সারওয়ার চৌধুরী
(হতে পারে এই গদ্য রচনার চিন্তাকণারা বৃষ্টিভেজা পাখির ডিম সমতুল্য তাই এই রচনার শিরোনাম নেয়া হয়েছে কবি মজনু শাহ’র ‘জেব্রা মাস্টার‘ থেকে)
পক্ষপাতদুষ্ট লাল নীল সবুজ ইত্যাদি
লাল কিংবা সবুজ অথবা নীল রঙকে লাল সবুজ নীল বলা হচ্ছে, মানা হচ্ছে, কারণ লাল, নীল আর সবুজের পক্ষে ধারণা প্রতিষ্ঠা দিয়েছে মানুষ এবং বংশানুক্রমে এই বোধ সচেতনতাতে মজুদ থাকছে। কেউ ভাবতেও চায় না যেন লাল সবুজ নীল ইত্যাদি রঙের জ্ঞান পক্ষপাতদুষ্ট জ্ঞান। প্রশ্ন রাখা দরকার এই পক্ষপাতদুষ্টতাই কি সত্য বোধ? কোথাও কোথাও কখনো কখনো রঙ যখন রূপক হয়, অন্য রূপের প্রতিনিধি হয়, তখন একই উত্স থেকে উদ্ভাসিত বুঝে নেবার ফলে যাহা সবুজ তাহা নীল তাহা লাল বোধগম্য হয়।
সচেতনতা নতুন নতুন ঘ্রাণ ছড়ায়, আলো রঙ বিকিরণ করে, উন্নতি পেয়ে পোক্ত প্রবল মনোহর হয়, বিষয়ের পক্ষপাতদুষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফলে। হতে পারে প্রকৃতির অলংকার তুল্য কিছু, যেমন বাতাস, যার প্রতি বিবর্তনের দাওয়াত দিয়ে লাভ নেই, বাদবাকি বহু কিছু মানুষের বোধের সাথে কিংবা সচেতনতার সাথে মনে হয় লুকোচুরি খেলে! পৃথিবীর বাতাস, সকল দেশের ভোরের হাওয়া বিবর্তন নৃত্য দেখে শুধু। মানুষের পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক ফোঁসফাঁস, জিঘাংসা, হত্যা হাস্যকর।
সুতরাং বন্ধু তুমি এতো চেতো কেন? কেন তোমার প্রতিক্রিয়াতে বিষক্রিয়ার বিপরীতে নতুন প্রখর বিষ উত্পন্ন হয়? নিজেকে প্রশ্ন করো, যা তুমি সহ্য করো না, তা-ই তুমি ধারণ করে নিজেকে বিষাক্ত করো কেন?
বড় মাপের চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানীও ধরে আসতে পারেন নাই মন-সচেতনতার উন্নতি অবনতি বিষয়ক ভেলকি। এই ক্ষেত্রে বড়লোক যা, ছোটলোকও তা।
পক্ষপাতদুষ্ট জ্ঞান মানুষকে দেখায়, বড়লোক ছোটলোক সকলের মধ্যে, সম্মানিত চোখ মুখ হাত মাথা পা জঙ্ঘা উরু নিতম্ব কোমর এবং চলনভঙ্গি ইত্যাদি শান্তি এবং অশান্তির প্রসঙ্গকে উস্কে দেয়।
বন্ধু তুমি নিজেকেই গালি দাও কেন! কেন নিজের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলো অন্যের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছো! নিহিতার্থ পেলে বুঝে নেবে অন্য/অপর নাই, আছে শুধু গহীনদেশে ‘আমি’।
ভেল্কিবাজিতে যেও না বিজ্ঞানী ভাই
বিজ্ঞানী ভাই, তুমি তোমার আবিস্কারের কথা জানানোর জন্যে ভেল্কিবাজিতে ডুব দিও না। তুমি বরং দুপুরের ঘুঘুটির মতো বসে সংবাদ সম্মেলনে কথা বিনিময় করো। কোনো অবস্থাতেই তোমার বাজপাখি হওয়া মানায় না। অচিরেই নিউট্রিনো কিছু কহিতে আসবে।
মৃতদেহ পড়ে আছে, মানুষটি নেই
মৃত্যুভয় অথবা কমজোর চিত্তের আতংকিত প্রতিক্রিয়া হতে প্রাপ্ত কিছু শব্দের মাধ্যমে অজস্র মানুষ কিছু ধারণা প্রকাশ করে থাকে। যেমন- লোমহর্ষক, মর্মান্তিক, নৃশংস ইত্যাদি। অন্য সব প্রসঙ্গ বাদ দিলেও বিজ্ঞান-যুক্তির ল্যাবরেটরীতে এই শব্দগুলোর ভূমিকা খুবই নগন্য। অনেক ক্ষেত্রেই শব্দগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহৃত। মৃত্যু অবস্থান্তরের জরিয়া বুঝে নিয়েও প্রাসঙ্গিক মায়া মৃত্যুভয় উত্পন্ন করার কারণ। মানুষের শরীর আত্মা পৃথক পৃথক অবস্থান্তরে যায়। শরীরের মত্যু ধরলেও আত্মার মৃত্যু ধরা হয় না। তাই কহিলেন, ‘রাস্তায় মানুষটির মৃতদেহ পড়ে আছে।’ ‘মানুষটির মৃতদেহ’ পড়ে আছে। মানুষটি পড়ে নেই। মানুষটি চলে গেছে। কোথাও গিয়েছে চলি জানা নেই। ‘আমার পরাণ পাখি দিয়া ফাঁকি কই গেলি কই?’
অমৃতসমৃদ্ধ কবিতার পাঠক
ভাষা জানলেই ভাষার অন্তর পাঠ সব সময় সম্ভব হয় না। অমৃতসমৃদ্ধ ভাষা আর অমৃতসমৃদ্ধ কবিতা পাঠ করতে পারার জন্যে ভাষার মনোভূমে প্রস্ফুটিত বিশেষ ভাষার দিকে মনোযোগ দিতে হয়। ওই যে বৃক্ষ-শাখা-পল্লব দোলে, ওই দোলা দেখতে পারলে প্রথমত দেখা হয় প্রাথমিক বাচ্যার্থ। কেন দোলে? দোলবার পেছনের এবং পরের কারণ কী? এই দোলাতে আর কি কি দোলে? না-দোলা দিলে কী হতো? বৃক্ষ আর তার শাখা পল্লব অন্য সিগনিফায়েডস-এর প্রতিনিধি কি না? ইত্যাদির সাথে পরিচয় পেতে গেলে নিহিতার্থ পেতে হবে, আপাতবর্ণনার সীমাতে থেমে থাকলে হবে না। কবিতার পংক্তিতে মজা রূপায়ন, ধ্বনিসুন্দর যা কিছু যুক্ত আছে তার বাইরে, মানে, ভেতরে তালাশ নিলে গহীনের অর্থসুন্দরসমূহ।
যে-কবি/শব্দকারিগর/ভাষাশিল্পীর শব্দেরা অমৃত বিকিরণ করবার ক্ষমতা রাখে, সেই শব্দেরা মন-চেতনার পাঠ দ্যায়, থেরাপী দ্যায় মাত্রানুসারে যাতে ক্ষ্যাপা শিম্পাঞ্জিটাও (রূপক) ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। অমৃতকে হয়তো আমরা শনাক্ত করতে পারি চেতনার সারমর্ম হিসাবে।
ঘষিয়া উজ্জল করো হে
ঘষতে হয়, ঘষলে পরিশীল হয়, চিন্তার সাথে চিন্তাও ঘষতে পারতে হয়। মাটির ঢেলাকে পাথর দিয়ে ঘষলে মাটিচুর্ণ নামে, মাটি ধুলো হয়, ভেজা মাটি পাথরের গায়ে লাগে ক্ষণকালের জন্যে। এই কারণে হয়তো পাথরের হাসি পায়। মাটিও যে হাসে না এমন নয়। কয়লার সাথে পাথরের ঘষা হলে পাথর ধৌতকরণের প্রার্থনা রাখতে পারে প্রকৃতির কাছে। পদার্থ বিদ্যার সূত্রের সাথে ম্যাটাফিজিক্স বা কোয়ান্টাম ম্যাকানিজম সূত্রের ঘষা লাগবার কারণে নতুন হাইপোথিসিস উঁকি দিতে পারে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছা ঘষা লাগবার প্রসঙ্গ বিদ্যমান। ঘর্ষণে বর্ষণ। ঘষলে চকচক। ঘষামাজার অন্যরূপ মর্দন। মর্দন নিয়ে এসেছে রিফ্লেক্সোলজি বা মেসেজ থেরাপী। থেরাপী পেয়ে গেলে ইমমিউন সিস্টেম উজ্জ্বল, উজ্জ্বলতর প্রাকৃতিক পরিশোধনের দৌলতে।
চুপ থাকতে পারো ম্যাগনোলিয়া
চুপ থাকবার যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত কারণ প্রস্ফুটিত হয় কখনো কখনো। চুপিচুপি বলে যাওয়া চমত্কার! কথার ভেতরে কি চমকপ্রদ নিরবতা নেই? একটি কথা নিরবতাকে উস্কে দিতে পারে, যে-নীরবতা বলে দেয় মনোহর ভাষাহীন কথা। চুপচুপ কথার ভেতরে রোদ-বৃষ্টি-জোছনা বহু রঙ বিবৃতি বিন্যাস দিতে পারে।
……………..
১৫ অক্টোবর, ২০১১
সিলেট, বাংলাদেশ