, কিন্তু সালভাদর দালির চিত্রকর্মটি রঙিন। স্বপ্নের সঙ্গে মিলানো এই ক্যানভাস আমাদেরকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখল বেশ কিছুক্ষণ।
(চলবে)
ছবির বিবরণঃ
১। শিল্পী সালভাদর দালি ও তাঁর স্ত্রী গালা দালি
২। দ্যা হর্স সাডল উইথ টাইম (The horse saddled with time)
৩। দালি’র বহুল আলোচিত স্যুরিয়ালিস্ট চিত্রকর্ম ‘দ্যা পারসিস্টেন্স অব মেমরি’(The Persistence of Memory)
৪। স্পেলবাউন্ড চলচ্চিত্রের বিখ্যাত স্বপ্নদৃশ্যের তেলচিত্রটি (Spellbound)
নানা আনুষঙ্গে ফেরদৌস এর দৃষ্টি’তে এসেছে বিবিধ শিল্প পর্যবেক্ষণ, ফেরদৌস এর লেখ্যরীতি যেনো সুখ শ্রুতি
Pingback: সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (চতুর্থ পর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে
Pingback: সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (শেষপর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে