মীজান রহমান
লোকে হাসবে জেনেও না বলে পারছি না। এপ্রিল এলে প্রতিবার একই ঘটনা ঘটে—আমি যেন কৈশোরে ফিরে যাই। অকারণে মন খারাপ হয়, অকারণে উদাস হই। মন প্রজাপতি হতে চায়। রাতের বেলা দক্ষিণের আর্দ্র বাতাস যখন শিস দিয়ে যায় জানালায়, আচমকা মনে হয়, কারো পদধ্বনি শুনছি দরজায়। জানি ওটা কেউ নয়—শুধু আমারই প্রাচীন স্মৃতিদের জেগে ওঠার শব্দ। তারা সরব হচ্ছে। এপ্রিল আমার পুরনো স্মৃতির পুনর্জাগরণের মাস— ক্যানাডার গাছেদের মতো।
প্রতিবছর এই সময় আমি গাড়ি নিয়ে বের হই। কার্পের গোরস্থান এখান থেকে ৩৫ কিলোমিটার। এপ্রিল চলে আসামাত্র মনে হয় সে যেন অভিযোগের সুরে বলছে: কইগো তুমি আসছ না কেন এখনো? আমি কখন থেকে বসে আছি তোমার অপেক্ষায়। দারুণ অভিমানী মেয়ে ছিল সে জীবনকালে। একটুতেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকত। লোকে বলে স্বভাব যায় না ম’লে। আমার বেলায় কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য। প্রায় নয় বছর হতে চলল, এখনো যেন তার মান ভাঙানো গেল না। এমনই আশ্চর্য জেদী ছিল মেয়েটা।
ওর কথা সবসময় মনে পড়ে তা নয়। সময়ের সঙ্গে স্মৃতির বড় দ্বন্দ্বটা তো সেখানেই। সময় বলে, এগিয়ে চল। স্মৃতি চায় বিরতি। একটু থেমে থেমে চলা, একটু রোমন্থন, প্রিয়জনের নিষ্প্রাণ শরীরের পাশে দুটি নিবিড় মুহূর্ত। স্মৃতি চায় বোধকে জাগিয়ে রাখতে, সময় তাতে ঘুমের শিশির ছড়ায়। ওর কথা আগে অনেক ভাবতাম, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হত যদি কখনও ভুল করে ভুলে যেতাম ভাবতে। কিন্তু এখন দিনের পর দিন, কখনও মাসের পর মাস কেটে যায়, একবারও সে উঁকি দেয় না মনে। অথচ কি আশ্চর্য, আগের মতো নিজের কাছে অপরাধী বোধ করছি না— অর্থাৎ সেই অপরাধ বোধটিও ভোঁতা হয়ে গেছে। অবশেষে বুঝি সত্যি সত্যি ওকে পথের পাশে একা ফেলে আমি চলতে শুরু করেছি। অবশেষে বুঝি আমরা সবাই এমনি করে পথের পাশে পড়ে থাকব, আর আমাদের পাশ দিয়ে নীরব কাফেলা এগিয়ে যাবে অন্য কোনোখানে।
ওর কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, বাড়ি পরিষ্কার করা হয় নি দু’সপ্তাহের ওপর। ও বেঁচে থাকলে এটা কখনোই সম্ভব হত না। ওর কাছে দৈনন্দিন জীবনের প্রধান কাজটিই ছিল ঘরদোর সাফসুফো করে ঝকঝকে তকতকে রাখা। আর সব কাজ জাহান্নামে যেতে পারে, সাধের বাড়িখানা নয়। চলাফেরা করার অবস্থা যদ্দিন ছিল তদ্দিন একবেলা সে ভ্যাকুয়াম চালাবেই। এককণা ধুলো জমে থাকবে কোথাও, উঁহু, আমাদের বাড়িতে সেটি হবার উপায় ছিল না। টেবিল চেয়ার সোফা এমন টিপটপ অবস্থায় রাখত সে যে বাইরে থেকে আগন্তুক এসে রীতিমত অস্বস্তি বোধ করত সেগুলি ব্যবহার করতে। জুতোপায়ে আমাদের ঘরে কেউ ঢুকবে সেটা একেবারেই কল্পনার বাইরে ছিল। একবার এক মহিলা দরজায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের জুতোজোড়া খুলে ঘরে-পরা জুতোপায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। বেচারীর জানা ছিল না যে আমাদের বাড়িতে ঘরের জুতোও নিষিদ্ধ। সে কি কেলেঙ্কারি! গিন্নী সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকলেন তাঁর প্রতি— আর আমি বারবার ঢোক গিলছি, আর খুঁজছি কোথায় গিয়ে লুকনো যায় । আমাদের ছোট ছেলে যখন নিউইয়র্কে পড়াশুনা করছে তখন তার একটা কুকুর ছিল। একবার সেই কুকুরটিকে অটোয়ায় নিয়ে এসেছিল। আমার স্ত্রীর মনের অবস্থা কল্পনা করুণ— নিজের ছেলে এবং তার প্রিয় কুকুর। বলার উপায় ছিল না যে এবাড়িতে তোমাদের ঢোকা হবে না। একটা সুরাহা সে নিজেই বের করে ফেলল— কুকুরটি যখন ঘরে ঢুকবে তখন তার পাগুলি সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে তারপর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে আনতে হবে, নইলে তাকে বাইরে ঘুমুতে হবে! ওর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কিংবা পরিষ্কার বাতিকের খবর সারা উত্তর আমেরিকায় জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমাদের বাড়িতে লোকজন খুব একটা আসতেন না।
সেই খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষটা এখন আর নেই, কিন্তু স্মৃতিটা তো আছে। আসলে আমি যে একাকী জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি এই বাড়িতেই, যার তিনটে ঘরই মোটামুটি অব্যবহৃত, তার প্রধান কারণই এই স্মৃতি। ওর সেই ‘ঝকঝকে তকতকে’ মেঝে আর আসবাব ফেলে আমি কোথায় যাব। ওর আঙুলের দাগ তো সবখানে। চারটে ভ্যাকুয়াম ছিল আমাদের বাড়িতে— তিনটে অকেজো হয়ে পড়ে আছে বেইজমেন্টে। দরকার পড়ে না বলে সারাবার গরজ বোধ করি নি। ও বেঁচে থাকাকালে প্রতিটি ভ্যাকুয়ামই বলতে গেলে রোজ ব্যবহার হত— তিনটে তিন ফ্লোরের জন্যে, একটি যাকে বলে এক্সট্রা, জরুরি প্রয়োজনে। ইলেট্রলাক্স কোম্পানির ম্যানেজার আমার স্ত্রীকে খুব খাতির করতেন।
সুতরাং এবাড়িতে দুসপ্তাহ ভ্যাকুয়াম না করে থাকাটা যে কত বড় অন্যায় সেটা আমি ভাল করেই বুঝি। তাই কাছা বেঁধে লেগে গেলাম। অনেক জঞ্জাল জমে ছিল অনেকদিন ধরে। শোবার ঘরের একটা শেলফ বলতে গেলে ওর জিনিসপত্র দিয়েই বোঝাই ছিল— যেগুলো ছিল তার দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস। দাঁতের মাজন, সেন্সোডাইন টুথপেস্ট, চুলের কাঁটা (যদিও শেষের দিকে ওগুলোর কোনও প্রয়োজন ছিল না বলা চলে), গুটিকয়েক চিরুনি (যার ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত শেষ কটি বছর), সেফটি পিন (ব্লাউজের বোতাম পড়ে গেলে পিন দিয়েই কাজ চালিয়ে দিত), দুই বোতল কেরি লোশন ( চামড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল বলে রোজই ব্যবহার করতে হত), ছোট একটি আয়না যার ব্যবহার সে একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল ট্র্যান্সপ্লান্টের পর মুখ ফুলে যখন বড়সড় এক মিষ্টিকুমড়োর আকার ধারণ করে । একটা সাধারণ নোটবই যাতে সে বাজারের ফর্দ লিখে রাখত সপ্তাহের সদাইয়ের জন্যে। এছাড়া আরো অনেক টুকিটাকি জিনিস যা অনেক আগেই গার্বেজে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল। আমি যদি যুক্তিবান মানুষ হতাম তাহলে ওর মৃত্যুর পরপরই ফেলে দিতাম। কিন্তু আমি তা নই। আমি হলাম, এদেশের ভাষায় যাকে বলে sentimental slob। ওর আঙুলের ছাপ তো সবখানে— ওগুলো আমি কেমন করে ফেলে দিই বলুন তো?
ভ্লাডিমির নাবুকভ একটা আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছিলেন যার নাম: Speak, Memory. দারুণ নাম। স্মৃতি, কথা বল। বইটিতে একটা কথা ছিল এরকম: “The cradle rocks above the abyss, and the common sense tells us that our existence is but a brief crack of light between two eternities of darkness”, যার বাংলা অনুবাদ এরকম হতে পারে: “প্রকাণ্ড এক গহ্বরের শিখরে অবস্থিত এই দোদুল দোলনা আমাদের— সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, আমাদের গোটা অস্তিত্বটাই ক’টি সংক্ষিপ্ত মুহূর্তের উচ্চকিত ঝলকমাত্র, দুপাশে দুটি সীমাহীন অন্ধকারের পারাবার”। নতুন কথা তা নয়, কিন্তু যতবার শুনি ততবারই যেন নতুন মনে হয়।
ইদানিং আরো একটি বই পড়লাম যার নাম: “Museum of Innocence”। আপাতদৃষ্টিতে নামের সঙ্গে গল্পের খুব একটা সামঞ্জস্য আছে বলে মনে হবে না। একজন আল্লারসুলভক্ত গোঁড়া মুসলমানের হাতে পড়লে তো সর্বনাশ— একশবার ওজু করে নফল আদায় করে নেবেন। তাঁর কাছে মনে হবে, এটা অপাপের বই নয়, পাপের— অনেকটা কামসূত্র ধরনের। কিশোরসুলভ যৌনউত্তেজনাতে আক্রান্ত হয়ে পড়াও খুব অস্বাভাবিক হবে না তাঁর জন্যে। কিন্তু তুর্কি লেখক ওরান পামুক বইটি সস্তা যৌনতা নিয়ে লেখেননি, পাপের ছিঁটেফোঁটা নেই এতে। দৈহিক যৌনতা যে একটা পর্যায়ে গিয়ে মৌন প্রার্থনার রূপ ধারণ করতে পারে এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটিই নানা বিচিত্র ছন্দে বর্ণে প্রকাশ পেয়েছে অসাধারণ এক রূপকের আচ্ছাদনে। এটা পাপপুণ্যের কাদামাটিতে নিদারুণভাবে নিমজ্জিত নামাজীর বোধাতীত তো হতেই পারে। পামুক নোবেল প্রাইজ পাওয়া লেখক— পর্ণগ্রাফি তিনি লিখবেন না সেটা বুঝবার ক্ষমতা যাঁদের নেই তাঁরা যেন উপন্যাস না পড়ে দীনিয়াত বা অন্যকিছুতে মনোযোগ দেন। বইটির মূল বক্তব্য বেশ প্রচ্ছন্ন বললে সবটা বলা হয় না। এখানে লেখক নায়ক-নায়িকার চিরাচরিত পটভূমিকে অবলম্বন করে হয়তো তাঁর গোটা দেশটির যে অন্তর্বেদনা, তার হৃতগৌরবের যে অব্যক্ত যাতনা, যে নীরব ক্রন্দন, তাকেই ব্যর্থ প্রেমের মোড়কে ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন। পাঁচশ বছর আগে তুরস্কের সব ছিল। আজকে তার কিছুই নেই, সেই গৌরবেরই কতিপয় ধ্বংসাবশেষ ছাড়া। বিগত দিনের স্বর্ণমুকুট আজ কোনও প্রতাপশীল নৃপতির শিরোধান নয়, কেবলই জাদুঘরের সুরক্ষিত প্রদর্শনীকক্ষ সুশোভিত করে রাখছে।
বলতে লজ্জা নেই যে আমার এই লেখাটির শিরোনাম পামুক সাহেবের বইটিরই অনুপ্রেরণাতে। তবে আমার জাদুঘরটি পাপ বা অপাপের নয়, স্মৃতির। আমার ছেলেদের আমি বলে রেখেছি, উত্তরাধিকার বলতে প্রায় কিছুই পাবে না তোমরা আমার কাছ থেকে, এই জাদুঘরটি ছাড়া। এখানে যা থাকবে তার কোনটাই বাজারে বিকোবে না। আমি কোনও বিশিষ্ট পুরুষ নই যে আমার ব্যক্তিগত দ্রব্যাদি নিলামের বাজারে কুবের ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
আমার বাবার কাছ থেকে আমি কি পেয়েছিলাম জান? একটা অচল ঘড়ি— একশ’ বছর আগেকার এক হাস্যকর পকেটঘড়ি। এতই পুরনো যে হতভাগাকে মেরামত করবে এমন লোকও খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। এই ঘড়ির এক কানাকড়ি মূল্য নেই আজকে। কিন্তু আসলেই কি সেটা মূল্যহীন? তোমাদের কি মনে হয়? এর মূল্য আছে কি নেই তা যদি এতদিনে বুঝে উঠতে না পারো তাহলে বলতে হয় আমি তোমাদের কিছুই শেখাতে পারিনি— ব্যর্থতা আমারই। আমার বাবার বাবা তো তা’ও দিতে পারেন নি তাঁর সন্তানকে। তিনি ক্ষেতখামার করতেন, স্কুলকলেজে যাবার সুযোগ পান নি, কিন্তু ছেলেকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়েছিলেন, কখনো পাট বিক্রি করে, কখনোবা জমি বিক্রি করে। তিনি আমার বাবার জন্যে যা রেখে গেছেন তা অমূল্য, এবং সেকারণেই তার কোনও বাজারমূল্য নেই। ওই বস্তুটির নাম স্বপ্ন। স্বপ্নের চেয়ে বড় উত্তরাধিকার আর নেই যে বাবা। সব সম্পত্তির সেরা সম্পত্তি এই মোহন শব্দটি— স্বপ্ন। আমার বাবাও তেমনি করে, তাঁর এক তুচ্ছ পকেটঘড়ির মধ্য দিয়ে বিশাল এক স্বপ্নের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন আমার বুকের মাঝে। এই বীজ থেকে উৎপন্ন বৃক্ষটিই তোমাদের পিতা।
তোমরা কেউ আমার সঙ্গে থাক না। তোমরা থাক তোমাদেরই নিজ নিজ স্বপ্নের জাল দিয়ে বোনা পৃথিবীতে, আমার বলয় থেকে যোজন যোজন দূরে। তোমাদের মা’ও এখন নেই। লোকে ভেবে পায় না আমি একা থাকি কেমন করে। মনে মনে হয়তো দোষারূপ করে তোমাদের: কেমনতরো ছেলেরে বাবা যে বৃদ্ধ পিতাকে পুরো একটা বাড়িতে একা ফেলে আরামসে জীবন কাটাচ্ছে। হয়তো ভাবছে তোমাদের প্রাণে মায়াদয়া বলতে কিছু নেই। ওদের কথা মনে নিয়ো না। ওরা মূর্খ। ওরা গতানুগতিকার বাইরে কোন যুক্তি বোঝে না। ওরা বোঝে না যে একা থাকার সিদ্ধান্তটি আমার, তোমাদের নয়। ওরা বোঝে না যে আমি একা কেবল ওদেরই চোখে, আসলে আমি মোটেও একা নই। আমার চারপাশে তোমরা আছ, আছে তোমাদের মা। তোমরা আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে প্রবহমান হয়ে আছ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। তোমরা জানো না কেমন করে প্রতি মুহূর্তে জ্ঞানে-অজ্ঞানে আমি রচনা করে যাচ্ছি এক অলীক ভবন তোমাদের মায়ের স্মৃতির তন্তু দিয়ে গাঁথা যার প্রতিটি প্রস্তর। আমি যখন থাকবা না, আশা করি তোমরা যত্ন নেবে আমার এই সাধের জাদুঘরটির। এটি আমার আপন জাদুঘর।
এদেশে ‘স্প্রিং ক্লিনিং’ বলে একটা কথা আছে। নববর্ষে রবিঠাকুরের মতো করে ‘বৎসরের আবর্জনা’ মুছে ফেলা বলতে পারেন। একসময় আমাদের বাড়িতেও স্প্রিং ক্লিনিং হত, যখন আবর্জনা সৃষ্টি করার মতো মানুষ ছিল, যখন ছিল বিষয়বৃদ্ধির অন্ধ উন্মাদনা, ছিল রঙ্গালয়ের রঙিন মোহাবিষ্টতা। বরফ গলার সাথে সাথে আমার স্ত্রী, পারুল, (আমরা পরস্পরকে ‘মনা’ বলে সম্বোধন করতাম, কেন জানি না। যৌবনের সেই পাংশু পুষ্পটুকু আমরা শেষ অবধি জিইয়ে রাখতে পেরেছিলাম), বাগানের মরা ঘাস নিড়ানোর জন্যে একপ্রকার দাঁতালো যন্ত্র (এদেশে একে বলে ‘রেইক’) হাতে তুলে দিয়ে বলত: ব্যাকইয়ার্ড ফ্রন্টইয়ার্ড সব সাফসুফো করে ঘরে ফিরবে, নইলে ভাত নেই। বলত: জানালাগুলো কিরকম ময়লা হয়েছে দেখেছো (কই আমি কোনও ময়লা দেখছি না তো!)? গ্যারাজে সারা শীতের ধুলোবালি জমে আছে। গাড়িটার কি চেহারা হয়েছে খেয়াল করেছো? না তা হবে কেন। সারাজীবন ছাত্র ঠেঙ্গালে কি কারো মাথায় কিছু থাকে? আমি সুবোধ বালকের মতো বিনা বাক্যব্যয়ে ঝাড়ুজাতীয় স্প্রিং ক্লিনিংয়ের যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে বের হয়ে যেতাম সারাদিনের জন্যে। ঘাস রেইক করা থেকে গাড়ি ধোয়া আর জানালার কাচ মোছা সব শেষ করে ক্লান্তদেহে ঘরে ফিরতাম সূর্য ডোবার আগে। ভাবতে অবাক লাগে এখন। সেজীবনে একটা অদ্ভুত গতি ছিল— একটা দেহজ জান্তব গতি। এখন সেটা নেই। সেই মানুষগুলো নেই। সেই দিনগুলি, সেই শঙ্খচিলের ডানার মতো রঙিন দিনগুলি, এখন কেবল দূর সাগরের দিগন্ত থেকে মেঘের ঝলকের মতো হাতছানি দেয় মাঝে মাঝে। এখন আমার গ্যারাজের ময়লা গ্যারাজেই থাকে, ইতিহাসের কোনও গোপন উপাখ্যানের মতো। পারুলের আঙুলের ছাপলাগা সেই প্রাচীন দন্তময় যন্ত্রখানা, রেইক না কি যেন তার নাম, সেটিরও একই দশা। গ্যারাজের এককোনাতে একটি বিবর্ণ আংটার সঙ্গে ঝুলানো আছে বিগতদিনের কংকালের মতো। ভেবেছিলাম ফেলে দেব— পারি নি। গাড়ি ধোবার কিছু সরঞ্জাম ছিল গ্যারাজে— সেগুলোও মনে হচ্ছে আমার এই নিজস্ব জাদুঘরের অংশ হয়ে থাকবে উত্তরপুরুষদের জন্যে। এগুলোর এখন কোনও বাজারমূল্য নেই— গ্যারাজসেইলে দিলেও কোনও আগ্রহী ক্রেতা এগিয়ে আসবে না। এবং ঠিক সেকারণেই এগুলোর এত মূল্য। সেটা কি তোমরা বুঝতে পারছো? এই যান্ত্রিক যুগের মানুষ হয়েও কি তোমাদের ক্ষমতা আছে কোনো অচল যন্ত্রের মূল্য বোঝার?
আমাদের শোবার ঘরের ক্লসেটটা একসময় ঠাসা ছিল কাপড়চোপড়ে। ও বেঁচে থাকাকালে সেগুলো ব্যবহারও হত নিয়মিত। এখন প্রায় একেবারেই হয় না, কিন্তু ঠাসা একইরকম। তার কারণ ওগুলো সরানো বা ঘাঁটাঘাটি করার মন ছিল না আমার। আলসেমি বা গড়িমসি নয়— আমার চরিত্রের বস্তাখানেক দোষের ভেতরে ওদু’টি অন্তর্গত নয়। না, তা নয়। সমস্যাটি আমার দুর্বল মনে। ক্লসেটটির সর্বমোট চারটে অংশ। বাঁয়েরটিতে ওর হাজারখানেক শাড়ি, যাতে হাজার বছরের ধুলো জমে আসল রঙ ঢাকা পড়ে গেছে। ডানেরটি আমার, যাতে আশ্রয় পেয়েছে আমার যাবতীয় বিষয়াদি— শার্ট, প্যান্ট, কোট, যার একাংশও আমি ব্যবহার করি না। মাঝের কামরাটি নিত্যব্যবহার্য কাপড়চোপড়ের জন্যে— যাতে আমার রোজকার ট্রাউজার (ব্যবহার শুরু করলে দুর্গন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ওটা বদলানোর চিন্তা আমার মাথায় আসে না), আমার শার্ট কোট সোয়েটার গেঞ্জি আণ্ডারওয়ের, যেগুলো আমি নিজেই লণ্ড্রিতে ঢুকাই দুতিন সপ্তাহ পর পর, এবং শার্টগুলো ইস্ত্রি করি নিজেই (যেকারণে পারতপক্ষে আমি শার্ট বদলাই না)। পারুল বেঁচে থাকাকালে এ স্বাধীনতাটুকু আমার ছিল না (অর্থাৎ সপ্তাহে আমাকে দুবার শার্ট বদলাতে হত, তা না হলে নাকি আমার কাছে আসা যেত না)। পাশে আমাদের তথাকথিত লিনেন ক্লসেট, যাতে লিনেন তো ছিলই, উপরন্তু ছিল, এবং এখনো আছে, ওর পুরো একতাক পেটিকোট যার সংখ্যা গুণতে ক্যালকুলেটারের দরকার হয় (ওর একটা অভ্যাস ছিল রোজ টাটকা নতুন পেটিকোট পরা, না হলে নাকি গা কুটকুট করত!), দশ হাজারের মতো তোয়ালে নানা সাইজের মিলিয়ে। ওপরের তাকে বিশেষ বিশেষ অতিথিদের উপলক্ষ্যে ব্যবহার্য বাহারি সার্ভিয়েট, টেবিলক্লথ ( সৌখিন দোকানে বিশেষ অর্ডার দিয়ে ডিজাইন করা কাপড়ের তৈরি। এসব ছোটখাটো দুর্বলতাগুলো ওর প্রচুরপরিমানেই ছিল), দামি বেডসিট, এবং দশ পনেরো বছরের অব্যবহার ও অবহেলায় সেগুলোও কালে কালে গৃহহারা ধুলিকণাদের নিরাপদ আশ্রমের আকার ধারণ করেছে।
ওর মৃত্যুর পর গত ন’টি বছর আমি ওগুলোকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি। এগুলোকে সে কত ভালোবাসত জানা ছিল বলেই মনে হত ওগুলতে হাত দেওয়া মানে ওর স্মৃতিকে অসম্মান করা। কি অদ্ভুত আবেগপ্রবণতা বলুন তো। গতকাল ঠিক করলাম, ঢের হয়েছে, আর নয়, বাজে আবেগ দিয়ে ঘরদুয়ার সব বিশ্রি চেহারাতে ফেলে রেখে ওকে সম্মান না দেখিয়ে বরং আরো বেশি অসম্মান করা হয়। ওগুলোকে স্থানান্তরিত করা হোক। সরকারি অফিসের ভাষায় ফাইল করে সাজানো যাক। সিদ্ধান্ত নিলাম বেইজমেন্টের খালি ঘরখানা এবার আমার জাদুঘরে পরিণত হবে, যাতে থাকবে প্রধানত ওরই যাবতীয় জিনিসপত্র— যা সে পরত, দেখত, ভালবাসত। আমার একান্ত আপন স্মৃতিমন্দির— সাত্বিক হিন্দুদের বাড়িতে যেমন থাকে পূজাঘর। আচ্ছা, স্মৃতিমন্দিরও তো একপ্রকার পূজামণ্ডপে পরিণত হতে পারে, তাই না? নশ্বরের দেহেতে অবিনশ্বরের স্পর্শলাভের যে নিত্যকালীন নিষ্ফল আকুতি মানুষের তাকেই তো আমরা স্মৃতি বলি সাধারণ ভাষায়। পামুক তাঁর ‘অপাপের জাদুঘর’ বইটিতে প্রেমিকা ফুসুনের প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্মৃতিবহ বস্তু সযত্নে সংগ্রহ করে সঞ্চিত করেছিলেন এক পরিত্যক্ত পারিবারিক পোড়োবাড়িতে। তিনি হয়তো পাঠককে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে জাগতিক জীবনে যতই রাজবাড়ি তৈরি করি আমরা একসময় সবই পোড়োবাড়িতে পরিণত হয়ে ইতিহাসের জীর্ণ পাতায় প্রবেশ করে। সেই পোড়োবাড়িটিকেই তিনি নির্বাচন করেছিলেন হতভাগী ফুসুনের ব্যবহৃত দ্রব্যাদির আধার বানিয়ে তাকে একধরণের প্রেমের মানমন্দিরে পরিণত করতে। আমার ব্যক্তিগত রাজবাড়িটি গোড়া থেকেই ছিল পোড়োবাড়িতুল্য— স্বল্পবিত্ত অধ্যাপকের জীবনে এর নাম রূঢ় বাস্তবতা। সুতরাং আমার ঘটনাটি কোনকিছুর রূপান্তর নয়, কেবল একটি দেবোত্তর মণ্ডপ সৃষ্টির চেষ্টা মাত্র।
প্রথমে বেইজমেন্ট থেকে কতগুলো খালি বাক্স নিয়ে এলাম ওপরে। বাক্সগুলো আমার কর্মজীবনের ভ্রমণসঙ্গী ছিল— ভ্রমণশেষে সেগুলোও জাদুঘরের অংশ হয়ে পড়েছে। ওগুলো এখন লোকসমক্ষে ব্যবহারযোগ্য নয়। কি আশ্চর্য জানেন, আমার প্রয়াত স্ত্রীর একটা ছোট্ট ক্লসেট খালি করতেই গোটা তিনেক বাক্স একেবারে টানটান বোঝাই হয়ে গেল। বস্তুর যে এত আয়তন তা বস্তু না ফুরালে বোধগম্য হয় না।
সবশেষে সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে পেলাম পুরনো চিঠিপত্র। আমার লেখা চিঠি ওর কাছে, ওর চিঠি আমার কাছে। আমার চিঠিগুলো ও ফেলে দিতে পারে নি (ফেলে দেবার স্বভাবটিই ওর ছিল না, বিশেষ করে আমার চিঠি)। ও খুব কম লিখত। বাংলায় অনার্স পড়া মেয়ে, অথচ লিখবার বেলায় মাথা চুলকানি শুরু হয়ে যেত। কাউকে বলে বিশ্বাস করানো যাবে না যে ওর নিজের ভাইবোনের কাছেও সে চিঠি লিখতে চাইত না। বারবার বলার পর উল্টো আমার সঙ্গে রাগ করে বলত: তোমার এত ইচ্ছে হলে তুমিই লিখে দাও। মাঝে মাঝে সত্যি সত্যি তাই করতাম— অর্থাৎ আমি লিখতাম, ও সেটা নকল করত। সুতরাং সেই চিঠিকৃপণ মেয়ের চিঠির দাম আছে। মৃত্যুর পর চিঠিগুলোর দাম আরো শতগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। ওগুলোতে ওর নিজের হাতে লেখা অক্ষর একসাথে মিলে একটা ভাব সৃষ্টি করেছে। মানুষের ব্যক্তিগত চিঠিগুলোকে আমি সেই ভাবেই দেখি— ছোটখাটো সৃষ্টিকর্ম প্রতিটি চিঠি। পারুলের সেই বিরল চিঠিগুলি আমার জাদুঘরের বড় আকর্ষণ।
বস্তু আর সংসার বোধ হয় একে অন্যের পরিপূরক, নইলে আমার স্ত্রীর মতো একজন বস্তুবিরাগী মানুষের সামান্য ক’টি জিনিসপত্র দিয়ে চারটে বড় বাক্স আর একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ ঠাসাঠাসি করে ভরে যায় কি করে। আমার মনে হয় বস্তুর একটা নিজস্ব মন আছে যা সংসারী মানুষের সঙ্গে খেলা করতে ভালোবাসে। বস্তুর পীড়ন বলে একটা জিনিস আছে যা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি তিনবার বাড়িবদল করতে যেয়ে। এবার আমি একা। বাড়িবদলের পালা ফুরিয়ে গেছে। কেবল একটি ব্যক্তিগত জাদুঘর তৈরির বাসনা— তাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। কায়িক পরিশ্রম সহ্য হয়, মানসিকটাই কাতর করে ফেলছে। যেখানে হাত দিই সেখানেই ও চোখ তুলে তাকায় আমার দিকে। যেন অনুযোগের সুরে বলছে: এবার বুঝি আমার শোবার ঘর ছেড়ে দিয়ে বেইজমেন্টে যাবার সময় হল! শেষ পর্যন্ত তুমিও তা পারলে। হ্যাঁ, পারলাম বইকি— শেষ পর্যন্ত আমিও পারলাম ওকে জাদুঘরে পাঠাতে। কেন পাঠাচ্ছি সেটা তো ও বুঝবে না, যা অভিমানী মেয়ে সে, আশা করি আমার ছেলেরা বুঝবে আমি চলে যাওয়ার পর। সেজন্যেই তো এত আয়োজন। জীবনের সবকিছুই তো জীবন ফুরাবার পরের সময়টুকুর জন্যে।
সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছিল ওর নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলো সরাতে গিয়ে। ওর টুথব্রাশ ( মৃত্যুর পাঁচদিন আগেও সে ওটা ব্যবহার করেছিল), চিরুনি, গায়ের লোশন (ওটিও সে রোজ ব্যবহার করত। চামড়া শুকিয়ে তালগাছের মরা বাকলের মতো হয়ে গিয়েছিল)। তারপর সেই চিঠিগুলি। ওর হস্তাক্ষর। ভাগ্যিস ওর জীবনকালে ই-মেইলের ব্যবহার চালু হয়নি। তাহলে ওর হস্তাক্ষর পেতাম কোত্থেকে।
বেইজমেন্টের এই ঘরটি তৈরি করা হয়েছিল ’৮৫ সালে, বাড়ি কেনার সময়। তখন ছোট ছেলে রাজা বছরে দু’চারবার ছুটি কাটাতে বাড়ি আসত— তাই তার পিয়ানো বাজানোর একটা আলাদা জায়গা করে দেওয়ার জরুরি প্রয়োজন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বেইজমেন্টের দরজা দিয়ে নামলেই দেখা যেত প্রকাণ্ড পিয়ানোটি। এখন ছেলে আসে না, ওর মা নেই, ওর পিয়ানোও নেই— সারা বেইজমেন্ট জুড়ে শুধু এক বোবা নির্জনতা। এপাশের ছোট ঘরটি রাখা হয়েছিল আমার ব্যক্তিগত অফিসঘর হবে একদিন সে আশাতে। সেটা হয়নি কোনোদিন। ওর মৃত্যুর পর হাসপাতাল থেকে ওর সব জিনিসপত্র বাড়িতে এনে সেই ঘরের একটা কোণাতে রেখে দিয়েছিলাম— ওর হসপিট্যাল গাউন, স্লিপার, টাওয়েল, একটা চাদর। ওগুলো কি গার্বেজে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল আমার? আপনি কি পারতেন? হয়তো পারতেন—আমার মতো ছিঁচকাদুনে আবেগডোবা পুরুষ তো সবাই নয়। না, আমি পারি নি। ভাগ্যিস পারি নি, কারণ সেই আপাতবর্জ্য দ্রব্যগুলোরও অনেক দাম বেড়ে গেছে এখন। আমার জাদুঘরের সবচেয়ে বড় সম্পদই তো ওগুলো। একান্ত আশা আমার, আমি চলে যাওয়ার পর ছেলেরা এই জাদুঘরটির জন্যেই বারবার আসবে এখানে। শেষমেশ এছাড়া আর কিইবা থাকবে বলুন। শেষমেশ তো আমরা সবাই জাদুঘরের প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হই। কিম্বা তা’ও না। সবাই কি আমার মতো পাগল যে বিষয়সম্পত্তি রেখে যাবার কথা না ভেবে তুচ্ছ একটা জাদুঘর বানিয়ে যাবে তার উত্তরপুরুষের জন্যে। বদ্ধ পাগলরাই কেবল তা করে।
অটোয়া, ৫ই এপ্রিল,’১১
মুক্তিসন ৪০
মিজান আহমদের লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় পরবাস পত্রিকায় ওনার লেখা পড়ে.
জাদুঘরের লেখক সত্যিই শব্দের যাদুকর. খুব ভালো লাগলো.
মীজান আহমদের লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় পরবাস পত্রিকায় ওনার লেখা পড়ে.
জাদুঘরের লেখক সত্যিই শব্দের যাদুকর. খুব ভালো লাগলো.