মূল: মহাবলেশ্বর শৈল
অনুবাদ: আবদুর রব
শংকর বাড়ির সদর দরজার চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে যতদুর চোখ যায় দেখলো মাঠের পর মাঠ পেকে ওঠা ধানক্ষেত জায়গায় জায়গায় এখনও সবুজ, তবে বেশীর ভাগ ক্ষেতে দানা শক্ত হয়ে উঠেছে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে মাটিতে হেলে পড়বে। কিন্তু হলে কি হবে, ঠাকুর মশাই তো বলেই দিয়েছেন ধারেকাছে কোনো লগ্ন নেই সুতরাং ফসল তোলার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করতে পারছেন না।
সোমো, কদিন থেকে ষাঁড়টা ক্ষুধায় দাপাদাপি করছে। এক আঁটি খড় নেই। তবু ভালো, প্রকৃতি পশুদের ব্যাপারে অনেক সচেতন। চারদিকে ছড়িয়ে রেখেছে খাদ্য। নালার ধারে, ক্ষেতের আল দিয়ে গজিয়েছে তাজা সবুজ ঘাস। কিন্তু দিনকাল খারাপ হলে যত দুর্ভোগ সব মানুষের।
“ধারে কাছে কোনো লগ্ন নেই,” ঠাকুরের কথার সূত্র ধরে আপন মনে গজরাতে থাকে শংকর। “লগ্ন নেই তা নিজেই একটা সৃষ্টি করতে পারে না, কেমন ঠাকুর সে? যতসব অকর্মা। ঠাকুর বলেছে তাতেই ফসল কাটা বন্ধ। অনুষ্ঠান ছাড়া ফসল কাটেই বা কি করে? সংসারে এতগুলো মুখ এখন খাওয়াব কী?”
ঘরে একমুট খুদ পর্যন্ত নেই। কিছু বীজধান ছাড়া সবই তো চতুর্থীর আগেই শেষ। গ্রামের সব কৃষকেরই এক অবস্থা। হোলির পর থেকে সবাই আধপেটা খেয়ে যে করে হোক খোরাকির মজুদ কদিন বাড়াবার চেষ্টা করে। যাদের আগেভাগে শেষ হয়ে যায় তারা নিঃশব্দে ভোগে। কে কাকে দেখবে, সবারই এক অবস্থা। কারো কাছে থেকে খাদ্যদ্রব্য ধার পাওয়ার আশা নেই। এ যেন এক যোগী আরেক যোগীর কাছে ভিক্ষা করা, যেখানে প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নেই।
বাড়ীর ভিতর থেকে আড়াই বছরের মেয়ে শিলু তারস্বরে চিৎকার করছে। শংকরের বুড়ো মা বাচ্চাটার পাশে বসে বৃথা থামাবার চেষ্টা করছে। বড় ছেলে হতভম্বের মতো দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে জিভ দিয়ে বারবার ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করছে। শংকরের মনে হলো কেউ যেন তার গলায় ধারালো ছোরা দিয়ে পোচাচ্ছে। ভয়ংকর ক্ষুধা তার গোটা অস্তিত্বটাকেই খেয়ে ফেলছে।
সাবিত্রী এক ঝুড়ি তাজা ঘাস এনে গরুটার সামনে ঢেলে দিল, কাঁচিটা বেড়ায় গুজে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো:
“আমি বালু দেশাই’র বাড়ী যাই, কি বলো?”
“কেন? চড়া সুদে ধান আনার জন্যে?”
“তা আর কি করা যাবে?”
“অনুষ্ঠান শেষ হলেই তো সপ্তা খানেক বাদেই ফসল তোলা যাবে। খামাকা কেন আমরা যা নেব তার দেড়গুণ ধান দিতে যাব?”
“তা এখন আমাদের ক্ষিদের কি ওষুদ আছে? তুমি তো এক সপ্তা পরে কি ঘটবে তাই বলতিছো, এদিকে সবাই যে ক্ষুধায় মরতি বসেছে।”
শংকর চুপ মেরে গেল। তার সমস্ত রাগ আর হতাশা নিজের ভিতরে আটকে গেল। সাবিত্রী অস্বস্তিতে সামনে থেকে সরে যায়। অনেক ক্ষুধা সে জীবনে গোপন করেছে। কিন্তু স্বামী সন্তান আর বৃদ্ধা শাশুড়ীর অনাহার সে আর সহ্য করতে পারছে না।
বালু দেশাই’র বাড়ি গিয়ে দেখলো, দামী কোট, ধুতি ও মাথায় টুপি পরা কিছু অচেনা লোক। বালু দেশাই’র বউ তাকে ঠেলে বাড়ির পিছনের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
“কি খবর সাবিত্রী, কি মনে করে?”
সাবিত্রী কিছুটা বিভ্রান্ত, কথা খুঁজে পায় না। শেষে মুখ ফসকে বলে:
“ছোটটার কদিন থেকে জ্বরজ্বর ভাব। কিছু ওষুদ দিতে পারেন?”
“ওষুদ? এখানে? দেখছিস না বোতল শূন্য?”
সাবিত্রী আর কিছু না বলে চলে আসে। তাকে খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে শংকর জিজ্ঞেস করলো:
“তা কি বললো ওরা?”
“ও বাড়িতে অতিথি এসেছে দেখলাম। লোক-কুটুমের সামনে কিছু ধার চাওয়া লজ্জার ব্যাপার না? কি বল?”
“হ্যাঁ তা ঠিক!” শংকর মাথা নাড়ালো, তা খিদে আর লজ্জা তো একসঙ্গে চলতি পারে না। লজ্জা বাদ দিতি না পারলি তো না খেয়ে মরতে হবে। লজ্জার মাথা খেয়েই তো ধার চাতি হয়। তুই আমি কেউই আমরা এ কাজের যোগ্য না। তোর বাপ তো ছেল আবার সম্মানীয়, আর্মির লোক। আর আমি,” তৎক্ষণাৎ আবার বিরক্তিতে বলে উঠলো:
“সেদিন জঙ্গল সাফ করার কাজ নিতি চালাম তুই তা করতি দিলি না, কেন?”
সাবিত্রী মাথা নিচু করে বললো: “আমরা হলাম গেরস্থ কৃষক পরিবার। আর তুমি কিনা সস্তা দিন মজুরের কাজ করতি চাও?”
শংকরের বাপ ছিল সম্পন্ন কৃষক। চার ভাইয়ের মধ্যে বড় সে, চাইতো সবার জন্য এক হাঁড়িতে রান্নাবান্না হোক। তাদের সেই যৌথ পরিবারটাকে এক মাপে একই ছাদের তলায় রাখার কি প্রাণান্ত চেষ্টাটাই না করেছে সে। তবু সহায়-সম্পত্তি ভাগ করে দেয়ার দাবি ক্রমশঃ উচ্চকিত হয়। ফলে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো। শেষমেশ সংসারের দরকারি জিনিস জমি আর ঘরদোর ভাগ করে দিতে বাধ্য হলো সে। তখন যদিও মনে হয়েছিল শনির দশা কাটলো, কিন্তু আসলে সেই থেকে আর সংসারে কোনো উন্নতি হলো না।
“তা এখন কী করা যায়? ”
“কী করবা?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো সাবিত্রী।
“সীতাদের বাড়ী থেকে কিছু চাল আনতি পারবি, তুই?”
“তুমি জানো সকাল থেকে আমি কত বাড়ী ধন্না দেলাম? কিচ্চু হলো না।”
শংকর নীরবে নিজের ঠোঁট কামড়াতে থাকে।
সন্ধ্যা সাথে করে নিয়ে এলো একরাশ অন্ধকার। পৃথিবীর উপর জেঁকে বসে সেই অন্ধকার। চারিদিক থেকে ঝিল্লিরা কলরব করে তাকে স্বাগত জানায়। ঘন অন্ধকারে প্রত্যেকটা খুপি ভরে উঠেছে, বাড়িটাকে অদ্ভুত এক এলিয়নের মতো মনে হয়। ক্ষুধায় অবসন্ন শংকর ভাবে উষ্ণ আর জ্বলন্ত উনুনই পারে তার সংসারটাকে সংসারে পরিণত করতে। একদিন যদি উনুনে আগুন না জ্বলে তবে সংসার তার সংসারত্ব হারায়। তখন সব শান্তি আর আরাম হারাম হয়ে যায়।
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, জেগে উঠে আবার ফোঁপাচ্ছে। সাবিত্রী যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তাকে বোঝানোর জন্য, ছেলেটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে ছিল, ঘুমের ভেতরে সে আরও নুয়ে পড়েছে।
“ও শংকর আমার গলায় কিছু ঢাল, মরে গেলাম যে বাবা, শংকরের বুড়ো মা ডেকে উঠেলো।”
“মর যত তাড়াতাড়ি পার মরে নিজের সমস্যার নিজে সমাধান কর।”
রাগে হতাশায় কথাগুলো বলে নিজেকে অপমানিত করে অসহায় শংকর।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল সাবিত্রী, ক্লান্ত স্বরে প্রতিবাদ জানায়:
“ওকি কতা! হাজার হোক উনি তোমার মা।”
বাড়িটাকে ঘিরে যে সাবিত্রী প্রজাপতির মতো উড়তে থাকে আজ তাকে প্রাণহীন মনে হয়, যেন সে শুকনো জবা, রৌদ্রে শুকিয়ে গেছে। ওর অবস্থা দেখে মায়া হলো শংকরের। মনে মনে সে ভাবে, “আমি হচ্ছি এ ঘরের খুঁটি, ঘাড় বাঁধিয়ে চালটা উচু রাখি বলেই তো ওরা নিশ্চিন্তে বাস করে এর নিচে। আমার উপর কত ভরসা। সমস্ত বিপদ আপদে আমি ওদের রক্ষা করবো। ওদের খিদে মেটাতে না পারলি আমি কিসের পুরুষ মানুষ? কেমন স্বামী, কেমন পুত্র, কেমন বাপ আমি?” তার হৃদয়টা মোচড় দিয়ে ওঠে। কেউ যেন তার পুরুষত্বে বিরাট আঘাত হানে। আত্মাটাকে পাতালে নামিয়ে দেয়। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় তার সমস্ত অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন এক অহংবোধ আর আত্মশক্তি এসে ভর করে তার মনে। সমস্ত শিরাউপশিরায় নবশক্তির আগুনের প্রবাহ অনুভব করলো শংকর।
দেয়ালে গোঁজা কাঁচিটা এক হ্যাঁচকায় টেনে সাথে একটা বস্তা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
“এত রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছ?” সাবিত্রী ছুটে এসে পথ আগলায়।
“তাতে তোর কি?”
“না বল আমাকে, কনে যাচ্ছ?” উঠোন পর্যন্ত অনুসরণ করতে করতে সে আবার জানতে চাইলো।
কিন্তু শংকর কোন কথা না বলে ওকে অন্ধকারে একা ফেলে হন্ হন্ করে চলে গেল।
শুকতারার আলোয় উদ্ভাসিত সমস্ত প্রকৃতি রূপালি আভা ছড়াচ্ছে। ছায়া ছায়া ঝোঁপগুলো যেন ন্যাড়ামাথা দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে তার চলার পথে। সে যখন বাঁধের উপর উঠে তারপর খাল পার হলো, পোকা মাকড়ের কোরাস ধ্বনি ছাড়া কোন প্রাণের চিহ্ন দেখলো না।
শংকর দেখলো তার ক্ষেতের ধানগুলো পাকা, সম্পূর্ণ কাটার উপযুক্ত। কদিন থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় মাঠটা তুলনামুলক ভাবে শুকনো। বস্তা রেখে সে ক্ষেতের মাঝখানে ঢুকে গেল। ঘস ঘস করে গোড়া থেকে পোচ দিয়ে কয়েক সারি ধান কেটে নিল। আধ ঘন্টার মধ্যে কাজ খতম। বড় একটা আঁটি বেঁধে গামারী গাছের নিচে এনে বস্তা বিছিয়ে মাড়াই শুরু করে দিল। তার সঙ্গে কিছু ছিল না সুতরাং পা দিয়ে মলে মলে আছড়ে আছড়ে ধানগুলোকে খড় থেকে আলাদা করে। কিছুটা রোগা সে কিন্তু তখন তার গায়ে অসুরের শক্তি। সমস্ত শরীর ঘামে জবজবে।
খড় সরিয়ে ধানগুলোকে বস্তায় ভরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো শংকর। বাড়ি ঢুকে সে যখন উঠোনে বস্তা ফেললো, স্থানু হয়ে বসে থাকা সাবিত্রী নড়েচড়ে উঠলো। ঘরের কোনে পড়ে থাকা হাতঢেঁকিটা এনে ভানার আগে কুলো দিয়ে ধান ঝাড়তে বসে।
“ধান কনে পেলে?”
“সব কথা জানতি হবে কেন তোর?”
এ কথায় ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে দেয়ালের দিকে সেঁদিয়ে গেল, ক্লান্ত আর দুর্বল সাবিত্রী। তবু সে প্রতিবাদ জানালো।
“কোনো প্রার্থনা হলো না, দেবতার ভোগে গেল না আর সেই ধান কিনা তুমি বাড়িতে আনলে। তার আগে আমাদের মরতি দিলে না কেন?”
এসব কথার জবাব দেবার সময় নেই শংকরের। ধাম…ধাম করে ঢেঁকির গদায় শব্দ করতে থাকে। হঠাৎ সে বউয়ের কাছ থেকে কুলো কেড়ে নেয়।
“বসে আছিস কেন, চুলো ধরা, হাড়িতে পানি চড়া।”
নিষ্প্রাণ সাবিত্রী শংকর যা যা বললো তাই করলো। চাল ঝেড়ে হাঁড়িতে চাপালো। কিছুক্ষণ বাদেই নতুন চালের ভাত ফুটে গেল। চুলো থেকে হাঁড়িটা নামিয়ে সে আবার দেয়ালের কাছে গিয়ে বসে পড়লো। শংকর আচারের বোতল থেকে ৪/৫ টুকরো আম নিয়ে বললো, “ভাত বাড়।” কিন্তু তবু সে নিঃস্পৃহ।
শেষে শংকর নিজেই রান্নাঘর থেকে ৩টি বড় থালা এনে ভাত বাড়লো। একথালা ভাত মার সামনে রেখে ছেলে মেয়ে দুটোকে ডেকে তুলে খেতে বললো। নিজে বসে থেকে তৃপ্তি সহকারে ওদের খাওয়া দেখতে লাগলো। তদারকি করে আরো কিছু ভাত নিতে বলে, “খা আরো একটু খা”।
বুড়ো মা ও ছেলে দুটি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লে, শংকর আস্তে করে বউয়ের কাছে সরে এলো।
“আয় খাই।”
“না আমি খাব না, তুমি খাও।”
“আয় এক সাথে খাই।”
“না আমি খাব না। সে অনড়।”
শংকর আর কিছু না বলে ঘর থেকে কাঁথা-বালিশ নিয়ে এসে নিঃশব্দে বারান্দায় শুয়ে পড়লো। আর কোন সাড়াশব্দ নেই বাড়িতে। কেরোসিনের বাতিটা যেখানে ছিল সেখানেই জ্বলছে, আস্তে আস্তে; কিন্তু ঘরের ভিতর যে ভারী অন্ধকার জমা হলো তা বিন্দুমাত্র আলোকিত করতে পারলো না ঐ বাতিটা। সাবিত্রী দেখলো লোকটা না খেয়েই শুয়ে পড়েছে, অগত্যা উঠে গিয়ে বললো:
“চল যাই।”
“তুইও খাবি?”
“হ্যাঁ।”
তারপর সে দুই থালে ভাত বেড়ে খাওয়া শুরু করলো। সাবিত্রী বারবার তার পাতে ভাত তুলে দেয়, আর মাথা নিচু করে নীরবে খেতে থাকে শংকর।
বাড়ির সবাই এখন গভীর ঘুমে, এমনকি শংকরের বুড়ো মা যে কি না ঘুমের ভিতর বিড় বিড় করে আজ তাও করছে না। পেটের ক্ষুধা নির্বৃত, ক্রোধ প্রশামিত, ফলে এবার শংকরের মনে কৃতকর্মের পরিণাম সম্পর্কে নানা চিন্তার উদয় হলো। এককালে আমরা এত বড়লোক ছিলাম যে ডোল ভর্তি পুরনো ধানে হাত দিতে হতো না। এমনকি নবান্ন উৎসব পার হয়ে যাওয়ার পরেও তা থাকতো। তার উপর আবার নতুন ধান জমে যেত। আর আজ যা ধান পাই তাতে নতুন ধান ওঠার আগ পর্যন্ত খেয়ে পরে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়ে।
শংকরের আত্মাটা এবার ককিয়ে উঠলো: “এ আমি কি করলাম?
ধর্মীয় অনুষ্ঠান না করে ধান কাটলাম!”
হঠাৎ গামারী গাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে আসা খড়ের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা খচ খচ করতে লাগলো। কাকপক্ষী ডাকতেই তো বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাবে। সবাই তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবে, দুয়ো দেবে, বলবে হাভাতে শংকর ক’টা দিন দেরিও করতে পারলো না। সমস্ত আচার বিচার ত্যাগ করেছে, ভগবানকেও ভুলে গেছে।
পূর্বের আকাশ ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত সে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটালো। তারপর কারোর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চোরের মতো পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে মাঠের দিকে হাঁটা শুরু করলো। গামারী গাছের তলা থেকে খড়বিচালিগুলো জড় করে এনে গোয়াল ঘরের এক কোনে লুকিয়ে রাখলো। এবার সে সবার নজরে পড়ে এমনভাব করে আবার মাঠের দিকে রওয়ানা হলো।
ইতিমধ্যে আরও সকাল হয়ে গেছে। পাখ-পাখালি ডাকছে। এক্ষুণি সারা গ্রাম উঠে পড়বে। কেউ কেউ গোয়াল ঘরের দিকে পা বাড়াবে গরু-মহিষ দোয়ার জন্যে। কেউ কেউ আবার ঘাস কাটতে কিংবা ক্ষেত দেখতে বেরুবে।
শংকর ভেবে পায় না কী করবে। মরিয়া কিছুটা নার্ভাস, শেষে দু’হাত দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মাঠের মাঝখানে দাড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিল: “হায় হায় কারা রাতে আমার ধান কেটে নিয়ে গেল।”
গ্রামবাসী যারা ঘাস কাটছিল, কাঁচি থামালো। যারা গরু চরাচ্ছিল, উঁচুতে উঠে দেখার চেষ্টা করে। যারা হাঁটতে বেরিয়েছিল, হাঁটা থামিয়ে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে; সবাই অবাক; কে এমন সর্বনাশ করলো, ভগবানের ভোগে দেওয়ার আগে ধানগুলো কেটে নিয়ে গেল!
সাবিত্রী মাঠে স্বামীর বিলাপ শুনতে পেয়ে মনে মনে সতর্ক হয়ে কর্তব্য স্থির করে ফেললো। সংসারের অভাব অনটনকে অভিশাপ দিতে দিতে যথাসম্ভব আবেগ দমন করে দাওয়ায় উঠলো। সে জানে এছাড়া মানুষটার মান-সম্মান বাঁচাতে আর কোন পথ খোলা নেই। সামনে দিয়ে ননদ জানকীকে যেতে দেখে ভারী গলায় চোখ ছল ছল করে বললো:
“জানকীদি শুনছো, কারা যেন রাতের আঁধারে আমাদের ক্ষেতের ধান কেটে নিয়ে গেছে?”
লেখক পরিচিতি: মহাবলেশ্বর শৈল (জন্ম: ১৯৪৫) কঙ্কনী ভাষার ছোট গল্প লেখক। ১৯৯৩ সালে তাঁর ছোট গল্প সংকলন “তরঙ্গ” এর জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরুষ্কার লাভ করেন। পেশায় তিনি একজন পোষ্টমাস্টার।